
আবু সাইদ কামাল
সন্ধে সাতটা পঞ্চাশ মিনিটে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে উত্তরবঙ্গগামী দ্রুতযান ট্রেন ছাড়বে। এ ট্রেনেই রাজশাহীর নওগাঁ শহরে যাবার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তবে সেই জেলাসদরে তো আর রেলস্টেশন নেই। তাই নওগাঁ জেলা শহর থেকে তিন কিলো দূরে সান্তাহারের টিকিট কেনা হয়েছে। আমাদের পূর্ণ প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও বাদ সেধেছে বঙ্গোপসাগরের গভীর নিম্নচাপ। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে-ধেয়ে আসছে হ্যারিকেনের প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়। সিডর নামের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়টি অত্যাসন্ন বলে আবহাওয়া অফিস ইতোমধ্যে দশ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত ঘোষণা করেছে। বিশেষ সংবাদ-বুলোটিনে তা বারবার প্রচারও করা হচ্ছে। গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে এরই মাঝে ঢাকায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত পাহাড়পুরে ভ্রমণে যাওয়া হবে কিনা এ নিয়ে অনেকের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। এজন্য মোবাইল ফোনে কিংবা কখনও টেলিফোনে বারবার সংবাদ নিয়ে নিশ্চিত হলাম। দলনেতা তথা কথা সাহিত্যকেন্দ্রের সভাপতি ইউসুফ শরীফ বলেন, ‘ফোনে খোঁজ নিয়েছি। উত্তর বঙ্গের আকাশে রোদ। মেঘের কোন আনাগোনা নেই। কাজেই আমাদের ভ্রমণ কর্মসূচির কোনো পরিবর্তন হবে না।’ দলনেতার সাথে মত বিনিময়ের পর মনের সাথে বোঝাপড়া করে নিজেকে বললাম, এমন ঝড়ো দিনে ভ্রমণে যাওয়া কি ঠিক হবে ? ভেতর থেকে উত্তর আসে, টিকিট যখন কেনা হয়ে গেছে এবং গন্তব্যস্থলের আকাশ যেহেতু ভালো, সেহেতু ভ্রমণে যেতে অসুবিধা কোথায়! উল্লেখ্য যে, কথাসাহিত্য কেন্দ্রের আয়োজনে এমন ভ্রমণ এটাই প্রথম নয়। এর আগেও ২০০৬-শ্রীমঙ্গলে এমন আর একটি ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই ভ্রমণে মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ইউসুফ শরীফ । সে সময়ে মৌলভী বাজার থেকে সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন কথাসাহিত্যিক রুহুল আমিন বাচ্চু।
সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় বৃষ্টির প্রাবল্য বাড়ে। সন্ধে সাতটায় প্রস্তুতি শেষে আমি ভ্রমণ ব্যাগ কাঁধে বের হলাম। পথে নেমে রিকশা পেলাম। কাছেই কমলাপুর। হাঁটা দূরত্বে। কিন্তু যেহেতু বৃষ্টি, ভাড়া একটু বেশি দিয়েই রিকশা নিতে হলো। কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছেই ফোন করলাম সালেহীন ভাইকে। আমি তখন প্লাটফর্মের গেট অতিক্রম করছি। আর কানে মোবাইল ফোন লাগিয়ে সালেহীন ভাইয়ের সাথে কথা বলছি। তিনি জিজ্ঞাস করলেন, আপনি কোথায় ?
-জ্বি, আমি কমলাপুর রেল স্টেশন।
-আপনি…?
-আমিও তো রেল স্টেশনেই।
-স্টেশনের কোন জায়গায় আপনি?
-গেটের সামনে।
-আমিও তো গেট অতিক্রম করছি মাত্র।
এই বলে যেই না পিছনে ফিরে তাকালাম, দেখি তিনি অদূরেই। কানে মোবাইল ফোন লাগিয়ে আমার সাথে কথা বলেছেন। এমন নিকট সান্নিধ্যে ব্যস্ত রেলস্টেশনে মোবাইল ফোনে নিজেদের মাঝে কথা বলার দৃশ্য দেখে সশব্দে হেসে উঠলাম। হাসলেন তিনিও। তার সাথে একজন সাথী দাঁড়িয়ে। সুদর্শন এক যুবক। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, জামাল উদ্দিন। একজন গল্পকার ও সিনিয়র রির্পোটার ।
আমি হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে নিজের পরিচয় দিলাম। সময় ঘনিয়ে আসছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টিতে ভিজে উপস্থিত হলেন ইউসুফ ভাই এবং জমির হোসেন। ইউসুফ শরীফ মোবাইল ফোনে খোঁজ নিয়ে অবগত হলেন যে, সৈয়দ শওকত আলী আন্তঃনগর দ্রুতযান ট্রেনের ‘জ’ বগিতে অবস্থান করছেন। দেরি না করে আমরাও একযোগে স্টেশনের চার নম্বর প্লাটফর্মে ঢুকলাম। ট্রেন দাঁড়িয়ে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে। যাত্রীদের মাঝে ব্যস্ততা। সবাই গাড়ির নিদির্ষ্ট বগিতে নির্ধারিত আসনে বসেছে। আমরাও নিজ নিজ আসনে গিয়ে বসলাম। ঠিক সময়েই ট্রেন ছাড়ল।
জয়দেবপুর স্টেশন অতিক্রম করলে ট্রেনের গতি বাড়ে। ট্রেন ছুটছে টাঙ্গাইলের পথে। রাতের অন্ধাকারে ঝড়ের গতিতে এগোচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর স্টেশন অতিক্রম করার সময় লাইনের জোড়া পার হতে গিয়ে চলার ছন্দের ভিন্ন মাত্রার শব্দ শোনা যায়। তারপর আবার স’মিল ছন্দের গতি নিয়ে এগোয় দ্রুত ধাবমান ট্রেন। যমুনা পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় ট্রেনটা। ওখানে গাড়ি চেকিং হয়। নাশকতামূলক ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এমন চেক করে থাকে নিরাপত্তা কর্মীরা। প্রায় দশ মিনিট ধরে নিরাপত্তাকর্মীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ট্রেন আবার ছাড়ল। তখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঝঞ্চা বিক্ষুদ্ধ রাতে বাইরে ঘন অন্ধকার। ধীর গতিতে ট্রেনটা যমুনা সেঁতুতে সওয়ার হয়। ডান পাশের জানাল খোলা যাচ্ছিল না। কারণ, পুবপাশ থেকে দমকা বাতাসসহ বৃষ্টির ঝাপটা আসছিল। তবে বাম পাশের জানালা নিরাপদ। তাই বামপাশের জানালা খুলে বাইরে তাকালাম। অমনি চোখ দুটো অপরূপ দৃশ্যে আটকে যায়। আহা, রাতের রানি যমুনা ব্রিজটা ধনুক বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অসংখ্য বাহু উঁচু করে আলোর পসরা সাজিয়ে কী অপূর্ব ভঙ্গিমায় দাড়ানো ! রাতে যমুনা সেতুকে যারা দেখেনি, তাদেরকে এ দৃশ্যের উপলদ্ধির