পাকিস্তানের ভয়াবহ দিনগুলি

নূরহাসনা লতিফ

নূরহাসনা লতিফ

একাত্তরের সেই দিনগুলির কথা ভাবলে এখনো আমার গা শিউরে ওঠে।আমার বয়স তখন২১-২২। আমাকে কাটাতে হয়েছে কী বিশাল দুর্বিষহ দিন!পশ্চিম পাকিস্তান সে সময় ছিল আমাদেরও  ।জীবিকার তাগিদে পুর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানে যেতো। অন্যান্য প্রয়োজনীয়  কারণেও অনেকেই যেতো সেখানে । আসলে দেশতো একটাই। পুর্ব-পশ্চিম মিলেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা হতো। আমার স্বামী আব্দুল লতিফ মন্ডল    অংশগ্রহন করে  এই পরীক্ষায়। উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পায় প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা সেকশন অফিসার হিশেবে। তার কর্মস্থল ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রবেশনার প্রিয়ড কাটে করাচিতে।পরে সে জয়েন করে রাওয়াল পিণ্ডিতে প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েটে। আমিও ছিলাম পাকিস্তানে ওর সাথে। আমাদের বাসা ছিল ইসলামাবাদে।

এদিকে তখন শুরু হয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলন।পাকিস্তান আর্মিদের অত্যাচারে পুর্ব পাকিস্তান ছেয়ে যায়। কত রকমের যে জুলুম ওরা করেছে তা বলে শেষ করা যাবেনা। মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা হয়েছে শত শত বই। কিন্তু পশ্চিম  পাকিস্তানে যারা ছিল তাদের দুঃখ কষ্টের দিনগুলি রয়ে গেল অগোচরে। এর কারণ এ নিয়ে লেখালেখি তেমন একটা হয়নি। এক সময় দেশ স্বাধীন হয়, এই ভূখণ্ডের  নাম হলো বাংলাদেশ। যার মাটিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি গর্বে বুক ফুলিয়ে—এ আমার স্বাধীন দেশ। দেশ স্বাধীনের পর ভয়াবহ বিপদ হলো আমাদের। কারণ আমরা শত্রুর হাতে বন্দী। সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে অচল করে দিল আমাদের। পাকিস্তান সরকার অপশন চাইলে বাঙালিদের কাছে-ওখানে থাকবো, না বাংলাদেশে চলে যাব। বাঙ্গালিরা নিজ ভুখণ্ডে যাওয়ার প্রস্তাব করে। সাথে সাথে আমাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বাঙ্গালিদের চাকুরিচ্যুত করা হয়। বেতন কর্তন করে মুল বেতনের অর্ধেক দেয়া হতো । তাও আবার পাঁচশ টাকার বেশি না। এই সময় আমার প্রথম সন্তান তমালের জন্ম হলো ইসলামাবাদ পলিক্লিনিক হসপিটালে। বাঙালি বলে তেমন কেয়ার নেয়া হয়নি। আমার অপারেশনের প্রয়োজন ছিল কিন্তু তারা সেটা করেনি। দীর্ঘ সময় পার করে দিয়ে নর্মাল ডেলিভারি করেছে। যার কারণে আমার শিশুটিকে  নিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার পর সমস্ত বাঙালি দেশে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের কোনও খোঁজ খবর আমরা পেতামনা। সরাসরি চিঠি আদান প্রদান বন্ধ ছিল। বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে চিঠি পাঠালে সেটা আমাদের নামে পোস্ট করলে আমরা চিঠি পেতাম। বাঙালির  চিঠি বুঝতে পারলে সেটা খুলে দেখা হতো। তবে রেডক্রশ কিছু চিঠি সরাসরি পাঠানোর ব্যবস্থা  করে। দিন যায় আমদের খুব মনোকষ্টের মধ্যে। আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা হতো। ওদের কাছে  সন্দেহজনক কিছু মনে হলে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো। আমাদের একেকটা  দিন অতিবাহিত হয় মানসিক  কষ্টে। যাদের সংসার বড় তারা পড়েছিলেন আর্থিক কষ্টে। খরচ চালাতে হয়েছে সোনাদানা, ফার্নিচার বিক্রি করে। আশায় আশায় থাকতাম নিশ্চয় কোনও ব্যবস্থা হবে আমাদের দেশে যাওয়ার। এর মধ্যে বাঙালির পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে পাঠানরা।পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে অবৈধভাবে অনেক টাকার বিনিময়ে তাদের সহযোগিতায় অনেকে বাংলাদেশে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু সে ছিল দুর্বিষহ ব্যবস্থা। বড় বড় লরিতে উপরে মালামাল রেখে ভেতরে মানুষ রাখার ব্যবস্থা । শিশুদের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হতো যাতে তারা কোনরকম শব্দ না করতে পারে, বাংলা বলতে না পারে। শাড়ি পরা যাবেনা। পরতে হবে ওদের পোশাক। তারপর গাড়িতে, বাসে যাওয়ার পর খচ্চরের পিঠে করে পার হতে হবে পাহাড়,পর্বত। কোথাও কোথাও অবসরের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু নিকৃষ্ট মানের থাকা খাওয়া।এমনকি আস্তাবলেও থাকতে দেয়া হয়েছে অনেককে। একদিন রাতের বেলা লতিফ ও আমি বাসার সামনে হাঁটছিলাম। দেখলাম পাশের বাসায় পুলিশ। লতিফ আমাকে ঘরে যেতে বলে নিজে এগিয়ে গেল সেই বাসার দিকে। আমি ঘরে ফিরলাম একরাশ ভয় নিয়ে। কোরান শরীফ হাতে নিয়ে ইয়াসিন সুরা পড়তে থাকি। আল্লাহর  কাছে কামনা করি লতিফকে যেন ওরা ধরে না নেয়। অনেক রাতে লতিফ  ফিরলে। বললো-‘মতিন সাহেবকে নিয়ে ধরে গেল। কেন নিল, কোথায় নিল জানিনা।’ সারা রাত আমার ভয়, ওকে যদি নিয়ে যায়। ঘুমুতে পারলাম না। আশেপাশে আত্মীয়-স্বজন দূরের কথা ,বন্ধু-বান্ধবও ছিলনা। যারা ছিল পাঠানের সাথে হাত মিলিয়ে চলে গেছে বাংলাদেশে। আমাকেও ওনারা যেতে বলেছিলেন কিন্তু আমাদের টাকা ছিলনা। তাছাড়া বাচ্চা ছোট। তারওপর দ্বিতীয়বার আমি মা হতে চলেছি। শুধু চিন্তা করতে থাকি ওকে যদি নিয়ে যায় আমি কি করবো? ভোরবেলা ডোরবেল বেজে ওঠে। লতিফ দরোজা খুলে অবাক-পুলিশ এসেছে। জিজ্ঞেস করলো ওদের আসার কারণ। ওরা জানালো-‘গত রাতে ইসলামাবাদে থাকা সমস্ত বাঙ্গালি অফিসারদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন আমরা তোমাকে নিয়ে যাব।’ লতিফ জানতে চায়- ‘আমার  নামে কোন ওয়ারেন্ট আছে?’ ওরা বলে- তা আমরা জানি না।উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ গ্রেফতার করতে হবে সব বাঙালি কর্মকর্তাদের।

