ইউসুফ শরীফের গল্প ‘সুবাস মদির’

ইউসুফ শরীফ

সুবাস মদির

আচমকা একটা নেশার মত ঘ্রাণ এসে লাগে রাতিনের নাকে-একেবারে তরতাজা নতুন-আর কোনদিন টের পায়নি। এক ফুটেরও কম দূরত্বে লুলু দাঁড়িয়ে। ঘ্রাণটা রাতিনের চেতনায় ঝর ঝর করে ছড়িয়ে পড়ছে। স্পষ্ট মনে হল তার কষ্টের সবটুকু গলিত ধারা চুষে নিচ্ছে।
লুলুর দিকে তাকায়- চোখে কৌতূহলের সাথে বিস্ময় গভীর হয়ে ওঠে- লুলু চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর রাতিনের হাত থেকে টিউটোরিয়াল নোটের ফটোকপিগুলো নিয়ে নরম পা ফেলে ভেতরে ঢুকে যায়।
ও চলে যাবার পর রাতিন নিশ্চিত হল ঘ্রাণটা লুলুর শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছে। বাসায় ফিরে রাতিন সোজা বিছানায়। অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল- অফুরন্ত অবসর- বাড়ি ফাঁকা- আছে শুধু বাবুর্চি। আব্বা অফিসে যান সকাল আটটায়- ফিরেন বিকেল চারটায়। আবার ছ’টায় বের হন- রাত বারটায় ফিরেন- তখন আর আব্বাকে আব্বা মনে হয় না। আম্মা! না- মনোরম এই শব্দটা মন-মগজ ও চেতনায় বিবর্ণ অর্থহীন। বালিশটা বুকের তলায় নেয়- উপুড় হয়ে শোয়- চোখ বন্ধ করে। এক ফুটেরও কম দূরত্বে লুলু- আর্দ্র গভীর ঘ্রাণ- লুলুর সতেজ মসৃণ ¯িœগ্ধ শরীরের সুবাস। কত দেখেছে লুলুকে- টইটম্বুর শরীরের অনাঘ্রাত এ ঘ্রাণ তো পায়নি! এখন লুলু ফার্স্ট ইয়ার অনার্সে- ও যখন সেভেন কী এইটে তখন থেকেই দেখছে- এরকম কাছাকাছি হয়েছে বহুদিন বহুবার- কিন্তু রোমকূপজাত এ ঘ্রাণের পরশ!
ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে ওঠে রাতিন। লুলু ভাল মেয়ে- চমৎকার মেয়ে- সামনে দাঁড়ালে রাতিনের কষ্টকর পৃথিবী- শ্লেটে-কষা অঙ্কের মত মুছে ফেলা যায়। নীল সাগরের বুকে আরেক পৃথিবী জেগে উঠতে চায়- পুরাপুরি নয়। তবু মনে হয় এ এক নতুন পৃথিবী- নতুন গাছে প্রথম কুঁড়ি দল মেলতে থাকার মত। আজ লুলুর মদির সুবাস সেই পৃথিবীতে প্রথম তরঙ্গ হয়ে ভাঙছে। মিষ্টি মেওয়ার গাঢ় মাদকতায় ভরা এ আবেশ- চৈতন্যে কী এক উন্মোচনের তাগিদ জাগে- রাতিন পরিষ্কার বুঝতে পারে না।
কেন এরকম জাগছে- কিভাবে জাগছে এ কৌতূহল ছাপিয়ে অনাস্বাদিত পুলকে দুলছে রাতিন। পৃথিবীর স্বপ্নের যাবতীয় সুখ রেণু রেণু হয়ে শরীরের কোষে কোষে দাপাদাপি করছে। অস্থির রাতিন চোখ বন্ধ করে ভাবছে- লুলুর শরীরের এ ঘ্রাণ কাউকে না কাউকে উদ্বেলিত করে তুলবে- আদরে আদরে সিক্ত হবে লুলু!
বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে রাতিন। ঘরে-বারান্দায়-বেলকনিতে অস্থির পায়চারি করে। যে করেই হোক যেভাবেই হোক এ সুখানুভূতির খবরটা জানিয়ে দিতে হবে লুলুকেও- লুলুও কী রাতিনের শরীরের এমন কোন ঘ্রাণের আবেশ টের পায়!
আবার বের হয়- লুলুদের বাসার ডোর বেলের বোতামে হাত রাখে- টিপতে যাবে- অমনি দরজা খুলে যায়। লুলু বেরিয়ে আসে- লুলু ক্লাসে যাচ্ছে। রাতিনকে দেখে থমকে দাঁড়ায়- দাঁড়িয়ে থাকে- চোখে দিগন্তপ্রসারী দৃষ্টি।
আবারও মিষ্টি মেওয়ার সেই মদির সুবাস- আকুল রাতিন অজানিতে হাত বাড়ায়- লুলুর কামিজের মাঝামাঝি ইঞ্চিখানেক তফাতে স্থির তার হাত।
রাতিনের অস্থির এলোমেলো কণ্ঠ, লুলু- আমি তোমাকে-
চোখ তুলে তাকায় লুলু- বিব্রত দৃষ্টি-
রাতিন তাকাতে পারে না- প্রাণপণ আবেগে মুখ খুলে, তোমাকে- তোমাকে একটা কথা বলব- অদ্ভুত সুন্দর-
লুলু চুপ- কিছু বলে না- চোখে আগ্রহের আতিশয্য নেই যে রাতিন উৎসাহিত হয়ে ওঠবে- আবার অনাগ্রহও নেই যে হতাশ হবে। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রাতিন লুলুর সুবাসিত শরীরের একদম কাছাকাছি। লুলু অপেক্ষা করে- অপেক্ষা যখন প্রশ্ন হয়ে ওঠতে যায় তখন ঘড়ি দেখে।
তারপর মুখ খুলে, ভেতরে যান রাতিন ভাই- আম্মী আছেন- আমার ইউনিভার্সিটি বাসের সময় হয়ে এসেছে- কিছু মনে করবেন না- প্লীজ-
লুলু রাতিনের বুক ঘেঁষে দু’ধাপ সিঁড়ি নিচে নেমে যায়- দ্রুত পায়ে মোড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই ফিরে তাকায় এবং একটা কলি ফুটিয়ে তোলে অধরোষ্ঠে। রাতিনের তাই মনে হল। লুলু কি তাহলে- না- নিশ্চয়ই বুঝতে পারেনি।
লুলুর আম্মা রাতিনকে আদর করেন- ভালবাসেন। নিরিবিলি হলেই রাতিন ভাবে- সব আম্মা কেন অমন হয় না?
