যে কারণে আজও লজ্জায় কুঁকড়ে থাকে মীর জাফরের বংশধরেরা

মাহমুদা আকতার

মাহমুদা আকতার

ফেসবুক নিয়ে নানা জনে নানা অভিমত প্রকাশ করে থাকেন, যার বেশিরভাগই নেতিবাচক। এর কারণও আছে। ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা অঘটনের জন্ম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অনেক সময় বিরোধ, কুৎসা রটনা কিংবা শত্রুতা তৈরিতেও রসদ জুড়িয়ে থাকে এই মাধ্যমটি। যদিও আমি এই সামাজিক মাধ্যমটিকে পছন্দ করে থাকি নানা কারণে। কথায় বলে-যে যেমন তার কর্ম তেমনই হবে। অর্থাৎ একজন ভালো মানুষের পোস্ট পড়ে লোকজন কমবেশি উৎসাহিত হয়ে থাকেন, যদিও তাদের সংখ্যা খুবই কম। আমি আমার বন্ধুদের পোস্ট থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই, নতুন কিছু লেখার আইডিয়াও পাই কখনও কখনও।

আজ সকালেই একজনের পোস্ট পড়ে খুব ভালো লাগলো। তার স্ট্যাটাসের মূল কথা হচ্ছে-‘মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মধ্যে। আপনার সৎ কর্ম যেমন মানুষ মনে রাখবে তেমন অসৎ কর্মও মনে রাখবে।’ আর তার পোস্টটি আমার মনে হচ্ছে- ‘কেবল সততার সঙ্গে বেঁচে থাকই নয়, ভালো চিন্তা করাও কিন্তু সওয়াবের কাজ’। যে কারণে বোখারি শরিফের এক হাদিসে বলা হয়েছে-ইন্না মাল আমানু বিন নিয়্যাত। অর্থাৎ প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।

কারো কারো পোস্ট থেকে নতুন নতুন তথ্যও পাই। গতকাল অর্থাৎ বুধবার এক ফেসবুক বন্ধুর পোস্ট পড়ে জানলাম বাংলার ইতিহাসের কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকে লোকজন এখনও কতটা ঘৃণা করে। যে কারণে তার বংশধরের এখনও মানুষের সামনে আসতে লজ্জা পায়, তার পরিচয় দিতে চায় না। আসামে বসবাসকারী ওই ইউজার তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘এটা মীর জাফরের কবর। বিশ্বাস ঘাতকের জন্য অবহেলিত। আমি কবর দৰ্শন করে আমার গাইডকে বললাম তার কোনো বংশধর এখনে আছে নাকি=? সে বললো আছে। সে আমাকে নিয়ে গেলো ৭০০ মিটার দুরে জাফরাগঞ্জ। রিটায়ার স্কুল শিক্ষক সে মীর জাফরের ৯ম প্ৰজন্ম বংশ। অনেক বলার পর সামনে এলো। আমি কিছু বলার আগেই তিনি শুরু করলেন। বললেন-আমরা লজ্জায় বাইরে বের হইনা আমাদের পূৰ্বপুরুষ যে কাজ করেছে আমাদের মেয়ে অন্য লোকে বিয়ে করেনা। আমাদের প্ৰায় বেশিরভাগ লোক লজ্জায় পরিচয় লুকিয়ে দূরে চলে গেছে। এই কলঙ্কিত বংশে জন্ম নেওয়াই আমাদের পাপ। আরো বহু কথা বললেন। আমাদের আজো অনুতাপ নবাব সিরাজকে ক্ষমতাচ্যূত ও হত্যা করে আমাদের পূৰ্বপ্রজন্ম খুবই অন্যায় করেছে।’

পাঠকদের সুবিধার্থে এবার মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কিছু তথ্য নিচে তুলে ধরছি।

মীর জাফরের পুরো নাম মীর জাফর আলী খান। তিনি ছিলেন আরব বংশোদ্ভূত এবং তার বাবার নাম সৈয়দ আহমদ নাজাফী। তিনি একজন ভাগ্যান্বেষী হিসেবে ভারতে আসেন। নবাব আলীবর্দী খান তার বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানমকে জাফর আলীর সাথে বিয়ে দিয়ে তাকে বখশী (নবাবের পরবর্তী পদমর্যাদা) পদে অভিষিক্ত করেন। তারে কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সেনাপতি পদ দেন আলীবর্দী খান। নবাবের মৃত্যুর পর বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন তার দৌহিত্র ২৩ বছরের তরুণ সিরাজউদ্দৌলা। কূটকৌশলে অপটু সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে বাংলার মসনদে বসার ষড়যন্ত্র শুরু করেন মীর জাফর। অবশ্য এর আগে তিনি রাজমহলের ফৌজদার আতাউল্যার যোগসাজসে আলীবর্দীকে ক্ষমতাচ্যূত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন।

