কবি ফজলল করিমের স্মৃতিচিহ্ন দেখতে বাধা দর্শনার্থীদের

শেখ ফজলল করিমের মাজার, ইনসেটে কবি

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট প্রতিনিধি

‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।’ বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় এই কবিতার রচয়িতা কবি শেখ ফজলল করিমের ৮৫তম মৃত্যুবার্ষিকী (২৮ সেপ্টেম্বর) চলে গেল নীরবে নিভৃতে। দিনটিতে পরিবারের লোকজন কোনো আয়োজন করেনি। এ ছাড়া উল্টো স্মৃতিচিহ্নবিজড়িত কবির কক্ষটি তালাবদ্ধ করে রাখছেন তার পরিবারের সদস্যরা।

প্রতিবছর কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের কাকিনায় দর্শনার্থী ও কবিপ্রেমীদের ভিড় জমে। কিন্তু এখন পরিবারের সদস্যরা তাদের ফিরিয়ে দেন। এতে ভক্তরা আক্ষেপ প্রকাশ করেন। তাই কক্ষটি তালাবদ্ধ না রেখে খুলে রাখা ও উন্মুক্ত করার দাবি জানান তারা।

লালমনিরহাট জেলা শহরের প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা বাজার গ্রামে তার। লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের পাশেই কবির স্মৃতিফলক রয়েছে। ১৯৯৩ সালে কবির বাড়ির দিকনির্দেশক হিসেবে গড়ে তোলা হয় এটি। যদিও মহাসড়কে উঁচু হওয়ায় সেটি নিচে পড়ে গেছে। সেখান থেকে হেঁটে কিছু দূর যেতেই চোখে পড়ে কবি শেখ ফজলল করিমের বাড়ি। বাড়ির পাশেই একটি পুকুর ও মসজিদ। তার পাশেই তার মাজার।

সরেজমিনে দেখা যায়, কবি শেখ ফজলল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার বাড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড় জমেছে। এ সময় তারা কবির স্মৃতিচিহ্ন দেখতে কবির কক্ষটির তালা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ মিলছে না। কিছুক্ষণ পর ছোট একটি শিশু দরজা খুললেও তার কাছে কবির কক্ষটি খোলার অনুমতি নেই বলে জানিয়ে দেয়।

প্রায় দুই ঘণ্টা পর কবির নাতবউ এসে আবার দরজা খোলেন। তখন তিনি সবার উদ্দেশে বলেন, এখন এসব দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রতিবছর অনেক মানুষ আসে আর দেখে চলে যায়। কী লাভ তাতে? এখন রুমটি খোলা যাবে না। পরে আরেক দিন আসবেন বলেই দরজা বন্ধ করে চলে যান।

এদিকে কবির পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা না হলেও দিনটি ঘিরে সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সদস্যরা বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেন।

জানা যায়, কবির কক্ষের ভেতরে আছে অযত্ন-অবহেলার ছাপ। শৌখিন কারুকাজ করা কাঠগুলো উইপোকা খেয়ে ফেলেছে। কাঠের দেয়ালজুড়ে কবির বড় দুটো ছবি আছে। কবির ব্যবহৃত জীর্ণ চেয়ার, খাট ও একটি গ্রামোফোন রাখা আছে তার পাশে। এক কোণে কাচের একটি শোকেস। কাচগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আছে কবির ব্যবহৃত টুপি, দোয়াত-কলম, ছোট্ট কোরআন শরিফ, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ও কিছু বোতাম।

২০০৫ সালে কবির স্মৃতিরক্ষার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত হয় ‘শেখ ফজলল করিম গণপাঠাগার’। তৎকালীন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু এটি উদ্বোধন করেন। তখন এটি রক্ষার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা থাকলেও এখন আর তা নেই। পাঠাগারে নেই নিরাপত্তা প্রহরী ও পাঠক মহলের পদচারণ। বইপুস্তকগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে বইপ্রেমীরা এখন সেখানে যান না। এদিকে পাঠাগারের পাশের দোকানপাট এটির সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া রাতের বেলায় এর আশপাশে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা।

কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি গণপাঠাগারের সভাপতি ও চেয়ারম্যান শহীদুল হক বলেন, ২০০৫ সালে স্থাপিত হয় কবি শেখ ফজলল করিমের সমৃদ্ধ পাঠাগার। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সবকিছু নষ্ট হওয়ার পথে। গণপাঠাগার হিসেবে এটা আমরা পরিচিত করা চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা সফল হইনি। যেসব বইপুস্তক আছে, ওই সব দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীকে পাঠক হিসেবে আনা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বসার স্থানসহ লাইব্রেরির উন্নয়নের বইপুস্তকে কার্যক্রম পরিচালনা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগান দেওয়া দরকার। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

কবিভক্ত আজাদ হোসেন বলেন, কবি শেখ ফজলল করিমের স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকই এসেছেন। কিন্তু অনেক আকুতি করলেও কবির পরিবারের লোকজন তালাবদ্ধ কবির রুমটি খুলে দেননি। ফলে রাজশাহী থেকে এসে আবারও চলে যেতে হচ্ছে।

কবির বাড়ি পাশেই এক প্রতিবেশী বলেন, দর্শনার্থীরা সব সময় আসেন বলেন তারা বিরক্ত হন। দর্শনার্থীরা এসে ডকাডাকি করলেও তারা ভেতর থেকে আওয়াজ দেন না। একরকম তারা বিরক্ত হয়ে গেছেন।

সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সদস্য প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলা সাহিত্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন কবি শেখ ফজলল করিম। বিশেষ করে তার পরিবারের বিষয়টি আমাদের ব্যথিত করে তুলেছে। তার কর্মগুলো আমরা আবার নতুন করে জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই। কবি শেখ ফজলল করিমের কবিতা, কাব্য আমাদের পাঁচটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার লেখা পাঠ্যবই থেকে বিলুপ্তপ্রায়। এসব নতুন করে জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। এ ছাড়া কবির স্মৃতিচিহ্নগুলো দর্শনার্থীদের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে। তাহলে নতুন প্রজন্ম কবিকে জানতে পারবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন যৌথ আয়োজন করে পাঠাগারে। কবির কক্ষটি তালাবদ্ধ বিষয়টি জানা ছিল না। তবে যত দ্রুত সম্ভব সেটি উন্মুক্ত করা হবে।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/