লুলু জানে রাতিন ওদের এখানে আসে আম্মার কাছে- আম্মার জন্য।
রাতিন ভাবে লুলুদের তিন কামরার এই বাসা কথাটা বলার জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত নয়- বিকেলে লাইব্রেরিতেই যাবে সে।

রোদ তখনও তীব্র-মোটে চারটা বাজে- চারদিকে ঝিমধরা নীরবতা- নেহাৎ দায়ে না ঠেকলে ঘরছাড়া দায়।
রাতিন বাড়ি থেকে বের হয় নিঝ্ঝুম দুপুরের শেষ প্রান্তে- মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখল প্রচ- রোদে লুলুদের কাঁটা মেহেদির বেড়া-সাদা বাড়ি-আশপাশের বাড়িগুলোও মিঁইয়ে এসেছে। রাস্তায় তাতিয়ে-ওঠা পীচ যেন থকথক করছে।
রোদে ম্রিয়মান একটা বাস এসে থামল স্ট্যান্ডে। জনাপাঁচেক ক্লান্ত লোক নামল। চুপচাপ যে যার গলিতে ঢুকে গেল। কোনদিকে নজর নেই কারও- ঘরে ফেরার তাড়ায় অস্থির। রাতিনের দৃষ্টির মাঝ বরাবর রোদে কাহিল বাস গোঙাতে গোঙাতে স্ট্যা- ছেড়ে গেল। রাতিন এক পা-ও নড়েনি- বাস ধরার ন্যূনতম চাঞ্চল্যও অনুভব করেনি।
রাস্তার অপর পাড়ে ন্যাড়া জামগাছটার কাণ্ডের ছায়ায় বুড়া রিকশা মেকার দিব্যি গামছা পেতে ঘুমিয়ে আছে- রাতিন ঘুমাতে পারেনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও। ঘুমাতে না পারার মধ্যেও মধুরতম ভাল-লাগার আমেজ জড়িয়ে থাকে- রাতিন সদ্য এ অভিজ্ঞতায় হতবুদ্ধি-
গাড়ি গ্যারেজে রেখে বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোলার মধ্যে- চ্যাপ্টা হওয়ার মধ্যে আবিষ্কারের মত যে একটা ব্যাপার আছে তা-ও ইতোমধ্যে টের পেতে শুরু করেছে রাতিন। বছরখানেক ধরে ওর জন্য গাড়ি বরাদ্দ- ড্রাইভিং জানে তবু ড্রাইভার আছে- সেই ড্রাইভার আনসার গ্যারেজের উপর-খোপে শুয়ে গোয়েন্দা সিরিজ পড়ে পড়ে নিজেকে প্রায় গুপ্তচর ভাবতে শুরু করেছে।
মাঝে-মধ্যে রাতিনকে বলে, ছোটসাব আর কয়দিন পর তো রাস্তায় নামলে স্টিয়ারিং ধরবার পারতাম না। আর কোন টেকনিক্যাল কাম তো জানি না- রুটি-রুজির পথটা বন্ধ কইরেন না ছোটসাব।
টিএসসি’র সামনে বাস থেকে নেমে ব্যস্ত রাস্তা পারাপারে রাতিন আরও আনাড়ী। ডান-বাম ভাল করে না দেখে এক পা-ও আগায় না। আজ ড্যামকেয়ার ভঙ্গিতে রাস্তা পার হয়। ভাবখানা এরকম : রাতিন মেহবুব রাস্তা পার হচ্ছে। যানবাহন সকল তোমরা দেখে পথ চল। আগে পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হতেও হয়নি- গাড়ি ওয়ার্কশপে থাকলে স্কুটার করে ক্লাশে এসেছে।
রাস্তার দিক্কার গেট বন্ধ। রোকেয়া হলের সামনের গেট দিয়ে তাকে ঢুকতে হয় লাইব্রেরিতে। ঝাড়া হাত-পা- রিসিপশনে গিয়ে টোকেন নিতে হয় না- সোজা সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায়।
লুলু তো বরাবর ক্লাশ শেষে শর্মীর সাথে লাইব্রেরিতেই বসে- আজ নেই। ওকে দেখে শর্মী বেলকনিতে বেরিয়ে আসে- রাতিন শর্মীর দিকে তাকায়। একরাশ কালো এলোচুলের পটে সোনালি রঙের ঈষৎ ডিম্বালু ভরাট মুখ। মধ্যমাকৃতি নাকে কয়েক ফোঁটা ঘাম মুনস্টারের মত টলমল করছে। কমলার কোয়ার মত আধরোষ্ট গোলাবী রেখাঙ্কিত- আপাত: শুষ্ক অধরে একটা চাপা আলোড়ন।
একটু আগেই অন্ততঃ তিরিশ সেকে- পর শর্মীর কথাটা তার কানে ঢোকে- নেই। সাথে সাথে রাতিনের অস্পষ্ট কন্ঠ একটা ‘না’-এর মত কেঁপে ওঠে।
শর্মীর সহসা বিস্মিত কন্ঠ : মানে!
