রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা সৃষ্টির পিছনের কথা

নূরহাসনা লতিফ

নূরহাসনা লতিফ

পাতার পর পাতা লিখে চলেন লেখক। তার প্রতিটি লেখার পেছনেই কারণ থাকে, থাকে কত না গল্প। এজন্য অনেকে বলে থাকেন- ‘নিঃশ্বাসের কালিতে কলম না ভিজলে লেখা আসেনা’। এই নিঃশ্বাসের  কারণ প্রকৃতি  ও মানুষ দুটোই হতে পারে। অবশ্য লেখকের মানস সরোবরও জন্ম দিতে পারে গল্প, কবিতার। মোট কথা আপনা থেকে কোনও কিছু সৃষ্টি হয়না। প্রত্যেক সৃষ্টির পিছনেই যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে। কবি শামসুর রহমান তার জীবন কথায় বলেছেন, তার ছোট একটা বোন মারা যাওয়ায় এত কষ্ট পেয়েছিলেন যে সেদিনই কলম ধরেন। সেই থেকে তার লেখা শুরু।

আজ ২২শে শ্রাবণ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০তম প্রয়াণ দিবস। আজকের এই বিশেষ দিনে আমরা তার বিখ্যাত কিছু কবিতা সৃষ্টির কারণ জানার চেষ্টা করব এই নিবন্ধে। কবি নিজেও কিন্তু অনেক জায়গায় নিজের সৃষ্টির কারণ বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে জীবনস্মৃতি ও ছিন্নপত্র থেকে তার লেখার অনেক কাহিনী  উদ্ধার করা যায়। আবার অনেক কবিতা সৃষ্টির পিছনের কাহিনী পাঠক ও সমালোচক তার জীবন ঘেঁটে আবিস্কার করেছেন। তার বিখ্যাত কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’র কথাই ধরা যাক।

আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।

এই সুন্দর কবিতাটি কে না পড়েছে! নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ এবং সেই দেশের বিখ্যাত কবি নদী নিয়ে কবিতা লিখবেন এটাই তো স্বাভাবিক। তারপরও আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে কবিতাটি কবি কখন লিখলেন এবং কেন লিখলেন। এ কবিতাটি কবি লিখেছেন বাংলাদেশে বসে। এক সময় জমিদারি তদারকির ভার পড়েছিলো বিশ্ব কবির উপর। জমিদারি পরিচালনার সাথে সাথে কবিতার ফসলও বুনেছিলেন তিনি। নওগাঁর আত্রাইয়ের পাতিসারে কাছাড়ি বাড়িতে বসে কবিতাটি লিখেছেন কবি। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নাগর নদীকে কেন্দ্র করেইএই কবিতার জন্ম। এই কবিতায় ধরা পরেছে পাতিসারের পরিবেশ, মানুষের সচল জীবন। শত বছর পরেও এই কবিতার প্রভাব মানুষের মন থেকে এতটুকু মুছে যায়নি।
 
তাল গাছ নিয়েও অসাধারণ এক কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উকি মারে আকাশে।
মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়—
একেবারে উড়ে যায়—
কোথা পাবে পাখা সে?

তিনি এই কবিতাটি লিখেছেন পাবনা শাহাজাদপুরে। এখানে অনেক উঁচু লম্বা তাল গাছ ছিল। পাল্কী করে যখন শাহাজাদপুরে আসতেন তখন এই তালগাছগুলির সাথে দেখা হতো কবির। লম্বা তালগাছের সারিতে মুগ্ধ হয়ে এই কবিতাটি লেখেন।

১৯৩৬ সালে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ঢাকার বলধা গার্ডেনে। বলধা এস্টেটের নরেন্দ্র নারায়ন রায় চৌধুরীর শখের পরিচায়ক বলধা গার্ডেনে। এই বাগানের  ক্যামেলিয়া ফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে যান কবি। আর তাই গার্ডেনের ‘জয় হাউজ’—এ বসে তার বিখ্যাত ক্যামেলিয়া কবিতাটি লেখেন। কবিতার কিছু চুম্বক অংশ এরকম-
  তনুকা বললে, "দামি দুর্লভ গাছ,

                 এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।'

                     জিগেস করলেম, "নামটা কী?'

                         সে বললে "ক্যামেলিয়া'।

             চমক লাগল–

      আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।

         হেসে বললেম, "ক্যামেলিয়া,

         সহজে বুঝি এর মন মেলে না।'

 কবির জীবনের কিছু গল্প নিয়ে লিখেছেন প্রয়াত সাহিত্যিক ও লোকগবেষক ড.আশরাফ সিদ্দিকী। এখানে কবির পিঠে খাওয়া নিয়ে মজার গল্প আছে। রবীন্দ্রনাথ  পিঠাপুলি খেতে খুব পছন্দ করতেন। তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীও খুব ভালো পিঠে বানাতেন। তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর শান্তিনিকেতনে কবির এক নারী ভক্ত রবীন্দ্রনাথের জন্য পিঠে বানিয়ে আনেন। কদিন পর তিনি কবির কাছে জানতে চাইলেন তার তৈরি পিঠা কবির কেমন লেগেছে। কবি বলেন—শুনবেন  তবে ছড়ার ছন্দে বলি—
        লোহা কঠিন, পাথর কঠিন
      আরও কঠিন ইষ্টক।
তাহার অধিক   কঠিন  কন্যে
তোমার হাতের পিষ্টক।

নূরহাসনা লতিফ: কবি ও লেখক।  তার প্রকাশিত বই এর সংখ্যা ৩২টি।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/