বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনামলের সাড়ে তিন বছর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মফিদা আকবর

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাংলাদেশের স্থপতি। বাংলাদেশের রূপকার। তাঁরই আহ্বানে এ দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতার জন্য এত রক্ত কোনো দেশ দেয়নি, যা বাংলার মানুষ দিয়েছে। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা শুধু স্বাধীনতাকামী নিরীহ ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তারা লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রমকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে।  নির্যাতন করেছে। আমাদের দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও স্থাপনা তারা ধ্বংস করেছে বিনা দ্বিধায়। এ দেশ স্বাধীনতার প্রাক্কালে যখন পাকিস্তানীরা বুঝতে পারলো যে, দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছেÑ  তারা আর কুলিয়ে উঠতে পারবে না। তখন এ দেশকে মেধাহীন করার জন্য চৌদ্দ ডিসেম্বর আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের একযোগে মেরে ফেলা হলো।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের শেষ জনসভা ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ। সেই ঐতিহাসিক জনসভায় তিনি বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন পাকিস্তানের দ্বারা বাংলার সম্পদ ধ্বংস করা এবং যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশের বিপন্ন অর্থনীতির বিষয়টি। বঙ্গবন্ধু বলেন, … আপনাদের মনে আছে, পাকিস্তানীরা যাওয়ার পূর্বে ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে, ১৬ই ডিসেম্বরের আগে কারফিউ দিয়ে ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গায় আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই বাংলা স্বাধীনতা পেলেও স্বাধীনতা রক্ষা করতে যাতে না পারে না। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেলেও একটি ধ্বংসযজ্ঞ দেশ পেলো। এ ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। আমাদের গোল্ড রিজার্ভ ছিল না। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না। আমরা যখন ক্ষমতায় এলাম দেশের ভার নিলাম, তখন দেশের রাস্তাঘাট যে অবস্থায় পেলাম, তাকে রিপেয়ার করবার চেষ্টা করলাম। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রায় সবকিছু ধ্বংস করে গিয়েছিল। শুধু কাগজের নোট দিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লোকের সরকার শুরু করলাম। পুলিশ বাহিনীর রাজারবাগ জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই খারাপ অবস্থা থেকে ভালো করতে কি করি নাই? আমরা জাতীয় সরকার গঠন করলাম। আমাদের এখানে জাতীয় সরকার ছিল না। আমাদের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট ছিল না, বৈদেশিক ডিপার্টমেন্ট ছিল না। প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট ছিল না। তার মধ্যে আমাদের জাতীয় সরকার গঠন করতে হলো। পোর্টগুলোকে অচল থেকে সচল করতে হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে ২২ কোটি মণ খাবার এনে বাংলার গ্রামে গ্রামে দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে হয়েছে। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানীরা আমার সম্পদ এক পয়সাও দিল না। আমার গোল্ড রিজার্ভের কোন অংশ আমাকে দিল না। একখানা জাহাজও আমাকে দিল না। একখানা প্লেনও আমাকে দিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ আমাকে এক পয়সাও দিল না। এবং যাওয়ার বেলায় পোর্ট ধ্বংস করলো, রাস্তা, কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শত জটিলতা, স্বাধীনতা বিরোধীদের নাশকতামূলক কার্যকলাপ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দেন। অথচ কুচক্রীরা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল সম্পর্কে জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করে আসছে। তবে বর্তমানে প্রমাণিত যে, বঙ্গবন্ধুর সরকার জাতির সার্বিক ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন তা অতিক্রম করা হয়তো আজও সম্ভব হয়নি।
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেই কালবিলম্ব না করে দেশ গড়ার কাজে লেগে যান। স্বদেশ প্র্যাবর্তনের দুইদিন পর অর্থাৎ ১৩ই জানুয়ারি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে অনুমোদিত হয় বাংলাদেশের পতাকার নকশা, জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’, রণসঙ্গীত ‘চল চল চল উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল।’ ডাক টিকেটের নকশা প্রণয়ন কমিটি গঠন, শহীদ মিনার পুনঃনির্মাণের অর্থ বরাদ্দ করেন। একইদিনে তিনি ১৩৭৮ সালের চৈত্র মাসের সকল খাজনা মওকুফ, অনতিবিলম্বে কৃষকের মধ্যে আড়াই কোটি টাকা ঋণ সরবরাহ, ৬ মাসের মধ্যে সারাদেশে টেলিযোগাযোগ পুনঃস্থাপন, রাজশাহী চিনিকলে উৎপাদনের ব্যবস্থা এবং ঢাকা-কুমিল্লা সরাসরি টেলিযোগাযোগ পুনঃস্থাপন, ঢাকা-কুমিল্লা সরাসরি টেলিযোগাযোগ পুনঃস্থাপনের ঘোষণা দেয়া হয়।