রাতিন দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ আর রমনা পার্কের সবুজ মিলেমিশে যেখানে আকাশের নীলে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে- সেই অভূতপূর্ব দিগন্ত রেখায়। লাইব্রেরির এই তৃতীয়তলা থেকে না তাকালে একের পর এক সবুজ তরঙ্গ আর নীল নীলিমার অবিস্মরণীয় এই লীলা-ভঙ্গিমা চোখে পড়ে না- কতবার এখানে দাঁড়িয়েছে অথচ এই অপরূপ দৃশ্য দৃষ্টিসীমায় আসেনি- মনে হয় এই দৃশ্যপটটি আজ এই মাত্র রচিত হয়েছে!
রাতিন চাপা ত্রস্ত আবেগময় কন্ঠে বলে ওঠে, এদিকে- পূবদিকে তাকাও- দেখ দুইপ্রস্থ সবুজের পেছনে একপ্রস্থ আদিগন্ত নীল মিশে কী অপূর্ব রঙের তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে!
শর্মী তাকাল একবার সেই নীল সবুজের বিচ্ছুরণের দিকে আরেকবার রাতিনের দিকে- এক অজানিত বিদ্যুৎ চমক ছুঁয়ে গেল তার চেতনায়- তারই কম্পন স্পষ্ট হয়ে ওঠল চোখের পাতায়- অধরের রেখায় রেখায়।
কম্পিত কন্ঠে বলে ওঠল শর্মী- বাহ! কী অপরূপ! এই এখানে এত কাছে এরকম দৃশ্য তৈরি হয় কোনদিন দেখিনি-
রাতিন ওর চোখে চোখ রাখে- মনে মনে বলে- আমিই কী আগে কখনও দেখেছি! আজ এইমাত্র তুমি যখন এই বেলকনিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালে তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়ল- পরাণ গহীনে রঙের তরঙ্গ ছড়িয়ে গেল। অথচ লুলু আর তোমাকে নিয়ে আগেও এখানে কতবারই দাঁড়িয়েছি- কই এমনটা কখনও মনে হয়নি!
শর্মীর দৃষ্টি ক্রমশঃ প্রসারিত হতে থাকে- রাতিন সেই বিচ্ছুরণ বেয়ে ওর দৃষ্টির গভীরে কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে আচমকা পেয়ে যাওয়ার উল্লাসে বলে ওঠে, আমরা কী ওই সবুজ আর নীলের গভীরে নেমে যেতে পারি না?
শর্মী কোন কথা না বললেও তার চোখে চকিতে প্রশ্রয়ের সলাজ আভা ঢেউ খেলে যায়। রিডিং রুমে ঢোকে শর্মী- রাতিনও তার পিছু পিছু। শর্মী কাগজপত্র গুছিয়ে ছোট্ট পার্সটা তুলে নিয়ে বের হয়- নিঃশব্দ অনুসরণে রাতিন সিঁড়িতে এসে শর্মীর পাশাপাশি পা ফেলে।
লাইব্রেরির নিরিবিলি চাপা সিঁড়ি- চুল থেকে নারকেল তেলের ঘ্রাণ ছাপিয়ে শর্মীর শরীরের গভীর মাদকতাময় সুবাস ওড়ছে- এ কী লুলুর মত না কী আরও গাঢ়- কোমল- বুঝতে পারে না। মনে হয় শুধু সুবাস খনির দুর্লভ ছিদ্র পথে দমকে দমকে মদির আবেশ রাতিনের লোমকূপের গোড়া বেয়ে শোণিতে এসে ভাঙছে। অজানা এক মোহন অনুভূতিতে ভাসতে ভাসতে রাতিন নিচে নেমে আসে। কাউন্টার থেকে বই-পত্র ব্যাগ নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় শর্মী- ফুরফুরে হাওয়ায় ওড়না উড়ছে। রাতিন পাশে- শেষ বিকেলের সূর্যালোকে ছায়া তাদের কখনও দীর্ঘ- কখনও অবিচ্ছিন্ন এবং অস্থির।
