লেবু-কাঁচামরিচের রাজস্থান

মানুষ নিজেকে শুদ্ধ রাখতে, ভালো রাখতে, পবিত্র রাখতে, দোষ-ত্রুটি মুক্ত রাখতে, সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পরিবার বা সমাজ দ্বারা আরোপিত যে সকল আচার-ব্যবহার মেনে চলে সেগুলোই হলো সংস্কার। অন্যদিকে কুসংস্কার হলো যুক্তিহীন অবৈজ্ঞানিক কিছু সংস্কার। কিন্তু এই দুটি বিষয় অনেকটা জমজ সন্তানের মতো হাত ধরাধরি করে চলে। এজন্য এদের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা টানতে অনেক সময় বেশ মুশকিলে পড়তে হয়। কেননা আজ যেটা সংস্কার, সময়ের বিবর্তনে সেটিই পরিণত হয় কুসংস্কারে। এছাড়া দেশ, কাল জাতিভেদেও এদের পার্থক্য ধরা পড়ে। এক দেশে যেটা কুসংস্কার হিসাবে নিন্দনীয়, অন্যত্র সেটা নান্দনিক এক সামাজিক সংস্কার হিসাবে স্বীকৃত। এজন্যই বোধহয় আমাদের ভাষায় – ‘এক দেশের গালি, আরেক দেশের বুলি’ প্রবাদ বাক্যটির প্রচলন রয়েছে।

ভারতের রাজস্থান সফরে গিয়ে এরকম বেশ কিছু সংস্কার দেখেছি যা আমাদের কাছে কুসংস্কার হিসাবেই বিবেচিত হবে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাঞ্জাবি কবি প্রয়াত দেব ভরদ্বাজের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনের নিমন্ত্রণ পেলাম। ১৪-১৫ অক্টোবর দু দিনের এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে তখন রাজস্থানের রাজধানী উদয়পুরের মোহনলাল সুখান্দিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বামী বিবেকানন্দ অডিটরিয়ামে। আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলন মানেই তো বিভিন্ন বিদেশি কবি লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ। তারওপর এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাজস্থানের মতো প্রদেশে, লোকজ ঐতিহ্য আর নিজস্ব সংস্কৃতির কারণে ভারতজুড়ে যার সুনাম আছে। অসাধারণ সব ঐতিহাসিক স্থাপনা, সুরম্য অট্টালিকা আর সংস্কৃতির সোনালি ফিতায় মোড়ানো রাজস্থানের পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধশালী। বছরজুড়ে দেশ বিদেশের বহু মানুষ এখানে ভ্রমণ করে থাকেন। তো এই দুই আকর্ষণের কারণে এতে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমি আর শওকত। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। এক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছিলেন  দেব ভরদ্বাজের। তিনি কেবল কবি নন, একজন সফল সাহিত্য সংগঠক হিসাবেও তার সুনাম ছিলো। বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা কাফলা ইন্টার-কন্টিনেন্টালের সম্পাদক ছিলেন তিনি। তারই উদ্যোগে প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হতো আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলন। এতে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ছাড়াও এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশের কবি-সাহিত্যিকরা অংশ নিতেন।

রাজস্থান যাব অথচ ঐতিহ্যবাহী জয়পুর দেখবো না তা কি করে হয়! আমরা পরিকল্পনা করলাম আগে জয়পুর শহর ঘুরে দেখবো, এরপর সম্মেলনে যোগ দিতে উদয়পুর যাব। পরিকল্পনা মতো ঢাকা থেকে রওয়ানা হলাম ১০ অক্টোবর, রাতের গাড়িতে। উদ্দেশ্য কলকাতা থেকে বিমানে করে জয়পুরে যাওয়া। পরদিন অর্থাৎ ১২ অক্টোবর দুপুর নাগাদ কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় পৌঁছায় আমাদের বাসটি। যেহেতু আমাদের ফ্লাইট সন্ধ্যা রাতে। তাই আমরা কলকাতায় কোনও হোটেল নেইনি।  একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুপুরের খাবার খেয়ে নেই পেট পুরে। এরপর একটা ট্যাক্সি ডেকে ওঠে পড়ি, গন্তব্য দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানে রাত সাড়ে ৮টায় ফ্লাইট, আমরা যাচ্ছি স্পাইসি এয়ারলাইন্সে। ট্যাক্সিতে উঠার পর একটা জিনিস খুব অবাক লাগছিলো। ড্রাইভারের সিটের সামনে টাঙানো সুতোয় ঝুলছে একটা সতেজ পাতি লেবু আর কয়েকটা কাঁচামরিচ।

