পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল

সুলতানা রিজিয়া

সুলতানা রিজিয়া

আজ ষোল ডিসেম্বরে মহান বিজয় দিবসের নবোদয় ঊষার রক্তিম আলোর স্নাত বাংলাদেশের সতেরো কোটি মানুষের মনে বিজয়ের আনন্দ প্রবহমান। তাদের ধমনির রক্তকণিকার কোষে কোষে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা প্রাপ্তির গৌরবানন্দ বিচ্ছুরিত। বাংলা, বাঙালি জাতির দীর্ঘ নয়মাসের জীবনপণ মুক্তির সংগ্রাম- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বড়ই মহিমান্বিত এবং পবিত্র।

রক্তের দামে অর্জিত এই দেশ- বাংলাদেশ,
প্রানের টুকরো বির্ষজনে এই দেশ-বাংলাদেশ,
নারীর মান-সম্মান লুন্ঠনে এই দেশ-বাংলাদেশ,
সাত সমুদ্র অশ্রুজলে স্নাত এই দেশ- বাংলাদেশ,
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে এই দেশ- বাংলাদেশ।

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি –
সকল দেশের সেরা সেযে আমার জন্মভূমি।

এটি কেবল কবির কল্পনা নায়, নয় কাব্যের পঙক্তিমালা, এতো প্রাণের অন্তর্স্থিত লালিত উপলদ্ধির ফলগুধারা, জন্মভূমির প্রতি অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতার শাশ্বত উচ্চারণ। আমরা এই দিনটিকে কান্না হাসির দোলাচলে আন্দোলিত হই, পাওয়া  এবং খোয়ানোর বিষাদবেদনায় বিচলিত হই। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে গিয়ে শান্তিপ্রিয় স্বভাবজাত ভাবুক বাঙালি জাতি হাতে তুলে নিয়েছিলো কাস্তে, কোদাল, দা, বটি,খুন্তি । বাংলার স্নেহময়ী মায়েরা চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সন্তানকে দেশজঅস্ত্র দিয়ে সাজিয়েছিলো, সন্তানরা পিতার আকাশসম নির্ভরতাকে উৎসর্গ করেছিলো, বোনেরা ভাইদের সাহসী হাতকে ছেড়ে দিয়েছিলো, নববধূ অশ্রুজলে স্বামীর বাহুবন্ধন খুলেছিলো মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনেই। ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নির্মমতায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো বাঙালিজাতি।

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চাই!
বাঙালি জাতি তাদের কোমলে কঠোরে গড়া স্বত্বার প্রমাণ দিতেই হাতের বাঁশি রেখে তুলে নিয়েছিলো অস্ত্র। সাত মার্চের রেসকোর্স ময়দানে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্তকণ্ঠের আহ্বানই ছিলো তাদের কাছে বিজয়ের মন্ত্র, স্বাধীনতার তৃষ্ণা, পরাধীনতার  শৃঙ্খলমুক্তের প্রতিজ্ঞা। তাঁরই নির্দেশে বাঙালিজাতি দৃপ্ততায় ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছিলো। মরণপণে বাজি রেখেছিলো সাত কোটি বাঙালি ( ব্যতিক্রম ধর্তব্য নয়) আপন জীবন, হৃদয়ে রোপন করেছিলেন স্বাধীনতার চেতনা, লড়াকু যোদ্ধার পথ বেছে নিতে ফেরারি হয়েছিলো উচ্চতর প্রশিক্ষণার্থে, জোট বেঁধেছিলো অটল অবিচল মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। বাঙলার দামাল কিশোর – যুবকরা জীবনের স্বাভাবিক চাওয়া পাওয়ার হিসাব ভুলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনন্দ উল্লাসের পর্ব স্থগিত রেখে, কেউবা তার প্রাণপ্রিয় প্রেমিকার আকর্ষণ ছিঁড়ে যুক্ত হয়েছিলো এক সাগর রক্ত দেয়ার ব্রতে। মাতৃভূমির শৃঙ্খলমুক্ত করতে।