নীরবে হাঁটতে হাঁটতে গেট পেরিয়ে রাস্তা- তারপর উদ্বেলিত সবুজের বিস্তার- সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সবুজ আচ্ছাদিত ঘাসের বিছানায় বসে পরস্পরের দিকে তাকাতে গিয়ে হেসে ওঠে। আগেও কাছাকাছি হয়েছে- মুখোমুখিও হয়েছে- তবে প্রাণের গহীন থেকে হাসি আচমকা মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত করে গড়িয়ে পড়েনি সবুজ লাবণ্যে।
বেশ কিছুক্ষণ অস্বাভাবিক নীরবতা শেষে শর্মীই বলল, কী ঘন সবুজ রঙ হয়েছে পাতার-
রাতিন বলল, আষাঢ়-শ্রাবণে এমনি ঘন হয়ে উঠে গাছপালা- প্রকৃতি আর মানুষের মন।
শর্মী টলমলে দু’চোখ বড় করে বলল, মানুষের মনও?
রাতিন উৎফুল্ল হয়ে ওঠতে গিয়ে সহসা কোন কথা খুঁজে পায় না। মনে হয় এই আর্দ্র ঘন নিঃসঙ্গ সবুজ তার সব কথা চুঁষে নিয়েছে। ভেজা ভারী সবুজ বেস্টনীর সর্বত্র থেকে শর্মীর শরীরের সেই মদির ঘ্রাণ তার নাসারন্ধ্রে ঢুকে যাচ্ছে। লুলুর ঘ্রাণও কি এখানে এরকমই ছড়িয়ে পড়ত? কে জানে! লুলুর কথা ভাবতে গিয়ে রাতিন চোখ ফেরাল শর্মীর দিকে। দেখল তার হাতের বড়জোর তিন আঙুল দূরে শর্মীর দীঘল আঙুল সমেত অসম্ভব ফর্সা হাত-
রাতিন ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলে, শর্মী তোমার হাতটা একটু ধরি?
শর্মী ফিক করে হেসে বলল, হাত ধরতে হয় বুঝি?
কি বলবে রাতিন? একটু ভেবে নিয়ে বলল, ভারী ইচ্ছা করছে এখন।
সাথে সাথে চাপা কলকলে কন্ঠে শর্মী বলে ওঠে, একলারই বুঝি ইচ্ছে?
রাতিন জবাব দেয় না- হাত বাড়িয়ে শর্মীর হাতটা তুলে নিতে গিয়ে একটু থামে- হাত কাঁপে- বুকের কম্পন আরও দ্রুত হয়। চেতনাশূন্য এক শূন্যতায় সে ওর হাত তুলে নেয়- শর্মীর হাত গোলাবী-নখের রঙ গোলাবী-হাতের রেখার রঙ গোলাবী এবং সিল্কের মত মসৃণ-বিড়ালের লোমের মত নরম-ভাপা পিঠার মত উষ্ণতা আবৃত- এই সবগুলো বিশেষণ একসঙ্গে ভিড় করে সামনে দাঁড়াল-
হাতটা ধীরে ধীরে মুখের কাছে তুলে এনে রাতিন এক নিঃশ্বসে বলে ফেলল, একটু শুঁকে দেখি-
রাতিনের বুকে সাহসের ঝর্ণাধারা যেন আগেই উদ্বেলিত হয়ে ছিল। জবাবের অপেক্ষা না করে শর্মীর পেলব হাতে অধরোষ্ঠ চেপে ধরে রাতিন লম্বা করে শ্বাস টানল। এ আরেক সুবাস-অজানিত এক সুবাসে তার চৈতন্য হারাবার মতই দশা। স্বপ্নের মধ্যে কথা বলছে যেন- এমন করে আপন মনে বলল, জান তোমার শরীরের সুবাস আমার শরীরের কোষে কোষে সঞ্চারিত হচ্ছে- কী যেন জেগে উঠছে- আমার মধ্যে একটা কিছু যেন জেগে উঠছে। শেষদিকে তার কণ্ঠ কুচান শাড়ির মত কেঁপে  কেঁপে জড়িয়ে গেল। শর্মীর দীঘল চোখের পাতা বন্ধ- রাতিনের অধরোষ্ঠের স্পর্শে শরীর তার বেতস লতার মত শিউরে ওঠে এখন অবশ উন্মুক্ত ও ভারহীন-
