‘এতে অসাধারণ একটা গল্প আছে যার আকর্ষণ আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি’

সোমালি লেখক লেখক নাদিফা মোহামেদ

আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক নাদিফা মোহামেদের জন্ম ১৯৮১ সালে, সোমালিয়ার হারগাইসায়। এসময় দেশটিতে চলছিলো স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা। যে কারণে ১৯৮৬ সালে সপরিবারে লন্ডনে পাড়ি জমান তার বাবা। ভেবেছিলেন দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঘরে ফিরবেন। কিন্তু ভাগ্য তার খারাপই বলতে হয়। কেননা তারা লন্ডনে আসার মাত্র কয়েক বছর পরেই সোমালিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধ। যে কারণে  আর দেশে ফেরার সৌভাগ্য হয়নি নাদিফা মোহাম্মদের। ফলে লন্ডনেই স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন তিনি ও তার পরিবার। লেখাপড়া করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে-ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে। লন্ডনে আসার দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় পর ২০০৮ সালে নতুন প্রজাতন্ত্র সোমালিল্যান্ডে যান লেখক নাদিফা, সফর করেন মাতৃভূমি হারগাইসা । লেখালেখির শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন এই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত লেখক। ২০১০ সালেতার প্রথম উপন্যাস ‘ব্ল্যাক মাম্বা বয়’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সমালোচকরা সেটি লুফে নেয়। গার্ডিয়ান পত্রিকা তার এই উপন্যাসকে লন্ডনের অভিবাসী লেখকদের ‘উল্লেখযোগ্য, প্রভাবশালী’ গ্রন্থ হিসাবে উল্লেখ করেছে। নিজের বাবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে রচিত এ উপন্যাসের জন্য তিনি পেয়েছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার। শুধু এটি নয়, নিজের লেখা তিনটি উপন্যাসের জন্যই পেয়েছেন নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ২০১৩ সালে নাদিফাকে ‘সেরা তরুণ ব্রিটিশ লেখক’হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে বিখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী ‘গানটা’। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ অবল্বেনে রচিত ‘দ্য অরচার্ড অফ লস্ট সওলস’ জিতে নিয়েছে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত সমারসেট মম পুরস্কার। পেশাজীবনে তিনি একজন শিক্ষক এবং কাজ করছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিভাগে লেখচারার হিসাবে।

চলতি বছরই প্রকাশিত হয়েছে লেখকের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘দ্য ফরচুন ম্যান’। সত্যি ঘটনার ওপর রচিত এই উপন্যাসটি ২০২১ সালে বুকার প্রাইজের শর্ট লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে। সম্প্রতি লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন  প্যান-আফ্রিকা নিউজ পোর্টালের সিনিয়র সাংবাদিক ভিকি লেই। সাক্ষাৎকারে নাদিফা মোহামেদ ‘দ্য ফরচুন ম্যান’লেখার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। ওমেন্স নিউজের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন  বিশিষ্ট সাংবাদিক ও অনুবাদক মো. শওকত আলী।

আপনি ‘দ্য ফরচুন ম্যান’উপন্যাসটি লেখার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন?

আমি অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষা থেকে এটি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এমন নয়। ভাবলাম এতে অসাধারণ একটা গল্প আছে যার আকর্ষণ আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি। গল্পের কিছু অংশ স্পষ্টতই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল-যুক্তরাজ্যে মৃত্যুদণ্ড, টাইগার বে, ১৯৫০-এর দশকের অভিবাসী পুরুষদের জীবনযাত্রা ইত্যাদি বিষয়। তবে উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাকে টানা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে।

বইয়ের শিরোনাম কীভাবে বাছলেন?
এটার একটা দীর্ঘ গল্প আছে। কয়েক বছর ধরে আমি আর আমার সম্পাদক বিভিন্ন শিরোনাম আর নানা ধারণা নিয়ে ভেবেছি, সবশেষে এটির নাম ‘ফরচুন মেন’ স্থির হয়। ‘ফরচুন মেন’টার্মটি সরাসরি সোমালিয়ার নাবিকদের কাছ থেকে এসেছে, যারা বিভিন্ন স্থান ঘুরে প্রচুর অর্থ নিয়ে ঘরে ফিরে। এজন্য সোমালিয়ার লোকজন এসব নাবিকদের ভাগ্যবান হিসাবে বিবেচনা করে থাকে।