লতিফকে ওরা ধরে নিয়ে গেল। বড় বাসাটায় আমি আর আমার আট মাসের ছেলে তমাল। এমন নিঃশ্ব, অসহায় জীবনে হইনি। তাও দেশে নয়, শত্রু দেশে,  শত্রুর হাতে এই অবস্থা। শব্দ করে অনেক কাঁদলাম। তমালের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সে অবাক হয়ে দেখছে। বুকেতুলে নিলাম ওকে। বললাম- ‘জানিনা বাবা তোমার বাবাকে ওরা কোথায় নিয়ে গেল ।ফিরে আসবে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু তোমাকে তো বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশের মাটিতে নিতে হবে তোমাকে।’ অঝোরে কাঁদলাম। একসময় আমার কান্না শুকিয়ে গেল। সাত দিন লতিফের কোন খোঁজ পাইনি। এই সাতদিন কীভাবে কাটিয়েছি বোঝাতে পারবোনা। আমি খাইনি । ঘুমাইনি। শুনেছি বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছে, সেটাই কি আমাদের ভাগ্যে ঘটবে?

সাতদিন পর একটা চিঠি পেলাম। বাবাকে দেখার জন্য খোঁজ খবর নিতে কাদিরাবাদ ক্যাম্পে যায় এক সিনিয়র ভাইয়ের ছেলে । ওর কাছেই চিঠপাঠিয়েছে লতিফ। মোজার ভেতর সে ওটা বহন করে আনে। এখনও ভাবলে অবাক লাগে । ওদের ক্যাম্পে নেয়ার খবরটা আমাদের জানালে কি হতো? আমরা এত কষ্ট পেতাম না ।চিঠিতে লতিফ জানিয়েছে আমাদেরও ক্যাম্পে নেবে। তখন মোবাইল ছিলনা বলেই আমরা কষ্ট পেয়েছি বেশি। পনের দিন পর ফ্যামিলি নেয়ার ব্যবস্থা হয়। কয়েকটা পরিবার ক্যাম্পে চলে যায়। কিন্তু আমাকে নিতে আসেনা অথচ প্রয়োজন আমারই বেশি ।  আসবে আসবে করে দেড় মাস কাটিয়ে দিলাম। বাঙ্গালিরা একজন আরেক জনের জন্য জান দিতে প্রস্তুত ছিল। কর্মকর্তা ছাড়াও যারা বাঙালি ছিল তারা একটা সাহায্যকারী দল গঠন করে দেয়। এই দলের তিনটি ছেলে মনটু, রুহুল আমিন ও ছাত্তার- ওরা অনেক সাহায্য করেছে আমাকে। লতিফ খুব চিন্তিত ওমর্মাহত হয়ে পড়ে। বার বার কর্তৃপক্ষকে জানায় আমার পরিবারকে একত্রিত করে দাও। আমার ওয়াইফ অসুস্থ। যেকোন সময় একটা কিছু ঘটে যেতে পারে।

