আমাদের কন্যারা ভালো নেই

হোমায়রা খাতুন

হোমায়রা হুমা

আন্তর্জাতিক কন্যা দিবস ২৬ সেপ্টেম্বর। অনেকটা যেন চুপিসারেই চলে গেলো দিনটি। ওইদিনের সকল দৈনিক পত্রিকা, টিভি কিংবা অনলাইন মিডিয়ার কোথাও  দিবসের ব্যাপারে কোনো টু শব্দটি করেনি কেউ। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কোনো বাণী নেই, নেই  কেন জানিনা। এ দিবসটি কি তবে গুরুত্ব হারিয়েছে? কন্যারা কেন অবহেলিত হয়েছে চারপাশের সংবাদমাধ্যম ও প্রচারে, কেন ?

আমাদের কন্যারা তো ভাল নেই। আঠারো মাস যাবত মহামারির নিষ্ঠুর আক্রমণে কন্যাদের একমাত্র আনন্দের ও সুস্হভাবে বেঁচে থাকার স্থান স্কুলগুলো বন্ধ ছিলো। ওরা গৃহবন্দী অবস্থায় ঘরে গুমড়ে মরেছে। তারাও শারীরিক,মানসিক, সামাজিক চাপ, পুষ্টিহীনতা ও মনোবৈকল্যের টানাপোড়নে দিনযাপন করেছে। কন্যাশিশুরা হত্যা,গুম, পাচার, ভয়ভীতি, প্রতিহিংসার শিকার, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানীর শিকার হয়েছে দেদারসে। করোনায় ২০২০ সালের এপ্রিল-মে মাসে জনগন কর্তৃক ত্রাণ বিতরণে চালডাল দেয়ার কথা বলে শিশুকন্যাকে ধর্ষণের মত জঘন্য খবরও দেখতে হয়েছে আমাদেরকে। গৃহবন্দী কন্যাশিশুরা গৃহেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এহেন অনিরাপত্তা ও দারিদ্রতা, অভাবের কারণে এ সময় কন্যারা এমন এক ভয়াবহ নিগৃহীত  ও অত্যাচারের শিকার হয়েছে, তা হচ্ছে বাল্যবিবাহ। ইউনিসেফ ও জাতিসংঘের নির্দেশে সরকার কিছুদিন পূর্বে সেপ্টেম্বর ২০২১ স্কুলগুলো খুলে দেয়ার পর বাল্যবিবাহের এই বিষয়টি আতংকজনকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কন্যাদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বলা হচ্ছে ২৩% প্রাইমারী ক্লাস ও ৩৩% সেকেন্ডারি ক্লাসের কন্যারা স্কুলে অনুপস্থিত। মনে করা হচ্ছে তারা বাল্য বিবাহের শিকার ও শিশুশ্রমে নিযুক্ত হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, এই করোনা মহামারির সময়ে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন সুবিধাদি বলবৎ ছিল, এছাড়া জেলা শিক্ষা অফিসার, ইউএনও তো ছুটিতে ছিলেন না, তারাও বেতনভাতা নিয়েছেন বটে। তাহলে এতো সংখ্যক ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার যে হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কিছুই জানেন না? তারা কেন ছাত্রছাত্রীদেরকে মনিটরিংয়ে রাখেননি? স্কুলের শিক্ষকরাও এই দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। এলাকা, পাড়ামহল্লা, প্রতিবেশীদের কেউ কি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?  কন্যাদের রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেননি কেন? করোনার মৃত্যুর চেয়ে বাল্যবিবাহের জীবনমৃত্যুর যন্ত্রণা কি কম? কে কাকে জবাবদিহি করবে? আমরা কি চোখ থাকিতে অন্ধ?  নাকি কন্যাদের শিক্ষার সুযোগ থেকে সরিয়ে গৃহবাসী করে প্রগতির পথকে থমকে দেয়ার হীন চক্রান্তকে বাস্তবায়নে সবাই চুপটি করে ছিলো? বিষয়টি বড়ই দুঃখজনক । কাজী সাহেবকে জবাবাদিহির আওতায় আনা হোক, কি করে জন্মসনদ ছাড়া কন্যাদের বাল্যবিবাহ পড়ানো হলো, কি করে? বিয়ে কি সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে? এদের ভবিষ্যত কি? এই বাল্যবিবাহের শিকার শিশুদের স্বামীদের বয়স কত, কি করে? এই শিশু কন্যাদেরকে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান জন্মদানরোধে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মীরা তাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে কি? কোনো তথ্য জরীপ কি শুরু হয়েছে? জানি কিছুই হয়নি। কারণ আজো এতো গভীর স্নেহ ভালবাসা কন্যাদের জন্য জন্মেনি আমাদের। জানি না এই মহামারীর  সময় কত শিশু তাদের নিকট আত্মীয়দের দ্বারা এবিউসের নিরব শিকার হয়েছে, কতজন সন্তান ধারণ করেছে, কতজনের অ্যাবারেশন করানো হয়েছে। কন্যা ভ্রুণ তো মাতৃজঠর থেকেই চরম অবহেলিত। জানিনা এসময় থেকে কতশত গর্ভের কন্যাকে হত্যা করা হয়েছে, কোনো কিছুরই কোনো পরিসংখ্যান নেই।

