মিষ্টি মেয়ে তুমি অপরাজিতা

নুসরাতের সঙ্গে তার স্বামী আসলাম সানী

মিষ্টি মেয়ে তুমি অপরাজিতা

নুসরাত একজন সফল নারী যিনি নিজচেষ্টায় গুছিয়ে নিয়েছেন সংসার ও ব্যবসা। তিন কন্যাকে করেছেন শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন হোমায়রা হুমা

নুসরাত ভাবির সাথে পরিচয় প্রায় ৩০বছর। মিষ্টিভাষী শুধু নয়, আচরণেও মধুময়ী। ১৯৮৭, সে সময়েই তিনি উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী। আজকের সময়ের নারীদের জন্য এত সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান পরিবেশের মতো তখন ছিল না। ছিলোনা কোনো শো রুম, ঝকঝকে দোকান,কোনো গার্লমডেল। ছিল শুধু মা, একনিষ্ঠ নীরব সমর্থক ও সহায়তাকারী। গোপনে বিয়ের আগে পড়ালেখার পাশাপাশি মায়ের কাছ থেকে শেখা সূচীশিল্পে, নিজের জামার দর্জিখরচ বাঁচানোর সাথে আশেপাশে দু'একটা বান্ধবীর ড্রেস বানিয়ে দিতে হতো, নিজ দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠার কৌশলে, আরকি!

নুসরাতের সেই সূচীবিদ্যার চর্চা চলেছিল বিয়ের পরও। তখনকার সময়ে অনেকে বাঁকা চোখে আলোচনা-সমালোচনা করতো নিশ্চয়ই। কিন্তু নুসরাতকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনি। সাহস করে নিজ হাতে বানানো নিত্যনতুন স্ট্যাইলের জামা,ব্লাউজ, বাচ্চাদের ফ্রক, ব্লাউজের ইর্ক তৈরি করে চুপিচুপি ব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে যেতেন নিজ মেয়েদের স্কুলের অভিভাবকদের কাছে। সেখান থেকে অর্ডার আসতো, এভাবেই নিজ সৎকর্মের ফলে গোপনে আড়ালে প্রতিকী ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। তারপর ধীরে ধীরে ইন্ডিয়ান থ্রিপিস, এমিটিশন গহনার দিকে মনোনিবেশ করলেন।এলাকার মধ্যবিত্ত নারীদেরকে দিয়ে বুটিকস্ এর কারচুপি,ভরাট সেলাই, কাশ্মীরি স্টিচ,ডলার বসিয়ে  শাড়ী,রেডিমেড থ্রিপিস তৈরি করে ওদেরকেও স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন। দৃঢ়তায় আত্মোন্নয়ের স্বপ্ন বুনেছেন নিজের ও সাধারন নারীদের প্রতিজ্ঞার জমিতে।

আজকের নারীদের জন্য সহজসরল রেডিমেড চলার পথ, তিনি ও তারমতো আরো অনেক প্রগতিশীল নারী কচ্ছপের মত slow and steady but wings the race, সক্ষম হয়েছেন। তাই তারাই তো আজকের এফবিসিআই নারীনেত্রী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের আলোকবর্ষ দিকদর্শন। নুসরাত, আজকের নারীদের স্বাবলম্বী পথের স্বিকৃতি লাভের প্রত্যয়ণপত্রের স্বাক্ষী  যে তুমি, তোমরাই। পুরানো ঢাকার নানান কুসংস্কারকে পায়ে পিশে যে গরবিনী নারী এগিয়েছিলেন বন্ধুর পথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে, আমি সেই নুসরাতের লড়াইয়ের কথাই বলছিলাম, আপনাদের। নুসরাত পুরানো ঢাকার কন্যা, বউ আর মা। এই তিন পরিচয়ে সে অনন্য।

