সম্প্রীতির বিরল দৃষ্টান্ত: একই আঙিনায় মসজিদ আর মন্দির

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত হয়ে গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছে দুটি উপাসনালয়

লালমনিরহাট থেকে হাসানুজ্জামান হাসান

লালমনিরহাট জেলা শহরের কালীবাড়ি এলাকায় একই আঙিনায় গড়ে উঠেছে পুরান বাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ি সার্বজনীন মন্দির। প্রতিদিন এ মসজিদে যেমন মুসল্লিরা নামাজ আদায় করছেন তেমনি মন্দিরে চলছে ভক্তদের পূজার্চনা। দুর্গাপূজায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশ ঝাকজমকভাবে তাদের ধর্মীয় উৎসব পালন করছেন।

এক পাশে ধূপকাঠি, অন্য পাশে আতরের সুঘ্রাণ। এক পাশে উলুধ্বনি, অন্য পাশে চলছে জিকির। এভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যুগ যুগ ধরে দণ্ডায়মান পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয়।

স্থানীয়রা জানান, ১৮৩৬ সালে কালী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় লালমনিরহাট শহরে কালীবাড়ী এলাকার পুরান বাজার এলাকায় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ধর্মপ্রাণ মুসলমান ব্যবসায়ীরা নামাজ করার জন্য তার পাশেই একটি ছোট ঘর তোলেন। আর সেটির নামকরণও করা হয় পুরান বাজার জামে মসজিদ হিসেবে। ওই সময় থেকে এক উঠানে চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়ের কাজ। পূজা শুরুর আগে মসজিদ ও মন্দির কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নেন। এ পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মন্দির ও মসজিদ দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে সাধারণ মানুষ। এমনকি কয়েক দেশের রাষ্ট্রদূতও এই দুটি উপাসনালয় পরিদর্শন করেছেন।

জানা গেছে, আজানের সময় থেকে নামাজের প্রথম জামায়াত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের মাইক, ঢাক-ঢোলসহ যাবতীয় শব্দ বন্ধ থাকে। নামাজের প্রথম জামায়াত শেষ হলে মন্দিরের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। এখানে কোনো বিশৃঙ্খলাও হয় না। শালীনতা বজায় রেখে একই উঠানে দীর্ঘ দিন বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন উভয় ধর্মের মানুষ।

ওই এলাকায় ঘুরতে আসা কয়েকজন জানান, লালমনিরহাটে ধর্মীয় সম্প্রীতির এটি একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই যুগ যুগ ধরে এ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ধর্মীয় উৎসব পালন করছেন তারা। সত্যি এটি আমাদের জন্য অনেক বড় গর্বের বিষয়।

পুরান বাজার জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ঐতিহ্যবাহী পুরান বাজার মসজিদের পাশেই একসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠান। মসজিদের আগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবুও এখানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণি পেশার মানুষ স্বাধীনভাবে ঘুরতে আসে। আমরা তাদের সব কাজে সহযোগিতা করি। তারাও আমাদের সহযোগিতা করেন। নামাজের সময় মন্দিরের ঢাক-ঢোল বন্ধ রাখা হয়।  কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই যুগ যুগ ধরে চলছে এ সম্প্রীতির বন্ধন।

কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী মন্দিরের সভাপতি ও প্রধান পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী জানান, ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এলাকার নামকরণও করা হয় কালীবাড়ী। পরে এখানে বাজার গড়ে উঠলে বাজারের ব্যবসায়ী ও শহরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মন্দিরের পাশেই প্রতিষ্ঠা করেন পুরান বাজার জামে মসজিদ। সেই থেকে এক উঠানে চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়ের কার্যক্রম। সামান্য বিশৃঙ্খলাও হয় না এখানে। জন্মের পর থেকে এভাবে চলতে দেখছেন তিনি।

এদিকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ ও মন্দির প্রাঙ্গণ দেখতে সোমবার (১১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আসেন ঢাকাস্থ নেপাল দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন (উপপ্রধান মিশন) মি. কুমার রাই ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য।

রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য বলেন, এটা আমাদের জন্য একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। পারস্পরিক সহযোগিতায় ধর্মীয় আচার পালন করে আসছেন স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মানুষ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বন্ধন বলে দেয় বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা মুসলিমের সঙ্গে মিলে-মিশে রয়েছে। তাই সবাইকে অনুরোধ করছি, এসব বেশি বেশি প্রচার করে বাইরের দেশগুলোকে জানান দিতে হবে। এতে সারা বিশ্বের মানুষ দুই ধর্মের মেলবন্ধনের এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সম্পর্কে জানতে পারবে।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/