সুলাইমান মাহমুদ রাসেলের গল্প ‘তৃষিত যৌবন’

সুলাইমান মাহমুদ রাসেল

তৃষিত যৌবন

রোদেলা সকাল। গাছের শ্যামল ছায়ায় দাঁড়িয়ে মাহিন।
অপেক্ষা
কখন আসবে জেরিন?
ও আজ কি পড়ে আসবে, কি রঙের সালোয়ার পড়বে? জেরিনের কথা ভাবতে ভাবতে প্রেমের সাগরে তলিয়ে গেছে।
কখন যে পথের ধূলিমাখা সেগুনকাঠের ওপর বসে পড়েছে সে উক তার নেই!
হঠাৎ অবচেতনার ঘোর থেকে ফেরা মাহিন উঠে দাঁড়াল। হাতঘড়িতে চোখ ফেলতেই ঘড়ির কাটা ন'টা থেকে সাড়ে ন'টায় গড়ালো।
’কি ব্যাপার, জেরিন এখনো আসছে না কেন?'
মাহিনের আর তর সইছে না, কখন আসবে আর কখন সে মন খুলে বলবে— জেরিন আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি আমার জীবনের চেয়েও তোমাকে বেশি ভালোবাসি’।

সদ্য ফোটা তাজা গোলাপ হাতে অপেক্ষারত পরিপাটি সুদর্শন যুবক মাহিনের মনে বসন্তের উতাল হাওয়া বইছে। কিন্তু কোথাও জেরিনকে দেখছে না। আজ ভালোবাসা দিবসে প্রথম শুভেচ্ছা তাকেই জানাবে বলে সেই ভোর থেকে বসে আছে মাহিন। হঠাৎ দেয়ালের পাশ ঘেঁষে উঁকি মারতেই নজরে পড়ল গোলাপি রঙের সালোয়ার পড়া একটি মেয়ে আসছে। হাঁটু বরাবর ঝিরিঝিরে কালো চুল বাতাসে দুলছে, মুখ ফেরাতেই মাহিন আবেগে উৎফুল্ল। বাহ! কি সুন্দর সেজেছ ও। এই ওটাই মাহিনের স্বপ্নের রানী জেরিন। এক কদম দু'কদম পা এগোচ্ছে তার। কিন্তু জেরিন যতই কাছে আসছে, মাহিনের বুক ততই ধুক ধুক করছে, প্রকম্পিত হচ্ছে।
কাছে আসতে মাহিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছু বলার আগেই মুচকি হাসি দিয়ে জেরিন বলল, শুভ সকাল।
কেমন আছ মাহিন?
মাহিন লাজুক চোখে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, শুভ সকাল। ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
হিম, ভালো।
মাহিন মনে মনে যে কথা বলার প্রস্তুতি নিয়েছিল দুজনের সদালাপের পর আর আগের মতো মানসিকতা নেই। সে হঠাৎ পাল্টে গেল৷
হাতের ফুলটা জেরিন দেখে ফেলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে কি? বাহ! সুন্দর তো। কোথায় পেলে?
'গাছ থেকে এনেছি, তাজা ফুল' বলে মাহিন ফুলটাকে বাম হাত ঘুরিয়ে পেছন থেকে ডান হাতে নিল। জেরিনের তুলতুলে নরম চেহারা দেখে মাহিনের মনে জমানো সব কথাই ভুলে গেল। কেমন শরম লাগছে দাঁড়িয়ে থাকতে। এই লজ্জাই প্রেম, এ লজ্জাই হৃদয়ের সহজাত টান।
জেরিন সপ্রতিভ বলেই ফেলল, দিবে আমাকে? মাহিন হাস্যজ্জ্বোল মুখে জবাব দিল, 'নাও। নিতে পারো।'

জেরিনের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও ভালোবাসার কথাটি আজ পর্যন্ত মুখ ফুটিয়ে বলতে পারেনি। বন্ধুত্ব বিশ্বাস আর আত্মসম্মানের জায়গা থেকে মাহিন নিজেকে ছোট করতে চায় না বিধায় অন্যদিনের মতো আজও বলতে পারেনি তার মনের প্রিয় কথাটি।
জেরিন ভালো করেই বুঝতে পারে যে মাহিন তাকে ভালোবাসে। এবং সেও অন্যদের থেকে মাহিনকেই বেশি কেয়ার করে, জ্বালাতন করে, নিজের কাছের মানুষ ভাবে। তবু জেরিন তা মাহিনকে বুঝতে দিচ্ছে না। গোলাপের সুগন্ধিময় একটি সরস কলি।