পুনর্গঠন ও অবকাঠামো নির্মাণ : সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে উৎপাদনের ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়। দেশে দুটি সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা সম্পূর্ণভাবে অকেজো করে যায় পাকিস্তানি পরাজিত শক্তি। বন্দর মুখে মাইন স্থাপন করা হয় এবং জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও রেল সেতুসহ ২১৯টি রেল সেতু, ২৭৪টি রোড ও সেতু যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৪০টি রেল লাইন ধ্বংস করে দেয়। ১০% রেল লাইন উপড়ানো ছিল। ৬৬টি ফেরি, ৫ হাজার ট্রাক ও ২৫০০টি বাস ধ্বংস করা হয়। আরও ধ্বংস করা হয় লক্ষ লক্ষ বাড়ি-ঘর। একটি বিমানও ছিল না। ছিল না একটি সমুদ্রগামী জাহাজ। ছিল না ব্যাংকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা বা স্বর্ণ মওজুদ। খাদ্য গুদাম ছিল খালি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু অতি দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনঃনির্মাণে যে সাফল্য অর্জন করেছিলেন সমগ্র বিশ্বের কাছে তা ছিল অকল্পনীয়।
শিক্ষা : স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশের প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। পরাজয়ের পূর্বে তারা এগুলোকে ধ্বংস করে বা জ্বালিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারি চাকরির মর্যাদা দেয়া হয়। ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক স্কুল স্থাপন ও প্রায় অর্ধ লক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রদের টিফিনের ব্যবস্থা, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নারী শিক্ষাকে অবৈতনিক, শিক্ষার উপকরণ বই, খাতা, পেন্সিল বিনামূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় উন্নীত করার লক্ষ্যে ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের গণমুখী সর্বজনীন শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন শুরু হয়। টেক্সট বুক বোর্ড গঠন, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। ব্যাপকভাবে ছাত্রবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কালা কানুন বাতিল করে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়। বাংলা একাডেমী পুনর্গঠন ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্তরে প্রচলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শিল্পকলা একাডেমী, সেন্সরশীপ ব্যতিত নাটক করার অধিকার এবং গণমাধ্যমে জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করার নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসমূহে ভর্তুকি মূল্যে ছাত্র-ছাত্রীদের খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করা হয়। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয় হতে শুরু করে প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত ছাত্রদের বিনামূল্যে শার্ট, প্যান্ট, কাগজ, বই, খাতা, কলম সরবরাহ করা হয়।
স্বাস্থ্য : সকল নাগরিকের সুচিকিৎসার জন্য প্রতি থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন কাজ শুরু হয়। ৩৬৫টি থানায় ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপিত হয় এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, নির্মাণ ও অস্থায়ী স্বাস্থ্য কর্মীদের স্থায়ী চাকরি দেয়া হয়। পরিবার পরিকল্পনা কার্যকর করার লক্ষ্যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সন্তানদানে সক্ষম দম্পতিদের জন্য রেজিস্ট্রেশন স্কিম চালু করা হয়। এ লক্ষ্যে টাঙ্গাইল, নোয়াখালী ও খুলনাতে পাইলট প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়। দুঃস্থ মহিলা ও শিশুদের মধ্যে বিনামূল্যে প্রোটিনযুক্ত খাবার বিতরণ করা হয় এবং মোট জনসংখ্যার প্রোটিনযুক্ত খাবার বিতরণ করা হয় এবং মোট জনসংখ্যার ৪৫% জনকে রেশন পদ্ধতির নেটওয়ার্কে আনা হয়। প্রত্যেক গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয়জলের জন্য বিনামূল্যে নলকূপ সরবরাহ করা হয়। নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করা এবং মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
