প্রয়াত কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী স্মরণে ‘হে বন্ধু বিদায়’

কথাসাহিত্যক বুলবুল চৌধুরী

হে বন্ধু বিদায়

তালুকদার লাভলী

‘তুমি অমন করে গো বারে-বারে জল ছল-ছল চোখে চেয়ো না
ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,
———————————       
তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায়
     কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়
    আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-’

আজ আমাদের প্রিয় বন্ধু বিদায় নিয়েছে। আর  স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কবি নজরুলের এই ব্যথাতুর কাব্য। মনে পড়ছে সেই সারল্য স্নিগ্ধ মুখে শুভ্র হাসি। আমার লেখক বন্ধু গল্পের মতোই শৈল্পিক দাগ রেখে চলে গেলেন খুবই সাধারণ ভাবে। যাবার বেলায় মৃত্যুদূত সন্মানের সঙ্গে কুর্নিশ করে নিয়ে গেলেন। যে মানুষটা মৃত্যুর সময় বলছে- ‘আমি ভাল আছি। আমার কিছু হয়নি তো।’ সত্যি তো, লেখক স্থান পরিবর্তন করছেন মাত্র। এটা চিরায়ত সত্য। তিনি পৃথিবীর সমস্ত জন্জাল থেকে মুক্তি নিয়েছে। কিন্ত আসলে লেখক বুলবুল চৌধুরী কোনোদিন এই পৃথিবী খেকে মুক্তি পাবেন না।  তিনি যে আলোকিত সাহিত্যকর্ম রেখে গেছেন তার মধ্যে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। হে বন্ধু, আপনি আমাদের গর্ব, আপনি আমাদের অহংকার।

শরতের স্নিগ্ধ শুভ্র সন্ধ্যা। নদী তীর ঘেষে কাশফুলের শুভ্র হাসি যেমন পৃথিবীর এই করোনা প্রলয়ে প্রকৃতিকে নূতন করে বাঁচার প্রেরণা দিচ্ছে। তেমনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শব্দশ্রমিক আলোর প্রদীপ আমাদের মাঝে জ্বেলে দিয়ে শনিবার ( ২৮ আগস্ট, ২০২১) সন্ধ্যা ৬ টার সময় খসে পড়লেন লেখকের পাতা থেকে, চিরতরে থেমে গেল চলমান একটা বুদ্ধিদীপ্ত  কলম।  জাতি হারাল একজন আলোকিত মেধাকে। আমরা হারালাম একজন লেখককে। তার পরিবার হারিয়েছে একজন অবিভাবকে। আমি হারালাম একজন বন্ধুকে। তার প্রয়াণে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। তার চলে যাওয়া আমাদের মাঝে যে শূন্যতা তৈরি হল তা কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হবার নয়। রেখে যায় এক শূন্যতা, এক নিরন্তর বেদনা ।  তবুও তার রেখে যাওয়া আলোর প্রদীপ আমাদেরকে নূতন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেবে।

যার প্রথম লেখা ‘টোকা কাহিনী’ দখল করেছিল পাঠকের মন। যার সঙ্গে কথায় আড্ডায় পার হয়ে যেত গোটা দিন। অনেক অনেক স্মৃতি লেখকের সঙ্গে। প্রায়ই ধ্রুব এষের বাসায় বসতো আমাদের আড্ডা। সে আড্ডায় বুলবুল চেীধুরীর সঙ্গে থাকতেন শিশু সাহিত্যিক আবু সাঈদ জুবেরী, ধ্রুবদা ও আমি। আবার কখনো লেখকের বাসায়। বেশির ভাগ সময় কথা হত লোখালেখি নিয়ে। আর বুলবুল ভাই নিজের জীবনের মজার মজার কাহিনী শুনাতেন। আমি যখন তার লেখা পড়ি তখন দেখি এসব তো আমার পরিচিত। তার মুখ থেকে শুনা কাহিনীগুলো থেকে পূর্বেই পরিচিতি ঘটেছে আমার। কী সুন্দর করে সেই জীবনের কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে শব্দের সারিতে বসিয়ে তৈরি করতেন গল্প, উপন্যাস। লেখকের জীবনটা ছিল যেমন অনাড়ম্বর, প্রতিক্রিয়া নির্বিকার মুখ, বয়সী খাতায় সংখ্যা বাড়লেও তারুণ্যে ভরা পবিত্র যৌবন দীপ্তি পৌরুষের জ্যোতি,  সরলতার আলো মুখে, ভালোবাসার সঞ্জীবিত চোখে তাকাতেন গভীর করে। দৃষ্টিতে ব্যক্তিত্বের বিস্তার। অথচ বিনীত। মাথায় বাউলা চুল। বহমান গ্রামের শান্ত নদীর মতোন বয়ে চলছে। এই চলার পথে যেতে যেতে আমার জীবনের বৈচিত্রগাথাঁ কথাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, সৌজন্য আর আন্তরিকতায় বলতেন, ‘লাভলী আপনার জীবন গল্প আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, অন্তর স্পর্শ করেছে। আরো জানব আর লিখব আপনাকে নিয়ে।’ আমার ‘কাল পুত্র’ উপন্যাসটির নামকরণ করেছিলেন বুলবুল ভাই। এছাড়াও আমার অন্যান্য উপন্যাসের নাম রাখা হত এই আড্ডায় বসে। আমার প্রথম উপন্যাস ‘তদবিরে তকদির’ পড়ার মধ্য দিয়ে প্রথম পরিচয় কথাসাহিত্যিক বুলবুল চেীধুরীর সঙ্গে।

