ভারতের সামাজিক বাস্তবতা, রুমানা ইসলামের সর্বোচ্চ নম্বর এবং এক শিক্ষকের হতাশা

জিনাত রেহেনা ইসলাম

জিনাত রেহেনা ইসলাম

চলতি বছর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলিম ছাত্রী রুমানা সুলতানা। উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০০ নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছেন পেয়েছেন ৪৯৯। অর্থাৎ মাত্র ১ নম্বর কম পেয়েছেন তিনি। তবে একজন মুলিম ছাত্রীর এতবড় সাফল্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিতর্কের সূত্রপাত নাম ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। ফল ঘোষণার সময় উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রধান মহুয়া দাস সভাপতি বলেন, এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে একক সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন একজন ‘মুসলিম কন্যা’, ‘মুসলিম লেডি’, ‘মুসলিম গার্ল’। এ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন স্বয়ং রুমানাও। সোমবার (২৬ জুলাই) এ নিয়ে এক ফেসবুক পোস্টে রুমানা প্রসঙ্গে নিজের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক ও কবি জিনাত রেহেনা ইসলাম। নিচে তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

দোলনদি খুব সুন্দর লিখেছেন উচ্চমাধ্যমিকের সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপক রুমানাকে নিয়ে। আজ আনন্দবাজারে পড়লাম। যারা প্রান্তিকতার নির্জনতা ও অবহেলার নিয়ত পদসঞ্চার শোনে, তাদের মধ্যে দোলনদি অন্যতম, আমার চেনা মানুষ। এক অভিঘাত আর এক অভিযোগের মধ্যে দিয়ে রাস্তা খুঁজে না ফিরলে এমন অনুভবের ইমারত তৈরি হয় না। সত্যিই প্রশ্নটা  মুসলিম ছেলে বা মেয়ের নয়। সমানুভূতির জায়গায় কেন  মিলবে সহানুভূতির খোঁচা? প্রশ্ন এটাই। ওরা ভালোটা  পারল কি করে? নির্ভেজাল আবেগ নাকি এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ অনুভবের সঙ্গে জুড়ে থাকে অন্য ব্যাঙ্গাত্মক ভাসান! দোলনদির এই লেখা  পড়তে পড়তে খুলে গেল সেই প্যান্ডরার বাক্স। উড়তে লাগল সেই ক্ষতের প্রজাপতিরা।

রুমানাতো আমাদের চেয়ে লাকি। ওকে নিজের নামটা আজীবন শেখাতে হবে না। ওর নামটা তবু একজন উচ্চারণ করতে ভুলে গেলেও অনেকে করেছে। এবং নির্ভুলভাবে।  আমার নাম তো  শব্দের নিরাশভাবে  গুলিয়ে যাওয়ার অসহায় পরিণতি।  জিনাতারা, জিনাত রেহেনা সুলতানা, জিন্নাত রেহেনারা,জিনৎ রহেমান, জিথাথ, শ্রীনাথা, জিন্না রহমান- লম্বা সংযোজন, শেষ হওয়ার নয়। গতকালই এক পত্রিকায় এসেছে এইরকম নাম। প্রশ্ন ভুল বলায় নয়। ভুল উচ্চারণের পর গর্বিত হয়ে বলা- 'তোদের নাম-ধাম গুলো পারিনা বাবা! বড় খটমট।' আসলে দোলনদি যে আধিপত্যবাদের কথা বলেছে সেটা নরম্যালাইজড জ্বর -কাশির মত অসুখ।  এবং সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে অবলীলায় অবগাহন এর প্রতিদিন।  প্রতিপত্তির অহংকার আর নিঃস্বের বিলাপ দুই মেরুর। একটার মধ্যে থাকলে অপরটিকে ছুঁতে পারা মুশকিল। ব্রাহ্মণের অহংকার শুদ্র জানে। কিন্তু শুদ্রের বেদনা? এক  অনালোকিত অপমান আর অবহেলায় মোড়া। এটির অদৃশ্যায়নে এক আলাদা সামাজিক  আস্ফালন আছে!