কৃষি : কৃষিক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। বিদেশের কাছে খাদ্যের জন্য ভিক্ষা করা বা হাত পাতার চেয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্য বেশি মনোযোগী হয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর গ্রাম পর্যায়ে ২২ লক্ষের বেশি কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হয়। তাদের কৃষি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কৃষি বিষয়কে মৌল কাঠামো নির্মাণে সহায়তাদানের পাশাপাশি নামমাত্র মূল্যে এবং বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ, বীজ, সার, কীটনাশক ঔষধ সরবরাহ করা হয়। হ্রাসকৃত মূল্যে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প ও ২৯০০টি গভীর ও ৩০০০ অগভীর নলকূপ বসানো হয় ১৯৭৩ সালের মধ্যেই। ’৭২-এ বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে অধিক ফলনের জন্য ধানবীজ বিতরণ করা হয় ১৬,১২৫ টন, পাটবীজ ৪৫৪ টন ও গমবীজ ১,০৩৭ টন। এছাড়াও পাকিস্তানী আমলের ঋণগ্রস্ত কৃষকদের উপর জারি করা ১০ লক্ষের উপর সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করে তাদের সকল বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করা হয়। কৃষিপণ্য বিশেষ করে ধান, পাট, তামাক ও আখের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে ‘প্রাইম সাপোর্ট’ বা ন্যূনতম মূল্য বেঁধে দেয়া হয়। গরীব কৃষকদের রেশনের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের ছেলে- মেয়েদের বিনা বেতনে ও সরকারি খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পূর্বে ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা ছিল ৩৫ ভাগ। ঐ ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে খাস জমি প্রদানের ব্যবস্থা হয়। ১০০ বিঘা জমির সিলিং নির্ধারিত হয়। স্বাধীনতার সময় ৩০ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল। চাষি জমির এক-তৃতীয়াংশ ছিল অনাবাদী। বঙ্গবন্ধুর সরকার অনাবাদী জমির আবাদ ও খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য নানাভাবে কৃষকদের সাহায্য ও উৎসাহিত করেন। বঙ্গবন্ধু সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এদেশের কৃষি ও কৃষকদের সমস্যা সমাধানকল্পে অতি দ্রুত পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং গ্রামভিত্তিক বিভিন্ন খাত ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার অধীনে তিন ধরনের সেচ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। ১. শক্তিচালিত পাম্প, ২. গভীর নলকূপ, ৩. অগভীর নলকূল সেচ প্রকল্প। দেশে এই শক্তিচালিত পাম্প প্রকল্পের দ্রুত উন্নতি হয়। ১৯৬৮-’৬৯ সালে যেখানে পাম্পের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার সেখানে  ১৯৭৪-৭৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৬ হাজারে। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ১৯৭০ সালে ২৬ লক্ষ একর থেকে ১৯৭৫ সালে একরে উন্নীত হয়। স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য উৎপাদন বেড়ে যায়। ১৯৬৯-’৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৩-৭৪ সালে রাসায়নিক সার ৭৪%, পোকার ঔষধ ৪০%, উন্নত বীজ ব্যবহার ২৫% বৃদ্ধি পায়।
কৃষি গবেষণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বিশ্ব বাজারে রাসায়নিক সারের দাম বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও সে অনুসারে  বাংলাদেশে তা বৃদ্ধি করা হয়নি। ১৯৭২ সালে ইউরিয়া, পটাশ, টিএসপি সারের দাম মণপ্রতি ছিল মাত্র ২০ টাকা, ১৫ টাকা এবং ১০ টাকা।
শিল্প : শিল্প-কারখানা ক্ষেত্রে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে এবং এ দেশের মানুষকে কাজে লাগিয়ে কর্মক্ষম করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী, অবাঙালি শিল্পপতি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যুদ্ধে অনিবার্য পরাজয় বুঝতে পেরে শিল্পে নিয়োজিত চলতি মূলধন, মূল্যবান যন্ত্রাংশ এদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেয়। একইসাথে স্থায়ী সম্পদ কল-কারখানা মেশিনপত্র অকেজো কিংবা ধ্বংস করে রেখে যায়। তাছাড়া এসব শিল্প-কারখানায় বাঙালিদের চেয়ে অবাঙালিদের বেশি চাকরি ছিল। সেজন্য বাঙালিদের যোগ্য ও কর্মক্ষম করে তুলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সার্বিক অর্থেই সঙ্কটে পড়ে । সব শিল্প-কারখানা তখন অচল । যোগ্য পরিচালক, যোগ্য শ্রমিক,  প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং প্রযোজনীয় অর্থ সংকটে নিপতিত হয়। এরকম সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে অতি অল্পসময়ের মধ্যে এই ধ্বংসপ্রাপ্ত অচল শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরকারের তত্ত্বাবধানে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। আগের তুলনায় ’৭৩-এ চিনি, সূতা, বস্ত্র ও ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদির উৎপাদনে যে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গিয়েছিল এবং তা ১৯৭৪-’৭৫ সালে সেই প্রবণতা বজায় থাকে, উৎপাদন বাড়ে ১২%। মিলে তৈরি সূতা ও বস্ত্র বৃদ্ধি হয় এবং প্রথম ৯ মাসে ১১% এবং ৩%। এছাড়া কতিপয় দ্রব্যের উৎপাদন উৎসাহজনকভাবে বৃদ্ধি পায়, এর মধ্যে খাদ্যশস্য, নিউজপ্রিন্ট, চা, সাইকেল, বৈদ্যুতিক কেবলস্ ও তামার তার ইত্যাদি ছিল প্রধান।
দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি : বঙ্গবন্ধু  যখন দ্রুতগতিতে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে মরীয়া। দেশের মানুষদের একটু স্বস্তি দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন সে সময় কিছুসংখ্যক কুচক্রী মহল অসাধু চেষ্টা চালায়।  চোরা কারবারি এবং সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য অসহনীয় করে তুলে। অবশ্য ১৯৭৪ সালে বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায়ও মুদ্রাস্ফীতি তীব্র আকার ধারণ করে। যার প্রভাবে উন্নত বিশ্বসহ সকল দেশের দ্রব্যমূল্য অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। এই সুযোগটি সে সময়ের ব্যবসায়ীরা আরো কাজে লাগায়। ১৯৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৫ সালে আর্জেন্টিনায় সকল ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় ১১ গুণ, কোরিয়াতে তিনগুণ, ব্রিটেনে দ্বিগুণ। খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পায় আর্জেন্টিনায় ১০ গুণ, চিলিতে ৩০ গুণ, কোরিয়াতে তিনগুণ।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববাজারে গমের দাম ১৯৭২ সালের তুলনায় চারশ গুণ বৃদ্ধি পায়। থাইল্যান্ড ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে চাল বিক্রয় করতো প্রতি টন ১৩০ ডলার, তা ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬০০ ডলারে। স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত আমদানিকারক দেশ হিসাবে ১৯৭৪-’৭৫ সালে বাংলাদেশেও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। ১৯৭৪ সালের জুন হতে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধি পায়, জানুয়ারির পর থেকে মূল্য হ্রাস পায়। ঢাকায় ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে মোট সিদ্ধ চালের প্রতি সেরের মূল্য ছিল ৪ টাকা, অক্টোবরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ টাকা। তবে ফেব্রুয়ারি, জুনমাসে এই মূল্য কমে সের প্রতি ৬ টাকায় নেমে আসে। ১৪ই আগস্ট ’৭৫-এ এসে দাঁড়ায় ৩.৭৫ পয়সা। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই সময়ে ঢাকা শহরে চালসহ সকল প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম ক্রমেই হ্রাসের দিকে দেখা যায়।
বন্যা, আকাল, কুচক্রী মহলের বিশ্বাসঘাতকতা, ব্যাংক ডাকাতি, ব্যাংক লুট, আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা, অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টির অপচেষ্টার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু এগিয়ে যাচ্ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় পদক্ষেপে। ভাবতে অবাক লাগে যে, এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তিনি কাজগুলো গুছিয়ে নিয়েছিলেন। পুনর্গঠনের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তা জাপান, জার্মান, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্সের বেলায় ঘটেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঐসব দেশে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবুও তারা ৫ বছরের মধ্যে কোনো অতিরিক্ত দাবি-দাওয়া বরদাস্ত করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আমেরিকা ৫ বছর পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মচারীর বেতন বাড়ায়নি। রাশিয়া ও চীনের বিপ্লবের পর অনাহারে লাখ লাখ লোক মারা গেছে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু সকল প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে ১১ হাজার কোটি টাকার ধ্বংসস্তূপের পর আরো ১৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন স্তম্ভ দাঁড় করিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টের মধ্যে তিনি বাংলাদেশকে জাতিসংঘ সদস্যপদ, কমনওয়েলথ সদস্যপদ, ওআইসিসহ ১৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ, ২২১টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি, শিল্পোৎপাদন ও কৃষি উৎপাদন ভারসাম্য এনে দিয়েছিলেন। নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি দেখে বিশ্ব অবাক হয়েছে। ১৯৭৪-’৭৫ সালের বোরো মৌসুমে ২২ লাখ ৪৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয় যা ১৯৭৩-’৭৪ সালের চেয়ে ২৯ হাজার টন বেশি। এর আগে উৎপাদন হয় ৩৪ লাখ টন খাদ্যশস্য। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ডিসেম্বরে ঘোষণা দেবেন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এ সময়ই তার উপর পরিকল্পনা মোতাবেক চূড়ান্ত আঘাত হানা হয়।
স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশকে গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিনবছর সময় পেয়েছেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার অর্থনৈতিক কর্মকা-কে পরিচালিত করেছেন দুটি ভাগে।