 

গাড়িতে ড্রাইভার এসব কেন ঝুলিয়েছে কে জানে! কৌতুহলী হলেও এ নিয়ে অবাঙালি চালককে কোনও প্রশ্ন করলাম না। কিন্তু জয়পুরের মাটিতে পা রেখেই বুঝে গেলাম এই কাঁচমরিচ আর লেবুর রহস্য। রাজস্থানের লোকজনের ধারণা, এই দুটো বস্তু যে কোনও রকমের অনিষ্ট এবং খারাপ আত্মার প্রভাব থেকে তাদের এবং তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে পারে। দোকানপাট ও বাড়ির সদর দরজায় লেবু-লঙ্কা ঝোলানোর প্রথা বেশ পুরনো। আর এই পুরনো প্রথাটি সযতনে রক্ষা করে চলেছে এই রাজ্যের বাসিন্দারা। রাজস্থানের বাড়ি, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট মার্কেট সর্বত্র লেবু আর কাঁচামরিচের জয় জয়কার। লোকজন তাদের বাড়ি বা অন্যান্য স্থাপনার দরজায় এগুলো ঝুলিয়ে রাখে। বাজারে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে একসঙ্গে লেবু আর কাচামরিচ গেঁথে রাখা শোপিসগুলো।  অনেকে তো আবার বাসাবাড়ির দেয়ালে এঁকে রাখে এগুলোর ছবি। রাজস্থানের এই লেবু-কাঁচামরিচ প্রীতিকে সংস্কার বলবেন না কুসংস্কার সেটা আপনারাই ভেবে বলুন।

শনি উতারো

কেবল লেবু আর কাঁচামরিচ নয়-রাজস্থানের লোকজনের মধ্যে আরও বেশ কিছু কুসংস্কার লক্ষ্য করেছি। শনিবার তাদের কাছে খারাপ দিন। এই দিনটিতে নানা অঘটন ঘটতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য শনি থেকে বাঁচতে তাদের রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি। উদয়পুরে অবস্থানকালে আমরা তেমনই একটি কুসংস্কারের মুখোমুখি হয়েছিলাম। উদয়পুরে আমি আর শওকত উঠেছি একটা মোটামুটি ভালো মানের হোটেলে-উদয় প্যালেস। এখান থেকে আমাদের লেখক সম্মেলনের ভেন্যু কাছে। আয়োজকরা গাড়ি দিয়ে আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। প্রথম দিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর উদয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত লেখক সম্মেলনে অনেক বিদেশি কবি লেখকের সাথে পরিচিত হলাম। এদের মধ্যে ফিলিপাইনের কবি ভার্জেনিয়া জেসমিন পাসালো, তাজাকিস্তানের মাহফুজা ইমোনোভা, মিশরের জর্জ ওনসি, কাশ্মীরি লেখক ও গবেষক জনার্দন পাঠানিয়া, পুয়ের্তো রিকোর কবি, অনুবাদক লুজ মারিয়া লোপেজ, কানাডার কবি ইব্রাহিম হানজোর নাম উল্লেখযোগ্য  অডায়াসে দাঁড়িয়ে নিজের লেখা দুটো ইংরেজি কবিতা পড়লাম। সার্টিফিকেট নিলাম কবি ও অনুষ্টানের প্রধান আয়োজক ভরদ্বাজের হাত থেকে।

দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠানে যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ। গাড়ির জন্য উদয় প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এসময় এক বৃদ্ধা আসলেন যার হাতে একটা কাঁসার পাত্র ঝুলানো যাতে রয়েছে নানা ধরনের জিনিসপত্র, যেগুলো আমি চিনিতে পারিনি। ওই নারী আমার কাছে এসে কি কি যেন বলছে আমি যার মধ্যে কেবল ‘শনি উতারো’ শব্দ দুটিই বুঝতে পারলাম। আমি তখন কাউন্টারে বসে থাকা হোটেলের রিসিপসনিস্টের কাছে জানতে চাইলাম- ‘উনি কি বলছেন?’ ওই ভদ্রলোক তখন ইংরেজি আর হিন্দি মিলিয়ে বললো-‘আজ তো শনিবার। এজন্য উনি আপনার শনি কাটাতে চাইছেন। আপনি উনাকে কিছু পয়সা দিয়ে দিন।’