দু'জনেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দেখতে চিনতে ক্রমশ তারা আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। রোমান্টিকতার ভুবনে হারিয়ে যাচ্ছে দিন আর দিন। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটাও খুব ভালো। মাহিন পড়াশোনায় একদম খারাপ না। তবে জেরিনের থেকে ভালো নয়। তাই মশকরা করে প্রায়ই মাহিনকে নিয়ে ক্লাসের সবাই মজা করে। কেউবা আবার কুটনামি করে। ও সব গায়ে মেখে নেয় মাহিন। শুধু জেরিনের জন্যই এগুলো সহ্য করে।

মাঝেমাঝে বেশ খটকা লাগে জেরিনকে। কেন যেন মনে হয় মাহিনের, জেরিন তাকে ঠকাচ্ছে! কিন্তু না, মাহিনের মন কোমল। সে অবিশ্বাস্য নর্দমায় পা ফেলতে রাজি না। জেরিনের অপেক্ষায় মাহিনের কতকিছুই হারাতে হচ্ছে।

এখন পড়াশোনা পরিবার প্রতিবেশী একদিকে, জীবন ও জেরিন একদিকে। ভাবনার রাজ্যে শুধু যৌবনবতী জেরিনের রূপের উন্মাদনা। কিন্তু মাহিন বাজে ছেলে না। মাহিন জেরিনের রূপের পাগল নয়। পাগল তার মনের। মায়ায় পড়েছে সে। মানুষের মায়ায়। মানুষের মায়া বড় ভয়ানক। ধরলে আর ছাড়ে না বজ্জীনের চেয়েও ভয়ংকর ও সুদূরপ্রসারী। পৃথিবীর সব মানুষ কিন্তু মেধাবী না তবে সবারই একটা বিশেষ গুণ আছে। কেউ তার চর্চা করতে পারে, কেউ নিজের অজান্তেই ভোঁতা হয়ে যায়। তেমনি মাহিনেরও আছে সততা আর পরোপকারের লিপ্সা। পরের দুঃখে পাশে দাঁড়ানো, পরের বিপদে ঝাপিয়ে পড়া এ তার ছেলেবেলাকার অভ্যাস।

মাহিন বাসায় ফিরে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মাথায় জেরিনের ভূত চেপে আছে। কোনোভাবেই তার কথা ভুলতে পারে না। এক মুহুর্ত ভালো লাগে জেরিনকে ছাড়া। জেরিন মেধাবী ; দেখতে বাদামি ফর্সা। কাজল কালো চোখ, বাঁকা চাঁদের মতো দুজোড়া গাঢ় কালো ভ্রু, কচি মুখ। লালচে ঠোঁটে সেকি স্নিগ্ধতা! যেদিন থেকে মাহিন মেয়েটিকে দেখল, সেদিন থেকেই মনোরাজ্যে এক নতুন সুর বেজে উঠেছে যে সুরের জাদুতে মাহিনের হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা তার জন্যই নিবেদিত।

জেরিন ভালো ঘরের মেয়ে। মাসে হাজার হাজার টাকা ব্যয় হয় তার পিছনে। গান তার প্রিয়। কিন্তু মাহিন বারবার জেরিনকে সাবধান করে আর বলে, তুমি বাঙালি। তোমার কেশবেশ বাঙালির মতোই যেন হয়।
জেরিনের ফোনে রিংটন দেয়া — দিল বারি জানিয়া দিল বারি জানিয়া।
এ রিংটন মাহিনের পছন্দ না। সে জেরিনকে বলেছে — ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা বা মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি দেশপ্রেমের এ গানগুলিও কিন্তু ভালো রিংটন হতে পারে। মাহিনের এ অনুরোধটি জেরিন রেখেছিল। জেরিন যাই করুক, তার প্রতি মাহিনের দুর্বলতা মানসিক, হৃদয়ঘটিত।