গৃহকর্মের কন্যারাও সঠিক  সময়ে পুষ্টিকর খাবার, বেতন, আরাম, বিনোদন, শিক্ষা, ঘুমআরামের সুযোগ, নিরাপত্তা পায় নি। পরিবারে অবস্থিত শিশুকন্যারাও নিরাপদে ছিল না, এখনো নেই। আত্মিয়স্বজন, গৃহশিক্ষক, ইসলামী শিক্ষক, ড্রাইভার,দারোয়ান,গৃহশ্রমিক, সৎপিতা সকলের টার্গেটে ছিল শিশু কন্যারাও। যেকোনো সময় লালসা ও প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে, হতে পারে এই নরপিশাচদের দ্বারা আমাদের অবুঝ শিশুরা।

রাষ্ট্রও কি কন্যাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? স্কুল, মাদ্রাসা, এতিমখানা সর্বত্র নজরদারির অভাব। বাল্যবিবাহ রোধ করার যে আইন কন্যাশিশুকে রক্ষা করতে পারতো-সেখানেও রাষ্ট্র আইন শিথিল করে বাল্যবিবাহকে তড়াণ্বিত করেছে বৈকি। সেখানে উল্লেখ আছে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মা-বাবা যদি মনে করেন ১৪ বছরেই বিবাহ দিতে পারেন। এমন মোক্ষম  সুযোগ পেলে বাল্যবিবাহ কি আর থেমে থাকে?

গত ২৬সেপ্টেম্বর '২১ প্রথম আলোর এক সংবাদ এমন যে, সরকারের উচ্চমহল থেকে বলা হচ্ছে, ‘১৮ বছরে কি শিশু হয়? এটিকে বদলাতে হবে। কারণ, কিশোর অপরাধীকে শাস্তি দিতে জেলে ঢুকানো যাচ্ছে না, পাঠাতে হচ্ছে সংশোধনাগারে। তাই ১৮ বছরটিই দায়ী। অপরাধ রোধ ও বন্ধ করার উপায় নেই, শাস্তি প্রদানের জন্য শিশু বিবেচনায় বয়স কমাতে হবে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রূপকাররা কন্যাদের কথা ভাবলেন না? বয়স কমালে বাল্যবিবাহ কি হারে বাড়বে? তাছাড়া এ শিশু বয়স নির্ধারণ করেছে ইউনিসেফ। সরকার কি কমাতে পারবে? আসলে কন্যাশিশুদের  বিপদ
আপদের কথা কেউ মনে রাখে না।

মাদক এসময়ে এক বিরাট আতংক হয়ে দেখা দিয়েছে। মাদকের সহজলভ্যতা, হিরোইজম, দেখে দেখে শেখা নারী ও শিশুর ওপর সহিংস আচরণ, উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন নির্যাতন  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্ণগ্রাফির  ছড়াছড়ি, শিশুদেরকে আদর্শ নৈতিকতা বিবর্জিত বিবেকহীন মানুষে পরিণত করছে। ফলে নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। পিতার অবৈধ অর্থের যথাচ্ছ ব্যবহার ধনী-গরিবের মধ্যবর্তী পার্থক্য স্পষ্ট হওয়ায় হীনমন্যতার পরষ্পর অপরাধে শিশু ও টিনএজদের মধ্যে প্রতিহিংসা জন্ম দিচ্ছে।  

যদিও শিশু জন্ম নিবন্ধনের সুব্যবস্থা, জীবন রক্ষাকারী টিকার ব্যবস্থাপনা সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনও সরকার যুগপোযোগী আইন প্রণিত করেছেন। বর্তমান সময়ে শিশুদেরকে রক্ষা করতে হলে মোটিভেশন কর্মসূচির ব্যাপক বাস্তবায়ন করা দরকার। বাল্যবিবাহ থেকে বাঁচার জন্য 'না' বলার সাহস তৈরি করতে হবে। শিশুদের গুড টাচ,ব্যাড টাচ্, কেউ শরীরে হাত দিলে মাকে বলা, যেকোনো বাজে পরিস্থিতিতে ৩৩৩-এ ফোন করা+সব জানানো এবং সাবধানতার বিষয়ে শিশুটিনএজ সন্তানদেরকে ব্যপক মোটিভেশন কর্মসুচির উদ্যোগ নিতে  হবে, নইলে আগামী প্রজন্ম মেধাশক্তি না হয়ে পেশীশক্তি কে অবলম্বন করে বেড়ে উঠবে।

কিন্তু যে শিক্ষক, মাদ্রাসার হুজুর, গৃহবান্ধব মুরুব্বী, শিশুদেরকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার দায় ও দায়িত্ব পাল করবেন বলে আমরা মানসিকভাবে মেনে নেই, আসলে তারাই তাদের ওপর সহিংসতার নোংরা নখরযুক্ত হাত বাড়ায়। তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়াবো?  কাকে ভরসা করবো? কোথায় আমার কন্যাকে পাঠাবো? ভয়,আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা চারপাশ ঘিরে থাকে। এতো অনিশ্চয়তা, এতো দুশ্চিন্তা কেন? পৃথিবী কি হায়নার দলে ভরে গেছে? কাউকে তো গ্যারান্টি দিয়ে ভালো বলা যায় না। কী দুঃসময় এখন! কন্যারা তাই কোথাও একদণ্ড ভালো নেই। কবে ভালো হবে, আদৌ ভাল হবে কি?

হোমায়রা হুমা: হোমায়রা হুমা: কবি, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/