কথা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। দীর্ঘতম যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে সরীসৃপের মত ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে লম্বা যন্ত্রযান। মাঝে মধ্যে সাঁই সাঁই করে আসা-যাওয়া করছে দূরগামী বাস। বৃহৎ এ ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটন্ত বাসগুলো মনে হচ্ছে যেন ছোট ছোট পিঁপড়ে। আর ট্রেনটা যেন ধীরগামী ডোরা সাপ। রাতের ঘন আঁধারে আলোর ডালি সাজিয়ে দাঁড়ানো ব্রিজটির এমন মনমাতানো দৃশ্য দেখে কার না ভালো লাগে! দশ পনের মিনিটে যমুনা সেতুটি অতিক্রম করল। তারপর ফের গতি ফিরে পায়। দুরন্ত কিশোরের মত প্রান্তর মাড়িয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে ট্রেন। রাত ছিল বলে ঘন আঁধার পথে জীবনানন্দ দাশের সেই নাটোরের বনলতা সেনকে দেখতে পারিনি। ট্রেন ছুটে চলে বিরামহীন গতিতে। সান্তাহার যখন পৌঁছে তখন রাত দুটো পাঁচ বাজে। ওখানে বৃষ্টি নেই। রাতের আকাশের অগণিত তারার ফুল ফুটে আছে। সদলবলে আমরা নামলাম। সান্তাহার যেকে নওগাঁর দূরত্ব মাত্র তিন কিলো। তবে এত রাতে তিন কিলো অতিক্রম করে নওগা যাওয়া নিরাপদ হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ভোর পর্যন্ত রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে হবে। আমরা সবাই এগিয়ে যাই ওয়েটিং রুমের দিকে। কিন্তু প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগার তখন ছিল তালা লাগানো। একজন রেল কর্মচারিকে ডেকে বিশ্রামাগার খোলার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়। রেল কর্মচারি তার অধস্তন কর্মচারিকে বিশ্রামাগার খোলার ব্যবস্থা করতে নিদের্শ দেয়। নিদের্শপ্রাপ্ত কর্মচাার প্রথম শ্রেণির লাগোয়া বিশ্রামারটির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে। কিন্তু ভিতর থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। কর্মচারীটি আবার কড়া নাড়ে। তবু কোন সাড়-শব্দ নেই। কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য সে দরজার ফুটো দিয়ে ভিতরে তাকায়। কী যেন দেখে সে মুখ ঘুরিয়ে সরে আসে দরজার কাছ থেকে। তখন আমাদের মাঝ থেকে কোনো একজন জিজ্ঞেস করে, কী হল?
-সর্বনাশ! আজরাইল শুইয়া আছে।
-আজরাইল মানে?
প্রশ্নটা আমাদের সবার মনে একযোগে হানা দেয়। লোকটা ও কথা বলেই কাছে দাঁড়ানো অপর রেল কর্মচারির দিকে এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় ব্যাক্তি গিয়ে ফের কড়া নেড়ে নাম ধরে ডাকে। এবার কাজ হয়। ক্বড়াৎ শব্দে হঠাৎ খুলে যায় দরজা। আমরা সবাই আজরাইল … অভিধায় অভিহিত প্রাণীটিকে এক নজর দেখার জন্য অধীর আগ্রহে নিস্পলক তাকিকে আছি। ততক্ষণে সবার উম্মুখ প্রতীক্ষার যবনিকা টেনে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে শ্বেত বসনা এক ধুমসি মহিলা। বয়সে প্রৌঢ়া। তাকে বলা হল ভি আই পি কক্ষটি খুলে দিতে। কিন্তু মহিলা তাতে সাড়া না দিয়ে যে কক্ষ হতে বেরিয়ে এসেছে, সে কক্ষটির দরজা মেলে দেয়। এবং বলে, এই ঘরে বসেন।
দ্বিতীয় রেল কর্মচারি বলে, ঐ ঘরের দরজটা খুলে দেন!
-না বাপু! ফাস্ট কেলাস টিকিট না দেখালে ঐ রুম আমি খুলে দিতে পারব না।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে কক্ষটি গুছাতে গুছাতে তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলে মহিলা। তখন আমাদের পক্ষ থেকে ফাইজুস সালেহীন বলেন, দেখুন! আমরা ঢাকা থেকে আসলাম। প্রথম শ্রেণির যাত্রীই। আমরা সাংবাদিক এবং লেখক।
-না-না বাপু! টিকিট না দেখালে আমি ঐ ঘর খুলব না।
মহিলার কথা শুনে রেল কর্মচারিটি বলে, ও কারও কথা শুনে না। ও শুধু বুঝে তার ওপর তার কর্তৃপক্ষের কী হুকুম। ঐ হুকুমই সে তামিল করবে। যা হোক মহিলা শেষ পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির বিশ্রামগারটি খুলে দেয়। আমরা সবাই গিয়ে ভিতরে বসলাম।
ভোর চারটার দিকে আমাদেরকে নেওয়ার জন্য নওগাঁ থেকে দু’টি গাড়ি পাঠানো হয়। মাইক্রোকারে সবাই উঠে বসি। দশ মিনিটের মধ্যেই নওগাঁ শহরের ঢাকা বাস ষ্ট্যান্ড সংলগ্ন হোটেল ‘অবসর’ এর সামনে গাড়ি থামে। হোটেলের চার তলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারটি কক্ষ দু’জন করে থাকার ব্যবস্থা। দলনেতা ব্রিফিং দিয়ে বলেন, ভোর সাতটায় উঠতে হবে। চারটা থেকে সাতটা পর্যন্ত ঘন্টা তিনেক ঘুমিয়ে নেন সবাই । অবশ্য এর আগেই ভ্রমণসূচি পাঠ করে শুনিয়েছেন সৈয়দ শওকত আলী । যা হোক ইউসুফ শরীফ ভাইয়ের ব্রিফিং শুনে আমরা নিজ নিজ কক্ষে গিয়ে তড়িঘড়ি শুয়ে গেলাম। আমি এবং রুহুল আমিন বাচ্চু শুলাম এক কক্ষে। দু’শয্যা বিশিষ্ট কক্ষ। ইউসুফ শরীফ এবং সৈয়দ শওকত আলী, শামসুল আলম এবং জমির হোসেন, ফাইজুস সালেহীন এবং জামাল উদ্দিন প্রমুখ জোড়ায় জোড়ায় শুলেন ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে। ঘুম যেন দু’চোখের আঙিনায় উন্মুখ ছিল। উপযুক্ত পরিবেশ আর সুযোগ পাওয়া মাত্রই ঝেঁকে ধরেছে। সারা রাতের ভ্রমণ-ক্লান্তি এবং অনিদ্রার পর শেষ রাতে শয্যায় যাওয়া মাত্রই ঘুমে তলিয়ে যাই।
সকাল সাড়ে সাতটায় কিংবা পৌণে আটটার দিকে দরজায় তুমুল কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙে। আমি দু’চোখ খুলে সাড়া দেওয়া মাত্রই ইউসুফ ভাই বলেন, ওঠো! আটটা বেজে গেছে প্রায়। গাড়ি এসে যাবে। ইউসুফ ভাইয়ের ডাক শোনার পর কি আর বিছানায় শুয়ে থাকা যায়! আড়মোড়া ভেঙে শয্যা ছাড়ালাম। উঠলেন রহুল আমীন বাচ্চু ভাইও। তাড়াহুড়োর জন্য গোছল করা সম্ভব হয়নি। যদিও দীর্ঘ ভ্রমণ আর আংশিক ঘুমের পর গোছল করতে না পারার জের বুঝেছি পরে।
