রানা জামানের গল্প ‘মুক্তিযোদ্ধা রওশন আরা’

রানা জামান

মুক্তিযোদ্ধা রওশন আরা

পিরোজপু্র মহকুমার রামনগর গ্রামে রওশন আরার বাড়ি। উনিশ শ একাত্তর খৃস্টাব্দের জুন মাসের কোনো এক সময়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এক সকালে চলে এলো গ্রামটায়। বেশ কয়েকটি বড় ট্রাক, ছোট পিকাপ ও জিপ ভর্তি হানাদার বাহিনীর সৈন্যে। গ্রামের রাজাকাররা পথ দেখিয়ে ওদের নিয়ে এসেছে। ভয়ে গ্রামের লোকজন আহাজারি করতে করতে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো।

হৈ চৈ কান্নাকাটির শব্দে রওশন আরা বিরক্ত হলো। সে এসএসসি পরীক্ষার্থীনী। পড়া করছিলো। মনযোগে বিঘ্ন ঘটায় চিৎকার করে বললো, কী হইছে মা? এতা চিল্লাপাল্লা হইতাছে ক্যান? গ্রামে কি ডাকাইত পড়ছে?

মা মতিজান বিবি বললেন, আমি কী জানি! আমিও তোর মতো ঘরে কাম করতাছি। তুই দেইখ্যা আয় না!

বইটা বন্ধ করে রওশন আরা ঘরের বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। উঁকি দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু খাটো হওয়ায় কিছুই দেখতে পেলো না। সে বরান্দা থেকে নেমে দৌড়ে বাড়ির বাইরে এসে হতভম্ব হয়ে গেলো। চিৎকার করে মাকে ডাকতে লাগলো, মা মা দেইখ্যা যাও। গ্রামে এইসব কী হইতাছে?

মেয়ের ডাকে মতিজান বিবি শাড়ির আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন বাইরে। মেয়ের কাছে এসে আশেপাশে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলেন। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। মনে হচ্ছে পুরো গ্রামটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। তালুকদার বাড়ি, মাতবরবাড়ি, হাওলাদার বাড়ি ও মোল্লাবাড়ি পুড়ছে। বোমা ফাটার শব্দে পুড়ছে বাঁশ।

মতিজান বিবি বেদনার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, অমন কইরা কেডা আগুন দিলো রে? এই শত্রুটা কেডা? তোর বাপ বাইচ্যা থাকলে সবার আগে দৌড়ায়া আগুন নিভাতে যাইতো।

রওশন আরা বললো, আমিও হেই কথা ভাবতাছি। আমি যাই মা? দেইখ্যা আসি?

মা নিষেধ করলেন, তোর একলা যাওনের কাম নাই।

রওশন আরা ডান হাত তুলে সামনে দেখিয়ে বললো, ঐ দেখো মা, মানুষজন কেমন ছুটাছুটি করতাছে। আগুন নিভাইতে না গিয়া কেমন যেনো ছুটাছুটি কইরা পালাইতাছে। ব্যাপারটা কী মা?

মতিজান বিবি বললেন, তুই বাড়িত থাক। আমি দেইখ্যা আহি।

রওশন আরা বললো, আমারও যাইতে ইচ্ছা করতাছে মা!

মতিজান বিবি বললেন, হুড়াহুড়ির মধ্যে খালি বাড়িতে চুরি হয়। তুই এইখানেই খাড়ায়া থাক। আমি তাড়াতাড়ি চইলা আসবো।

মতিজান বিবি এগিয়ে গেলেন। ছুটন্ত একজন মতিজান বিবিকে ওদিকে যেতে দেখে বললেন, ঐদিকে যাইও না ভাবি।

মতিজান বিবি জিজ্ঞেস করলেন, ক্যান? কী হইছে ঐদিকে? গ্রাম জুইড়া আগুন দিছে কেডা?

লোকটি বললেন, গ্রামে পাক বাহিনী আয়া পড়ছে। ঐ শয়তানরা আগুন দিতাছে আর লুট করতাছে। জোয়ান মাইয়াগুলারে ধইরা নিয়া যাইতাছে। তুমি তোমার মাইয়া নিয়া অহনই পালাও।

মতিজান বিবি আর সামনে না গিয়ে ফিরে এলেন নিজ বাড়িতে। তখন বিদ্যালয় থেকে শাহ আলমও ফিরে এলো। সে হাপাচ্ছে হাপড়ের মতো।

মতিজান বিবি জিজ্ঞেস করলেন, তুই অতো হাপাইতাছস ক্যান রে বাপ? দৌড়ায়া আইছস?

