শাহলা আহমদের গল্প ‘ময়না মুনিয়ার স্বপ্ন’

শাহলা আহমেদ

ময়না মুনিয়ার স্বপ্ন

পথ হারানো  ছয় সাত বছরের ছোট্ট ত্রকটি  মেয়ে ভীরু ভীরু চোখে হাটিহাটি পায়ে, পিচঢালা পথে হোটচ খেতে খেতে, অজানা শহরে উঠে আসে। পথঘাট লোকজন সবই তার অচেনা। ভীষণ ক্ষুধার্ত, ভীতিগ্রস্ত মেয়েটির চোখে পরে খাবারের দোকান,সাহস করে খাবারের জন্যে হাত বাড়ালো।
-এই সর এখান থেকে। দোকানে বসা লোকটা খেঁকিয়ে উঠলো।ভ্যাবাচিকা খেয়ে মেয়েটি একপাশে সরে পরে। হঠাৎ খিলখিল হাসির শব্দে চমকে উঠে,পিছন ফিরে দেখে ওরই বয়সী একদল ছেলেমেয়ে হুরহুর করে মস্ত বড় এক দালান থেকে বেরিয়ে আসছে। সবার পরনে একই রকম জামাকাপড়। ওর পরনে শুধু একখানা হাফপ্যান্ট, খুব লজ্জা লাগছিল। যদিত্ত ওর দিকে ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওরা কিছু একটা খাচ্ছিল শেষ না করেই ছুড়ে ফেলে দিল। ফেলে দেওয়া খাবার টা তাড়াতাড়ি তুলে নিলো, প্রচণ্ড ক্ষিদে যে পেট চৌ চৌ করছে।
-ইশ এটা নোংরা খেওনা। মেয়েটা ছোট্ট একটা বিস্কুটের প্যাকেট ওর হাতে দিয়ে গাড়িতে উঠে পরলো।
ওই সাদা রং এর বিশাল স্কুলটা ওকে চুম্বকের মতন টানে। একটি বারের জন্যে হলে ও ভিতরে যেতে চায়-জায়গ টা ওর খুব পছন্দ তাই  খোলা আকাশের নিচে ওই  ফুটপাথেই থাকা শুরু করে। পরনের প্যান্ট ছাড়া আর কোন সম্বল নেই তাই চুরির কোনও ভয় নেই। এক সময় স্কুলের দারোয়ান আর ওই বাঁজখাই দোকানির কাছে ও খুব প্রিয় হয়ে উঠে,ওরা খুব আদর করে,প্রত্যকদিনই কিছু না কিছু খেতে দেয়। একদিন দারোয়ান চাচার কাছে আবদার করে বসলো স্কুলের ভিতরে যেতে চায়, দেখতে চায় ওই বাচ্চা গুলো ওখানে কি করে। দারোয়ান চাচা প্রথমে রাজি না হলেও পরে সুযোগ বুঝে একদিন ওকে নিয়ে যায়। অবাক বিস্ময়ে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখলো কী সবুজ ঘাসে বিশাল মাঠ, ফুলের বাগান, ছেলে মেয়েরা ওই মাঠে খেলাধূলা করে। দারোয়ান চাচা ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো পুরো স্কুলটা। ওর দুচোখে বিস্ময়। ছেলে মেয়েরা ক্লাশ করছে, খুব সুন্দর শাড়ি পরিহিত একজন মহিলা ক্লাস নিচ্ছে। ওর ও ভীষণ ইচ্ছে হয় ক্লাসে গিয়ে বসতে, বই পড়তে। দারোয়ান চাচা বলে এখানে বড়লোকের বাচ্চারা পড়ে, অনেক টাকা দিতে হয়। তাই তো, ও কোথায় এত টাকা পাবে?

ঢং ঢং ঘন্টা বেজে উঠলো…। হুরহুর করে ওরা ক্লাস থেকে বেড়িয়ে ত্রলো। ওকে দেখতে পেয়ে ওরা খুশিতে লাফিয়ে উঠে। রাতে হাল্কা শীত পরেছে দেখে চাচা একটা লম্বাহাতা ফুল তোলা জামা ও একটা প্যান্ট চাদর কিনে দিয়েছিল। হাতমুখ ধুয়ে ওই জামাটা পরে আজ স্কুলে এলো। গায়ে জামা দেখে ওরা খুব খুশি।
-এই, তোমার নাম কি? ও ফ্যালফ্যাল করে থাকিয়ে থাকে, তাই তো কি ওর নাম?
কেউ বলে-এই এদিকে আয়।
কেউ ডাক দেয়, এই পিচ্চি…
-তুমি কোথায় থাকো? তোমার মা বাবা, ওরা কোথায়?