তোমার তো প্রেমের বিয়ে। কিভাবে এ যুদ্ধ জয়ী হলে?
-অন্ধকারে মোমের আলো জ্বেলেছি আর পথ চলেছি।শ্বশুরঘরের সবার মন জয় করেছি।
জীবনযুদ্ধে কি কি করতে হয়েছে?
-চাপা, এ মুখ বন্ধ রেখে কাজ ও দায়িত্ব পালন করলে মন জয় হয়। বিবাহিত জীবনের শুরুতে রোজ সকালে আটার গুড়ি চেলে ৩৩/৪০টি রুটি বেলতে হতো। একান্নবর্তী পরিবার, রুটি, খাস্তা পরাটা, সবজি ভাজি, সুজির হালুয়া, চা। কোন ভোরে রান্না ঘরে ঢুকে কখন যে ১০/১১টা বেজে যেত বুঝতাম না।
কি বলছো?
-তুমি তো জানো পুরানো ঢাকার মানুষ রাত জাগে বেলা করে ঘুমায়। তাই নাস্তা শেষ হতেই তরকারী কাটা, মাছ ধোয়া, রান্নার সব জোগার শাশুড়িকে সাজিয়ে দিয়ে তবে নাস্তা করে আমার রান্নাঘর থেকে ছুটি। আর বাজার হতো প্রতিদিন। শ্বশুর নাস্তা করে বাজারে যেতেন। বেলা এগার, বাজার আসতো বাসায় তখন।
তারপর?
-তারপর এই রুটিন কাজ থেকে বাঁচলাম, আমার বাচ্চাকে সকালের স্কুলে দেয়ার পর। আমি কতবছর পরে সকালের আকাশ দেখার সুযোগ পেলাম, আল্লাই জানেন।
তোমার বাচ্চা ক'জন?
-তিনটি মেয়ে।
তাই নাকি? নাম কি? কোন স্কুলে পড়তো? এখন কি করে ওরা? বিয়ে দিয়েছ? অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করে ফেলেছি–
-ওরা অগ্রণী স্কুল, ইডেন, বদরুন্নেসা কলেজে পড়তো। বিয়ে দিয়েছি, একজন এখনো পড়ছে। ওদের নাম হচ্ছে, অনন্য শতদ্রুম রুম্পা-ও এনআরবি ব্যাঙ্কে চাকরী করে, মৌলী তাপসী শম্পা, ওর নিজের 'টু ফেইস' বিউটি পার্লার আছে লালবাগ কেল্লার সামনে। আর সৌন্দর্য প্রিয়দর্শিনী ঝুম্পা, রবীন্দ্র ভারতীতে স্কর্লারশীপে ভারতনাট্যম শিখছে।
দারুণ তো! কিভাবে এতো গুরুদায়িত্ব সফল করলে তুমি?
-হ্যা কষ্ট অনেক হয়েছে।পুরানো ঢাকার ঐতিহাসিক চিপাগলি মাঝ দিয়ে এমন কঠিন কাজে মেয়েদেরকে এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় সংকল্প ছিল আমার স্বপ্ন জাগরণে। মেয়েদের বলেছি 'পরিবারের কেউ বা বাইরের কেউ কিছু কটুক্তি করলেও তোমরা নিজের কর্তব্য করে যাবে, উত্তর দিবে না।' আমার লক্ষি মেয়েরা বেদবাক্যের মত আমার কথা মেনে চলেছে।হ্যা সত্যি, তাই ওরা আজ এখানে,সত্যি। আমিও পুলকিত হলাম। বল্লাম, জিতে গেছো যুদ্ধে।

