জিল্লুর রহমান প্রামানিকের আত্মকথন ‘বাবাকে মনে পড়ে, মগ্ন দ্বিপ্রহরে’

জিল্লুর রহমান প্রামানিক

  বাবাকে মনে পড়ে, মগ্ন দ্বিপ্রহরে

বাবাহীন শুন্যতায় আজ নিঃসঙ্গ বসবাস আমার মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ! চারদিকে বাবার দৃশ্যমান অস্তিত্ব-প্রচন্ড কষ্ট দেয়। পৃথিবীর সব বাবা-ই ভালো থাকুক, সুস্থ ও নিরাপদ থাকুক। আজকের এইদিনে ২৫ শে জানুয়ারী ১৯৯১ সালে আমার বাবাও আমাদের থেকে হারিয়ে গেছেন।

যার হাত ধরেই গাঁয়ের পথে পৃথিবী দেখেছি,পরম মমতা আর নির্ভরতায় হাঁটতে শিখেছি,আজ সেই বাবার মৃত্যুবার্ষিকী! শুধু মৃত্যুবার্ষিকীতে নয় শত মগ্নদ্বিপ্রহরেও বাবাকে মনে পড়ে!  

ঢলঢলে শাদা পাঞ্জাবি আর ছোট ছোট শাদা শাদা চেকের লুঙ্গি।বাবা যখন বাজারে যেতেন আমিও পিছনে লম্বা একটা ব্যাগ হাতে বাজারে যেতাম। বাজার শেষে এক টাকার গুড়ের বাতাসা বা লাঠি লজেন্স কিনে দিতেন বাবা।চুষতে চুষতে বাড়ি ফিরতাম। খুব লোভনীয় ছিল গুড়ের বাতাসা আর লজেন্স। তাই সারাদিন অপেক্ষায় থাকতাম কখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে বাজারে যাবো বাবার সাথে। সে এক মোহময় জীবনের সংরাগ।
 
স্কুলের নুতন শ্রেণিতে নতুন বইয়ের বায়না ধরতাম।দ্রুত সে বায়না পূরণ করেছো তুমি। সযত্মে বইয়ের মলাট লাগিয়ে দিতে তুমি। এখনো পৌষের কুয়াশামাখা শীতে তোমার সান্নিধ্যের সেই উৎসারিত আলো তোমার অনুপস্থিতির আলোক হয়ে স্মৃতির আকাশকে করে বির্দীণ।

বাড়ির পুবপাশে পুকুর। বিশাল। সাঁতার জানিনা,বাবার হাত-পা-গা ধরে অল্প পানিতে লাফঝাঁপ। দাপাদাপি। বাবা সারা গায়ে সাবান মেখে দেন। জলের ওপর ভাসতে থাকে সাবানের ফেনা। বাবা আমার বুকের দুই পাশে ধরে পানিতে ডুব দেওয়ান। একবার,দুইবার,তিনবার।সাঁতার শিখতে হবে। বাবা দুই বাহু ধরে রাখেন। আমি পা ঝাপটাই।তাতে পুকুর থেকে লাফিয়ে ওঠে সাদা জল সম্ভার। বাবা হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যান। আমি ভয় পাই। হাত-পা ছুঁড়ি। বাবা এমন করছে কেন? তলিয়ে যাই যদি? না, তলিয়ে যাবার আগে ডুবুডুবু শরীরের নিচে বাবার দুই হাত। আহা! কী আনন্দ! অলৌকিক আনন্দে আমি হাসি। জীবনের আহ্বানে ছুটতে ছুটতে,যখন নিজের ভুলে কিংবা অন্য কোনো মায়াবী আয়োজনে,তলিয়ে যেতে থাকি,অস্থিরতায় প্রাণান্তকর তড়পাই,ছড়ানো-ছিটানো কুহকে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে,ঝড়ে-পড়া নৌকার মতো দুলতে থাকে তামাম দুনিয়া,তখনই সমস্ত চরাচরে ভেসে ওঠে,বাবা,তোমার মুখ। আমি নিশ্চিত হই,আমি নিশ্চিত হই,নির্ভার হই—তলিয়ে যাবার আগে তোমার মমতাময় বলিষ্ঠ দুই হাত আমাকে পাড়ে তুলে দিবে।

এরকম হাজারো স্মৃতি তোমার জড়িয়ে আছে। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা তুমি ব্যবহার করতে। মেলায় যাব টাকার বায়না,টাকা দিতে চাওনি,চশমার হাতল ভেঙ্গে দিয়েছি। ভয়ে ভয়ে তোমার আড়ালে গেছি। শাস্তিতো দাওনি, ডেকে ৫ টি টাকা দিয়েছো। কী যে অবাক হয়ে যেতাম! তোমার স্নেহ এতো কেনো গাঢ় ছিল বাবা? কত কথা যে মনে পড়ে! সে স্নেহগুলো এখন অশীতিপর চোখের নালায় জোনাকির সাঁকো;সন্ধ্যার বন্ধ্যা দীপাবলি-কফিনে ভরা শুধু! তোমার শুন্যতা সকাল বিকাল রোদ হয়ে মিশে যায় শিশির জলের মতো!

বাবা হয় মহাকাব্য। মহাকাব্যের নায়ক। বাবা হয় আকাশ। আর আকাশ ভরা তারা। মেঘের মতো কোমল বাবা, ফুলের মতো নরম। বাবা হয় সাত সমুদ্র অনন্ত ইশারা।

মৃত্যু তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সেই কবে। অনেক বছর পার হলেও বর্ষার বাতাসে মহাকালের ওপার থেকে তোমার গন্ধ আসে। কিছু কিছু মৃত্যু মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়, কিছু কিছু মৃত্যু অনপনেয়,পলেপলে অনুক্ষণ কেবল কষ্ট বাড়ায়!আর সেটা যদি হয় মা-বাবার! তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার কারো হৃদয় থেকে পৃথিবী মুছে ফেলতে পারে না।তোমাকেও পারেনি! তোমার জন্য হৃদয়ের অন্ত:পুরে সবসময় বয়ে বেড়ায় চির করুণ এক হাহাকার অসহায় তোমার সন্তান কেবল বলতে পারি- ‘রাব্বির হামহুমা-কামা রাব্বায়ানির সাগিরা”।

লেখক পরিচিতি: জিল্লুর রহমান প্রামানিকের জন্ম গাইবান্ধা জেলায়। অনেকদিন ধরেই তিনি লেখালেখির সাথে জড়িত। নীলাম্বরে নীলপরী, বুকের গহীনে,মহাঢেউ, তার যৌথ কাব্যগ্রন্থ। ২০২০ সালে জাতীয় গ্রন্থমেলায় তার একক কাব্যগ্রন্থ ‘ফোঁটায় ফোঁটায় উষ্ণ কিছু জল’ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/