শুভ জন্মদিন প্রখ্যাত লেখক ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান

জহির রায়হান

আজ ১৯ আগস্ট, বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাহিত্যিক জহির রায়হানের জন্মদিন। তিনি নিজের সৃজনশীল প্রতিভা দিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প ও কথাসাহিত্যের দুই শাখাকেই করেছেন সমৃদ্ধ। এই দুই ক্ষেত্রে কাজের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি বাংলা একাডেমি ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ পেয়েছেন আরও নানা পুরস্কার ও সম্মাননা।

প্রাথমিক জীবন
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক এবং ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। জহির রায়হান কলকাতায় মিত্র ইনিস্টিউটে এবং পরে আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। ভারত বিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিজ গ্রামে চলে আসেন। তিনি ১৯৫০ সালে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। তিনি আই.এসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

অল্প বয়সেই জহির রায়হান কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তখন কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। তিনি কুরিয়ারের দায়িত্ব পালন করতেন অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দিতেন। গোপন পার্টিতে তার নাম রাখা হয় ‘রায়হান’। তার আসল নাম ছিল জহিরুল্লাহ। পরবর্তী সময়ে তিনি জহির রায়হান নামে পরিচিত হন।

চলচ্চিত্রে অবদান
জহির রায়হানের ঢাকাই চলচ্চিত্র জগতে আগমন ১৯৫৭ সালে, ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবির সহকারী পরিচালক হিসেবে। তিনি সালাউদ্দীনের ছবি ‘যে নদী মরুপথে’ চলচ্চিত্রে সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে ‘এ দেশ তোমার আমার’য়ে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান; জহির এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি রূপালি জগতের পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি) এবং পরের বছরই নিজের প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ মুক্তি দেন।

তার নির্মিত তিনটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে- ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও সফল চলচ্চিত্রটির নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’। এই ছবিতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর আইয়ুব খান ও পশ্চিম পকিস্তানি শাসকদের দমন ও নিপীড়নকে সফলভাবে একটি সংসারের ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি পশ্চিমা শাসকদের বর্বরতাকে চলচ্চিত্রে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলেন। দেখালেন, ছবির সাজানো সংসার যেমন একনায়ক গৃহকর্ত্রীর কর্তৃত্বে টিকল না, তেমনি পাকিস্তানও টেকার নয়।

এই ছবিতে ভাষা আন্দোলনের কথা ছিল, ছিল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান। মাত্র এক বছর পরে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধে এসবই ছিল বাঙালির প্রেরণা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ছবিতে ব্যবহৃত ‘আমার সোনার বাংলা’ হয় আমাদের জাতীয় সংগীত।

এই ছবি মুক্তির আগে জহির রায়হানকে এই মর্মে বন্ড দিতে হয়েছিল, যদি এই ছবি মুক্তির পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, তার সব দায়ভার জহির রায়হান নেবেন।

এরপর তিনি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’নামে একটি ইংরেজি ছবি নির্মাণের কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তিনি তার এ আলোচিত ছবির কাজ শেষ করতে পারেন নি।

১৯৬১ সালে তিনি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন এবং ১৯৬৮ সালে অপর চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সুচন্দাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।

প্রসঙ্গত, বাংলা চলচ্চিত্রের দুই কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচন্দা ও তার ছোট বোন ববিতা জহির রায়হানের হাত ধরেই চলচ্চিত্রে এসেছিলেন।

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান
বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন জহির রায়হান। তিনি ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে  ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। অন্যান্যদের সঙ্গে তাকেও মিছিল থেকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়।

পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তিনি তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ নির্মাণ করেন। এই ছবিতে প্রতীকী কাহিনীর মধ্য দিয়ে তিনি পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাংলার মানুষকে প্রভাবিত করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তার অবদান রয়েছে।  ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর তিনি কলকাতায় যান এবং ক্যামেরা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।  কলকাতায় গিয়ে শুরু করেন স্টপ জেনোসাইড-এর শুটিং। এ চলচ্চিত্র সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও ভারতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরেছিল। এই প্রামাণ্যচিত্রটি গোটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম এবং নির্মাতা হিসাবে তিনি প্রশংসা কুড়ান।

কলকাতায় অবস্থানকালে তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটকের মতো পরিচালকেরা এটির ভূয়সী প্রশংসা করেন বলে জানা যায়। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেন।

সাহিত্যে অবদান
জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর তার সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। এছাড়া তিনি  এক্সপ্রেস (ইংরেজি সাপ্তাহিক) ও প্রবাহ (বাংলা মাসিক) নামে দুটি পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি চলে তার সাহিত্য চর্চা। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ। তার রচিত প্রথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। তার রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস-হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), বরফ গলা নদী (১৯৬৯), আর কতদিন (১৯৭০), কয়েকটি মৃত্যু, একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭০) ও তৃষ্ণা (১৯৬২)

এছাড়া তিনি বহু গল্প লিখেছেন যেগুলো বিভিন্ন গল্প সঙ্কলনে সন্নিবেসিত আছে। এছাড়া তিনি বেশ কিছু কবিতা ও প্রবন্ধও লিখেছেন যা বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

অন্তর্ধান
জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন এবং তার নিখোঁজ ভাই বাংলাদেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানি আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তিনি খবর পান যে, শহীদুল্লা কায়সারকে ঢাকার মিরপুরে রাখা হয়েছে। তিনি ভাইকে উদ্ধারের জন্য সেখানে যান, কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। ওই দিনটি জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

পুরস্কার ও সম্মাননা
আগেই বলেছি জহির রায়হান তার চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে সৃজনশীলতার স্বীকৃতি হিসাবে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪), ‘কাচের দেয়াল’চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে নিগার পুরস্কার (   ১৯৬৫), গদ্য সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭১,), চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য একুশে পদক (মরণোত্তর,   ১৯৭৭), সাহিত্যে অবদানের জন্য মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯২) এবং ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

আজ তার ৮৭তম জন্ম দিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অনেক শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।  শুভ জন্মদিন বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/