মুসলিমদের মধ্যে আজও এই সমাজ এক গফুর আর  লাদেনকে খুঁজে পায়। আর মুসলিম মেয়েদের মধ্যে এক আমিনা বা কখনও সখনও একটি তসলিমা খুঁজে পায়। যাদের তসলিমায় আপত্তি তারা এক লহমায় রোকেয়াকে তুলে এনে মুসলিম সমাজটার সঙ্গে একাত্ম হতে চায়। রুমানাদের নিজের হাতে কলম এসে পড়লে হয়ত ইতিহাস হবে। 'অপর' নিয়ে উপলব্ধি আর যাপন বুঝি আলাদা।

এই তো লকডাউন শুরু হওয়ার ঠিক আগে। ফিরছি এক হায়ার্ড কারে স্কুল থেকে। সহসঙ্গী আরও  তিনজন। একজন বছর বাইশের ছেলে হু হু করে কাঁদছে! মায়ের হার্ট অ্যাটাক। বহরমপুরে ভর্তি। তার সঙ্গে রয়েছে তার খালাম্মা। সেও জোরে জোরে কাঁদছে। পাশে থেকে তৃতীয় ব্যক্তি বললেন – "আপনাদের তো এই অসুখ খুব।" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,আপনারা মানে কারা? উনি অবলীলায় বললেন – "উনারা নিজেরাই বলুন, উনারা কি খান? কেন ওদের এত হার্টের অসুখ, অম্বল, গ্যাস।"  ভাবছিলাম, এক ২২ বছরের ছেলে মাঠ থেকে ছুটে এসেছে মা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে জেনে  অথচ তাকে তার সহনাগরিক কি ভাষায় সান্ত্বনা  দিচ্ছে! অসুখেরও জাত হয়?

বছর তিনেক আগে বালির ব্রিজে মর্মান্তিক বাস দূর্ঘটনায় মারা গেল অনেকে। মৃতদের প্রকাশিত  তালিকায় ছাপার হরফে লেখা  ছিল এক 'মুসলিম শিক্ষিকা।' প্রতিবাদ করায় এক অভিজ্ঞ অধ্যাপক বোঝাচ্ছিলেন মঞ্চে বসে – মুসলিম শিক্ষিকা নাকি পরিচয়ের অঙ্গ।  সাধারণ সম্বোধন। এতে খারাপ ভাবার কোনও কারণ নেই। সেদিন আমি এতবড় মিথ্যাচারণার মধ্যে বুঝেছিলাম মৃতদেহেরও জাত হয়!

আরও পড়ুন-যে সমাজে ব্যক্তি নয়, তার ধর্মীয় পরিচয়ই প্রাধান্য পায়

'মুসলিমরা স্নান করে না। এরা যে পাত খায় সে পাত উল্টায়। এরা বিশ্বাসঘাতক। এরা বিছানার উপর ভাত খায়। এরা ভীষণ নোংরা। এরা বড় দাড়ি নিয়ে খেলার মাঠে সিজদা দেয়, অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে কাজ করে।' আরও কত কি! বন্ধুর নাম ও মুখ অপষ্ট। কিন্তু এই শব্দগুলো যে বুলেটের চেয়ে শক্তিশালী তা আঘাতে বুঝেছি। গোরুর মাংস খাই না। দুর্গা পূজোতে অঞ্জলি দিই। মা  কালীর  ভক্ত। পুজাও করি প্রতি অমাবস্যায়। সময়ের বদলে হয়ত নামাজও পড়ব কোনওদিন। এতকিছুর পরেও জীবন  থেকে ধর্মের চিহ্ন মুছে যায়না।

বিয়ে করেছিলাম অমুসলিমকে। বিয়ের পরই  ছেলের শ্রাদ্ধ করে দেয় ছেলের বাবা। জানলাম মুসলিম হওয়া এত বড় অপরাধ। বাবা তার একমাত্র ছেলেকে মৃতও ঘোষণা করে দিতে পারে। সময় এল। মেয়ের আঠারো বছর হলো। মেয়ের বাবার পরিবার বলে দিল -"এতবছর মুসলিমদের ঘরে থাকলে সে অটোমেটিক মুসলমান হয়ে যায়! মেয়েও মুসলিম হয়ে গেছে।"