সকাল আটটার আগেই হোটেল কক্ষে নাস্তা আসে। সবাই মিলে একসাথে নাস্তা পর্ব শেষ করার সাথে সাথে ইউসুফ শরীফ ভাইয়ের তাগিদ। ‘জলদি প্রস্তুতি নাও!’ সৈয়দ শওকত আলী কানে মোবাইল ফোন লাগিয়ে নিশ্চিত হয়ে বললেন, গাড়ি এসে গেছে। কাজেই আর অপেক্ষা নয়।
প্রস্তুতি সম্পন্ন করে স্বল্প সময়ে সবাই দ্রুত নিচে নেমে গাড়িতে উঠি। গাড়ি ছুটলো বদল গাচীর উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছোট শহর নওগাঁর আঙিনা ছেড়ে গাড়ি ছুটে গ্রামের পথে। আকাবাঁকা গাঁয়ের পথ। দুপাশে হেমন্তের সোনালি ফসলের প্রান্তর। কিছুক্ষণ পরপরই গঞ্জ বাজারের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এ সবের কত কী যে নাম, সে সব কি আর মনে থাকে? দু-একটি নাম অবশ্য বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। একটি স্থানের নাম বালিভরা, অন্যটি গোবর চাপা কিংবা বা ঠেঙ্গা মারা। এ ক’টি নাম ছাড়া বাকি সব তো স্মৃতি থেকে ঝরে গেছে। অবশ্য সৈয়দ শওকত আলী শাদা কাগজে নামগুলো টুকে রাখছিলেন ক্রমাগত। গাড়িটি যতই গাঁয়ের গভীরে যাচ্ছে, ততই বিচিত্র দৃশ্যের দেখা মিলছিল। সাক্ষাৎ মিলছিল কিছু আদিবাসীর। এখানে কিছু সাওঁতালের বসবাস রয়েছে। দু’পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় বদলগাছী উপজলো সদর অতিক্রম করলাম। সেখান থেকে উর্ধশ্বাসে গাড়ি ছুটছে পাহাড়পুরের দিকে। পাহাড়পুর গ্রামের সোমপুর বৌদ্ধবিহারের প্রত্মতাত্ত্বিক নিদশর্নই আমাদের মূল লক্ষ্য। বেলা সাড়ে দশটা কিংবা পৌনে এগারটার দিকে সোমপুর বৌদ্ধ বিহারের আঙিনায় গিয়ে গাড়ি থামে।
গাড়ি থেকে নেমে টিকিট সংগ্রহ করে প্রথমেই আমরা জাদুঘরে ঢুকলাম। ঘুরে ফিরে দেখলাম, জাদুঘরে সযত্মে সংরক্ষিত প্রত্মনিদর্শনগুলো। তারপর বিশালায়তন বৌদ্ধবিহারের মূল স্থাপত্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে আমাদের আট সদস্যের দলটি। বিশাল বিস্তৃতি এই বৌদ্ধবিহারটির। মূল বৌদ্ধমন্দিরের নিদর্শনটি ঘিরে চার দিকে রয়েছে ১৭৭টি কক্ষের চিহ্ন বা কুঠুরি। বিস্তৃত প্রবেশ পথ, ছোটোখাট অনেক ধ্বংসস্তূপ। এ ভূখণ্ডে যতগুলো বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে সোমপুর মহাবিহার যে আয়তনে সবচেয়ে বড় তা সচক্ষে না দেখলে বোঝার মতো নয়। পাহাড়পুরে খনন কাজ চালিয়ে যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে, তাতে এক সময়ে এ অঞ্চলে প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু সমাজ সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির তথ্যই প্রদান করে। পাল রাজা ধর্মপাল এই স্থাপণাটি প্রতিষ্ঠা করেন বলে মনে করা হয়।
ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ চত্বরে কথাসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি ইউসুফ শরীফ, সাধারণ সম্পাদক ফাইজুস সালেহীন, ড. মুহম্মদ জমির হোসেন, রুহুল আমিন বাচ্চু, আবু সাইদ কামাল ও জামালউদ্দীন[
যা হোক মূল বৌদ্ধ বিহারটির আঙিনায় প্রবেশ করেই গল্পকার ও সাংবাদিক ফাইজুস সালেহীন ছবি তোলার জন্য তৎপর হন। বৌদ্ধ মন্দির সামনে রেখে প্রাবন্ধিক জমির হোসেনের ক্যামেরায় কয়েকটি এবং গল্পকার ও সাংবাদিক জামাল উদ্দিনের ক্যামেরায় বেশ কিছু গ্রুপ ছবি তোলা হয়। আমরা মূল বৌদ্ধ বিহারের বিশালত্ব দেখে শুধু অভিভূত হইনি, অবাকও হয়েছি। পুরাকালে মানুষ কর্তৃক এত বিশাল স্থাপত্য নির্মিত হতে পারে তা যেন কল্পনারও অতীত মনে হয়। প্রথমে এর চারদিকে ঘুরেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। মূল বিহারটির নিচে প্রবেশ পথের কাছেই একটি শিশু দোকান সাজিয়ে বসেছে। দূর্বাঘাসে বসে মেলেছে তার দোকান। বার ভাজা, সেদ্ধ ছোলা, খিরাই এবং ডাব ইত্যাদি খাবার উপকরণে শোভা পাচ্ছিল তার দোকান। আমি এবং শামসুল আলম ততক্ষণে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে দোকানের পাশে মনোরম দূর্বাঘাসে বসলাম। সেদ্ধ ছোলা আর খিরাই খেয়ে ক্লান্তি ঘুচালাম দু’জন। আমাদের পরপরই জমির হোসেনও এসে পাশে বসলেন। তিনি বুট-খিরা খেয়ে তারপর দুটি ডাবের একটি কিনলেন। ডাবের পানি যে সময় খাচ্ছেন, সে সময়ে সালেহীন ভাই বৌদ্ধ বিহারের উপর থেকে হাঁক দিয়ে বলেন, এই জমির! একা একা খেলে তো চলবে না। তখন আমাদের কথাসাহিত্যিক ইউসুফ শরীফ এবং সৈয়দ শওকত আলী স্থানীয় একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে গাইড হিসেবে নিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরটি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। গাইড বর্ণনা করেছেন। আর ইউসুফ শরীফ তা গোগ্রাসে হৃদয়ঙ্গম করেছেন। সৈয়দ শওকত আলী সাহেব মাঝে মধ্যেই ওসব তথ্য শাদা কাগজে নোট করে নিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউসুফদের দলটি আমাদের দলের সাথে মিলিত হয়। অর্থাৎ আমাদের আট সদস্যের বিখণ্ডিত দল একত্রিত হলো। তখন এক মজাদার ঘটনা ঘটে। নিচের দোকনের সর্বশেষ ডাবটি জমির হোসেন যখন সালেহীন ভাইয়ের কাছে দিলেন, তখনই ইউসুফ ভাইদের দল আমাদের কাছে এসেছেন মাত্র। তাদের রেখে সালেহীন ভাই একা একা কী করে ডাবের পানি খাবেন। দৃষ্টিকটু কিংবা সৌজন্য বর্জিত আচরণ হয়ে যায় না? অথচ একটাই ডাব। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সালেহীন ভাই। হাতে কাটা ডাব। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি শেষ পর্যন্ত তাদের না দেখার ভান করে একটু পিছিয়ে গেলেন এবং অন্যদিকে তাকিয়ে ঢকঢক করে ডাবের পানি পান করছেন। ঠিক তখনি কথা শিল্পী রুহুল আমিন বাচ্চু ইউসুফ শরীফের মনোযোগ আকর্ষণ করে বললেন, সালেহীন ভাই! ওখানে আপনি একা একা কী করছেন…?