যেখানেই তার দেখা সেখানেই মাহিনের উপস্থিতি। অমায়িক বোঝাপড়া। দু'জনের কাজে কথায় বেশ মিল। এ ভেবে মাহিনের আনন্দেরও শেষ নেই। জেরিনও মাহিনের সাথে মিলেমিশে চলে। মাহিনের প্রতি তার অঢেল বিশ্বাস। ক্লাসের ফাঁকে আড্ডায় মেতে ওঠে তারা। সরল মাহিনের মন যেমন উদার তেমনি বিশ্বাসপ্রবণ। তাই জেরিনের সব কথাই সে শুনে। কারণ জেরিনের সুখে দুঃখে তার পাশে থাকতে পারলে মাহিনের যে কি ভালো লাগে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। মনের ভেতর লুকানো ভালোবাসা আজও অপ্রকাশিত। ভালোবাসার দাবি নিয়ে কখনো তার সামনে যায়নি সে। ভয়, যদি তাদের বন্ধুত্ব ভেঙে যায়!

বন্ধু হিসেবে সেয়ানা জেরিন মাহিনকে যখন-তখন কাজে ডেকে নেয়। ক্রিকেট খেলা বন্ধ রেখেও মাহিন জেরিনকে টিফিন এনে দেয়, খাবার পানি, ব্যাগ বইসহ কত কি! জেরিন চকলেট ভালোবাসে। তাই মাহিন প্রায়ই তাকে চকলেট এনে দেয়। এত সুন্দর সম্পর্কের পরও জেরিন মাহিনকে 'জাস্ট ফ্রেন্ড' হিসেবেই মূল্যায়ন করে; মন থেকে না হলেও জনসম্মুখে।
কি এমন বিশেষত্ব জেরিনের? যার জন্য মাহিন এত অস্থির। না সৌন্দর্য, না টাকা পয়সা, না তার শরীরের ঘ্রাণ — মাহিনকে এর কোনটাই টানে না বরং মাহিন তার মনের মানুষ জেরিন যাকে সবসময় কাছে পেতে চায়। এমন একটি মেয়ে যদি তার গৃহলক্ষ্মী হয় তবে সে আমৃত্যু সুখী হবে বলেই তার বিশ্বাস। কত অপমান, কত অপবাদ তাকে নীরবে মুখ বুঝে সহ্য করে যেতে হয়েছে একটি মেয়ের জন্য।

এভাবে আনন্দ-বেদনা, রাগ-অনুরাগে তাদের ভালোবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। তবুও মাহিনের কাছে একটা ছবি ছিল না যে সে মন ভরে তাকে একবার দেখবে। ছিল না স্মার্টফোনও যে মেসেজ করবে। বাটন টিপে টিপে কত কষ্ট করে দু'একটা মেসেজ দেয়। কারন জেরিন ব্যাংকার বাবার কড়াকড়িতে থাকে। জেরিন অনেক চালাক, এটা মাহিনও জানে তবু ভালোবাসে বলেই সবকিছু মানিয়ে নেয়। সে যখন দেখে অন্য ছেলের সাথে কথা বলে, মাঠে বসে ক্লাস করে তখন মাহিন ক্রেজি হয়ে ওঠে। জেলাস ফিল করে।
জেরিন খুব ভালো করেই জানে এটা। তবু কি করে যেন মাহিন তার থেকে দূরে সরে যায়। কিন্তু মায়া তা কি ভোলার উপায় আছে? মাহিনের সাথে জেরিনের ফোনালাপ হয়। তবে কম। কিন্তু যখন জেরিনকে ওয়েটিংয়ে পায় তখন মনটা ভীষণ ভার হয়।

