শুভ জন্মদিন কবি, সমাজ সংস্কারক ও নারী অধিকারকর্মী সাবিত্রীবাঈ ফুলে

সাবিত্রীবাঈ জ্যোতিরাও ফুলে

আজ ৩রা জানুয়ারি, ভারতের যুগান্তকারী সমাজ সংস্কারক, নারী অধিকারকর্মী ও শিক্ষাবিদ সাবিত্রীবাঈ জ্যোতিরাও ফুলের জন্মদিন। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের নিম্নবর্ণের মানুষ, বিশেষ করে নারীদের শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান অপরীসিম। একই সঙ্গে কবি হিসাবেও সুনাম রয়েছে তার। তিনি হলেন আধুনিক যুগের প্রথম নারী কবি যার কবিতা পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করেছিলো। এজন্য তাকে বলা হয় ‘আধুনিক কবিতার জননী’।

১৮৩১ সালের এই দিনে ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের সাতারা জেলার নাইগাঁও গ্রামে এক দলিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সাবিত্রীবাঈ। তিনি ছিলেন লক্ষ্মী এবং খান্দোজি নেভাসে পাটিলের জ্যেষ্ঠ কন্যা। তার বাবা-মা দুজনেই নিম্নবর্ণের মালি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ১৮৪০ সালে ১২ বছর বয়সী জ্যোতিরাও ফুলের সঙ্গে বিয়ে হয় নয় বছরের শিশু সাবিত্রীবাঈয়ের। এই দম্পতির ছেলেমেয়ে ছিলো না। এজন্য তারা এক ব্রাহ্মণ বিধবার পুত্র যশোবন্ত রাওকে দত্তক নিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। যদিও এটি সমর্থন করার মতো কোনও মৌলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

শিক্ষা বিস্তারে অবদান
বিয়ের সময় সাবিত্রীবাঈ লেখাপড়া জানতেন না। বিয়ের পর জ্যেতিরাওয়ের সাহচর্যে এসে শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। স্বামীর সহযোগিতায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন সাবিত্রীবাঈ, পরবর্তীতে তার শিক্ষার দায়িত্ব নেন স্বামীর দুই বন্ধু সখারাম যশবন্ত পরাঞ্জপে এবং কেশব শিবরাম ভাভালকারে। তিনি কেবল নিজে শিক্ষাগ্রহণ করেই দায়িত্ব শেষ করেননি, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সংগ্রাম শুরু করেন। আর এ কারণেই বেছে নেন শিক্ষকতা পেশা।

এর আগে দুটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেন সাবিত্রীবাঈ। প্রথমটি ছিল আহমেদনগরের আমেরিকান ধর্মপ্রচারক সিনথিয়া ফারারের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়টি ছিল পুনের একটি সাধারণ স্কুলে। প্রশিক্ষণ শেষে পুনের এক স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন সাবিত্রীবাই। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম নারী শিক্ষক। পরবর্তীতে তার স্বামী জ্যোতিরাও ফুলে ১৮৪৮ সালে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করলে সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন সাবিত্রীবাই। এরই মাধ্যমে তিনি ভারতের প্রথম নারী প্রধান শিক্ষক হওয়ারও যোগ্যতা অর্জন করেন। স্বামীর সঙ্গে মিলে তিনি বিভিন্ন গোত্রের শিশুদের শিক্ষাদানে নিজেকে উৎসর্গ করেন।

তবে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে শিক্ষা বিস্তারের এই কাজটি সহজ ছিলো না। এজন্য সাবিত্রীবাই ও জ্যোতিরাও ফুলকে সইতে হয়েছে নানা প্রতিরোধ ও দুর্ভোগ। জানা যায়, রক্ষণশীল ও মৌলবাদী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাকে কেবল গালাগাল করেই ক্ষান্ত হতেন না, তার গায়ে ছুড়ে মারতেন ইট,পাথর আর গোবর। এ কারণে স্কুলে যাওয়ার সময় যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গে একটি অতিরিক্ত শাড়ি নিতেন সাবিত্রীবাই, যাতে পরনের শাড়ি নষ্ট হলে সেটা পাল্টে আরেকটা পরতে পারেন। মনে করা হয়-এই দম্পতি নিম্নবর্ণের হওয়ার কারণেই রক্ষণশীল ও উচ্চবর্ণের হিন্দু বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে এতটা শক্তিশালী বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল। কেননা তখনকার যুগে নিম্নবর্ণের হিন্দু যাদের শিক্ষার অধিকার ছিলো না তাদের শিক্ষায় উৎসাহিত করার কাজটি করছিলেন এই দম্পতি। এর আগে হাজার হাজার বছর ধরে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল ভারতের শূদ্র জাতি। ১৮৪৯ সাল পর্যন্ত, সাবিত্রীবাই ও তার স্বামী জ্যোতিরাও এর বাবার বাড়িতে বসবাস করছিলেন। কিন্তু সমাজিক চাপের মুখে ১৮৪৯ সালে জ্যোতিরাও এর পিতা ছেলে ও পুত্রবধূকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। সামাজিক চাপ ছাড়াও মনুস্মৃতি এবং এর থেকে প্রাপ্ত ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থ অনুসারে তাদের কাজকে পাপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।

বাবার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর বন্ধু উসমান শেখের বাড়িতে আশ্রয় নেন এই দম্পতি।  সেখানেই উসমান শেখের বোন ফাতিমা বেগম শেখের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সাবিত্রীবাইয়ের।  ফাতিমা ছিলেন ভারতের প্রথম মুসলিম নারী শিক্ষক।  ফাতিমা এবং সাবিত্রীবাই মিলে ১৮৪৯ সালে শেখের বাড়িতে একটি স্কুল খোলেন। পরবর্তীতে এই দুই নারী একসঙ্গে দুজনেই একসাথে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

