আফরোজা অদিতির প্রবন্ধ ‘ভালোবাসা চিরন্তন’

আফরোজা অদিতি

ভালোবাসা চিরন্তন

‘তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’/ সখী, ভালোবাসা কারে কয়!’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়েই শুরু হলো ভালোবাসার তালাশ! ভালোবাসা কাকে বলে? কোথায় থাকে? ভালোবাসাকে কী ডেকে বলা যায় আমার কাছে এসো, একটুখানি আমার পাশে বসো, আমার হাতটি ধরো। আমার বুকের গহন-গভীরে হাড়-পাজড়ের তলে আসন পেতেছি তোমার একটু জিরিয়ে নাও, তোমাকে চিরন্তনী মহিমায় মহিমান্বিত করে যাবো! কী ভাবছেন? ভালোবাসা আসবে না! আসবে, আসবে, ভালোবাসা আসবে; আসবেই যদি তাকে ডাকার মতো ডাকতে পারা যায়, তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদাপূর্ণ আসনটুকু দেওয়া যায় তাহলে ভালোবাসা আসবে এবং যতœ-আত্তি করলে চিরটাকাল থেকেও যাবে! কারণ ভালোবাসা শুধুমাত্র আকর্ষণের মাধ্যমে হয় না। ভালোবাসার সঙ্গে যদি সম্মান-শ্রদ্ধা-বিশ্বাস না থাকে তাহলে তা কখনও টিকে থাকে না, থাকবে না, থাকতে পারে না! আর তাকে ভালোবাসা বলে অভিহিত করাও যাবে না। এবারে “ভালোবাসা দিবস”এর কথা : “ভালোবাসা দিবস” এলো কবে, কোথা থেকে? আমাদের বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকে “ভালোবাসা দিবস”-এর প্রচলন শুরু হয়। যায় যায় দিন পত্রিকার সম্পাদক তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশে “ভালোবাসা দিবস”-এর পরিচিতি তুলে ধরেন। সেই থেকে বাংলাদেশে চলছে মহাতোড়জোড়ে “ভালোবাসা দিবস।”       

বর্তমানে “ভালোবাসা দিবস”-এর ইতিহাস সবারই কমবেশি জানা আছে। সেই যে, ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে নিষিদ্ধ ধর্ম প্রচারের অভিযোগে সেন্ট ভ্যালেটাইন নামে একজন খ্রিষ্টান পাদ্রীকে বন্দী করা হয়েছিল এবং তিনি বন্দী অবস্থাতে একজন কারারক্ষীর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে দেওয়ার পর সেন্ট ভ্যালেটাইন-এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় তৎকালীন রোম স¤্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে মত্যুদ- দেন এবং ১৪ ফেব্রুয়ারী সেই মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এরপর ৪৯৬ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি “ভ্যালেটাইন ডে” হিসেবে ঘোষণা করেন পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম। এবং সেই থেকে প্রত্যেক বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি সেন্ট ভ্যালেনটাইন’স ডে উদ্যাপিত হয়। এই দিনটিকে “ভালোবাসা দিবস” বা “সেন্ট ভ্যালেনটাইন’স ডে” কিংবা “ভ্যালেটাইন’স উৎসব”ও বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি দেশে এই দিবস উদ্যাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং প্রত্যাখ্যান করা হলেও বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্যে এই দিবস মহাসমারোহে পালন করা হয়। আমাদের বাংলাদেশেও এই দিবসটি “বিশ্ব ভালোবাসা দিবস” নামে পালিত হয়ে আসছে। পঞ্জিকা অনুসারে ১ ফাল্গুন (১৩ ফেব্রুয়ারি) বসন্ত উৎসবের মাধ্যমে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করা হয় এবং তারপর দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি “ভালোবাসা দিবস” পালিত হয়।   