-তাই তো, ওখানে কী করছো সালেহীন ?
দরাজ গলায় বললেন ইউসুফ ভাই। ফাইজুস সালেহীন তখন মুখে বোকার হাসি ঝুলিয়ে বলেন, ইউসুফ ভাই! ডাব ছিল একটাই। তাই-
-না না, তুমি নির্দ্বিধায় খাও। আমাদের ভাগ দিতে হবে না।
-জ্বি, ইউসুফ ভাই। ধন্যবাদ।
এই বলে সালেহীন ভাই ডাবের অবশিষ্ট পানিটুকুও পান করে যখন মূল দলে ফিরছেন, তখন তার মুখে যে রসোত্তীর্ণ কৌতুকের অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তা সবার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠে। এমন মজার দৃশ্যে সবাই রম্য হাসিতে ফেটে পড়ে। কাজের ফাঁকে কিছুটা রসিকতা কিংবা কৌতুক যেনো মজাদার খাবারে সালাতের মত। যা হোক, ফের আমাদের মূল কাজের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন দলনেতা। বৌদ্ধ বিহারে মূল স্থাপত্যের যতটা ওপরে ওঠা যায়, আমরা ততটাই ওপরে উঠলাম। তারপর সচল হয় ইউসুফ ভাই, জমির হোসেন এবং জামাল উদ্দিনের ক্যামেরা। বৌদ্ধ মন্দিরকে সামনে রেখে নানা ভাবে তোলা হয় ছবি। কখনো গ্রুপছবি, কখনো দ্বৈত, কখনো একক। এভাবে অনেকগুলো ছবি তুলে শেষ করা হয় ফটো সেসন। তখন দুপুরের রোদ ঠিকরে পড়ছে। গায়ে যেন রোদ আমূল দাঁত বসাতে চাচ্ছে। ইউসুফ ভাই বলেন, বেলা বারোটা বাজে। চলো এখন ফেরা যাক। আরও দু’টি দর্শনীয় স্থান আজ দেখতে হবে। স্থান দু’টোর দূরত্ব তো কম নয়। দু’টি ভিন্ন উপজেলায়।
এই বলে তিনি পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে পর্যটনের কাজে সমাপ্তি টানেন। আমরা ফিরে চললাম আমাদের বহনকারী গাড়ির দিকে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সবাই গাড়িতে উঠলাম। আগেই আমাদের কর্মসূচি বাতলে দিয়েছেন সৈয়দ শওকত আলী। ইউসুফ শরীফ গাড়িতে ওঠার আগেই সবার উদ্দেশ্যে ব্রিফিং দিয়ে বলেন, এরপর আমরা যাব-ভীমের পান্তি দেখতে। গাড়ি ছুটছে। সময় বেশি লাগেনি। প্রায় বিশ মিনিট পর মূল রাস্তা ছেড়ে গাড়ি গাঁয়ের ভেতরে ঢুকে। কাছেই একটা স্থানে গিয়ে গাড়ি থামে। মাটির রাস্তা। সামনের কালভার্ট ভাঙা। তাই গাড়ি নিয়ে আর এগোনো যায়নি। হেঁটে যেতে হয় সামান্য পথ। সামনে মাঠের মাঝে একটু উঁচু স্থান। ওখানে ক’টি ঘর। কাছে গিয়ে বোঝা যায়- সেগুলো আসলে মন্দির। তার পশ্চিমে একটা বড় বিল। বিলের পাড়েই একটা লম্বা খাম হেলানো অবস্থায় দাঁড়ানো। বিশাল এক পিলার। এটাকে বলা হয় ভীমের পান্তি। ওখানের আঞ্চলিক ভাষায় পান্তি মানে গরু তাড়ানোর লাঠি।
হিন্দু পৌরানিক কাহিনী অনুযায়ী ভীম নাকি হাল চাষ করে গরু নিয়ে ফেরার আগে গরু তাড়ানোর লাঠিটা বিলের কাদায় পুঁতে মাছ ধরতে বিলে নামে। বিস্ময়ে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, ভীমের পান্তি যদি এত বড় হয়, তাহলে ভীমের দেহাবয়ব কত বড় ছিল? এ যেনো এক জাদু বাস্তবতা। কালো পাথরের পিলারটির উচ্চতা নাকি সত্তর ফুট ছিল। বজ্রপাতে শীর্ষদেশের কিছু অংশ ভেঙে যায়। তারপরও যা অবশিষ্ট আছে-তাই মানুষের বিস্ময় জাগানোর জন্য যথেষ্ট। ভীমের পান্তি দেখার পর আমরা দুপুরের খাবারের জন্য রওয়ানা হই। বদলগাছি উপজেলা পার হয়ে বালিভরা এবং গোবরচাপা নামের স্থানগুলো অতিক্রম করে স্থানীয় একটা বাজারে ঢুকে আমাদের বহনকারী গাড়ি। ঐ বাজারেই এক ইটের ভাটার মালিকের বাসা। সে বাসায় আমাদের দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বেপরোয়া ক্ষুধাকে বশে আনতে সবাই হাত-মুখ ধুয়ে খাবারে টেবিলে বসে যাই। সবাই পেটপুরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছি বালিভরার দই খেয়ে। ঐ এলাকায় বালিভরার দই নাকি বেশ প্রসিদ্ধ।
খাবার শেষে যাবার পালা। সময় কম। এবার যাব আমরা মান্দা উপজেলার ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদে। সবাই গিয়ে গাড়িতে বসি। গাড়ি ছুটলো। গাঁয়ের পথ। দু’পাশে ফসলি মাঠ। সবুজ প্রান্তরের মনোমুগ্ধকর নানা দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে মনে মনে বলে উঠি, আহা! কতো বিচিত্র আমাদের এই দেশ। কখনো আখের ক্ষেত সবুজ ধানের মাঠে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছে। যমুনার এক শাখা নদী এখানে যমুনা নামেই পরিচিত। সেতু পথে নদী পার হয়ে আমাদের গাড়ি সামনের দিকে ছুটে। গাঁয়ের আঁকাবাঁকা পথে প্রায় আধাঘন্টা চলোর পর স্বচ্ছন্দে চলার মতো বড় রাস্তায় উঠে। রাজশাহীগামী রাস্তায় কিছুক্ষণ চলার পর মান্দা উপজেলায় পৌঁছি। উপজেলা সদর থেকে আরও কিছু পথ চলার পর আমাদের গাড়ি একটা সরু রাস্তায় মোড় নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই কুসুম্বা মসজিদের চত্বরে গিয়ে পৌঁছে আমাদের গাড়ি। আট সদস্যের দলের সাথে স্থানীয় একজন গাইডসহ ন’জন গিয়ে নামি মসজিদ চত্বরে। সবাই ঢুকলাম মসজিদের আঙিনায়।
অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন বহন করে চলছে সুলতানী আমলের এই মসজিদটি। পাথরে তৈরি নিপূণ কারুকাজ খচিত মসজিদের প্রাচীর যে এত সুন্দর হতে পারে, তা না দেখলে উপলদ্ধি করার মত নয়। মসজিদের মেহরাবগুলোও অপূর্ব কারুকাজ খচিত। সম্ভবত এ সৌন্দর্যের জন্যই এই মসজিদের ছবি পাঁচটাকার নোটে শোভা পায়।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ। প্রায় সাড়ে ৫ শত বছরের পুরানো এই ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে প্রতিদিন এখানে আসে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ। স্থানটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত পুরাতন ৫ টাকার নোটে কুসুম্বা মসজিদের মেহরাবের ছবি এবং নতুন ৫ টাকার নোটে কুসুম্বা মসজিদের পুরো ছবি ছাপা হয়েছে। পুকুরে কোনো আগাছা নেই। পানি স্বচ্ছ। কথিত আছে যে, দীঘির পানিতে পারদ মিশ্রিত থাকার কারণে কোন আগাছা জন্মে না।
