আবু সাইদ কামালের গল্প ‘দোলনচাপার ঐশ্বর্য’

Abu shayed Kamal

দোলনচাপার ঐশ্বর্য

আপনাদের দা’টা দেবেন প্লিজ?
দা?
হ্যাঁ।
দা দিয়ে কী করবেন?
বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ঝুমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে শোভন। জবাবে ঝুমা বলে, আজই প্রথম বাসায় উঠলাম কিনা। সব জিনিসপত্র এখনো আনা হয় নাই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তো। মা বললেন, মাছ- তরকারি কুটার জন্য আপনাদের দা’টা নিতে।
দিচ্ছি, একটু দাঁড়ান।
বলেই শোভন বাসার ভেতর ঢুকে। ঝুমা ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বলে, এ্যাহ্! সামান্য সৌজন্য বোধটুকু নাই। একটু বসতেও বলল না।
ঝুমা একাকী ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। মাথা ঘুরিয়ে তার চপল চোখে চারদিকে দেখে। মুহূর্তের মধ্যেই শোভন একটা দা হাতে নিয়ে আসে। বলে, এই নেন দা।
ঝুমার পটলচেরা চোখে চোখ রেখে শোভন দা’টা বাড়িয়ে দেয়। ঝুমা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। নিচের দিকে তাকিয়ে তাদের বাসার পথে এক পা দু’পা করে এগোয়। পেছন থেকে অপলক তাকিয়ে থাকে শোভন। ঝুমা আর ফিরে তাকায় না।
দা’টা কখন ফেরত দেবেন বললেন না যে?
হঠাৎ পিছন থেকে শোভনের প্রশ্ন। ঝুমা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, এইতো-একটু পরেই।
চাকুরি থেকে অবসর নেবার পর শোভনের বাবার একান্ত ইচ্ছে, জীবনের বাকি সময়টা শহরের অদূরে গ্রামের বাড়িতে কাটাবেন। সে লক্ষ্যে নেত্রকোণা শহরের আধা বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠিত দুটি বাড়ির অর্ধেকটাই বিক্রি করে দিয়েছেন ঝুমার বাবার কাছে। আজ বিকেলেই তারা বাসায় উঠেছে।
শোভন, তার বড় ভাই এবং ভাবি ছাড়া বাকি সবাই চলে গেছে গ্রামের বাড়ি। শোভন আর বাইরে যায়নি। সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করছে ঝুমা কখন আবার দা’টা ফিরিয়ে দিয়ে যায়। সন্ধ্যের আবছা আলো আঁধারে ঝুমার ছোট ভাই দা’টা ফিরিয়ে দিয়ে যায়। শোভনের শেষ বিকালের প্রতীক্ষা বিফল হয়। ঝুমা আসেনি।
কোন রকম বিরক্তি প্রকাশ না করে ঝুমার ছোট ভাই টুটুলকে শোভন সস্নেহে জিজ্ঞেস করে, যে দা’টা নিয়ে গিয়েছিল সে তোমার কী হয়?
বড় বোন।
তোমরা ক’ভাই বোন ?
দু’ভাই তিন বোন। সকলের বড় বোনের বিয়ে হইছে। তারপর মেঝ আপা। সবার ছোট বোনের বয়স তিন বছর।
ও, আচ্ছা।
ছেলেটা চলে গেলো। শোভন লক্ষ করল তাদের সদ্য বিক্রী করা বাড়ির আঙিনায় ছায়ার মত কে যেন দাঁড়িয়ে। ছেলেটা নাগালে গেলে ছায়াটা নড়ে উঠলো। টুটুলসহ  বাড়ির ভেতর মিলিয়ে গেল। শোভনের বুঝে নেয়, এই সেই মেয়েটি। শোভন মনে মনে বলল, তাহলে লুকোচুরি? আচ্ছা, দেখা যাবে!