মীরজাফরের কূটবুদ্ধির এবং উচ্চাভিলাষী কর্মকাণ্ডের কারণে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়। আলীবর্দীর মৃত্যুর পর মীর জাফর পুর্নিয়ার শওকত জংকে বাংলা আক্রমণ করতে উৎসাহিত করেন। অন্যান্য কুচক্রীদের সাথে মিলিত হয়ে মীরজাফর শওকত জংকে উক্ত কাজে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকেও ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাহদারির ফরমান সংগ্রহের গোপন চেষ্টার প্রয়াস পান। কিন্তু ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে সিরাজ মীরজাফরকে বখশীর পদ থেকে অপসারণ করে মীরমদনকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন।

ইংরেজরা যখন স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে অপসারণ করে একজন ক্রীড়নককে বাংলার মসনদে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কলকাতায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, ধনকুবের জগৎ শেঠ ভ্রাতৃদ্বয় এবং প্রাক্তন দীউয়ান রায় দুর্লভের সাথে সিরাজউদ্দৌলাকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে মীরজাফরও জড়িত ছিলেন। ১৭৫৭ সালের এপ্রিলের শেষে নাগাদ ইংরেজরা সিরাজের উৎখাতের জন্য মীরজাফরের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস লাভ করে। ওই বছর ১ মে কলকাতা কাউন্সিল শর্ত সাপেক্ষে মীরজাফরকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মসনদে বসানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক গোপন চুক্তি সম্পাদনে সম্মত হয়। কাসিমবাজার ফ্যাক্টরির প্রধান উইলিয়ম ওয়াটস ষড়যন্ত্র পাকাপাকি করেন। ৫ জুন তিনি গোপনে মীরজাফরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর নেন এবং তার আনুগত্যের স্বীকৃতি লাভ করেন।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নিহত হন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমদন। তখন নিরূপায় সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে তার তাঁবুতে ডেকে আনেন এবং তার আনুগত্য কামনা করেন। তখন পবিত্র কোরআন মাথায় রেখে নবাব সিরাজের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন মীর জাফর। তবে শর্ত দেন- নওয়াবকে সেদিনের যুদ্ধ বন্ধ ঘোষণা করে সেনাবাহিনীকে শিবিরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিতে হবে, যাতে পরের দিন মীরজাফরের সেনাপতিত্বে তারা নতুন উদ্যমে আবার যুদ্ধ শুরু করতে পারে। সরল বিশ্বাসে তার সেই শর্ত মেনে নেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। অন্যদিকে সিরাজউদ্দৌলার তাঁবু থেকে নিজ সৈন্যদের মাঝে ফিরে এসেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন মীর জাফর। তিনি লর্ড ক্লাইভকে নবাবের অসহায়ত্বের খবর পৌঁছে দেন এবং তৎক্ষণাৎ নবাবের বাহিনী ও তার শিবির ঘেরাও করর পরামর্শ দেন। আর এভাবে এক জঘন্য ষড়যন্ত্রের মুখে পরাজিত হন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তিনি বন্দি হন। বন্দিদশায় মীরজাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন মোহাম্মদী বেগ ।

২৯ জুন ক্লাইভ সিরাজউদ্দৌলার প্রাসাদ হীরাঝিলে মীরজাফরের সঙ্গে মিলিত হন। দেশীয় রাজন্যবর্গ ও সভাসদদের উপস্থিতিতে তিনি মীরজাফরের মসনদে বসান এবং অনুরূপভাবে সভাসদরাও তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। কিন্তু তার এই সাফল্য ছিলো সাময়িক। কেননা তিনি ছিলেন নামমাত্র নবাব, প্রকৃত ক্ষমতা ছিলো ইংরেজদের হাতে। আর তাদের আর্থিক দাবি মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় মীরজাফরকে সরিয়ে তার মেয়ে জামাতা মীর কাসিমকে নবাবি দেন ইংরেজরা। কিন্তু সেটাও অল্প কিছুদিনের জন্য। মীর কাসিম স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করতে চাইলে তাকে সরিয়ে ১৭৬৩ সালে ফের মীরজাফরকে পুনরায় মসনদে বসায় এবং তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে থাকে। কিন্তু এর মাত্র দু বছর পর দুরারোগ্য কুষ্ঠব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান মীরজাফর।

