অতি সামাজিকতায় ভাঙছে ঘর-পুড়ছে স্বপ্ন

মাহমুদা আকতার

মাহমুদা আকতার

‘বহুদিন মনে ছিলো আশা
ধরণীর এক কোণে
রহিব আপন মনে;
ধন নয়, মান নয়, একটুকু বাসা
ক’রেছিনু আশা।’

মনে মনে যতই আশা করি না কেন, এই সময়ে একটি ‘সুখী গৃহকোণ’ রচনার সুযোগ কিন্তু আসলেই কমে আসছে। এই কসমোপলিটান শহরের বাসিন্দা হিসাবে আমরা ক্রমশই নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে অতিমাত্রায় সামাজিক জীব হয়ে উঠছি, দূরে সরে যাচ্ছে পরিবার ও কাছের মানুষগুলো। যদিও আমরা সবাই কিন্তু একটি সুখী পরিবারের স্বপ্ন নিয়েই বেড়ে উঠি এবং বেঁচে থাকি। একসময় ভালোবাসার মানুষটির সান্নিধ্য পেতে আমাদের কত না আকুলি বিকুলি! অথচ সময়ের বিবর্তনে পড়ে থাকে বাথরুম স্লিপারের মতো, প্রয়োজনীয় কিন্তু কাছে রাখা যায় না। অনেকটা যেন রজনীকান্তের সেই বিখ্যাত গানের মতো- ‘আমি সকল কাজের পাই হে সময়/ তোমারে ডাকিতে পাই নে।’

কথাগুলো পছন্দ হচ্ছে না? তাহলে নিজের প্রাত্যাহিক রুটিনের দিকে তাকান একবার। আপনি একজন ব্যস্ত মানুষ, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কর্পোরেট অফিসের বড় কর্মকর্তা। আপনার সকালটা শুরু হয় বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি দিয়ে। পাশে শায়িত সঙ্গীনীকে ‘গুড মর্নিং’ বলার সময় নেই, আপনি ছুটছেন স্বাস্থ্য রক্ষায়। সকালে আপনার মর্নিং ওয়াক এবং পার্কে হাঁটাসঙ্গীদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা, কখনও বা জম্পেস খানাপিনা। তারপর বাড়ি ফিরে অফিসযাত্রার প্রস্তুতি। অফিসে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে জরুরি মিটিং ছাড়াও কলিগদের সাথে খুনসুটি বা হালকা আড্ডা। এর বাইরে নিয়মিত অফিস পার্টি  বা জব ট্যুর তো থাকছেই। বিকেলে আছে ক্লাব আর ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে মুখরোচক আড্ডা। বৃষ্টি, বন্যা যত প্রাকৃতিক দুযোগ আসুক না কেন এই আড্ডা তো মিস হবে না। জানি এগুলোও আপনার কাজেরই অংশ, জীবনের উন্নতির সোপানে তড়তড়িয়ে উঠতে গেলে কতজনকে হাতে রাখতে হয়!

এর বাইরে বন্ধু বান্ধব কিংবা আত্মীয় স্বজনদের জন্য কিছু সময় তো বরাদ্দ রাখতেই হয়। তাছাড়া সপ্তাহে না হউক মাসে অন্তত একবার হলেও তো ভার্সিটির সহপাীঠদের মিলনমেলা তো মিস করলে চলে না। এছাড়া আজকাল তো অনেকে মিডনাইট পার্টিতেও অংশ নিতে হয়, নইলে যে মান থাকে না। এর মধ্যে আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা না-ই বা বললাম। এখানেও তো আপনাকে কোয়ালিটি টাইম দিতে হয়।