শাহ আলম দম সামলে নিতে নিতে বললো, হ মা। গ্রামের অবস্থা ছেড়াবেড়া হয়া গেছে মা। পাক বাহিনী সব বাড়িঘর পুড়ায়া দিছে।

মতিজান বিবি বললেন, জানি। আমিও দেখতে গেছিলাম।

শাহ আলম বললো, গ্রাম ছাইড়া সবাই চইলা যাইতাছে মা। আমাদেরও চইলা যাইতে কইছে।

মতিজান বিবি বললেন, আমারেও কইছে। কিন্তুক কই যামু?

রওশন আরা বললো, বহুদিন মামার বাড়ি যাই না। চলো মামার বাড়ি চইলা যাই।

মামার বাড়ি কই যাবি? তোর মামারা কেউ বাইচা নাই। খালি ভিটা পইড়া আছে।

শাহ আলম জিজ্ঞেস করলো, কোনো ঘর নাই ভিটায় মা?

ভিটায় কেউ না থাকলে কি ঘর থাকে? ভাইঙ্গা টাইঙ্গা কবেই মাটির সাথে মিশ্যা গেছে।

তাইলে আমরা কোথাও যাইতাম না? এখানে থাকলে যদি পাক বাহিনী ধইরা লইয়া যায়? তখন কী হইবো?

মতিজান বিবি বললেন, চুপ থাক। আমারে ভাবতে দে।

মতিজান বিবির দুই সন্তান নিয়ে গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাওয়া হলো না। কোথায় যাবেন? এই গ্রামের বাইরে কিছুই চিনেন না। না যেতে যেতে বাবার বাড়ি যাবার পথটাও স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে গেছে। দুই সন্তান নিয়ে তিনি সাহস করে গ্রামেই রয়ে গেলেন; তবে মেয়েকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করলেন। মেয়ের কথা গ্রামের কেউ জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে করে বলেন যে রওশন আরাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। শাহ আলমকে আল্লাহর কিড়া দিয়ে বোনের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করেছেন। শাহ আলম তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছে।

এই ঘটনার কিছুদিন পরে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এলো। তাঁরা গ্রামের যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উৎসাহিত করতে লাগলেন। যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য এলেন, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে লাগলেন। একদিন রাতে রওশন আরা মাকে বললো- মা, আমি ও শাহ আলম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই?

মতিজান বিবি আঁতকে উঠে বললেন, কী কস তুই! তোরা বাচ্চা পোলাপান। তোরা যুদ্ধ করবি কিভাবে? না না! তাছাড়া তোদের কিছু হইলে আমি কারে লইয়া থাকুম? তোদের যাওনের দরকার নাই।

ঐ রাতে দুই ভাইবোন আর কিছু বললো না। শাহ আলমের বিদ্যালয়ে আর ক্লাশ হয় না। সে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়; আর রওশন আরা ঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বসে থাকে। ঘরের বাইরে গেলে কী বিপদ হতে পারে আঁচ করতে পেরে সে চুপ মেরে গেছে। শাহ আলম মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের আশেপাশে ঘুরঘুর করে ওদের কার্যকলাপ তথা গ্রামের যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান দেখে।

রাতে দুই ভাই বোন পাশাপাশি শুয়ে থেকে ভাই-এর কাছ থেকে গ্রামের খবরাখবর জেনে নেয় রওশন আরা; বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের বিষয় আশয় জানতে চেষ্টা করে। আর ওর মনে মুক্তিযুদ্ধে যাবার কামনা বাসনা আকুলি বিকুলি করতে থাকে। এক রাতে রওশন আরা ফের মার কাছে মুক্তিযুদ্ধে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করে।

মা মতিজান বিবি আবেগে দুই সন্তানকে বুকে চেপে ধরে নিরবে অশ্রুপাত করে বলেন, তোদের যখন এতই ইচ্ছা মুক্তিযুদ্ধে যাওনের, তখন যা। আামি আর নিষেধ করুম না। আগামীকাল আমি তোদের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে লইয়া যামু। এখন ঘুমা।

পরদিন মতিজান বিবি দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গেলেন। কথা শুনে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা. গোলাম মোস্তফা বললেন, তোমরা দুইজন এখনো বাচ্চা। যুদ্ধ করবে কিভাবে?