ঝুমার আকস্মিক উপস্থিতি রাতেও শোভনকে বিশেষ এক ভাবনার ঘোরে আচ্ছন্ন রাখে। পড়াশোনায় মন বসছে না। পড়ার ফাঁকে মনের কোণে কখন যে রঙিণ ভাবনাগুলো উঁকি মারে তা কিন্তু বলাও যায় না, দমন করাও যায় না। কারণ এ বয়সে তো এসব ভাবতে ভালই লাগে। শরীর-মনে এক ধরনের পুলক জাগে।
ভোর বেলায়ই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস শোভনের। সকালের পড়াটা তার ভালোই লাগে। সারা সকাল ঝুমার একটু দেখা পাবার জন্য শোভন উতলা। নাইবা থাক কোন সম্পর্ক। তবু সুন্দরকে কে না দেখতে চায়!
সেদিন বিকেল বেলা। বিএসসি (অনার্সে} অধ্যয়নরত শোভন কলেজ থেকে ফিরেছে খানিক আগে। তবে দুপুরের খাবার খেয়েছে বিকেলে। পাঠ কক্ষে শুয়ে বিশ্রাম নিয়েছে কিছুক্ষণ। পড়ন্ত বিকেলে যখন সবাই আয়েশি ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন গাণিতিক অনুশীলনের জন্য শোভন তার কক্ষের একটা জানালা খুলে টেবিলে বসেছে। দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে অনুকুল করেছে পড়ার পরিবেশ। শোভন পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে। যাচ্ছে কিছুক্ষণ। হঠাৎ সুললিত কণ্ঠের একটি সম্মোহিত সুর ভেসে আসে কানে। নিচু স্বরে। স্বল্প দূরে। মন মাতানো এমন সুর শুনে শোভন আর স্থির থাকতে পারেনি। গলা বাড়িয়ে খোলা জানালা পথে বাইরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খোঁজে। কিন্তু পাচ্ছে না। বাতাসে ভেসে আসা এমন পাগলপারা সুর শুনে উতলা শোভন কোথাও কাউকে না দেখে বিস্ময়ে থ বনে থাকে কিছুক্ষণ। মনে মনে বলে, আহা কী মধুর সুর!
‘সব ক’টি জানালা খুলে দাওনা’
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর শোভন হঠাৎ দেখতে পায় সেই মেয়েটি।  নতুন প্রতিবেশী সেই মেয়েটিকে লাগোয়া বাসার অভিন্ন আঙিনায় অবস্থিত দোলন চাপার ঝোপের আড়ালে হঠাৎ দেখা গেল। সেখান থেকেই দ্বিতীয়বার গানের সেই কলিটিতে সুর দিয়েই চপল গতিতে চলে যাবার সময় শোভনের দৃষ্টি-জালে আটকে যায়। চোখে চোখ পড়ে। চার চোখের জ্যামিতিক দৃষ্টি বিনিময়। শোভন সুরের রানির দু’চোখে দৃষ্টির শর বিদ্ধ করলে ম্রিয়মান দু’টি চোখ তার লজ্জায় আনত হয়। তারপর দ্রুত ঐ জায়গা ছেড়ে চলে গেলো। যেনো বসন্তের কোকিল। মধুর সুর বর্ষণ করে চলে যাবার পর শোভন ভাবনার ঘোরে পড়ে। ভাবে, মেয়েটি গানের কথাগুলোর মাধ্যমে শোভনকে কিসের আহ্বান জানিয়ে গেলো!