আপনার এই প্রাত্যাহিক রুটিনে পরিবারের জন্য কোনও সময় বরাদ্দ নেই। অফিসে শত ব্যস্ততার মাঝেও ফোন করে কখনও জানতে চান না আপনার সঙ্গিনী লাঞ্চ করেছেন কিনা। সন্তান ঠিকমতো বাড়ি ফিরেছে কিনা- সে নিয়েও আপনার আগ্রহ কম। আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সহকর্মী বা বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিতে পারেন, কিন্তু বাড়িতে বাজার করা কিংবা সন্তানকে স্কুলে দেয়ার কথা উঠলে আপনার কেরিয়ারের বারোটা বেজে যায়। সত্যি কথা বলতে কি কোনও কোনও ব্যস্ত ব্যক্তি যেন রোজ বাসায় ফিরেন কিছু দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজ সারতেই, যার অন্যতম হচ্ছে রাতের ঘুম। অন্তত তাদের জীবনযাত্রা দেখলে এমনটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আপনি বুকে হাত দিয়ে বলেন তো -আপনার কলেজ বা ভার্সিটিতে পড়ুয়া সন্তানের সঙ্গে শেষ কবে আপনি গল্প করেছেন? মনে করতে পারছেন না তো? আসলে আপনি তো তার সঙ্গে গল্প  করাটা কোনও কাজই মনে করেন না। তার টিউশন ফি আর অন্যান্য আর্থিক প্রয়োজন মেটানোকেই আপনি কর্তব্য বলে মনে করেন। আপনার পরিবারের জন্য কোনও সময় নেই। আপনি কখনও সন্তানদের ডেকে জানতে চান না- তাদের স্কুলে বা কলেজে কোনও মজার ঘটনা ঘটেছে কিনা। তাদের ভালো মন্দ, পছন্দ-অপছন্দ কোনও কিছুই আপনি জানেন না।  আপনার সন্তান এরই মধ্যে কয়টা কোর্স রিটেক দিয়েছে তা আপনি বা আপনার স্ত্রী জানেন না। ছেলে বা মেয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, ব্যস আপনাদের দায়িত্ব শেষ।

আচ্ছা আপনি আপনার স্ত্রী/স্বামীর সাথে শেষ কবে বেড়াতে গিয়েছেন বলুন তো? জানি, মনে করতে পারছেন না। আপনি তার সঙ্গে গল্প করেন না, বেড়াতে যান না, তার আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ নেন না। এমনকি কালে ভদ্রে একদিন তার সঙ্গে মার্কেটে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। এমন অনেকে আছেন জীবনসঙ্গী বা সন্তানদের বিশেষ দিনটিও মনে রাখেন না। এইসব কারণে সংসারের আপনজনদের সাথে দূরত্ব কেবল বাড়তেই থাকে। একসময় ফাটল এতটাই বেড়ে যায় যে কোনও কিছু দিয়েই তা আর ভরাট করা সম্ভব হয় না।

আপনি যেমন তাদের খোঁজ নেন না-তারাও আপনার জন্য আর অপেক্ষায় নেই। আপনি তাদের কাছে কেবল একজন টাকা সাপ্লাইয়ের মেশিন। তারাও নিজেদের মতো করেই খুঁজে নিয়েছে তাদের জীবন। স্ত্রী শপিংয়ে যাচ্ছে, ফেসবুকে চ্যাট করছে, বন্ধুদের নিয়ে প্লেজার ট্রিপে যাচ্ছে। সন্তানরাও তেমনি বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা আর মৌজ মাস্তি নিয়ে ব্যস্ত। তাদের কারো জীবনে কারো জন্য কোনও স্পেস নাই। সবাই এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। একই ছাদের নিচে তো আছি সবাই, কিন্তু কেউ কারো পাশে নেই। কারণ আমরা খুব আধুনিক, আমরা খুব সামাজিক, আমরা একটি কসমোপলিটান শহরের বাসিন্দা। আমাদের বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, ব্যাংক ব্যালেন্স আছে-এমনকি সংসারও আছে প্রত্যেকের একটি করে, কিন্তু সে সংসারে সুখ নাই।

এভাবে চলতে থাকলে একসময় ভেঙে যাবে সংসারগুলো, অর্থহীন হয়ে পড়বে পরিবারের সুন্দর কনসেপ্টটা, যা নিয়ে আমরা এই প্রাচ্যের মানুষেরা খুব গর্ব করি। গত কয়েক বছর ধরে বিবাহ বিচ্ছেদের উচ্চ হার কিন্তু এমনটাই ইঙ্গিত দেয়। এমনটা চলতে থাকলে ‘ধন নয়-মান নয় এতটুকু বাসা/ করিছিনু আশা-’এই স্বপ্ন কেবল কবিতার পাতাতেই অমর হয়ে থাকবে, বাস্তবে দেখা মিলবে না।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/