একাত্তরের ২৫ শে মার্চে বাঙালিজাতি ভাগ্যে এক করুণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো। যা বিশ্বের বুকে এক কালো কুৎসিত অমানিশা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।  তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের জনসাধারণকে দাবিয়ে রাখার, মেধাশূন্য করার, ভারবাহী প্রানী করার অভিলাসে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের বুকে রাতের অন্ধকারে নিরীহ ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলো। রাজনীতির কালো থাবা বিস্তারে নির্মম চক্রান্তের জাল বুনেছিলো। গণহারে এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদেই বিশ্বের বুকে সূচনা হয়েছিলো অভূতপূর্ব মুক্তিযুদ্ধ, মরনপণ লড়াই। শান্তিপ্রিয় স্বাধীনতাকামী আপামর বাঙালিজাতি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমরাস্ত্রে সজ্জিত সুদক্ষ ও চৌকশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলো। হাতে তুলে নিয়েছিলো দেশজ সহজলভ্য সাধারন অস্ত্র। প্রাথমিক পর্যায়ে এইসব অস্ত্রনিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরলেও পরবর্তিতে অধুনিক সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণ শেষে দীর্ঘ নয়মাস বীরবিক্রমে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সন্মুখ সমরে থেকেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ সেই সাহসী পদক্ষেপে ত্রিশলক্ষ শহীদের রক্তের ধারায় পাকিস্তানি যোদ্ধারা নিদারুণ পরাজয়ে ভেসে গিয়েছিলো। ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী ময়দানে পরাজিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৯১,৬৩৪ জন সদস্য  মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠনিকভাবে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিলো। ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানের পক্ষে  সেই আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পন করেন। পাকিস্তান সরকারের ২৩ বছরের জোর, জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার ও দখলদারিত্বের অবসান হয়। পূর্ববাংলার মানুষ বিজয়ের আনন্দে জীবনের পথে ঘুরে দাঁড়ায়।

১৬ ডিসেম্বর আমাদের গৌরবময় বিজয়ের দিন। লাখো শহীদের আত্মত্যাগে আর্জিত বিজয়ের মুহূর্ত। এর মাত্র দুইদিন পূর্বে ১৪ ডিসেম্বরে এদেশকে মেধাশূন্য করার নীলনক্সায় ছলে বলে কৌশলে বুদ্ধিজীবী হত্যার পথ বেছে নিয়েছিলো। আমরা হারিয়েছি আমাদের সোনার সন্তানদের। যাদের জ্ঞান, মনীষা ও অধ্যবসায় এদেশের মানুষকে পথ দেখিয়েছিলো।মুক্ত করেছিলো ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলব্যাপী এই বাংলাদেশকে। শহীদদের বীরত্বগাঁথায় উড্ডীন হয়েছিলো লালসবুজের  পতাকা। এই পতাকায় ঢেকে গিয়েছিলো অযুত লক্ষ মা বোনদের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা এবং লজ্জার গ্লানি। বাংলাদেশের এই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব অর্জন করেছিলো। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলো।

আজকে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর  মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে  অবলীলায় ভাবতে পারি উন্নয়নশীল পর্যায় অতিক্রম করে উন্নততর জীবন যাপনের বাস্তবতা। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ও সহজলভ্যতায় দেশের শিল্প বানিজ্যে, জ্ঞান- বিজ্ঞানে, সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এসেছে উন্নয়ন জোয়ার। মাথাপিছু আয় এখন সম্মানজন কোঠায়, প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক মু্দ্রার লক্ষ্যমাত্রও আশাব্যঞ্জক। বৈশিক মহামারী কোভিড-১৯ এর ছোবলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও অতিমারি মুকাবিলা করতে হচ্ছে। গুণতে হচ্ছে মৃত্যুহার। জনজীবনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে  স্বাস্থবিধি পালনে তথষ্ট থাকতে হচ্ছে। জনজীবনকে নিরাপত্তার আওতায় রাখতে উন্নতবিশ্বের সাহায্য সহযোগিতায় টিকাকার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে সাফল্য লাভ করেছে। বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে বসবাসরত মানুষকে টিকার আওতায় আনাতে স্থানীয় প্রশাসন  তৎপর। করোনা সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে টিকার বিকল্প নেই। একই সাথে পর্যায়ক্রমে খুলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দীর্ঘদিনের স্থবিরতার জট খুলতে শুরু করেছে। জীবন যাপনে (স্বাস্থবিধি মেনে) এসেছে কর্মচাঞ্চল্যময় ছন্দ। এরই মাঝে বাঙালিজাতি উদযাপন করবে  স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব। মুজিববর্ষ এই উৎসব সবদিক থেকেই ভিন্নমাত্রা লাভ করবে। এবারের এই বিজয় দিবসকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী প্রাণের পিলসুজ জ্বেলে  স্বাগত জানাবে, উৎসব আয়োজনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সুলতানা রিজিয়া: কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘নন্দিনী’নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করছেন। এছাড়া তার রয়েছে প্রকাশনা হাউস সম্রাজ্ঞী। তার প্রকাশিত একক গ্রন্থের সংখ্যা ২৩ টি। সাহিত্য ও সাংগঠনিক অবদানের জন্য পেয়েছেন ত্রিশটির বেশি সম্মাননা পদক।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/