দেড়মাস পর এক সন্ধ্যায় দুজন লোক আসলো।বললো-‘তুমি গোছগাছ করে নাও, তোমাকে নিয়ে যাব কাদিরাবাদ ক্যাম্পে যেখানে তোমার হাজবেন্ড আছে। সঙ্গে কোনও ফার্নিচার নেবেনা। শুধুমাত্র থালা বাসন, কাপড় চোপড় নেবে।’ আশেপাশের অবাঙ্গালি ভাবিদের সঙ্গে আমার সর্ম্পক ভালো ছিল। লতিফকে নেয়ার পর ওরা আমার সাথে দেখা করেছে। বলেছে- ‘তোমার জন্য আমাদের খুব খারাপ লাগছে। ভাল লাগতো তোমার জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগতো। রাতে যাওয়ার কথা শুনে আমার ভালো লাগছিল না। পাশের বাসার ভাইকে কথাটা জানালাম। উনি কিছু বলাতে রাতে আমাকে নেয়নি। ভোরবেলা আমি রওনা দিলাম।  আমার করুণ অবস্থা দেখে মন্টু ও রুহুল আমীন বলে- ‘আপা, আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা আপনার সাথে যাব।’ওদের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ ছিলাম। ওরা আমার  আপন ভাইয়ের মতো ছিল। দুইশত মাইল দুরে গুজরানয়ালা, তবুও ভালো যেতে পারছি।  আর সেটা সম্ভব হয়েছে্ লতিফের অবাঙ্গালি বন্ধুদের কারনে। ওনাদের কাছে হেল্প চেয়েছিল লতিফ। আমাকে নেয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল স্পেশালভাবে। অসুস্থ শরীর জার্নি করতে কষ্ট হয়েছিল। তবুও রক্ষা আমার ভাই দুজন ছিল আমার সাথে।

ক্যাম্পের বন্দী জীবন হলেও শান্তির বারিধারা পেলাম। সবাই মিলে আছি একসাথে। ছোট ছোট বাসার একটা কলোনি। ছিল কোন একটা প্রজেক্টের। সেই বাসাগুলো দেয়া হয়েছিল আমাদের। চারদিকে কাঁটা তারের বেড়া। পুলিশ আছে সবসময় পাহারায়। ইচ্ছে করলেই গেটের বাইরে যাওয়া যাবে না, জেল জীবনের স্বাদ তখনই পেয়েছি। পাকিস্তান সরকার চিন্তা করেছিলেন আমাদের বিচার করার। সেজন্য এই ব্যবস্থা। ক্যাম্পের ভেতরেই বাজার, ডাক্তার সব ছিল। আমার দ্বিতীয় ছেলের জন্ম হয় গুজরানওয়ালা হাস্পাতালে, এই বিপদের দিনেও আমি বন্ধু পেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে এক ভাবি ছিলেন। এই হাস্পাতালেও আমার সাথে ভালো ব্যবহার করা হয়নি। ভাবি আমার সাথে অনেক কষ্ট করেছেন। আল্লাহ ভাবিকে পাঠিয়েছিলেন তানা হলে আমার মৃত্যু হতো। সে সময় ক্যাম্পে আর এক জুলুম এলো। হঠাৎ করে বন্যায় ক্যাম্প  ডূবে গেল।পানি ঢুকলো সবার ঘরে। পাকিস্তানীরাও অবাক, এরকম বন্যা কখনো সেখানে হয়নি। আমাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কোনও ব্যবস্থা করতে পারেনি পাকিস্তান সরকার। পানির মধ্যে আমাদের থাকতে হয়েছে বেশ কদিন। পানির মধ্যে রান্না খাওয়া, কী যে কঠিন অবস্থা বোঝাতে পারবোনা । পানির মধ্যে আমি  হাসপাতালে       গিয়েছিলাম। ছয় দিন থাকার পর আবার পানিতেই ফিরে এলাম। হাসপাতালে আমি ভাবির সাথে গিয়েছিলাম। তমাল ক্যাম্পে ওর বাবার কাছেই ছিল। আবার সবাই মিলে একসাথে হলাম। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের আশার গাছে ফুল ফুটলো। এবারে পাকিস্তান সরকার আমাদের দেশে পাঠাবে। যাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো। একদিন সত্যি সত্যি লাহোর এলাম। সেখান থেকেই বাংলাদেশে যাব। আসলে বঙ্গবন্ধু আমাদের কারণে যুদ্ধবন্দীদের বিচার করেননি। বাংলাদেশে যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার হলে আমাদের বিচার হতো। হয়তোবা আমরা নিশ্চিহ্ন  হয়ে যেতাম। তারিখটা ছিল ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সাল। আমরা বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় বাংলাদেশ বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। আহ! কী  শান্তি!

নূরহাসনা লতিফ: কবি ও লেখক।  তার প্রকাশিত বই এর সংখ্যা ৩২টি।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/