শোভনের পড়ার ঘরের সব ক’টি জানালাই কী খুলে দিতে বলল, নাকি গানের কথাগুলোর অবলম্বনে তার মনের সবক’টি জানালা খুলে দেওয়ার জন্য মেয়েটির মধুময় নিবেদন এটি ! শোভন মনে মনে উল্লসিত। স্বগতোক্তি করে বলে, জানালাগুলো খুলে দিলে যদি ফুলের সুগন্ধ মাখা বাতাসে ঘর আমোদিত হয়, তাহলে আর সংশয় কেনো! তাকে সে সাদরে অভিনন্দনই জানাবে।
দু’দিন আগে যে মেয়েটির সাথে নাটকীয়ভাবে শোভনের দেখা হয়েছে, সেই মেয়েটির এমন আকস্মিক আবির্ভাব! তবু তার মনের আঙিনায়! শোভনকে ভাবিয়ে তুলে। এরপর থেকে তার আগ্রহভরা পর্যবেক্ষণের দৃষ্টি মেয়েটির প্রতি খোলা রাখে। পরদিন শোভন গানের পাখিটিকে খুঁজেছে। কিন্তু সে তো তার নিজস্ব গাছের পাতার আড়াল থেকে সহসা বের হতে চায় না। যেনো কোকিলের মত কেবল অলক্ষ থেকে ডাকে। শোভন কান পেতে রাখে। আর দু’চোখ খুলে অপেক্ষায় থাকে।
পরদিন কলেজে যাবার সময় হয়। শোভন কলেজের উদ্দেশে যখন গেটের কাছে গেলো, অমনি ঝুমাও স্কুল ব্যাগ ভর্তি একগাদা বই নিয়ে গেটে উপস্থিত। শোভন ঝুমার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে, ও তাহলে স্কুল ছাত্রী?
জি, স্কুল ছাত্রী। দশম শ্রেণী।
এতো দেখছি হাতির কান।
কী! আমাকে হাতি বললেন ?
না মানে শ্রবণ শক্তি একটু বেশি তো, তাই।
আপনিতো কলেজে, তাই না ?
হ্যাঁ সরকারি কলেজে।
গেট থেকে বের হয়ে প্রধান সড়ক পর্যন্ত দু’জন একই সাথে হাঁটে। তারপর দু’জন দু’রিকশায় দু’দিকে। আর কোন কথা হয়নি তাদের মাঝে।

দুই
পরদিন সকালে শোভন পড়ার টেবিলে। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বই এবং খাতা হাতে নিয়ে শোভনের পড়ার ঘরে ঢুকলো ঝুমা। ভূত দেখার মতই ঝুমাকে দেখে অবাক শোভন। ঝুমা বলে, অনেকটা দায়ে পড়ে আপনার কাছে আসা। আপনি তো অঙ্কের ছাত্র।
কে বলল ?
আমি জানি।
জানেন মানে? কার কাছে শুনেছেন ?
আমার এক বান্ধবী। আপনার বন্ধুর ছোট বোন রীনা।
ও আচ্ছা।
বেশি ডিস্টার্ব করব না। মাত্র দুইটা অঙ্ক।
চটপটে মেয়ে ঝুমা। কোন রকম ইতস্তত না করে শোভনের টেবিলের বিপরীত পাশে বসে গেল। শোভন বই এবং খাতা নিয়ে নির্দেশিত অঙ্ক দুটো চট করে করে দিল।
ঝুমা বলে, ঐটাও পারি না। প্লিজ একটু…
ঠিক আছে, করে দিচ্ছি।
অল্প সময়ের ব্যবধানে সে অঙ্কটাও করে ফেলল শোভন। এরপর বই খাতা বাড়িয়ে বলল, এই নেন।
শোভন ঝুমার চোখে দৃষ্টি মেলল।
ঝুমা বলল, ছাত্রীকে আপনি বলতে নেই শোভন ভাই। তুমি বলবেন প্লিজ!
