বিশ্বসাহিত্যে আফ্রিকান লেখকদের জয়জয়কার

বিশ্বসাহিত্যে আফ্রিকান লেখকদের কারিশমা কোনও নতুন বিষয় নয়। সৃষ্টিশীলতা, শৈলী, বিষয়বস্তু, নতুনত্ব ইত্যাদি নানা কারণে বহু বছর ধরেই আলোচিত বেশ কিছু আফ্রিকান লেখক। কিন্তু ২০২১ সালটি যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। গত বছর গোটা পৃথিবী যখন মহামারীতে কম্পমান তখন পুরো আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখকের রচনা সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কারও লাভ করেছে  এসব রচনা। এসব আফ্রিকান সাহিত্যিকদের সাফল্যগাঁথা তুলে ধরেছেন সামিরা সাওলানি তার ‘African authors took the literary world by storm in 2021’ শিরোনামের লেখায়। লেখাটি গত মাসে প্রকাশিত হয়েছে আল জাজিরা সংবাদ মাধ্যমের ফিচার বিভাগে। ওমেন্স নিউজের সাহিত্যপ্রেমী পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও অনুবাদক মোঃ শওকত আলী

গতবছর সমগ্র আফ্রিকার লেখকরা সাহিত্য জগতে ঝড় তুলেছেন। তারা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার লাভ করেছেন। অন্যদিকে, তাদের লেখা বইগুলো সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। সবচেয়ে সম্মানজনক মুহূর্তটি ছিল ৭ অক্টোবর যখন জাঞ্জিবারে জন্মগ্রহণকারী আবদুলরাজাক গুরনাহকে সাহিত্যে এই বছরের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ পরেই, দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক ড্যামন ড্যামন গ্যালগাট তার উপন্যাস ‘দ্য প্রমিজ’য়ের জন্য মর্যাদাপূর্ণ বুকার পুরস্কার জিতেন। এছাড়া, ব্রিটিশ-সোমালি লেখক নাদিফা মোহামেদের বই ‘দ্য ফরচুন মেন’ বুকার পুরস্কার লাভের জন্য মনোনীত সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহ

আফ্রিকান লেখক যারা ফরাসি ভাষায় উপন্যাস লিখেছেন তারাও বড় সাফল্য লাভ করেছেন। সেনেগালের ঔপন্যাসিক মোহামেদ এমবুগারসার তার লেখা ‘লা প্লু সিক্রেত মেমোয়া দেস হোমস’ (পুরুষদের সবচেয়ে গোপন স্মৃতি) বইটির জন্য ফ্রান্সের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্য পুরস্কার প্রি গনকু জিতেছেন। এই উপন্যাসটি এই বছরের হেনেসি বুক অ্যাওয়ার্ড এবং সেরা ফরাসি উপন্যাসের জন্য ট্রান্সফিউজ পুরস্কারও জিতেছে। সেনেগালের অরেকজন লেখক প্রবন্ধকার ও সাংবাদিক বুবাকার বরিস ডিওপ সাহিত্যের ক্ষেত্রে নিউস্ট্যাড ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭০ সাল থেকে ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ব সাহিত্য টুডে যৌথভাবে দুবছর অন্তর এ পুরস্কার প্রদান করে আসছে।

সেনেগালের জন্য আরো সাফল্য অর্জন করেছেন ফরাসি-সেনেগালিজ ঔপন্যাসিক ডেভিড ডিওপ তার অনূদিত কথাসাহিত্য ‘অ্যাট নাইট অল ব্লাড ইজ ব্ল্যাক’-এর জন্য আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতেছেন। এ বছরেই মোজাম্বিকের প্রথম নারী ঔপন্যাসিক হিসাবে পরিচিত পাওলিনা চিজিয়ান পর্তুগিজ সাহিত্য জগতে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসাবে বিবেচিত প্রিমিও ক্যামোয়েস পেয়েছেন। এদিকে, যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক উগান্ডার ঔপন্যাসিক জেনিফার নানসুবুগা মাকুম্বি তার উপন্যাস ‘দ্য ফার্স্ট ওম্যান’য়ের জন্য ২০২১ সালের ঝলক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে আফ্রিকান লেখকদের প্রশংসা করতে গিয়ে কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি এবং জেন্ডার স্টাডিজের একজন সহযোগী অধ্যাপক র‌্যাডিক্যাল বুকস কালেক্টিভের প্রতিষ্ঠাতা ভক্তি শ্রিংগারপুরে বলেছেন, ‘পুরস্কারগুলি আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশের সাহিত্য জগতকে বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ করেছে। এর অর্থ আফ্রিকান লেখকদের জন্য প্রকাশক, এজেন্ট এবং সম্পাদকদের কাছ থেকে আরও সুযোগ লাভের সম্ভাবনা। মূলধারার মনোযোগ আকর্ষনের অর্থ হল বইয়ের দোকানে আরও বেশি আফ্রিকান সাহিত্যের বই সহজলভ্য হওয়া।’