এমনকি আমার প্রথম উপন্যাস, ব্ল্যাক মাম্বা বয় -এ 'ভাগ্যবান পুরুষদের' -বিষয়টির উল্লেখ আছে এবং এই শিরোনামের মাধ্যমে এই দুটি উপন্যাসের সাথে সংযোগ স্থাপন করার ধারণাটি আমার পছন্দ হয়েছে। উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে সাবেক বণিক সমুদ্রযাত্রী মাহমুদ মাত্তানকে নিয়ে। ব্রিটিশ ইতিহাসে তিনি প্রথম ব্যক্তি যার মৃত্যুদণ্ডের ৪৬ বছর পরে তাকে যে ভুলভাবে হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো, তা প্রমাণিত হয়।

আপনার বাবা তাকে চিনতেন। এই গল্পটি লেখার সময়  কাহিনী ও বাস্তবতার  ব্যবধান ফুটিয়ে তোলার বিষয়ে আপনার অনুভব কেমন ছিল?

গবেষণায় যতই গভীরে যাচ্ছিলাম ততই একটা কিছুর অনুপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম যেখানে আসল মাহমুদ থাকা উচিত ছিল। পুলিশের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, মেডিকেল ফাইল এবং আদালতের প্রতিলিপিতে তার সম্পর্কে বিভিন্ন টুকরো ধারণা হাজির হচ্ছিল। পুরো ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার নিজের মধ্যে ডুব না দিয়ে এবং তার পদাঙ্ক অনুসরণ না করে তাকে সম্পূর্ণ করে তোলার কোন উপায় ছিল না।

‘দ্য ফরচুন মেন’থেকে পাঠকদের আপনি কোন অপরিহার্য বার্তাটি দিতে চান?  
মাহমুদের সাথে যা ঘটেছিল এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে তিনি যে সহিংসতা ভোগ করেছিলেন তা এখনও আমাদের সামনে রয়েছে, আমরা বিশ্বের যেখানেই থাকি না কেন। আমরা সবাই আমাদের সমাজের অপূর্ণতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখি, যদি অপব্যবহারের শিকার না হই, যতক্ষণ না তা আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে।

আমি চেয়েছিলাম যে, লোকজন বিদ্রোহী মানুষদের বিষয়ে জানবে যারা সবসময় যেভাবে সবকিছু ঘটে চলেছে তার বিরুদ্ধে যায়, যারা নতুন জীবনযাপনের জন্য জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করেছে।

বইটি লেখার ব্যাপারে আপনার সবচেয়ে বেশি কী ভাল লেগেছিল?
আমার কাছে এ বইটির সবকিছু ভাল লেগেছে – এটি লিখতে পারাটাই একটা আনন্দদায়ক বিষয় ছিল। এছাড়া বিভিন্ন জনের সাক্ষাৎকার গ্রহন, কার্ডিফ ভ্রমণ, আর্কাইভ রেকর্ড দেখা এবং দুই দশক ধরে চিন্তা-ভাবনা জিইয়ে রাখার পরে সবকিছু লেখার জন্য প্রস্তুতি ছিল আনন্দদায়ক অনুভূতি।   

আপনি খুব অল্প বয়সে সোমালিল্যান্ড থেকে চলে এসেছেন। এই চলে আসা কীভাবে গল্পকার হিসাবে আপনার সৃজনশীলতাকে প্রভাবিত করেছে?

আমি মনে করি, আধা-আধি দেখা বা বোঝা যায় এমন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার চেষ্টায়রত চিরকালের জন্য দেশের বাইরে চলে যাওয়া ব্যক্তি হিসেবে এটি ছিল জীবনবোধ সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

প্রবাসে বসবাসকারী সোমালি এমন কোনও গল্পকার বা ঔপন্যাসিক কি আছেন, আপনি যাদেরকে সত্যিই প্রশংসা করেন?

হাসান গেদি সন্তুর প্রবাসী সোমালিদের সম্পর্কে বিশেষ করে তার উপন্যাস ‘ইয়ুথ অফ গড’ -এ সুন্দরভাবে লিখেছেন। মোহাম্মদ আবদুল করিম আলীর ‘অ্যাংরি কুইয়ার সোমালি বয়’ আমার পঠন তালিকায় শীর্ষে আছে।

আপনি একজন সোমালি হিসাবে কী পছন্দ করেন?

আমাদের বৈশ্বিক ও মৌখিক ইতিহাস; আমাদের অতীত যা বনের কাহিনী আর অ্যাডভ্যাঞ্চারে পরিপূর্ণ। আর এসবের মধ্যে রয়েছে নারী-পুরুষদের সবার কাহিনী।

নিজের সেরা সৃষ্টি ‘দ্য ফরচুন ম্যান’য়ের সাথে লেখক নাদিফা মোহামেদ

মাহমুদা আকতার: কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/