ষড়ঋতুর এক ঋতু বসন্ত। ফাল্গুন-চৈত্র এই দুই মাস মিলিয়ে বসন্তকাল। শীতের জড়তা কাটিয়ে আসে বসন্ত, প্রকৃতিতে লাগে দোলা। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর প্রকৃতি উজাড় ঢেলে দেয় পত্রপুষ্পসহ সপ্তরঙের ডালি; পুষ্পিত প্রকৃতির ডাকে হেসে ওঠে,আনন্দিত হয় মানুষের মন, মানবাত্মা। বসন্তে প্রকৃতির রূপ অতুলনীয়। আকাশ থাকে নির্মল আর সেই আকাশে অজ¯্র তারার মেলা মানবচক্ষুকে দেয় আরাম। গাছে গাছে সবুজ পাতার আড়ালে ডাকে কোকিল। দখিনা বাতাস বয়, ফুলে ফুলে ওড়ে প্রজাপতি, ভ্রমরগুঞ্জনে মুখর হয় পুষ্পকানন। স্বচ্ছ সুন্দর প্রকৃতির সব কিছু মিলিয়েই বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়। বাংলাদেশে এই দিনটিকে বরণ করতে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন কমিটি পহেলা ফাল্গুন চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে বসন্ত উৎসব-এর আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সালে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ পালিত হয়। বাংলাদেশে অনেক উৎসবের মধ্যে ‘ঋতুরাজ বসন্ত’কে বরণ করাও একটি উৎসব এবং সেই উৎসবের রেশ থাকতে থাকতেই পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি “ভালোবাসা দিবস” পালিত হয়ে আসছে। বসন্ত উৎসব এবং ভালোবাসা দিবস, এই দুইদিনেই তরুণ-তরুণী, বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশু-কিশোরেরা ঘুরে বেড়ায় হলুদ পোষাক বা ঝলমলে নতুন পোষাকে; দেখতে ভালো লাগে, ভালো লাগে আনন্দ উচ্ছ্বল জীবনের ঐটুকু পথচলা। এ যেন নিজে আনন্দ পাওয়ার সঙ্গে অন্যকে আনন্দ দেওয়া। এই দিনে অনেক সন্তান তাঁদের মা-বাবার সঙ্গে সময় কাটায় অর্থাৎ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায়, উপহার দেয় খারাপ তো কিছু নয়। আমাদের এই কঠিন জীবনযাত্রায় যদি কোনো দিবস উপলক্ষ্য করে একটু আনন্দ পাওয়া যায় ক্ষতি তো কিছু নেই। কার্ড বিনিময়, শুধু কার্ড বিনিময় নয় যে কোনো ছোটোখাটো নতুন উপহার পেলেই মানবচিত্ত আনন্দমুখর হয়, উদ্বেল হয়! এই দিন উপলক্ষ্যে বাবা-মা উপহার দেন সন্তাদের, সন্তান দেন তাঁর বাবা-মা-বয়স্কজনদের;পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। বন্ধু-বান্ধবীরা তো আছেই! বর্তমানে এই কঠিন সময়ে যদি পারস্পারিকভাবে একটু সময় আনন্দে কাটানো যায় মন্দ কি! অনেকে ‘ভালোবাসা দিবস’ উপলক্ষ্য করে দরিদ্র বয়স্ক এবং শিশুদেরও উপহার দিতে পছন্দ করে।