তবু প্রেমে চিনে না কালো ধলা
পড়লে প্রেমে মান থাকে না!
সহজ কথাও যায় না বলা।


জেরিন কিছুদিন আগে দুই হাজার টাকা ধার চেয়েছিল মাহিনের কাছে। টাকাটা খুব জরুরি ছিল। মাহিনের কষ্ট সত্ত্বেও টাকাটা ম্যানেজ করে তাকে বিকাশ করে দেয়। এক জীবনে বন্ধু-বান্ধবতো কতই হয়, ক'জন পাশে থাকে বিপদের কালে! মাহিন অপমান অবহেলা মনে রাখার ছেলে না। তার কাছে কিছু চাইলে তাকে ফিরাতে পারে না।
জেরিন বড় লোকের মেয়ে। হাতভর্তি টাকা কিন্তু তা মাহিনের জন্য না। মজা-মাস্তিতেই খরচ করে বেশি। আনন্দপিপাসু জেরিন আড্ডা পছন্দ করে। উৎসব আমেজ পছন্দ করে। জেরিন ক্লাস ডিঙায়, মাহিনও নতুন বর্ষে ওঠে। বয়সে বুদ্ধিতে দুজনই মেচুয়েট।
জেরিন মেয়েমানুষ। তার মন থকথকে জেলির মতো নরম আবার ইবলিশের মতো কুটিল। দুনিয়ায় আর কিছু না চিনলেও মেয়েরা টাকা চিনে। যার তার সাথে প্রেমখেলা খেললেও বিয়েটা ঠিক পয়সাওয়ালাকেই করে। জেরিনের মনেও হয়ত এমন কিছু আছে।

মাহিনের বাবা কলেজের পিয়ন। একমাত্র ছেলে মাহিন তার মেঝ সন্তান। পড়াশোনা করে কলেজে। মা অসুস্থ। বাসার কাজে মন দিতে হয়, আবার পার্টাইম জবও করে। বড় বোনের বিয়ে, ছোট বোনের পড়ালেখা সব কিছু মাথায় সে এখন মোটামুটি পেরেশানিতেই দিন কাটায়। ক্রমশ লেখাপড়ায় ভালো করতে থাকে। জেরিন ও মাহিন এক কলেজেই পড়ে। দেখাসাক্ষাৎ নিয়মিত। প্রায়ই জেরিনকে ফোনে রিচার্জ করে দেয়। তবুও ইদানীং জেরিন মাহিনকে এভয়েড করে চলে। বন্ধুত্ব সুদৃঢ় থাকলেও মাহিন ছোট খাটো বিষয়গুলো নোটিস করে রাতে শোবার আগে ঠিকই ভাবে। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে মা-বাবার কথা ভেবে।
হিমশিম খায় নিজের প্রতিটি কাজে; ভুল করছি নাকি ঠিক পথে আছি?
এভাবেই রোজ ঘুমোতে যায়। মা অসুস্থ হলেও ঘর-সংসার দেখভাল করে। মাহিন লাজুক ও ভদ্র স্বভাবের ছেলে। মা-বাবাকে জেরিনে কথা জানায়নি কখনো। কারণ জেরিনের কথা বলাটা সময়ের অপেক্ষা। সে এখনও বেকার। চাকরি-বাকরি না নিয়ে কিভাবে জেরিনের কথা বলে।
আর বলবেই বা কি করে— জেরিনকে যে সে আজও মুখ ফুটিয়ে বলতে পারেনি 'আই লাভ ইউ জেরিন'।

দোটানায় থাকা মাহিন অবিশ্বাস্যভাবে একদিন জেনে যায় যে, জেরিনের সাথে সমবয়সী একটা ছেলের অ্যাফেয়ার চলছে। জেরিন তাকেই ভালোবাসে। বজ্রাহত মাহিন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। থ হয়ে দাঁড়িয়ে। বাসায় এসে শুয়ে পড়ে। অতীত স্মৃতি ভেবে ভেবে অপ্রত্যাশিত বিষাদে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে।  এটা প্রতারণা বা ধোকা নয় বলে মাহিন নীরবে কাঁদতে লাগল।
বিশ্বাস, হায়রে বিশ্বাস।
চুরি হয়ে গেল?
জেরিনকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে না পেলেও আজীবন বন্ধু হিসেবে তাকে অন্তত পাশে পাবে।
কিন্তু কি হল? কেন এমন করল মেয়েটা?
ও সম্পর্ক করে এটা ওকে জানানোর প্রয়োজন মনে করল না!
কার জন্য এতদিন কষ্ট করল, কাকে বিশ্বাস করে নিজের সর্বস্ব উড়াল করল।
দুঃস্বপ্নময় বেদনায় শোকার্ত মাহিন ঘুমের দেশের হারিয়ে গেল।
মনভাঙার ছবি দেখা যায় না। দেখানোও যায় ন কাউকে। শুকনো মুখে মা যখন মাহিনকে দেখল তখন মায়ের কাছে লুকানোর উপায় ছিল না।
মা বুঝে গেছে ছেলে অসম্ভবের কাছে হেরে গেছে, পাহাড়সম বেদনায় কাতরাচ্ছে।
আগুন জ্বলছে বুকের গহীনে।
এই কি ভালোবাসা, এটাই কি বন্ধুত্ব?