সেনেগালের ঔপন্যাসিক মোহামেদ এমবুগারসার

যদিও এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ২০২১ সালের এসব অর্জন সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের সাহিত্যের জন্য একটি নজির স্থাপন করেছে। এই প্রেক্ষিতে লেখকরা নিজেরা এই পুরস্কারগুলিকে নিয়ে কি ভাবছেন?
জিম্বাবুয়ের ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা সিৎসি ডাঙ্গারেম্বগা এই বছরের শুরুতে ২০২১ পেন পিন্টার পুরস্কার এবং জার্মান বুক ট্রেডের শান্তি পুরস্কার লাভ করেছেন। এই নারী লেখক বলেছেন, পুরস্কারগুলি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার কাজের উপর আলোকপাত করেছে। তিনি নিশ্চিত নন যে তা কতটা স্থায়ী প্রভাব ফেলবে। আন্দোলন কর্মী এবং সামাজিক ন্যায়বিচার কর্মী ডাঙ্গারেমব্গা বলেছেন, ‘পাঁচ বছর বা তারও পরে, আমি পিছনে ফিরে তাকাতে চাই এবং বলতে চাই যে এই পুরষ্কারগুলি আমার জীবনের এমন একটি সময়ের সূচনা ছিল যখন আমার লক্ষ্যগুলি অর্জনের ক্ষেত্রে আমার কাজটি অনেক বেশি সৃষ্টিশীল ছিল।’
তিনি আশা করেন যে, তার সৃজনশীল কাজ অন্যদেরকে বিশ্ব বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে। ডাঙ্গারেমব্গা বলেছেন, তিনি এমন সাফল্য চাইছেন যা তার প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলবে যাতে তার কাজ ও সামাজিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জিম্বাবুয়ে ও মহাদেশের ঘটনা প্রবাহকে আরও প্রভাবিত করতে পারে।

সোমালি লেখক লেখক নাদিফা মোহামেদ

 

‘পশ্চিমা দাবির কাছে নত নয়’

যদিও আফ্রিকার লেখকরা পুরস্কারের মতো স্বীকৃতি লাভের জন্য অপরিচিত নন, যার ফলে মহাদেশজুড়ে সাহিত্য ক্রমবর্ধমানভাবে বিশ্বমঞ্চে স্থান পেয়েছে এবং প্রবাসীরা ক্রমবর্ধমানভাবে বৈশ্বিক মঞ্চে স্থান খুঁজে পেয়েছে। অনেকগুলি কারণে এই বছর সাফল্য  এসেছে। শ্রীংরারপুরে বলেছেন যে, গুরনাহ, ডিওপ এবং ডাঙ্গারেম্বগার মতো লেখকরা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসে আপসহীন এবং আমাদের ‘আফ্রিকান জীবন ও অভিজ্ঞতার জটিল, সংক্ষিপ্ত, সৎ এবং সুন্দর প্রতিকৃতি’ দেওয়ার জন্য সাহিত্যের সাথে জড়িত রয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘[তারা] কখনই পশ্চিমা প্রকাশনার দাবির প্রতি ঝুঁকে পড়েনি এবং মূলধারার পাঠকদের সাথে মানানসই থিম ও শৈলী অনুসরণ করার ধারাবাহিকতার সাথে মানিয়ে নিতে অস্বীকার করেছেন।’ পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির এই অবহেলার কারণে লেখক এবং প্রকাশকরা মহাদেশজুড়ে ভিন্ন ধরনের গল্প পাঠকদের কাছে নিয়ে এসেছেন। উদাহরণস্বরূপ, সার রচিত ‘লা প্লুস সিক্রেট মেমোয়ার ডেস হোমস’ বইটিতে ফ্রান্সের একজন তরুণ সেনেগালিজ লেখকের গল্প বলা হয়েছে। ডেভিড ডিওপের রচিত ‘অ্যাট নাইট অল ব্লাড ইজ ব্ল্যাক’ হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াইকারী একজন সেনেগালিজ সৈনিকের সম্পর্কে একটি বেদনাদায়ক কাহিনী যা পাঠ করা জরুরি।