ভারতে নিম্নবর্ণের মানুষ বিশেষ করে নারীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এই নারীর অবদান অপরিসীম। কেবল শিক্ষা গ্রহণই নয়, তিনি ভারতীয়দের ইংরেজি শিক্ষার প্রতিও আগ্রহী করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। ইংরেজি ও ইংরেজ শাসকদের প্রশংসা তিনি বেশ কিছু কবিতাও লিখেছেন। ও সাবিত্রীবাই ও জ্যোতিরাও ফুলে মিলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে সবমিলিয়ে ১৮টি স্কুল স্থাপন করেন বলে জানা যায়। এ কারণে সাবিত্রীবাইয়ের জন্মদিনটি সমগ্র মহারাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে ‘বালিকা দিবস’হিসাবে পালিত হয়।

নারী অধিকার রক্ষায় অবদান
নারী শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি সামজিক ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে নিয়োজিত ছিলেন তিনি।  মহারাষ্ট্রের সমাজ সংস্কারে সাবিত্রীবাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনেও তার অবদান অপরীসিম। আর এইসব সামাজিক সংস্কারের কাজে অংশ নিতে গিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন একজন প্রবল নারীবাদী। তিনি নারীদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ‘নারী সেবা মন্ডল’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।  তিনি নারীদের সমাবেশের জন্য একটি সভাস্থলেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন যেখানে নারীরা একত্রিত হয়ে জাতিগত ও লিঙ্গ বৈষম্যসহ  বা যে কোনও ধরণের সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে নিজেদের মতামত তুলে ধরতে পারেন। সেবা মন্ডলের বৈঠকে উপস্থিত সমস্ত নারীরা একই মাদুরে বসতেন, কোনও রকম ছোঁয়াছুঁয়ির তোয়াক্কা না করেই। এর মাধ্যমে তিনি ভারতের প্রচলিত বর্ণবাদী সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ভারতের ভ্রূণ হত্যা, বাল্যবিবাহ ও  সতীদাহ প্রথার মতো সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও লড়েছেন। পাশপাশি বিধবা বিবাহের পক্ষে চালিয়েছেন জোর প্রচারণা। এসব সামাজিক সংস্কারের জন্যই বিধবা ও তাদের অসহায় শিশুদের জন্য একটি আবাস কেয়ার সেন্টার চালু করেন সাবিত্রীবাই এবং জ্যোতিরাও। যেখানে ব্রাহ্মণ বিধবারা নিরাপদে তাদের সন্তানদের জন্ম দিতে পারতেন। কেউ চাইলে তাদের সন্তানদের দত্তক দেয়ার জন্য সেখানে রেখে যেতে পারতেন।

কবিতা যখন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার
শিক্ষা প্রসার ও সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা থেকে কলম  তুলে নিয়েছিলেন সাবিত্রীবাই ফুলে। প্রকৃত অর্থেই তার কবিতা ছিলো সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। তাই বলে সেসব কবিতার সাহিত্য মান কম ছিলো এমনটি বলা যাবে না। সাবিত্রীবাই ফুলে ছিলেন প্রথম দলিত নারী, প্রকৃতপক্ষে প্রথম নারী যার কবিতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সাহিত্য সমালোচকদের নজরে পড়েছিল। আর এ কারণে তাকে আধুনিক কবিতার জননী (mother of modern poetry) হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি প্রচুর কবিতা ও গল্প লিখেছেন। ১৮৫৪ সালে ‘কাব্য ফুলে’ এবং ১৮৯২ সালে ‘বভন কাশি সুবোধ রত্ন‌কর’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার কবিতার বেশিরভাগই শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারমূলক। তার এসব সাহিত্যকর্ম  শিক্ষা লাভের মাধ্যমে সমাজের নিপীড়তদের সামাজিক ও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার উৎসাহ জুগিয়েছে। এমনকি হিন্দুদের প্রচলিত ধর্মগ্রন্থ, যেখানে দলিত ও নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে বাণী রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছে তার কবিতা।

মৃত্যু
এই মহান নারীর মৃত্যু হয়েছে জনসভা করতে গিয়ে। সাবিত্রীবাই  ১৮৯৭ সালে চিকিৎসক ছেলে যশোবন্তের সঙ্গে মিলে নালাসোপারাতে মহামারীতে রূপ নেয়া বিউবনিক প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের সেবার জন্য একটি চিকিৎসালয় খুলেন। এখানেই রোগীদের সেবা করার সময় প্লেগে আক্রান্ত হন সাবিত্রীবাই ফুলে। ১৮৯৭ সালের ১০ মার্চ মারা যান এই ক্ষণজন্মা নারী।

সম্মাননা
মৃত্যুর শত বছর পরও নানাভাবে সম্মানিত হয়ে আসছেন এই নারী। সাবিত্রীবাইয়ের সম্মানে ১৯৮৩ সালে একটি স্মারক স্থাপন করে পুনে সিটি কর্পোরেশন। ২০১৫ সালে তার সম্মানে পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় সাবিত্রীবাই ফুলে পুনে বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৮ সালে তার সম্মানে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে ভারতীয় ডাক বিভাগ। ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি সাবিত্রীবাই ফুলের ১৮৬তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে গুগল ডুডল প্রকাশ করেছিলো সার্চ ইঞ্জিন গুগল।

আজ এই মহান নারীর ১৯২তম জন্মবার্ষিকীতে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন কবি,সমাজ সংস্কারক, নারী অধিকারকর্মী ও শিক্ষাবিদ সাবিত্রীবাই জ্যোতিরাও ফুলে।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/