মধ্যবৃত্ত ঘরের ছেলে মাহিন। সব কষ্ট সবাইকে বুঝতে দেয় না। ফোনের সুইচ অফ করতে পারে না আবার ঘৃণাভরা চোখেও তাকাতে পারে না— জেরিনের কাছে নিজেকে, নিজের বন্ধুত্বকে অন্তত ছোট করবে না মাহিন। এখনো মাহিনের সাথে জেরিনের আসা-যাওয়া আছে। কারণ মাহিন স্বার্থান্বেষী লোভী ছেলে নয় যে জেরিনের অ্যাফেয়ারের কথা শুনেই দূরে চলে যাবে।
হঠাৎ কলেজে শীতকালীন ছুটি দেয়ায় দু'জনের যোগাযোগে ভাটা পড়ল। মাহিন শেষবর্ষের ছাত্র। যে করেই হোক অনার্সটা কম্পিলিট করে একটা ভালো জব নিতে হবে। কিন্তু তাতেও যে বিড়ম্বনা, প্রতারণা। টাকা না দিলে চাকরি হবে না। মামু খালুও তার নেই। তবু সে নিরাশ নয়।


শীতকালীন ছুটিতে এক সপ্তাহের জন্য মাহিন তার বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেল। ম্যানেজারের থেকেও ছুটি কাটিয়ে জামা-কাপড় গুছিয়ে বন্ধু জাবেরের কাছে বরিশালের উদ্দ্যেশে রওনা হল। জাবের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অত্যন্ত মেধাবী, নামাযী ও চরিত্রবান ছেলে। সময় পেলেই বই পড়ে আর বাচ্চাদের ফ্রী ক্লাস নেয়। বাসায় এসে পড়ে যায় ছেলেপান।
বন্ধু মাহিনের আসার খবর শুনে জাবেরও খুশি হল। আগে ফোনে কথা হত ওদের কিন্তু জেরিনের কথা কখনও বলেনি। জাবের জানতো মাহিনের একটা বান্ধবী আছে। তত গুরুত্ব দিয়ে তাকে ভেবে দেখেনি জাবের।

মাহিন জাবেরের বাসায় উপস্থিত। ব্যাগ কাঁধে ও ফল হাতে রুমের সামনে নক করতেই জাবের দরজা খুলল। সে কি আনন্দ!
অট্টহাসি যেন দুটো খাঁচার পাখি আজ বনে এক হল। কোলাকুলি শেষে ভিতরে গিয়ে মাহিন সবার সাথে কুশল বিনিময় করে ফ্রেশ হল।
সকালের নাস্তা করল। দুজনে বিছানায় শুয়ে গল্প করছে। হঠাৎ জেরিনের ফোন।
মাহিন, কেমন আছ?
আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?
ভালো আছি। কোথায়, এসো আমরা একটু বসি কোথাও?
আমি তো বরিশালে। বন্ধু জাবেরের কাছে।
ও আচ্ছা। ঠিক আছে।
ভালো থাকো।
বলবা কিছু?
না, এমনি।
ওকে। বাই
বাই।

মাহিন মাস দুয়েক হল স্মার্টফোন কিনেছে। পার্টটাইম জব করে তো। কিন্তু আশ্চর্য! সে এখন আর জেরিনের ছবি খোঁজে না, রাখেও না তার ফোনে।
ফেসবুক আইডি আছে। ইবনাত জেরিন নামে আইডিতে ফ্রেন্ডও আছে। ম্যাসেনজারে কথাও হয়। কিন্তু ছবি বিনিময় হয়নি কোনোদিন। কারণ মাহিনের হৃদয়ে সেই বিশ্বাসের জায়গা নেই। গড়পড়তায় সম্পর্ক এখন।