নামের খোঁচায় শহরে পেলাম না পছন্দের ফ্ল্যাট। ঠিক এক দশক পেরিয়ে মেয়ে মেডিক্যাল কলেজে পড়তে গিয়ে পিজি খুঁজতে গিয়ে শুনল- "আধার দেখাও,মুসলমান কিনা জানতে হবে তো?" মনে মনে হাসলাম। যে বদলের জন্য আমার পরিবার বংশপরম্পরায় লড়েছে, কোথাও বুঝি একটা পাতাও নড়েনি।

দাদা  '৮৫  মাধ্যমিক ব্যাচ। রেজাল্টের পর অনেকদিন ধরে শুনেছিলাম জে  এন আকাডেমির এক মুসলমান ছেলে জেলায় স্টান্ড করেছে। আজ রুমানা শুনছে। অনেক বদলেছের দড়িটা বুঝি আয়তনে  বাড়েনি। শুধু রুগ্নই হয়েছে৷ অফিসেও বাবার পরিচিতি ছিল – ভালো মুসলিম অফিসার।  দাদাও আজ এক ভালো মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার। মাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল কুড়ি টাকার সিঙ্গার কোম্পানীর লালা রঙ। মুসলমানের দাগ মাকে ছুঁতে পারেনি।
ধারাপাতের মতো অকাতরে বর্ষণ হয়েছে যে লাঞ্ছনা, তাকে আমি-বাবা-দাদা পরিবারের সবাই এক অমীমাংসিত অধ্যায়ের মতো জীবনের এক কোণে লুকিয়ে  এগিয়েছি। খণ্ডিত সব মর্মান্তিক উপলব্ধিকে অনিবার্য মেনে নিয়ে যা মানুষকে ধারণ করে সুখে দুঃখে সর্বসঙ্কটে, তাকেই ধর্ম বলে জেনেছি। “যত্র মে সজ্জতে মনঃ” – বাবা বলতেন, এখানেই আমার মন আসক্ত, এটাই আমার দেশ। সাধ্য কার তাড়ায়? ডিটেনশন ক্যাম্পের ভয় থেকে আমাদের উদ্ধার করতে  মা এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে। নয়া নাগরিকত্ব  আইনের সময় বোঝানোর চেষ্টা করছিল " ন হি কল্যাণ কৃৎ কশ্চিদ্দুরগতিং তাত গচ্ছতি” অর্থাৎ কল্যাণকারীর কখনো দুর্গতি হয় না!

বলতে দ্বিধা নেই,দোলনদি মনস্করাই এবার বাঙালির তটে এসে আছড়ে পড়া গেরুয়া ঢেউ  সামাল দিয়েছে। হিন্দু-মুসলমান নয়, রুমানাদের পথ দেখাবে এই শক্তিই। দেশের বুকে বসে আগাছা উৎপাটনের গুরু দায় এদের মাথার উপরেই আজ এসে পড়েছে।

 লেখক পরিচিতি: জিনাত রেহেনা ইসলাম পেশায় একজন শিক্ষক। কট্টর নারীবাদে বিশ্বাসী এই লেখক ফেমিনিজম ডট কম পত্রিকার সম্পাদক। তার প্রেম, আবেগ সবকিছুই লেখাকে কেন্দ্র করে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে লেখালেখিই তার সব। তার দুটি কবিতা বই রয়েছে, ‘মৃত্যু জীবন’ ও ‘আমি এবং ইবলিশ’। নারী সংক্রান্ত ইস্যুতে তার লেখা বিভিন্ন নিবন্ধ নিয়মিত প্রতিদিনের সংবাদ এবং অনলাইন ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়ে থাকে। তিনি আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/

লাইক, কমেন্টস, শেয়ার দিয়ে আমাদের সাথে থাকুন