জবাবে শোভন বলে, আচ্ছা। না হয় তুমিই বলব।
এভাবে তাদের মাঝে স্বাভাবিক কথা হলেও উভয়ের চোখে ছিল সম্মোহন দৃষ্টি। ঝুমা প্রথম দেখাতেই শোভনের প্রতি মনে মনে দূর্বল হয়ে পড়লেও একেবারে যেচে এসে ধরা দিতে রাজি নয়। তার চাই সম্মানজনক একটা অবস্থান। কারণ, তারও তো একটা আত্মসম্মানবোধ আছে। ঝুমা অবশ্য জানে, শোভনকে আকৃষ্ট করার মত সম্পদ তার শরীরে আছে। সুন্দরী মেয়ে বলে ঝুমা ইতোমধ্যে স্বীকৃতিও পেয়েছে। কারণ, অন্য সব সমবয়সী মেয়েদের চেয়ে মহল্লার সব ছেলেরা তার পেছনেই লেগেছিল। একটা ছেলেতো বেপরোয়া ভাবেই তাকে উত্যক্ত করতো। সে জন্যই তো তড়িঘড়ি করে তার পরিবার ভাড়াটে বাসা ছেড়ে নতুন কেনা এ বাসায় উঠেছে।
ঝুমা শোভনের কাছ থেকে অঙ্ক তিনটা করেই চট করে কেটে পড়ল। শোভন অবশ্য ভাবল, এমন সুন্দরী উঠতি কিশোরী কিছুক্ষণ কাছে থাকলে মন্দ কী?
এরপর অবশ্য সারাবেলা ঝুমা শোভনের দৃষ্টিতে পড়েনি। পরদিনও না। তৃতীয় দিনও না। চতুর্থ দিন সকালে পুনরায় বই খাতা নিয়ে হাজির ঝুমা। বলল, শোভন ভাই ! আবারও বিরক্ত করতে আসলাম!
না-না, ও কিছু নয়। এ আর তেমন কী কাজ। তা গত দুই-তিন দিন আসনি কেন?
ওই দু-তিন দিন ক্লাস-রুটিনে গণিত ছিল না, তাই।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে, বস। তারপর দাও।
ঝুমা টেবিলের বিপরীত পাশে বসে হাত বাড়িয়ে বই খাতা দিচ্ছিল। অমনি তার ডান হাতের লিকলিকে দুটো আঙ্গুলে শোভনের প্রথম ছোঁয়া লাগে। ফলে ঝুমার বুকের ভেতর এক বিশেষ অনুভূতি মোচড় দিয়ে উঠে। নিরিবিলি কক্ষে এমন যুবতীর আকষ্মিক আঙ্গুলের স্পর্শ পেয়ে শোভনের শরীরেও এক ধরনের বিশেষ অনুভূতি বিদ্যুৎ খেলে। উভয়ের ভেতর রাজ্যে ক্ষণিকের সুখানুভূতির ঝড় বয়ে গেলেও পরস্পরের বাহ্যিক আচরণে তা প্রকাশ পায়নি। গাণিতিক সমস্যা সমাধানের পর আজও চট করে চলে যায় ঝুমা।
এভাবে শোভনের কাছে ঝুমার যাতায়াত প্রবণতা লক্ষ করে ঝুমার মা ঝুমাকে প্রথম বাধা দেন। জবাবে ঝুমা বলল, না-মা, শোভন ভাই এমন ছেলেই না। মা বললেন, তবু তো এমন সোমত্ত ছেলে-মেয়েদের অবাধে মেলামেশা করতে নাই। তাহলে লোকে মন্দ বলবে।
ঝুমা বলল, মেলামেশা করলাম কোথায়? আমি না ক’টা অঙ্ক করছি মাত্র। প্রাইভেট টিউটর পেয়ে গেলে তো আর যাব না।
কিন্তু তবু…
জান মা, শোভন ভাই কলেজের ছাত্র নেতা। কত ছেলেমেয়ে তার কাছে আসে যায়। কই, কেউতো তাকে খারাপ বলে না!
ঠিক আছে। শোভনকে এক সময় আমার সাথে কথা বলতে বলিস।
আজই সন্ধ্যায় না হয় আসতে বলি?