নিজের উপন্যাস ‘দ্য মার্নঅ্যাবল বডি’ হাতে সিৎসি ডাঙ্গারেম্বগা। এই বইটি গত বছর বুকার শর্টলিস্টে ঠাঁই পেয়েছে

আন্তর্জাতিক লেখক সিৎসি ডাঙ্গারেম্বগার সাক্ষাৎকার পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন-

অবরুদ্ধ সমাজে মানুষের নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ কমে আসছে: লেখক ডাঙ্গারেম্বগা

আফ্রিকান লেখকদের রচনা প্রকাশ করে এমন একটি প্রকাশনা সংস্থা কাসাভা রিপাবলিক প্রেসের প্রতিভা এবং পাঠক বৃদ্ধি ব্যবস্থাপক নিকি ইগবারুলা বলেছেন, প্রকাশনা শিল্পে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে হয়তো উপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে, সেখানেও আফ্রিকান শিল্পের বিশ্বব্যাপী আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইগবারুলা বলেছেন,  কাজ বিদ্যমান রয়েছে কিনা সমস্যা নয়, কিন্তু দেখতে হবে যে কাজটিকে দৃশ্যমানতা দেওয়া হয়েছে কিনা। তিনি কণ্ঠ পরিবর্তনের জন্য ও পাঠকদের ব্যাপক ক্ষমতা প্রদানের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ‘দুর্বৃত্ত’প্রকৃতিকে কৃতিত্ব দিয়েছেন।

পর্তুগিজ সাহিত্য জগতের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার প্রিমিও ক্যামোয়েস পেয়েছেনমোজাম্বিকের প্রথম নারী ঔপন্যাসিক পাওলিনা চিজিয়ান

অন্যদিকে শ্রিংগারপুরে বলেন, প্রকৃতপক্ষে, সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি এবং আফ্রিকান সাহিত্যের উপর গুরুত্বদানকারী প্রকাশনা সংস্থাগুলির অস্তিত্ব একসাথে মিলিত হয়েছে। ফলে আফ্রিকা মহাদেশে সাহিত্য ও প্রকাশনা কাঠামো অনলাইনে বিকশিত হয়েছে। এসব কিছুই আফ্রিকার সাহিত্যে তাদের ভূমিকা পালন করেছে এবং ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। পুরস্কার বিজয়ী নাইজেরিয়ান লেখক চিমামান্ডা আদিচির উদ্ধৃতি দিয়ে শিংরারপুরে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত, আফ্রিকান সাহিত্য সম্পূর্ণরূপে একজন লেখককে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।’

আরো পড়তে পারেন-‘এতে অসাধারণ একটা গল্প আছে যার আকর্ষণ আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি’

‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, আমরা পশ্চিমে বা অন্য কোথাও থাকি না কেন আমরা দৈবক্রমে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরণের আফ্রিকান সাহিত্যের সাথে পরিচিত হই যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ধারায় লেখা।’

ইগবারুলা বলেছেন, আশা করা যায় যে, আরও আফ্রিকান লেখক তাদের কর্মজীবনের শুরুতে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের স্বীকৃতি লাভ করবেন। তবে, এই ধরণের স্বীকৃতি বৃহত্তর পাঠকদের কাছে পৌঁছে না।

তিনি আরও বলেন ‘পুরষ্কার লাভ বই বিক্রি বাড়িয়ে তুলতে পারে। এগুলোর সবচেয়ে বড় মূল্য হচ্ছে সম্মান। এতে প্রমাণ হয় না যে, এই লেখকদের বইগুলো ব্যাপকভাবে পড়া হচ্ছে, বা তাদের বইগুলি মহাদেশ এবং বিদেশে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এই সাফল্যগুলির জন্য আনন্দ উদযাপন করলেও এ বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে না নেয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

জেনিফার নানসুবুগা মাকুম্বি

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/