“ভালোবাসা দিবস” উদ্যাপিত হয় কিন্তু ভালোবাসা কী? সকলেই জানে ভালোবাসা হলো অদৃশ্য-অনুভব। আসলেও তাই; ভালোবাসা হলো মানবিক অনুভূতি এবং আবেগীয় অভিজ্ঞতা। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে অনুসারে  ভালোবাসা অর্থ :
১.¯স্নেহ, প্রীতি : সন্তান এবং সন্তানতুল্য যারা তাঁদের প্রতি যে ভালোবাসা তা হলো ¯েœহ এবং বন্ধুত্বের প্রতি ভালোবাসা হলো প্রীতি। স্নেহের সঙ্গে অবশ্য প্রীতি জড়িয়ে থাকে, প্রীতর সঙ্গে স্নেহের।  
২. প্রণয়, আসক্তি : স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে থাকে প্রণয়, আসক্তি। প্রণয় বা আসক্তির সঙ্গে সম্মানবোধ যুক্ত না থাকলে বন্ধন দৃঢ় ও সুন্দর হয় না।
৩. পছন্দ : পছন্দের বই পড়া, খাবার খাওয়া, পোষাক পরাও হলো ভালোবাসা; খাবার, বই, পোষাকের প্রতি ভালোবাসা।
 এই রকম ভালোবাসার মধ্যে আছে ভ্রমণ করা, লেখালেখিসহ অন্যান্য পছন্দের কাজ করা। এক কথায় যে কাজ পছন্দ
    নিয়ে শ্রম-শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করা হয় এবং যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে উচ্ছ্বাস তাই ভালোবাসা।
৪. ভক্তি : ভক্তি, ভালোবাসা থেকেই আসে। শুধু ভালোবাসা নয়, এই ভালোবাসার সঙ্গে যদি সম্মানবোধ জড়িয়ে না থাকে
    তাহলে ভক্তি করা যায় না। অর্থাৎ যে ভালোবাসায় সম্মান থাকে না সেখানে ভক্তি আসে না।  

এ কথা ঠিক যে, নিজের হৃদয় উপুড় না করলে অন্যের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। প্রেম শুধু দেশ এবং ঈশ্বরেই হয়! এক হিসেবে অনেকেই মনে করেন প্রেম হলো একে অন্যের প্রতি দৃঢ় আকর্ষণ বোধ করা। এবং ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কিত উত্তেজনাপূর্ণ আবেগীয় মনোদৈহিক এক রহস্যময় অনুভূতি। কথায় আছে “প্রেম যে কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়ে না”- সাধারণত প্রেম অর্থ দুয়ের মাঝে পারস্পারিক সম্পর্ককেই বুঝ্য়া। এই প্রেম আবার প্লেটোনিক ভালোবাসা বা আত্মিক ভালোবাসাও বলা যায়। এই প্লেটেনিক ভালোবাসা বা প্রেম এতোই শুদ্ধ যে এর সঙ্গে কোনোরকম চাওয়া-পাওয়ার যোগ থাকে না। এই প্রেম বা ভালোবাসয় শুধুই ভালোবেসে আনন্দ, শুধু নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই সুখ। আর নয় ভালোবাসার কথা কারণ ভালোবাসার কথা বলে শেষ করা যায় না। শুধু মনে রাখতে হবে ভালোবাসা অনুভব দিয়ে টেনে রাখে জীবন, এই সংসার! সঙ্গে এটাও স্মরণযোগ্য যে, ভালোবাসা আর প্রেম এক নয়।     

ভালোবাসা আর প্রেম মানুষকে তার ঈশ্বর, দেশ ও জীবন সম্পর্কে ধারণা দেয়, পারস্পারিক সৌহার্দ্যবোধ আর সম্প্রীতি বজায় রাখতে সহায়তা করে। সৌভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে এবং সব বিষয়ে পরিমিতি বোধের দীক্ষা দেয়। ভালোবাসা জীবনের করিডোরে সুবাতাস বইতে সহায়তা করে এবং একে অপরের সঙ্গে বসবাস করতে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। জীবনধারণ এবং উন্নত জীবনের সোপানে আরোহনের জন্য ভালোবাসা খুবই জরুরী। তাই জীবনের জয়গান হোক প্রেম করো ঈশ্বরে আর নিজ জীবনকে ভালোবাসো। নিজেকে ভালোবাসতে না জানলে বা না পারলে কখনও অন্যকে ভালোবাসা যায় না, কোনো শুভকাজ করার জন্য ভালোবেসে এগিয়ে যাওয়া যায় না! আর সুকর্ম না করলে উচ্চশিখরে পৌঁছানো যায় না কখনও। এই উচ্চশিখর হলো মৃত্যুর পরেও এই পৃথিবীর বুকে নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা, যা প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজন।  

আফরোজা অদিতি: কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫৫টি। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার যার মধ্যে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, কবি কামিনী রায় সাহিত্য পুরস্কার, কবি জীবনানন্দ দাশ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ নারী লেখক সোসাইটির পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।
ওমেন্স নিউজ/