ষাটের দশকে আর্বিভূত সৃজনশীল কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট আলোকিত কলম হাতে গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় সাংবাদিকতা করেছেন সমকাল-সহ দেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি দৈনিকে। লেখক সমকাল থেকে বিদায় নেবার পর বেশিরভাগ সময় গ্রামে কাটাতেন। স্বপ্ন দেখতেন গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে। আর সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রজেক্ট হাতে নিয়ে শুরু করলেও সফল হতে পারেনি। আসলে যার হাতে কলম সফল তার হাতে অন্যকিছু শোভনীয় নয়।

বাউলা স্বভাবের এই লেখকের গোটা জীবনটাই যেন আস্ত একটা উপন্যাস।  তিনি চশমা চোখে জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরতেন। চশমা চোখে জলের নিচে পরিষ্কার দেখেতেন মাছদের চলাফেরা। অবাক লাগলেও এটা সত্যি। তিনি ছিলেন নিতান্তই মামুলি মানুষ। বিনোদন বলতে আড্ডা আর লেখা। দামী রেস্টুরেন্ট বা বিলাসি পানীয় তার জীবনকে স্পর্শ করেনি। তার আগ্রহ ছিল গাঁজার প্রতি। দোষ বা নেশা যাই বলি ওইটুকুন। আমি প্রশ্ন করতাম- ‘গাঁজা খেলে কি হয়? কেন এটা খান?’ উত্তরে তিনি বলতেন, ‘গাঁজা খেয়ে লিখতে বসলে সম্পুর্ণ মনোযোগ লেখার মধ্যে থাকে। দুনিয়ার কোনো কিছু আর মনে স্থান পায় না।’

প্রসঙ্গক্রমে লেখকের জীবনের মজার একটা ঘটনা বলি। একদিন বাসে চলতি পথে তার দেখা হয়েছিল এক বেদেনির সঙ্গে। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় জেনেছিলেন ওই নারীর নাম। আরও জেনেছিলেন বেদেনির বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। কোনও একদিন হঠাৎ করেই মনে পড়ে সেই বেদেনিকে। পথে নেমে পড়লেন বেদেনির খোঁজে। নারায়ণগঞ্জের  অলিগলি খুঁজে প্রথম দিন না পেলেও দ্বিতীয় দিন পেয়েছিলেন। শুনে আমি হেসেছিলাম, অবাকও হয়েছিলাম কিছুটা। আসলে এসবই ছিল তার লেখার মূল।

বুলবুল চৌধুরী তার গদ্য সাহিত্য সৃষ্টির জন্য এহেন কাজ নাই যা করেননি। এমনকি লেখার রসদ সংগ্রহের জন্য নারায়ণগঞ্জের পতিাতা পল্লীতেও সময় কাটিয়েছেন তিনি।গণিকাদের সঙ্গে গল্প করে জেনেছেন তাদের জীবন গাথাঁ। প্রকৃত লেখকরা এমনই হয়। তার লেখায় কোনো রাজনীতি ছিল না, কোনো বিতর্ক ছিল না। তার লেখায় ছিল প্রান্তিক মানুষের জীবনগাঁথা, তাদের সারল্য প্রেম, সংগ্রাম, তাদের জীবনের জটিলতা।

বুলবুল চৌধুরীর রচিত গল্পগ্রন্থের মধ্যে-টোকা কাহিনী, পরমানুষ, মাছের রাত, চৈতির বউ গো । উপন্যাস,-অপরূপ বিলঝিল নদী, কহকামিনী. তিয়াসের লেখন, অচিনে আঁচাড়ি, মরম বাখানি,এই ঘরে লক্ষী থাকে। ইতু বৌদির ঘর, দখিনা বাও, জলটুঙ্গি, পাপপুণ্যি,ঘরবাড়ি, দম্পতি, বলো কি অনুভবে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আরো রয়েছে কিশোর গ্রন্থ-গাঁও গেরামের গল্পগাঁথা, নেজাম ডাকাতের পালা, ভালোভুত, প্রাচীন গীতিকার গল্প এবং আত্মজৈবিক গ্রন্থ- জীবনের আঁকিবুঁকি ও অতলের কথকতা।

লেখক বুলবুল চৌধুরী শব্দের বাগানে ফুল হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিলেন, যে ফুলের রূপ-রস-সুধা গন্ধে বিমোহিত সকল পাঠক। প্রচার বিমুখ এই লেখক নীরবে পাঁপড়ি মেলেসুগন্ধ বিলিয়েছিলেন। আর নিজের উজ্জ্বলতায় চারদিক আলোকিত করে ৭৩ বছর বয়সে নীরবে পাড়ি জমিয়েছেন পরলোকে। লেখকের এই নীরব প্রস্তানের ব্যথা ক্ষত হয়ে থাকবে হৃদয়জুড়ে। আজ এসময়ে মীর আবুল খায়েরের কবিতার দুটো লাইন বার বার মনে পড়ছে।

‘রিংকন পাহাড়ের সেই পথ আর সেই আমরা ছ‘জন
একত্র হবো না আর এ জীবনে হঠাৎ কখন’।’

লেখক ঘুমিয়ে আছেন মিরপুর কবরস্থানে- বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। তার মেধার কাছে, মননের কাছে চির কুতজ্ঞ আমি এবং আমরা।
‘নয়ন সন্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই’

হে বন্ধু বিদায়। আমরা আপনার বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করছি।

তালুকদার লাভলী: কবি ও কথাসাহিত্যিক, পেন বাংলাদেশের যুগ্ম সম্পাদক।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/