এতক্ষণে বোধগম্য হলো পুরো বিষয়টা। ওই বৃদ্ধা ঝাড় ফুঁকের মাধ্যমে তথাকথিত শনি দূর করেন এবং বিনিময়ে কিছু পয়সা পান। এ ধরনের ঝাড় ফুঁকের প্রচলন আমাদের দেশেও আছে। কেবল গ্রামে নয়, বালা মুছিবত দূর করার নাম করে শহরেও বহাল তবিয়তে চলছে এসব কুসংস্কার। তো আমি ‘শনি উতারো’ না করেই তাকে কিছু পয়সা দিয়ে দিলাম। এটা রাজস্থান ভ্রমণে এটা আমার কাছে একটা স্মরণীয় ঘটনা। এর জের ধরে পরদিন আমাকে একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। সেদিনও আমি আর শওকত উদয় প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। এসময় একজন বৃদ্ধের আবির্ভাব। তার পোশাক পরিচ্ছদ দেখে তাকে আমার ভিক্ষুক বলে মনে হলো। ব্যাগ খুলে আমি তাকে কিছু রুপি সাধছি। ওই লোক টাকা না নিয়ে হাসতে হাসতে হোটেলের ভিতরে চলে গেলো। তখন সেই রিসিপসনিস্ট এসে আমাকে বললেন, ‘ম্যাডাম আপনি কি করছেন। উনি তো এই হোটেলের মালিক!’ আমি তো পুরাই থ।

সে যাই হউক রাজস্থানের খাওয়া দাওয়া আমার খুব ভালো লেগেছে। হোটেলগুলোতে অল্প দামে নানা রকমের খাবার পাওয়া যায়। কোনও মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার করার চল নেই সেখানে। আপনাকে কেবল থালি বলতে হবে। এসব খাবারকে ওরা বলে থালি-গুজরাটি থালি, রাজস্থানি থালি-একেক অঞ্চলের নামে একেক ধরনের থালি। থালায় করে খাবারগুলো দেয়া হয় বলে এর নাম থালি। একটা বড় স্টিলের থালাতে ভাত, রুটি, পাপড়, সব্জি, কয়েক প্রকার ডাল, চাটনি, টক দই, পিঁয়াজ কুচি আর  কাঁচামরিচ দিয়ে সাজানো থাকে। যাই থাকুক না কেন, সবই নিরামিষ-মাছ, মাংসের নাম গন্ধ নেই। গুজরাটি আর রাজস্থানি খাবার প্রায় একই রকম, দু একটা আইটেম হেরফের হয়। এদের মধ্যে কমন জিনিস হচ্ছে- ডালের আধিক্য। ১০০ টাকার একটা থালিতে যে খাবার থাকে তাাতে একজন মানুষ পেট পুরে খেতে পারবে, যেটা আমাদের এখানে কল্পনাও করা যায় না।

ভারতে সব জিনিসপত্রের দামই তুলনামূলক কম এবং সর্বত্র একই দাম। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কোনও হেরফের নেই। রাজস্থান, আসাম কিংবা মনিপুর বেড়াতে গিয়ে ২৫ টাকা দিয়ে যে লেইস চিপস খেয়েছি ঢাকায় এটার দাম করে হলেও দেড়শ’টাকা। আর এনার্জি ড্রিংক রেডবুলের দাম শুনে তো আমার অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। ঢাকায় যে রেডবুলের একটা ক্যান আমি ২০০ টাকা করে কিনি, ভারতে সেটার মাত্র ৪০ টাকা। ভাবা যায়! একই কথা প্রযোজ্য ক্যাডবেরিসহ অন্যান্য চকলেট ও বিস্কুটের বেলায়। দাম কম হওয়ায় ভারতে প্রচুর চিপস আর জুস খেয়েছি। সত্যি বলছি-একটা পানির বোতল আর জুসের দাম প্রায় একই রকম। যে কারণে আমি পানির বদলে আপেল জুস (ফিজ) খেয়েছি। আর বাড়ি আসার সময় ছেলের জন্য অনেকগুলো রেডবুল, ফিজ জুস, চকলেট আর শনপাপড়ি নিয়ে এসেছিলাম। রাজস্থান ভ্রমণ আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে আছে। এই সফরের স্মৃতি আজীবন থেকে যাবে মনের মনিকোঠায়।

বাম দিক থেকে ১,পুয়ের্তো রিকোর কবি মারিয়া লোপেজ ২.কাশ্মীরি লেখক ও গবেষক জনার্দন পাঠানিয়া ৩.তাজাকিস্তানের মাহফুজা ইমোনোভা ৪.ফিলিপাইনের কবি ভার্জেনিয়া জেসমিন পাসালো

মাহমুদা আকতার: কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক। প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি।

ওমেন্স নিউজ/