তখন কিশোরী রওশন আরা বললো, আমরা যুদ্ধ করতে পারুম কমান্ডার ভাইজান। আমারে বন্দুক চালনা শিখায়া দেন।

কমান্ডার ডা. গোলাম মোস্তফা বুঝতে পারছেন না কী করবেন।ওদের গ্রুপে কোনো মহিলা মুক্তিযোদ্ধা নেই। একজন কিশোরীকে দলে নিলে কী ধরনের সমস্যায় পড়বেন বুঝতে পারছেন না। রওশন আরা ও শাহ আলমকে একবার দেখে বললেন, তোমরা এখন যাও। আগামীকাল আসো। আমি ভাবি।

রওশন আরা বললো, ভাবার কিছু নাই ভাইজান। আমি জান দিয়া যুদ্ধ করুম।

মতিজান বিবি বললেন, আপনার গ্রামে ক্যাম্প করার পর থাইকা যুদ্ধে যাওনের কথা কইতাছে। প্রথমে আমি রাজি হই নাই। পরে ভাইবা দেখলাম, যাউক যুদ্ধে। ঘরে বইসা থাইকা পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়নের চাইতে যুদ্ধে গিয়া মইরা যাওয়া অনেক ভালো হইবো, অনেক সম্মানের হইবো।

ঠিক আছে। আপনারা আগামীকাল আসেন। আমি রাতটা ভেবে দেখি।

তিনজন চলে এলো বাড়িতে। দিনের বাকিটা ও পুরো রাত দুশ্চিন্তায় কাটলো কিশোরী রওশন আরার। যদি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রাজি না হন, তাহলে কী হবে? কী করবে তখন ওরা? কী করবে?

রওশন আরা মাকে জিজ্ঞেস করলো, কমান্ডার ভাইয়া রাজি না হলে কী হইবো মা? তখন আমরা কী করুম?

শাহ আলম জিজ্ঞেস করলো, আমরা একা যুদ্ধ করতে পারুম না মা?

মতিজান বিবি বললেন, একলা কী আর যুদ্ধ করন যায় রে বেটা। যুদ্ধ করতে হইলে টেরেনিং লাগে, অস্তর লাগে। তোরা টেরেনিং পাইবি কই, অস্তর পাইবি কই।

অনিশ্চয়তার ভাবনা নিয়েই ওরা ঘুমিয়ে গেলো। পরদিন ভোর হবার সময় থেকে ওরা ছটফট করতে লাগলো ক্যাম্পে যাবার জন্য। আনুমানিক সকাল দশটায় ওরা বেরিয়ে পড়লো বাইরে। দ্রুত হেঁটে চলে এলো ক্যাম্পে। ওদের দুশ্চিন্তাকে মাটি করে দিয়ে কোম্পানি কমান্ডার ডা. গোলাম মোস্তফা দুই ভাইবোনকে দলে যোগ করে নিলেন।

বীরপাশা উচ্চ বিদ্যালয়ে শুরু হলো ওদের প্রশিক্ষণ। অন্যান্যদের সাথে দুই ভাইবোনের প্রশিক্ষণ চলতে থাকলো। এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা ওদের বাড়িতে ঘাঁটি স্থানান্তর করলো। প্রশিক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে রান্নার কাজে রওশন আরা মাকে সহায়তা করতে থাকলো।

প্রশিক্ষণ শেষ। অপারেশনে যেতে হবে। অপারেশন কোথায় হবে তা ঠিক করার পর রাতে রওশন আরা দেশাত্ববোধক গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে চাঙ্গা করতো।

শাহ আলম ছোট থাকায় সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে খবর নিয়ে আসতো। ও ছোট থাকায় পাক বাহিনী ওকে সন্দেহ করতো না। শাহ আলম মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে খবর পৌঁছে দেবার পাশাপাশি খাবারও পৌঁছে দিতো।

লেখক পরিচিতি: রানা জামান একজন অভিজ্ঞ লেখক। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন। কেবল গল্প নয়- ছড়া,কবিতা,উপন্যাস  ও প্রবন্ধসহ সাহিত্যের নানা শাখায় তার সরব পদচারণা। নানা ধরনের লেখা। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯১টি। লেখকের দেশের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অতিরিক্ত সচিব হিসাবে অবসর নিয়েছেন।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/