হ্যাঁ বল।
ঝুমার পড়ার ঘরটা বেশ পরিপাটি। সন্ধ্যায় শোভন এলো। ঝুমার ঘরেই বসতে দিল। ঝুমার মা শোভনকে বলল, দেখ বাবা! আমরা কিন্তু একটা বিপদে পড়ে তোমাদের বাসাটা কিনে তড়িঘড়ি উইঠ্যা পড়লাম। তুমি আমার ছেলের মতো। তাই বিপদের কথাটা তোমাকে না বলে পারছি না।
কী রকম বিপদ আন্টি ?
না মানে, একটা ছেলে ঝুমাকে খুব ডিস্টার্ব করতো।
কোন ছেলে ?
মুক্তার পাড়ার যে বাসাটায় আমরা ভাড়া থাকতাম, ঐ বাসার মালিকের ছেলে। নাম ঝন্টু।
ও, ঝন্টু ? দেখবেন, আর কিছু বলবে না।
তুমি বস। আমি চা পাঠাচ্ছি। কইরে ঝুমা?
মা চলে গেলো। দরজার পর্দার আড়াল থেকে ঝুমা ঢুকলো। মায়ের বলা দুর্বলতার কথা শোভনের কাছে বলাতে ঝুমা আত্মসম্মানবোধজনিত লজ্জায় বিমর্ষ হয়ে বিছানায় বসে রইল। কোন কথা বলতে পারছিল না।
শোভন তার নীরবতার কারণ বুঝতে পেরে বলে, ছেলেটা বুঝি খুব উত্যক্ত করতো ?
হ্যাঁ। খুব জ্বালাইতো আমাকে। আমি ওর দিকে ফিরেও তাকাইতাম না। অথচ…
দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কোনো কথা বলা দূরে থাক, ফিরে তাকাবার সাহস পাবে না ও।
এরই মধ্যে ঝুমার ভাবি চা নিয়ে আসে। ঝুমা পরিচয় করিয়ে দেয়। এর মাঝ দিয়েই শোভন ঝুমাদের বাসার প্রবেশপত্র পায়। সেদিন থেকেই শোভন প্রতি সন্ধ্যায় ঝুমাদের বাসায় টিভির অনুষ্ঠান দেখে। শোভনদের টিভি তাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে গেছে।
ঝুমাও প্রায় সকালে গাণিতিক সমস্যা সমাধানের অজুহাতে শোভনের ঘরে যায়। এভাবে ওরা খুব কাছাকাছি চলে আসে। ধীরে ধীরে তাদের মেলামেশা প্রণয়ে পরিণত হয়। তবে তাদের এ ভালো লাগার বিষয়টা কেউ কাউকে বলে না।
ঝুমা ষোড়শী। কখনো শোভনের সান্নিধ্য পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠে। তার পরিপূর্ণ যৌবন-শরীর বর্ষায় উছলে ওঠা ভরা নদীর তরঙ্গের ন্যায় ছন্দায়িত। কিন্তু শোভন চায় দোলন চাঁপার সতেজ কলি সম্পূর্ণ বিকশিত হলে তবেই ঘরের ফুলদানী সাজাবে। তার আগে তার শুভ্র কোমল পাপড়িতে স্পর্শ করলে তার ঐশ্বর্য ক্ষুন্ন হবে। এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে ওরা অনেক দূর এগিয়ে যায়। সেদিন বিকাল বেলা। শোভনের ভাই-ভাবি বাড়ি চলে গেছে। শোভন বাসায় একা। পড়ন্ত বিকেলে শোভনের বাসায় থাকা মানেই ঝুমার জন্য প্রতীক্ষা করা। ঝুমাও সুযোগের অপেক্ষায়। দুপুরের খাবারের পর বাসার সকলে আয়েশি ঘুমে আচ্ছন্ন। একমাত্র ভাবি জেগে। ঝুমা তার ভাবির চোখে ধুলো দিয়ে চুপি চুপি শোভনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়। অভিজ্ঞ ভাবি বিষয়টি টের পায়।