নওগাঁ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত দেশের উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ। এর আরেক নাম কালা পাহাড়। মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথের উপরে স্থাপিত আরবি শিলালিপি থেকে জানা যায়, মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি তথা ১৫৫৮-৫৯ সালে নির্মিত। শেরশাহ শুরির শাসনামলের শেষ দিকে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহর রাজত্বকালে জনৈক সুলাইমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইটের তৈরি এ মসজিদের ভিতর ও বাইরের দেয়াল পাথরের আস্তরণ দিয়ে ঢাকা। মসজিদের পুব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেয়ালে আছে দুটি মিহরাব। উত্তর-পশ্চিম কোণে আছে একটি উঁচু প্লাটফর্ম। ধারণা করা হয় সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা এখানে নামাজ আদায় করতেন। মসজিদের মিহরাবগুলো খোদাই করা পাথরের নকশায় পরিপূর্ণ।
গৌড়ীয় স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত হয় এটি। মসজিদটি দৈর্ঘে ৫৮ ফুট, প্রস্থে ৪২ ফুট। দুই সারিতে রয়েছে ছয়টি গোলাকার গম্বুজ। মসজিদের গায়ে লতাপাতার নকশা। অভ্যন্তরে কালো পাথরের তিনটি মিহরাব। মিহরাবে আঙুরগুচ্ছ ও লতার নকশা খোদিত। মসজিদের ছাদ চালা ঘরের মতো ঈষৎ ঢালু।
মসজিদের সামনে বিশাল পুকুর। আমরা মসজিদের ভেতরে ঢুকে এর নির্মাণশৈলী দেখলাম। ওপরের গম্বুজগুলো ইটের তৈরি। মসজিদের দেয়ালের পুরুত্ব ছয়-সাত ফুটের মত হবে বলে কারো কারো ধারণা। বিস্ময়ভরে দেখলাম মসজিদটি।
জনশ্রুতি আছে মসজিদের ভিতরের ছাদে বসে নাকি সুলতানি আমলে বিচারকর্ম হতো। মসজিদের বহিরাঙ্গনে একটি কূপের নিদর্শন আছে। এলাকার মানুষ এটাকে চোর গাড়া বলে জানে। বলা হয় চুরির দায়ে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে কিংবা অন্য কোনো কারণে মৃত্যু দণ্ডে দণ্ডিত হলে এক সময় তাকে ঐ কূপে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। মৃত্যু কার্যকর করার পর ঐ কূপে মৃতদেহ ফেলে দেয়া হতো। ঐ কূপের সাথে নাকি বিশাল পুকুরের সংযোগ ছিল। পুকুরে খাকতো কুমির। মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিতের লাশ নাকি কুমিরের আহার হতো।
বাংলাদেশে মোগল স্থাপত্যের অল্প যে ক’টি নিদর্শন টিকে আছে, তার একটি শাহ সুজার তাহাখানা [বিশ্রামাগার]
মসজিদের পাশেই একটি পুরানো তেঁতুল গাছ। গাছটি এত পুরানো যে, বয়সের দিক বিবেচনায় মনে হয় এটার বয়স মসজিদের সমসাময়িক হবে। সম্মিলিতভাবে কুসুম্বা মসজিদ দেখা সম্পন্ন হলে ছবি তোলার পর্বে জমির হোসেন এবং এইউসুফ শরীফের ক্যামেরা সক্রিয় হয়। মসজিদ পাশে রেখে সামনের পুকুরকে ধারণ করে একের পর এক ছবি তোলা হয়। ফটোসেশন পর্বে বেলা পড়ে আসে। ফিরতে হবে। তাই দলনেতা গাড়িতে ওঠার তাগিদ দেন। সবাই এক ঝটকায় উঠলাম। গাড়ি ছুটলো। কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের গাইড জানায়, বলিহারের জমিদার উচ্চশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত ছিলেন। দেশবিভাগের সময় অর্থাৎ সাতচল্লিশে ওরা চলে যায় ওপারে। শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। এ কথা শুনে দলনেতা সেই জমিদার বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। রাস্তার পাশেই জমিদার বাড়ি। গাড়ি সেদিকে মোড় নেয়। ফটক মাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে জমিদার বাড়ি ঢুকলাম আমরা । ঘুরেফিরে দেখলাম জমিদার বাড়ির ভগ্নাবশেষ। বাড়ির উঠোনে যে কটি নাট্যমন্দির ছিল তার নিদর্শন এখনো বিদ্যমান। জমিদারের মূল ভবনটিতে একটি কলেজ প্রতষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্ত ভবনটি জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ততদিনে কলেজটি তার নিজস্ব ভবনে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আর সেই ভবনটি বিপজ্জনক হওয়ায় গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এলাকায় এখনও জমিদার বাড়ির সুনাম ছড়িয়ে আছে। তখন সূর্য ডুবে ডুবে অবস্থা। জমিদার বাড়িতে থাকার সময় মসজিদে আজান ধ্বনিত হয়। তখন আমরা সবাই গাড়িতে উঠি। পতিত জমিদার বাড়িকে বিদায় জানিয়ে আমাদের গাড়ি ফের রাস্তায় গতি ফিরে পায়। আঁকাবাঁকা পথে কিছুক্ষণ। তারপর আন্তঃজেলা সড়ক। ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে গাড়ি। প্রায় এক ঘন্টায় নওগা শহরের হোটেল অবসরে পৌঁছি।
সারাদিন গোছল নেই। গতরাতের কিছুটা অনিদ্রাও জমা আছে। তার ওপর দিনভর ভ্রমণের ধকলে কারো কারো মাথা ধরে গেছে। বিছানায় সটান শুয়ে কেউ বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি ততক্ষণে স্নান সেরে নিলাম। তাই শরীরটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। এ সময়ে ইউসুফ শরীফ ভ্রমণ সাথী সৈয়দ শওকত আলীর সাথে পরামর্শ করে জানান, রাত ন’টায় আমাদের এক বাসায় দাওয়াতে যেতে হবে।
তার আগ পর্যন্ত অনাবিল বিশ্রাম। ঠিক রাত নটার দিকে ইউসুফ ভাই এসে দরজায় কড়া নাড়েন। শব্দ শুনে আমার ঘুম ভাঙে। সাথে সাথে দরজার ছিটকিনি খুলে দিই। অমনি কক্ষে ঢুকে বললেন, প্র‘স্তুতি নাও। এখনি বের হব।’ রুহুল আমিন বাচ্চু ভাইকে তিনি বললেন, ‘বাচ্চু ভাই কি একটু ঘুমুতে পারলেন…?’