ফোন কাটলে দুজনে আবার নিজের আলাপে মগ্ন। হঠাৎ জাবের বলল : দোস্ত কি বলমু, টেকনোলজি আইসা এমন ক্ষতি হইছে। কি আলতু ফালতু ফেইক আইডি কইরা ধান্দালি করে মাইয়্যাগুলো।
মাহিন— তা যা কইছোছ। তবে আমি ঐ সব খোঁজনের সময় পাইনা।
আরে আমি কি খুঁজি নি।
এই বলে জাবের ফোন হাতে নিয়ে লগ ইন করে একটা আইডিতে ডুকলো।
'এঞ্জেল মেহেরিন'
জাবের পড়ুয়া হলেও মাঝেমধ্যে নিউজফিডটা ঘোরে, কিছু সময় চ্যাটিংও করে।
এঞ্জেল মেহেরিন আইডিটা ঘুরতেই দেখে জেরিনের ছবি। মাহিনের বিস্ফোরিত চোখ মুহুর্তেই আকাশের চিল হয়ে গেল। মাহিন কিছু বলার আগেই জাবের বলল, দোস্ত এই মাইয়্যাটা আমাকে ডিসট্রাব করে। ফোন দেয় বারবার। প্রেমের অফার দেয়, যতসব রোমান্টিক মেসেজ পাঠায়।
বিস্মিত মাহিনের জবান বন্ধ। কিছু বলতে চেয়েও যেন বলতে পারছে না। বহুরূপী জেরিনের কথা ভেবে চক্ষু লাল।
কীভাবে একটা মানুষ এমন হতে পারে? ভাবনায় পড়ে গেল মাহিন। আজ যদি জেরিন কাছে থাকতো ঠাটিয়ে চড় না মারার বিকল্প ছিল না৷ তবু মাহিনের হাতবাঁধা।
কারণ সে জেরিনের বন্ধু, প্রেমিক নয়।
দুর্ভাবনায় হাবুডুবু মাহিনের। যা ছিল তার কল্পনাতীত।
জাবের পাশের রুমে গেল। জেরিনের কথা মুখ ফুটে বলাটাও সমীচীন মনে করছে না মাহিন। তাহলে যে বান্ধবীকে অপমান করা হবে, নিজের ভালোবাসায় অবমাননা হবে।
চুপচাপ বালিশে মাথা ঠেকিয়ে খাটে হেলান দিয়ে ভাবছে।
জেরিন এত নীচ! ও কেন এমন করে। জেরিনও কি অন্য আর পাঁচজনের মতো নিশাচর পাখি। ফেইক আইডির মতো ফেইক ফ্রেন্ড? যে সেই  কি ওর ক্রাশ? ওকি বাজারি মেয়েদের মতো বস্তাপঁচা সস্তা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে? দুদিনের পরিচয়েই দেহ বিলিয়ে দিচ্ছে? না, এ হয়না। ও এমন অসভ্য মেয়ে না। সবকিছুই অবিশ্বাস্য। কতকিছুই না লুকিয়েছে জেরিন। চোখ ভিজে যাচ্ছে অভিমানে, কষ্টে ফেটে যাচ্ছে বুক।

জাবের এসে পড়ায় দু'জনে খেতে চলে গেল। এভাবে দেখতে দেখতে ছুটি শেষ। জেরিনেরও মুখোশ উন্মোচিত। মাস দুয়েক পড়ে পরীক্ষা দিয়ে মাহিন ফার্স্ট ক্লাস পেল। জেরিন পেল সেকেন্ড ক্লাস। দুজন আলাদা। যোগাযোগও শীথিল।
তবে কলেজজীবনের শেষদিনে শেষ সাক্ষাতে মাহিন বলল জেরিনকে,
'জেরিন প্রিয় মানুষদের ঠকাতে নেই। একদিন এ ঠক নিজেরই'।
-কি বলছ মাহিন, আমি কাকে ঠকিয়েছি?
-সে তুমি ভালো জানো। আমার জানার প্রয়োজন নেই। তবে জেনে রেখো শিক্ষা নিয়ে সবাই মানুষ হয় না, চরিত্র ভালো না হলে।
জেরিন মাহিনের জন্য একটা বই এনেছিল। মনের গোপন কিছু কথাও বলতে চেয়েছিল। কিন্তু না, মাহিন সে সুযোগটুকু দেয়নি।