চোখ খুলে শর্মী তাকাল রাতিনের দিকে- রাতিনের চোখের গভীরে। রাতিন দেখল শর্মীর চোখে সবুজ পত্র-পল্লবের আর্দ্র মদির ছায়া। রাতিন আবার শর্মীর হাত তার অধরোষ্ঠে ছোঁয়ায়- হাত থেকে হাতে লতিয়ে লতিয়ে বিদ্যুতের মত আকাঙক্ষা-কামনা প্রবাহিত হয়- দুমড়ে-মুচড়ে ফেলতে চায়-
শর্মী অস্ফুট কন্ঠে বলে ওঠে, উহ্!
শব্দটা অশ্রুতপূর্ব কাতরানির মত মনে হয় রাতিনের- সে চমকে ওঠে, কি হল শর্মী?
শর্মীর ভাঙাচুরা গুঁড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠ অনেক দূর থেকে ভেসে আসে, উহ্-নো-নো রাতিন- প্লীজ-প্লীজ রাতিন-
রাতিনের একটা হাত সজোরে আঁকড়ে সে চুরমার করে ফেলতে চায়- এত জোর শরীরে কোথায় সঞ্চিত ছিল বুঝতে পারে না শর্মী!
রাতিন বিহ্বল হয়ে ওঠে, শর্মী এ্যানিথিং রং?
শর্মী রাতিনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে ভাঙাচোরা কন্ঠে কঁকিয়ে ওঠে, আমার ভয় করছে রাতিন- আমি-আমি বুঝতে পারছি না- রাতিন প্লীজ- এমন কোথাও চল যেখানে আর কেউ নেই- আর কারও  কথা মনে পড়বে না-
রাতিন শর্মীর চোখে চোখ রাখে- কোন রঙ নেই- শব্দ নেই- বিচলন নেই- নেই কোন সুবাস- কোন গাঢ় মদিরতা। সন্ধ্যা নামছে- আশেপাশের অনেক চোরা-চোখ তাদের উপর স্থির- বেশ টের পেল রাতিন এবং মুহূর্তেই থেতলে গেল তার সবটুকু স্বপ্নময়তা।

লাইব্রেরি ভবনের তিনতলা থেকে এক লহমায় গড়িয়ে পড়ল- রাতিন তাজ্জব হয়ে গেল- লুলুর জায়গায় শর্মী- অবাক কা-! কিভাবে হল- কি হল- কি করে বিস্ময়কারভাবে মানিয়ে গেল- কোথাও কোন অপূর্ণতাই থাকল না। মনেই হল না- লুলু নামের কোন নারী-শরীরের সুবাস আজ সারাটা দিন- বিগত দিনগুলো তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। চরম বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত- মনে হচ্ছে লুলু নয়- সে শর্মী- লীলায়িত ভঙ্গিমায় প্রবাহিত ¯্রােতোবাহী এক নদী-
সন্ধ্যার অন্ধকার যখন তিনতলার বেলকনিতে ঘনত্ব অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তারিত করে দিয়েছে- তখন রিডিং রুমে কাঁচের দরজা ওপাশে পূবদিকে মুখ-করা টেবিলটায় দেখল- যা আগেও দেখেছিল- লুলু নেই- শর্মী পাঠে-নোট মগ্ন- ওরা দু’জন বরাবর এ টেবিলে বসে লাইব্রেরি ওয়ার্ক করে- ভাগাভাগি করে।