-না, আমি পারলাম কই! আবু সাইদ কামাল তো শোয়া মাত্রই ঘুম। নাক ডেকে ঘুমের গাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন একেবারে গভীর নিদ্রায়।
-ও আচ্ছা। শোয়া মাত্র ঘুম আসা তো সুখী মানুষের লক্ষণ।
এই বলে ইউসুফ শরীফ চলে গেলেন অন্যদের জাগাতে। কিছুক্ষণের মাঝে সবাই কাপড়-চোপড় পরে প্রস্তুতি নিই। যে বাসাতে দাওয়াত করা হয়েছে-তা হাঁটা দূরত্বে। জেলা পর্যায়ের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের বাসা। শহরের অভিজাত এলাকায় সেই বাসার অবস্থান। আমরা সদলবলে হাঁটছি। অনুমান সাত-আট মিনিট হাঁটার পরই কাক্সিক্ষত সেই বাসায় পৌঁছে যাই। সুরম্য একতলা বাসাটি বেশ সাজানো -গোছানো। গেটে ঢুকেই বারান্দা। বারান্দা পার হয়ে সোফা আর কার্পেটে সজ্জিত ড্রয়িং রুমে। স্বল্প সময় আমরা ড্রয়িং রুমে বসি। তারপরই ডাইনিং রুমে খাবারের জন্য আমন্ত্রণ। রকমারি খাবারের আয়োজন। ব্যাংক কর্মকর্তা এবং তার ছেলে-মেয়েরা সবাই মিলে বেশ আন্তরিকতার সাথে আমাদের খাবার পরিবেশন করে।
রাত দশটার দিকে খাবার পর্ব শেষ হলে সবাই বিদায় নিয়ে বের হলাম। তৃপ্তিসহ খাবার খেয়ে ভারী পেটে ধীর গতিতে হাঁটছি আমরা। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে সালেহীন ভাই তার স্বভাব সুলভ রসিকতায় আমাদের মাতিয়ে তুললেন। সফরকারী কথাসাহিত্যিকদের দলে একমাত্র তরুণ লেখক জামাল। বাকি সবাই যৌবন উতরে প্রৌঢ় রাজ্যের বাসিন্দা। জামাল উদ্দিন এখনও অবিবাহিত। আমাদের মাঝে তরুণ লেখক সবেধন নীলমনি সেই জামাল উদ্দিনই রসগল্পে আলেচনার কেন্দ্রবিন্দু। তাকে ঘিরে সবার মাঝে রসিকতাপূর্ণ হাসির ঢল।
এভাবে রসালাপে মেতে হাঁটতে হাঁটতে চারতলা হোটেলে পৌঁছে যাই। শুতে যাবার পালা। তখন সৈয়দ শওকত আলী এবং দলনেতা ইউসুফ শরীফ জানিয়ে রাখেন যে, সকাল সাতটায় উঠতে হবে। সকাল সাড়ে সাতটায় রাজশাহীগামী বাস ধরতে হবে। দু’রাতের সমন্বিত ঘুমের চাপে সকাল সকাল শুয়ে পড়লাম। আগের মতোই প্রতি কক্ষে দু’জন করে শুয়েছি। আমার কক্ষে রুহুল আমিন বাচ্চু ভাইও তাড়াতাড়ি বাতি নিভাতে আগ্রহী। এগারোটার আগেই আমি তলিয়ে গেলাম ঘুমের অথৈ সাগরে।
ভোরে আমার ঘুমই প্রথম ভাঙে। হাত-মুখ ধুয়ে সবার আগে গোছল সেরে নিলাম। রুহুল আমিন ভাইও জেগে শয্যা ছাড়লেন। সকাল সাতটায় আমি অবশিষ্ট তিনটি কক্ষে গিয়ে কড়া নাড়লাম। সবাই জেগে উঠে। হোটেলের চার তলাতে নাস্তার আয়োজন করা হয়। সাড়ে আটটায় আমরা হোটেল ছেড়ে রওয়ানা হলাম রাজশাহীগামী বাসের উদ্দেশ্যে। গেটলক বাসে চার সারিতে আটজন বসলাম। দু’ঘন্টায় রাজশাহী রেলস্টেশন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ডে নামি সবাই। অল্পের জন্য ফেল করলাম ছোট সোনামসজিদগামী বাস। পরবর্তী বাস এক ঘন্টা পরে। আমাদের ধারণা দেয়া হয়েছিল, রাজশাহী থেকে বাসে সোনা মসজিদ পৌঁছতে এক ঘন্টা সময় লাগে। কিন্তু বাস কন্ডাক্টরের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, সোনা মসজিদ যেতে সোয়া দুই থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে। সেই হিসেবে আসা-যাওয়া বাবদই পাঁচ ঘন্টা সময় দরকার। কাজেই বাসে সোনা মসজিদ গেলে ফিরে এসে ঢাকা যাওয়া কঠিন হবে। এ অবস্থায় কী করা যায়! কিংকর্তব্যবিমূঢ় সবাই। কী ভেবে যেনো সৈয়দ শওকত আলী তখন এক জায়গায় ফোন করেন। কিছুক্ষণের মাঝেই মোটর বাইক যোগে একটা লোক আসে। তার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত দেয়া হয় যে, রাজশাহী থেকে একটা মাইক্রোযোগে সোনা মসজিদ যাব আমরা। মাইক্রোকার আসার আগ পর্যন্ত কিছুটা সময় হাতে পাওয়া যায়। তখন স্বল্প সময়ের জন্য আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়ি। আমাদের লক্ষ, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা। প্রথমেই আমরা রাজশাহী রেলস্টেশনে ঢুকি। সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাজশাহী রেলষ্টেশন। সেখান থেকে বের হয়ে পদ্মা নদী দেখার জন্য জমির হোসেন এবং আমি রিকশা যোগে রওয়ানা হই পদ্মাপাড়ের পার্কে। একই সাথে আর এক রিকশায় রওয়ানা হন সালেহীন ভাই এবং জামাল উদ্দিন। আমরা যখন পদ্মার জলধারার কাছে নেমে ছবি তোলায় ব্যস্ত, তখনই সালেহীন ভাইয়ের মুঠোফোন বেজে উঠে। ফোনে সাড়া দিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখনি আসছি। ফোন ছেড়ে তিনি বলেন, এই চলো সবাই। গাড়ি এসে গেছে। এখনি যেতে হবে।