প্রিয় পাঠক আসুন এবার নুসরাতের প্রেমিকের কথা শুনি। প্রশ্ন করি, আচ্ছা,  তোমার প্রেমিকবর সম্পর্কে বলো এবার।
-আমার প্রেমিকের সাথে পরিবারের অনুমতি না নিয়েই বিয়ে করেছিলাম সেইই কঠিন দিনে। পুরুষতান্তিকতায় ডুবে ছিল গোটা সমাজ। শুধু একটি কথা কানে বাজতো যেন রের্কডপ্লেয়ার ‘মেয়ে মানুষ এমন কাজ করবে কেন, এতো সাহস কেন হবে।’ তাই ঝড়-টর্ণেডো সয়েছি একা। তিনি তো সকালে বাইরে যেতেন আসতেন বিকেলে কি রাতে। বিয়ে করে ঘরে পৌছে দিয়ে ভাকাট্টা ভোঁ। হাসলো এতোক্ষণে নুসরাত।
আর তুমি? আত্কে উঠলাম-
-রক্ষা এই যে,প্রেমিক বাইরের কেউ না, আমার মামাতো ভাই। তাই ঘরে স্হান হলো। গ্রহণ করার ঘটনা আরো অনেক অনেক পর ঘটেছিল। ছড়াকার বরকে কিছু বল্লে বলতো, 'কি আর করবে,সহ্য করো। এ বকা খাওয়ার দিন থাকবে না'। সত্যি,তাই হলো, আল্লাহর রহমতে।
এবার প্রমিকবরের পরিচয়টি দাও।
– (মুচকি হেসে) তিনি সাহিত্যঙ্গণে স্বনামধন্য জনপ্রিয় একুশে পদক প্রাপ্ত ছড়াকার, গীতিকার, নাট্যকার, নাট্যশিল্পী, উপস্হাপক, প্রাপ্ত সম্মাননা, ও সম্মানের অধিকার, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত আসলাম সানী। আমি তাকে ভালবেসে ঠকিনি। বরং জিতিছি।
 ইশ্ এতো!
– হ্যা তিনি তখনো অনেক ধৈয্যশীল,এখনো।
তিনি না তুমি ধৈয্যশীলা? ছড়া লিখাবার সময়ের কথাটা বলো না!
-তিনি তো খুব ব্যস্ত। ছড়া লেখেন সারারাত জেগে। খাটে কলম খাতা থাকে। ছন্দ মনে হতেই বেডসাইট বাল্ব জ্বেলে লিখতে থাকেন, দিনদুনিয়া শুধু না, আমাকেই ভুলে যান। তার সাধনায় তিনি মশগুল।সারাটা জীবন একই রকম,কোনো চেঞ্জ নাই।
আর তুমি?
-আমি তো জানি সৃষ্টিধর মানুষ, তার লেখাই তার জীবন। তাছাড়া প্রেমিকবর। আমার সব সহ্য হয়ে গেছে।
আরো কিছু বলো।
-হাসিটায় জাদু আছে। কখনো কিছু বকাঝকা দিলে এমনভাবে হাসতে থাকেন,ব্যস আমি চুপ। আসলে তার অনেক ভক্তের মধ্যে  আমিও তো একজন তাই না! সানী আসলেও খুব ভাল মানুষ। 'গোবরে পদ্মকোষ'— পুরানো ঢাকার চিপাগলির মাঝখানে ঝলমলে ফুঁটে আছে যেন।
তুমি এই ছাড়াকারকে এতো উপলব্ধি করো?
-কোনো কোনো অনুষ্ঠানে ওর পাশে থেকে ওর কথা, চটপটে ছড়ার উচ্চারণ, এতো জনপ্রিয়তা দেখলে আমার তো সেই বাবুর্চিখানার দিনগুলো মনে পড়ে যায়। গলাটা আবেগে ভারি হয়ে উঠলো।
তোমার ঘরে তো সব জনপ্রিয় স্টার, সবাই পেশাজীবী নারী বলে ঢাকা শহরের পুরানো মহল্লা আমলিগোলার হীনমন্যতায় ডুবে যায় নি।পৃথিবীর সকল অধিকারের জেন্ডার সমতা ও সমানাধিকার অর্জন করেছে তারা। আর এই সব সম্ভব হয়েছে তোমার সাহসীনী পদক্ষেপে,খাটুনি, দৃঢ় প্রত্যয়ের কারণে। তুমি নিজেও জয়িতা, তিনকন্যাও তাই। আচ্ছা, এবার করোনা সংস্কৃতি কেমন চলছে তোমার?
-প্রতিদিন মৃত্যুর খবর শুনে খুব খারাপ লাগে। তবে লকডাউন হলে ভয়ভীতির চেয়ে আমি স্বস্তি পাই বেশি। বলেই মন খুলে হাসলো কিছুক্ষণ, বল্লো আপনি বুঝেননি? সানীর তো সারা জীবনের ঘুরাঘুরি বন্ধ, এখন সে ঘরে থাকে, ঘর ভরা লাগে, ইচ্ছেমত রান্না করে ওকে খাওয়াতে পারি। বিকেলে ছাদে বসি। আমি লকডাউনে ভাল আছি ওকে নিয়ে। আল্লাহ করোনার আক্রোশ থেকে পৃথিবীকে ভাল করুন।
আজকের সময়ের বেড়ে ওঠা পুরানো ঢাকার মেয়েদের কিছু বলো।
-হ্যা মেয়েরাই পৃথিবীকে বদলে দিচ্ছে। মা বোন স্ত্রী কতরুপ তার। বড় আশ্চর্য প্রকৃতি হচ্ছে নারী। নারী তার মধ্যকার ভিতরের আলো দিয়ে পরিবারকে, সন্তানকে পৃথিবীকে আলোকিত করে। একদিন যারা আমাকে বলেছিল, 'তোমার তো তিনটা মেয়ে, কি হবে এদের দিয়ে। শ্বশুরের সম্পত্তির অংশও তো কম পাবে। বিয়ে দিয়া পার করো, কখন কি করে '। তাদেরকে আজ নম্রতার সাথে বলতে চাই, 'শোনো মেয়েরাই সৃষ্টির আধার, খনি। তাদেরকে মানুষ ভাবো, তারাই তোমার পৃথিবী বদলে দিবে একদিন।

হোমায়রা হুমা

 

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/