তার মৃত্যু নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। অসুস্থ অবস্থায় নিদারূন অর্থকষ্টে পড়েন মীরজাফর। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হওয়ায় নিকটজনেরাও তাকে ছেড়ে যায়। জানা যায়-রোগের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে এক তান্ত্রিকের পরামর্শে হিন্দু দেবী মূর্তির পা ধুয়া পানি খাওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এসম্পর্কে ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় লিখেছেন, ‘ক্রমে অন্তিম সময় উপস্থিত হইলে, হিজরি ১১৭৮ অব্দের ১৪ শাবান (১৭৬৫ খ্রি. অব্দের জানুয়ারি মাসে) বৃহস্পতিবার তিনি কুষ্ঠরোগে ৭৪ বছর বয়সে পরলোকগত হন। তাহার মৃত্যুর পূর্বে নন্দকুমার কিরিটেশ্বরীর চরণামৃত আনাইয়া তাহার মুখে প্রদান করাইয়াছিলেন এবং তাহাই তাহার শেষ জলপান।’

শুধু মীরজাফর নন, পলাশির যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী সকলের পরিণাম অনেকটা একই রকম ছিলো। লর্ড ক্লাইভ নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। বুড়িগঙ্গার জলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছিল আরেক ষড়যন্ত্রকারী ঘসেটি বেগমকে। মীরজাফরের ছেলে মীরনের মৃত্যু হয়েছিল ইংরেজদের নির্দেশে। সিরাজের হত্যাকারী মুহাম্মদী বেগ পাগল হয়ে কূপে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ধনকুবের জগতশেঠকে অত্যুচ্চ দুর্গশিখর থেকে গঙ্গারগর্ভে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছিল। আর মীরজাফরের জামাতা মীর কাসেম অত্যন্ত হীন অবস্থায় অজ্ঞাতবাসে নিকৃষ্টভাবে মারা যান।

আমরা অনেকেই মনে করে থাকি অন্যায়কারী ও লোভীদের কোনও শাস্তি হয় না, তারা দুনিয়ায় মহাসুখেই দিন কাটান। কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। মীরজাফরের পরিণতি দেখলে আমাদের অন্তত একটা বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদ মনে আসে- ‘পাপী মরে দশ ঘর নিয়ে’। নইলে মীরজাফরের মৃত্যুর ২৫০ বছরের বেশি সময় পরও কেন জনসমুখে আসতে লজ্জা পায় তার বংশধরেরা? কেন তারা মানব সমাজে এখনও ঘৃণার পাত্র হয়ে আছে?

মীর জাফরের সমাধি

তাই সমাজে যারা সততার সাথে জীবনযাপন করছেন তাদের নিয়ে হাতাশ হবেন না, বিদ্রুপ করবেন না। আর্থিক সফলতাই জীবনের সব কিছু নয়। সুস্থ স্বাভাবিক ও সৎভাবে বেঁচে থাকা আল্লাহর অনেক বড় নিয়ামত। সবার এই নিয়ামত পাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। তাই যারা এই সুযোগ পেয়েছেন তারা সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। সততার সাথে বেঁচে থাকার চেষ্টা করুন এবং আশপাশের সবার জন্য মঙ্গল কামনা করুন। কোনও দুশ্চিন্তা না করে সবসময় ভালো চিন্তা করার চেষ্টা করুন। কেননা ভালো চিন্তা করাও কিন্তু সওয়াবের কাজ। আর যে সব নির্লোভ মানুষ এই সময়ে এসেও সৎভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন তাদের বেশি বেশি উৎসাহিত করুন। কারণ চাকচিক্যময়, রঙ তামাশার এই আধুনিক সময়ে লোভ-লালসা নিবৃত করে সততার সঙ্গে সাধারণভাবে বেঁচে থাকা অনেক বড় ধৈর্য্য আর সাধনার বিষয়। এছাড়া যুগে যুগে সৎ থাকার চেষ্টা করাও কিন্তু অনেক বড় ইবাদত।

মাহমুদা আকতার: সাংবাদিক, কথাশিল্পী ও অনুবাদক। প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/