যে কথা সেই কাজ। পদ্মা পাড়ের ছোট্ট পার্কের আঙিনা ছেড়ে আমরা রাস্তায় নামলাম। দুটি রিকশায় দশ মিনিটের মাঝে আমরা হাজির হলাম। গাড়ি দাঁড়ানো। তড়িঘড়ি করে সবাই উঠলাম। গাড়ি ছাড়ার আগে ইউসুফ ভাই বলেন, আমরা রাজশাহীর শাহ মকদুম(রা) এর মাজার জিয়ারত করে চাপাইয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব। পদ্মার পাড়ে শাহ মকদুমের মাজার। অনুপম সুন্দর স্থানে মাজারটির অবস্থান। বেশ নিরিবিলি। মাজারে ঢুকলেই কেমন যেনো অপার্থিব শান্তিতে মন ভরে উঠে। মাজার সংলগ্ন পুকুরে ওজু করে আমরা মূল মাজারে ঢুকি। এবং শাহ মকদুম এর কবর জিয়ারত করি। মোনাজাতে গিয়ে তার উছিলায় যেনো মুক্তি পাই সে জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে পানা চাই। মাজার জিয়ারত শেষে পাশের স্টলে মুড়ির মোয়া ও চা খেয়ে গাড়িতে উঠি সবাই। গাড়ি ছুটলো। পরিচ্ছন্ন রাজশাহী শহর। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শহরের আঙিনা ছেড়ে গাড়ি ছুটে ফসলি প্রান্তরের বুক চিরে। সোনালি ধানের বন্যায় উথলে উঠেছে মাঠ। রাজশাহী শহরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো-এর সবুজ বৃক্ষের বিন্যাস। শহরের বাইরে গ্রাম-গ্রামান্তরও যেনো সবুজ বৃক্ষলতায় সাজানো এই জনপদ। মহানন্দা পার হয়ে আমরা উঁচুনিচু পথ ও ভূমির দেখা পাই। যেনো সাগরের ঢেউ খেলানোর ন্যায় উঁচুর পরে নিচু। এমন দৃশ্য দেখে ইউসুফ ভাই বলেন, পাহাড়ি এলাকার মত উঁচু-নিচু মনে হচ্ছে বুঝি?
জবাবে আমি সরব হয়ে বলি, বরেন্দ্রের বৈশিষ্ট্য মনে হয়।
-ঠিক বলেছ তুমি। বরেন্দ্রের বৈশিষ্ট্যই হবে।
রাজশাহী জেলার সীমানা পেরিয়ে তখন গাড়ি ছুটছে চাপাই নবাবগঞ্জের পথে। চাপাই তো অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। উঠতি ফসলে ভরপুর আদিগন্ত সোনালি প্রান্তর একবার দেখেই মন জুড়িয়ে যায়। কিন্তু চোখ তো আর ফিরে আসে না। ছুটন্ত গাড়িতে বসে কাঁচ-ঢাকা জানালা পথে শুধু বাইরেই থাকিয়ে রই। দূরের দৃশ্য কিছুক্ষণ মনভরে দেখা যায়। কিন্তু কাছের দৃশ্য সাঁই করে পিছনে ছুটে যায়। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর ভিন্ন ভূ-দৃশ্যপটে দেখা দেয় চাপাই নবাব গঞ্জের আম বাগান। এ এলাকায় ঢুকেই গাড়ি সীমিত গতিতে এগোচ্ছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে ড্রাইভার বলে, এ এলাকার নি¤œ বৃত্তের মানুষ রাস্তা পারাপারে অসচেতন। চাপাই হতে সোনা মসজিদ-মাঝখানে কানসাট। এ পথে সড়কদুর্ঘটনা বেশি হয়।
আমরাও খেয়াল করে দেখলাম, গ্রামের মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে, অথচ রাস্তার যানবাহনকে তেমন তোয়াক্কাই করছে না। যা হোক, আমাদের মনোযোগ কাড়ে তখন রাস্তার দু’পাশের আম বাগান। প্রথম প্রথম আমবাগান দেখে কেউ কেউ বলে, এটা বড় বাগান। গাড়ি এগিয়ে গেলে অন্যজন বলছে, না এটা বড়। আর একজন বলছে, না ওটা। কিন্তু যখন রাস্তার দুপাশে মাইলের পর মাইল আম গাছের অরণ্যের মাঝ দিয়ে গাড়ি ছুটছে, তখন আর কেউ বলেনি কোন বাগান বেশি বড়। কারণ অরণ্যের মাঝখানে ঢুকে আমাদের মনের মাপযন্ত্রের আর দরকার হয়নি। আমাদের প্রবল আগ্রহ ছিল কানসাট নিয়ে। কারণ, বিদ্যুতের দাবি নিয়ে নিকট অতীতে সাতজন কানসাট বাসী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। তারপর কী উত্তাল বিদ্রোহ! সামাল দিতে তৎকালীন সরকার হিমসিম খেয়েছিল। রক্ত দিয়ে ওরা সব দাবি-দাওয়া আদায় করে নিয়েছিল। গাড়ি অবিরাম ছুটছে। তখন প্রায় আড়াইটা বাজে। পেটের অরণ্যে তখন ক্ষুধা নামক বাঘটা ফুঁসে উঠছে-টের পাওয়া যায়। সোনা মসজিদ আর বেশি দূরে নয়। পনের মিনিটের মাঝে সোনা মসজিদের পাশ ঘেঁষে আমরা একটি ব্যাংক শাখায় গেলাম। রাস্তার পাশে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থামে। সবাই নামা মাত্র ব্যাংক কর্মকর্তা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানায়। দোতলায় ব্যাংক। আমাদের লাঞ্চের আয়োজন করেছেন ঐ ব্যাংকেই। ব্যাংক ম্যানেজারের কক্ষে আমরা আট সদস্যের দল বসি। দুটো টয়লেট বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে খাবারের টেবিলে যাই। খাবার খেয়ে নিভাই ক্ষুধার দহন। খাবার শেষ হলে ইউসুফ ভাই তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘দেরী করা যাবে না। কারণ, এখানে আমরা শাহ নেয়ামত উল্লাহ(র) এর মাজার, তহখানা, এবং সোনা মসজিদ পরিদর্শন করবো।’
দলনেতার তাগিদে আমরা ঝটপট বেরিয়ে গাড়িতে উঠি। একটা ভুল তথ্যে আমাদের বহনকারী গাড়ি ছুটে যায় সোনা মসজিদ সীমান্তে। একেবারে সীমান্তে স্থলবন্দর পয়েন্টে। ভুল ভাঙলে ফের গাড়ি ফিরে আসে একেবারে শাহ নেয়ামত উল্লাহর মাজারের আঙিনায়। প্রথমে আমরা তহথানা ঘুরেফিরে দেখি। মোঘল আমলের অপূর্ব স্থাপনা এটি। তিনতলা বিশিষ্ট তহখানা। একতলা মাটির নিচে। তহখানার মানে হল- মাটির নিচের ঘর। দোতলা মাটির সমতলে। তিনতলা ওপরে। সামনে বিরাট পুকুর। এটিকে জাহেদুল বালা পুকুরও বলা হয়ে থাকে। প্রাসাদোপম এ স্থাপনা দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, এটা কোনো সাধারণ মানুষের তৈরি নয়, রাজপৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এমন ইমারত তৈরি অসম্ভব। ইমারতটি দৈর্ঘে ৩৫.৫৫ মিটার, আর প্রস্থে ১১.৫৮ মিটার। উপর তলায় মোট ১৭টি কক্ষ রয়েছে। আন্ডারগ্রাউ-ের নির্মাণশৈলী দেখে মনে হলো-এ যেনো কোনো দরবার বা রাজকীয় বৈঠক খানা কিংবা বালাখানা। এর পুবপাশে লোহার শিকে আটকানো বড় বড় জানালা। যা দিয়ে বিশাল পুকুর থেকে আসে শীতল বাতাস। একতলার এ হাওয়াখানায় দাঁড়ালে শীতল বা মৃদুমন্দ বাতাসে গা জুড়িয়ে যায়। বিস্ময় জাগানোর মত স্থাপনা এটি। দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। বলা হয় বাংলাদেশে মোঘল আমলের দুটি প্রাসাদ আছে। সেগুলোর একটি ঢাকার লালবাগ কেল্লা। দ্বিতীয়টি হলো এটি।