চমকে তাকায় শর্মী- নিঃশব্দে অপ্রস্তুত হাসে। হাসে রাতিনও- এরকম হেসেওঠার কথা ছিল তার আজ লুলুর দিকে তাকিয়ে।
রাতিন দরজা ঠেলে বেলকনিতে এসে দাঁড়াল- সামনে অবারিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান- তারপর রমনা পার্ক। শর্মী এসে ওইভাবেই বেলকনিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।
রাতিন চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ায় শর্মীর টেবিলের কাছে- মিনিট পাঁচেক- শর্মীর নাকে- অধরোষ্ঠের উপর ফোটা ফোটা ঘাম- রাতিনের চোখ পড়ে- অবাক কা– মেয়েদের বিন্দু বিন্দু ঘাম কী চমৎকার মুক্তো হয়ে ওঠেছে। কেন এমন লাগে- কেন বুকের ভেতর খা খা করে দাপিয়ে ওঠে? ইচ্ছে হয় ভোরের শিশিরের মত ফোঁটা ফোঁটা ঘাম-জল অধরোষ্ঠ চেপে চেপে শুষে নিতে।
রাতিনের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলে, লুলু তো? আজ ও ক্লাশ সেরে সোয়া একটায়ই চলে গেছে।
রাতিন তাকিয়ে থাকে। তার সামনে শর্মী না লুলু- লুলু না শর্মী- বুঝতে পারে না।
রাতিন তখন শাহবাগের মোড়ে আর শর্মী নিশ্চয়ই এতক্ষণে রুমে ঢোকে টেবিলে নোটটোট ছুঁড়ে দিয়ে সোজা বিছানায়। রাতিনের তখন আবার লুলুর কথা মনে পড়ে গেল- আজ সকালের প্রথম সুবাস কোন ফাঁকে তার চেতনায় আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল। রাতভর টানাপড়েন- চলতে থাকে ভোর পর্যন্ত।
রাতিন এইটুকু কল্পনা করতে গিয়ে টের পেল- কী সাংঘাতিক লোক এই গল্পকাররা-তাদের চেয়ে আবার কয়েক ধাপ উপরে যারা উপন্যাস লেখেন।
আবেগ-ঘন এই গল্পাংশ লুলু না শর্মী- কাকে শোনাবে! এই কিছু সিকোয়েন্স থাকুক তার অলিখিত চিত্রনাট্যে- কখনও কোনদিন যদি মনে পড়ে লুলুর সাথে শেয়ার করতে পারবে!
ঠিক তখনই রাতিনের দৃষ্টি বরাবর লুলুকে পিজি’র গেট থেকে সাবধানে রাস্তা পার হয়ে এপারে আসতে দেখা যায়। বুক কেঁপে ওঠে- অস্থির উদভ্রান্তের মত সে জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে। আরেকটা বাস আসছে গোঙাতে গোঙাতে- আচমকা স্ট্যা-ের দিকে হাঁটতে শুরু করে রাতিন।
পেছনে লুলুর কণ্ঠ ভেসে আছে, রা-তি-ন…ভা-ই-ই-  
রাতিন রীতিমত দৌঁড়াতে শুরু করলেও অনভ্যস্ত পায়ে স্বচ্ছন্দে দৌঁড়াতে পারছে না। লুলু আর তার মাঝখানে দূরত্বটা কিছুতেই বাড়াতে পারছে না-

ইউসুফ শরীফ: দেশের স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক ও কবি। তার প্রকাশিত ছোটগল্পের সংখ্যা ৭০ এবং প্রকাশিত উপন্যাস ২১টি। তিনি কথাসাহিত্যিকদের সংগঠন কথাসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।

ওমেন্স নিউজ/