ওতো নিজেই জানে না। কেউ বলে ওকে জন্ম দিয়ে না কি ওর মা মারা যায়, রাস্তা রাস্তায় ও বড় হয়ে উঠেছে। আজ থেকে তোমার নাম ময়না। ও ফিক্ করে হেসে উঠে। ফুরুৎ ফুরুৎ করে ছুটাছুটি করো তাই তোমার নাম ময়না’। ওদের মধ্যে একজন ওকে আদর করে ডাকলো তুমি ‘ময়না মুনিয়া’ আমার পাখির নাম। নামটা ওর খুব পছন্দ হল। ময়না মুনিয়া ধীরে ধীরে সবার প্রিয় হয়ে উঠে। সবাই ওকে খুব স্নেহের চোখে দেখে, টিচাররা  ওকে দেখলে মিষ্টি হাসি দেয়। আস্তে আস্তে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শিখে ফেলেছে। সারাদিনই স্কুলে ঘুর ঘুর করে, দাইমা ওকে ভীষণ আদর করে। দাইকে ও মা বলে ডাকে। নিজের না দেখা মা কে খুঁজে পায় দাইমার  মাঝে। ইদানিং দারোয়ান চাচা বেশ কড়া শাসন করে, বড় হয়েছিস সাবধানে চলিস, কেউ ডাকলে চট করে যাবি না।

দোকানি চাচা বলে-ক্ষিদে পেলে দোকানে এসে খাওয়া নিয়ে যাবি। কারোর কাছে হাত পাতিস না। ও বোঝে না, কেন এত সাবধানতা। আজকাল রাত হলেই ভয় করে, ছোকরাগুলো ওর গায়ে হাত দিতে চায়, বাজে কথা বলে। দারোয়ান চাচা বেশ  আতঙ্কিত, চিন্তিত হয়ে পরেন। দিনে স্কুলের ভিতরেই চরকির মতন ঘুরে ফিরে, কিন্তু ছুটির পর যে ওকে তার আস্তানায় ফিরতে হয়। নির্জন রাতটা কাটাতে হয় ওই খোলা ফুটপাথে। কি করবে ভেবে পায় না বেচারা, নিজ পরিবারেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়, বেশ বড় সংসার। ফুটপাথের বসবাসকারী বাসিন্দাদের অনুরোধ করে মেয়েটাকে দেখে রাখতে, ওরা কতটুকুই বা সামলে রাখবে, বখাটেরা চারিদিকে ঘুরঘুর  করে। দারোয়ান চাচা স্কুলের দাইমাকে একদিন বলে বসলো-‘মেয়েটাকে নিয়ে আমি বেশ চিন্তিত, দুই কুলে কেউ নাই ওর, দিন দিন বড় হচ্ছে। বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছে। কেউ যদি ওর দায়িত্ব নিতো।’ দাইমা সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো -আমার তো কেউ নেই দূকুলে, ওতো আমাকে মা বলেই ডাকে, আজ থেকে ও আমার মেয়ে।
দাইমা ময়না কে পরম আদরে জড়িয়ে ধরলো। চোখে আনন্দ অশ্রু, আর ময়নার চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক্ করে উঠলো।
-আমি স্কুলে যেতে চাই, বই পড়তে চাই। ওদের মতন জামাকাপড় পড়ে ক্লাসে বসতে চাই, আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে মা ?
দাইমার কাছে ময়না মুনিয়ার ছোট্ট একটা আবদার -দিবে তো মা?
ভবঘুরে ফুটফুটে মেয়েটির একটা ব্যবস্থা করতে পেরে দারোয়ান চাচা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন । এই হতভাগা ছিন্নমূল শিশুগুলো একসময় অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে, বাধ্য করা হয় অসামজিক কাজে লিপ্ত হতে। মুনিয়া ভাগ্যবতী বটে। অচেনা শহরে অকৃত্রিম  ভালোবাসার জোয়ারে ভাসমান ময়না মুনিয়ার আকাক্ষিত স্বপ্ন  আজ ওর দুয়ারে।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/