তহখানার দক্ষিণ রয়েছে গম্বুজাকৃতির হাম্মাম। হাল আমলে ‘হাম্মাম খানা’-গোছলখানা নামে পরিচিত। এসব দেখে দেখে সবাই এগোলাম শাহ নেয়ামত উল্লাহর মাজারের দিকে। মাজার জিয়ারত করে সংলগ্ন মসজিদে আছরের নামাজ আদায় করলাম। এখান থেকে গাড়িতে উঠে রওয়ানা হলাম ছোট সোনা মসজিদের দিকে। বেশি দূরে নয়। কয়েক মিনিটের পথ। ছোট সোনা মসজিদের আঙিনায় গিয়ে গাড়ি থামে। আমরা সবাই নেমে ছোট সোনা মসজিদের নির্মাণ শৈলী দেখে বুঝলাম, গত কালের দেখা কুসুম্বা মসজিদ আর এ মসজিদের নির্মাণশৈলী অভিন্ন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সুলতান হোসেন শাহের আমলে এসব মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। সে হিসেবে এসব মসজিদের বয়স পাঁচ-ছয় শত বছর। অথচ এগুলোর মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলী হাল আমলের যেকোনো নির্মানের চেয়ে নান্দনকিতার মানে সেরা।
প্রত্নতত্ত্ব ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন জনপদ গৌড় বিভিন্ন সময়ে বাংলার রাজধানী ছিল। ফলে সে সময়ে এ অঞ্চলে বহু অবকাঠামো গড়ে উঠে। বিশেষ করে সুলতানী ও মোঘল আমলে বহু মসজিদ-মাদ্রাসা ও ইমারত নির্মিত হয়। তার মাঝে ছোট সোনা মসজিদ অন্যতম। রাজশাহী শহর থেকে ৮৪ কিলো মিটার উত্তর -পশ্চিমে চাপাই নবাবাগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে অবস্থিত ছোট সোনা মসজিদ। মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন এটি। আয়তাকারে নির্মিত মসজিদের পরিমাপ দৈর্ঘে ২৫ মিটার ও প্রস্থে ১৬ মিটার। মসজিদের দেয়াল পাতলা ইটে গাঁথা। দেয়ালের উভয়দিক শ্বেত পাথর দ্বারা মোড়ানো। পুব দেয়ালে ৫টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ৩টি করে ৬টি সর্বমোট ১১টি খিলান বা প্রবেশপথ রয়েছে। প্রতিটি দেয়াল সাড়ে তিনফিট পুরো। পশ্চিম দেয়ালে কারুকাজ খচিত ৫টি মনোমুগ্ধকর মিহরাব রয়েছে। মসজিদের উত্তর ও পশ্চিম কোণে স্তম্ভের উপর রয়েছে তখত। ৪ কোণে ৪টি আটকোণাকৃতি মিনার আছে। মসজিদের ভিতরে আছে ১৫টি করুকাজ খচিত পিলার। উপরে রয়েছে ১২টি গোলাকার ও ৩টি চৌ-চালাকৃতি গম্বুজ। গম্বুজগুলো এক সময় সোনাদ্বারা মোড়ানো ছিল বলে জানা যায়। এ জন্য মসজিদটি সোনা মসজিদ নামে পরিচিত। যেহেতু গৌড় দুর্গে(ভারতে) অবস্থিত সোনা মসজিদটি আকারে এই মসজিদের চেয়ে বড় এ জন্য এটাকে ছোট সোনা মসজিদ বলা হয়। এ সোনা মসজিদের মূল আকর্ষণ দেয়ালের বাইরে নান্দনিক অলংকার। স্থাপত্যকলা ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের বিচারে মসজিদটি গৌড়ের রতœ হিসেবে বিবেচিত। কেন্দ্রিয় দরজার শিলালিপি থেকে জানা যায, মসজিদটি সুলতান হোসেন শাহের আমলে ওয়ালী মুহম্মদ কর্তৃক ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি।
সোনা মসজিদের আঙিনায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। দু’জনের একজন হলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বাংলার কৃতী সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেনেন্ট শহীদ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। তার সমাধিস্থল এখানেই। তাদের সমাধি যেনো এ মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আরও বাড়তি মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এভাবে নানা দিক থেকে সোনা মসজিদ ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে আমাদের দেশ ও জাতির ঐতিহ্য বহন করে চলছে। গোধূলি বেলায় ফেরার জন্য গাড়িতে চাপলাম। সাতটার ক’মিনিট আগে রাজশাহী পৌঁছে ঢাকাগামী বাসের খোঁজ নিলাম আমরা। জানা গেল নৈশবাস রাত এগারোটায় ছাড়ে। টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা গেল-এগারোটার বাসের সব টিকিট এর মাঝেই শেষ হয়ে গেছে। আমাদের পক্ষ থেকে সাড়ে এগারোটার বাসের টিকিট সংগ্রহ করলেন দল নেতা তথা কথাসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি ইউসুফ শরীফ। এমন একটি সর্বাত্মক ভ্রমণের আয়োজন করায় কথা সাহিত্য কেন্দ্রকে ধন্যবাদ না জানালে নিজের কাছেই অকৃতজ্ঞ থাকব। ভোর বেলায় ঢাকায় পৌঁছে আমরা স্ব স্ব গন্তব্যে চলে যাই।
]
আবু সাইদ কামাল
লেখক পরিচিতি: কথাসাহিত্যিক আবু সাইদ কামাল (জন্ম ৫ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে ময়মনসিংহ জেলায়) লিখছেন প্রায় তিন যুগ ধরে। সত্তর দশকে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ নব্বইয়ের দশকে। নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, শিশুতোষ গল্প ও ছড়া। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩০ টি।
ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/