প্রথমত : পুনার্বসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়ত : উন্নয়ন। এ সময়ের মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ভৈরব সেতুসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরি, ১৮৫১টি রেল ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগি, ৪০৬টি বাস, ৬০৫টি নৌযান ও ৩টি পুরোনো বিমান বন্দর চালু করে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিট জাতীয়করণ ও উৎপাদনক্ষম করে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রগতিশীল সংবিধান প্রণয়ন. মদ-জুয়া, হাউজি-ঘোড়দৌড়সহ সমস্ত ইসলাম বিরোধী কর্মকা- নিষিদ্ধকরণ, ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন ও মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, পবিত্র হজ্ব পালনে সরকারি অনুদান প্রদান, ওআইসি সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপে।
ভারত থেকে ফেরা ১ কোটি লোকের পুনর্বাসন ও দেশের অভ্যন্তরে ৩ কোটি ছিন্নমূল মানুষের জন্য খাদ্য সংস্থান, ৩ মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ফিরিয়ে নেয়া, মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ শহীদ পরিবারকে আর্থিক সাহায্য, ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের দায়িত্ব গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন, প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারি করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ প্রণয়ন, ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ও সরকারি কর্মকা-ে বাংলা ভাষা প্রচলন, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনসহ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মসজিদ পুনঃনির্মাণ, ইসলামী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, প্রতি থানা ও ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও হাসপাতাল নির্মাণ এবং অস্থায়ী স্বাস্থ্য কর্মীদের স্থায়ী চাকরির মর্যাদাদান, জাতীয় সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীসহ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জাতীয় মর্যাদায় পুনর্গঠন, কুমিল্লায় দেশের প্রথম সামরিক একাডেমী স্থাপন, পুলিশ, বিডিয়ার, আনসার ও বেসামরিক প্রশাসনের অবকাঠামো গড়ে তোলা, পাকিস্তানে আটক ৪ লাখ বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসিত করা, কয়েক লাখ পাকিস্তানীকে ফেরত পাঠানো, বাঙালি জাতি বা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি এবং জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় প্রথম ভাষণ দান, জাতিসংঘের সদস্যপদ ও দুই শতাধিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি এবং ফারাক্কার পানি বন্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৪ হাজার কিউসেক পানির ব্যবস্থা এসব কার্যক্রম ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের অনন্য সাফল্যের উদাহরণ।
 আমাদের আক্ষেপ ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকা-টি যদি সংঘটিত না হতো তাহলে আজকের বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে দৈন্যদশা, মলিন ভাবমূর্তি এবং সর্বক্ষেত্রে নতজানু চেহারাটা অবশ্যই আমাদের দেখতে হতো না।
মালয়েশিয়ার মাহাথির যদি পারেন সাম্রাজ্যবাদীদের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে নতুন সমৃদ্ধ মালয়েশিয়া গড়ে তুলতে, তা হলে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তি নিয়ে কেন সমৃদ্ধ বাংলা গড়ে তুলতে পারতেন না? কোন মানুষই ভুল-ক্রুটির ঊর্ধ্বে নয়Ñ ভুল সবার হয়।  যেকোন মানুষের সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও থাকে। বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থতা ছিল তাঁর চারপাশের চাটুকার আর কুচক্রী বেঈমানদের জন্য। এরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তাই রাতারাতি স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারেননি তিনি। অথচ বঙ্গবন্ধুর নীতি ও নেতৃত্বের গুণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি অসাম্প্রদায়িক শোষণ ও বঞ্চনা মুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়াত তাতে কোন সন্দেহই ছিল না।

পনেরো আগস্টের পরাশক্তি সেই অসীম সম্ভাবনাকেই নির্মম হাতে ধ্বংস করেছে। আর আজ আমাদের ভাবতে হয় বঙ্গবন্ধুর যদি ঘাতকের বুলেটের আঘাতে পঁচাত্তরে তাঁর জীবন বেঁচে গেলে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ কতটা আত্মপ্রত্যয় ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত’। এভাবে যদি মৃত্যু না হতো তাহলে কত আগেই না বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা, মুক্তির আস্বাদ পেতো। অনেক আগেই বাংলাদেশ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা হতো।

মফিদা আকবর

মফিদা আকবর: কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক ও সমালোচক।  লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮৫ টি।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/