অমীমাংসিত সাক্ষাৎ। অপ্রত্যাশিত বিদায়। ফোনে বহুদিন কথা নেই। দেখা নেই প্রায় আট মাস। এতদিনে মাহিন একটা স্কুলের শিক্ষাকতায় যুক্ত হয়েছে। জেরিনের সাথে কথা নেই। তবে সেদিন শুনল—জেরিন নাকি সেই ছেলের কাবিনে বাধা পড়েছে।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, মেয়ে। হায়রে নারী কোথায় যে তোমার সুখ? নিজেও ভাবে না নিজের গন্তব্য, চিনে না আপন সত্তাকে।

জাবের মেয়েদের বিশ্বাস করে না।  মেয়েরা নাকি লোভী পট্টিবাজ হয়। প্রেমের অভিনয় করে। পয়সা পেলে সময় কাটায় যেখানে সেখানে। আবার কিছু বদমাশ ছেলেরাও মদ আর নারী ছাড়া এক মুহূর্ত ভালো থাকে না। তাই সে এসব বন্ধু থেকে নিজেকে বিরত রাখে যেমন আগুন থেকে থাকে দূরত্বে।

মাহিনও তাই ভাবছে। কত টাকা খরচ করল বন্ধুর জন্য, কত নামায কাযা করল, কত পাপ কাঁধে ! কি জবাব দিবে মরার পরে? মা-বাবা বোনের জন্যইবা সে কি করেছিল? অনুতাপ অনুশোচনায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জেরিনের খোঁজ নেয় না। জেরিন তো মাঝে মাঝে ফোন দেয় মাহিনকে। কিন্তু মাহিন বিশ্বাস ভাঙার কষ্ট উপলব্ধি করে তাই জেরিনের ঘরের অশান্তি দেখতে চায় না।
সে অপেক্ষায়
জেরিনের
অপেক্ষায়
চেতনার
যদি মানুষ হয়ে ধরা দেয় বন্ধু তার।
অপ্রকাশিত প্রেম পরানের গহীনে থাকবে সতেজ সবুজ সুঠাম। হয়ত ঝরবে না মিথ-রোদন। ছলনার ভ্রান্তি।
কিন্তু জেরিন! ওকি পারবে বেইমানির খেসারত দিতে? ওকি ছেলেটার ঘরে সুখী হতে পারবে?
জেরিনের বাবার বড় মুখে চুনকালি মেখে সে যে ছেলের সাথে ঘর বাঁধবে বলে ভেবেছিলো সে ছেলে তো রহস্য। তাকে দেখলে মুরগিখেকো শিয়ালের কথাই মনে পড়ে। কে বুঝবে জেরিনের মন! দুর্বোধ্য মায়ার মনন।

ফজর হয়েছে। লালাভ আকাশের সৌন্দর্য কত পবিত্র, কত নির্মোহ। মন ভরে যায় অলৌকিক অনুভবে। মাহিন জায়নামাজ হাতে মসজিদে যাচ্ছে।
কুসুমিত সূর্যের অপেক্ষা। সময় হলেই প্রিয় প্রাঙ্গনে বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশুদের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে।

লেখক পরিচিতি: সুলাইমান মাহমুদ রাসেল বাংলা সাহিত্যের সম্ভাবনাময় নাম। ধানসিঁড়ির পাড়ে বেড়ে ওঠা কবির জন্ম ৫ নভেম্বর, ঝালকাঠি জেলার বড় কৈবর্তখালি গ্রামে। মাধ্যমিকেই লেখালেখির হাতেখড়ি। সাহিত্যের বৈচিত্র্যময় সম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার সংকল্পে নিভৃতে লিখে চলছেন কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের পর তার কাব্যপ্রতিভার মৌলিকত্ব সাহিত্যমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, সমকাল, দ্রোহ বিদ্রোহ তার কবিতায় সাবলীলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশিত যৌথ কাব্যগ্রন্থ আটটি। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে অধ্যয়নরত। সাহিত্যেক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদ প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা পুরস্কার ২০২১, ঝালকাঠি জেলায় শ্রেষ্ঠ লেখক পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন।
ওমেন্স নিউজ/