শোভন একাকী বাড়ির দক্ষিণ আঙিনায় ছোট্ট ফুলের বাগানটায় লোক দেখানো পরিচর্যা করছিল। যার জন্য প্রতীক্ষা সেই ঝুমা-ই শেষে উপস্থিত। সে ঝুমাকে নিয়ে দোলন চাঁপার ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসে। নিরিবিলি জমে উঠল প্রেমালাপ। বিমুগ্ধ বিকেলে ওরা ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে। এমন সুন্দর বিকেল! উভয়েই নিজেদের অবচেতনে মজতে চলেছে দিশেহারার মত প্রেম প্রেম খেলায়। অমনি ঝুমার ভাবি অকস্মাৎ ভূত দেখার মত উপস্থিত হয়। ঝুমা তখন শোভনের উরুতে মাথা রেখে ঘাসের সবুজ গালিচায় চিৎ হয়ে শুয়ে। শোভনের শিকারি ওষ্ঠদ্বয় সবে ঝুমার কপালে চুম্বন রেখা এঁকে দিতে উদ্যত। হঠাৎ ভাবির কণ্ঠ, ঝুমা ভাবিকে দেখে এক ঝটকায় উঠে বসে পড়ে। ভাবি বলে, কী হে ননদি, ডুবে ডুবে জল খেয়ে এতদূর? শোভন অনেকটা থতমত খেয়ে বলল, না ভাবি; মানে…
-হ্যাঁ, যদি নিজের চোখে না দেখতাম।
ঝুমা লজ্জায় কোনো কথা বলল না। শোভন ঝুমার ভাবিকে কী বলে মানাবে ভেবে পাচ্ছেনা। তবু কিছু একটা বলা দরকার। তাই ফস করে বলে ফেলল, ভাবি! আমি ঝুমাকে নিয়ে যদি ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখি।
-সে ভবিষ্যতই বলে দেবে। তা ঝুমা কি অভিসারেই থাকবে? সন্ধ্যা যে ঘনিয়ে…।
লজ্জায় রক্তরাঙা হয়ে উঠেছে নতমুখী ঝুমা। আর কোন কথা না বলে ঝুমা ভাবির সাথে চলে গেলো। একেবারে হাতেনাতে ধরা খেলো ঝুমার ভাবির কাছে। নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল শোভনের। বিষয়টা তাকে ভাবিয়ে তুলে। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত শোভন বাগানেই বসে রইল। মনে মনে শপথ নিল, এ প্রণয়ের পবিত্রতা সে ক্ষুণ্ণ করবে না কখনো।

লেখক পরিচিতি: কথাসাহিত্যিক আবু সাইদ কামাল (জন্ম  ৫ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহ জেলায়) লিখছেন প্রায় তিন যুগ ধরে। সত্তর দশকে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ নব্বইয়ের দশকে। নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন গল্প, উপন্যাস,  প্রবন্ধ, কবিতা, শিশুতোষ গল্প ও ছড়া। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩০ টি। সম্পাদনা করছেন ‘পাদদেশ’, ‘ছোটদের সাহিত্য’ ও ‘ছড়াপাতা’ ও ‘বাকবাকুম’ নামে চারটি ছোট কাগজ। এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, একজন নিষ্ঠাবান এবং নিরলস সাহিত্যকর্মী ও সাহিত্যসেবী হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি নিজস্ব স্থান করে নিয়েছেন। এ লেখকের বিশেষ পরিচিতি কথাসাহিত্যিক ও ছড়াকার হিসেবে। গত তিন যুগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্পোত্তীর্ণ ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাহিত্যের ম্যাগাজিন ও ছোট কাগজে। বিশেষ করে গারো পাহাড়ের পাদদেশ এলাকার সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী নিয়ে তার ছোট গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ সুধীমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এ ছাড়াও ‘মাতৃকুলভিত্তিক গারো সমাজ’ ও ‘হাজংদের অতীত বর্তমান’নামে প্রকাশিত তার গবেষণাধর্মী দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ বেশ তথ্যসমৃদ্ধ।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/