উপলব্ধি
বায়তুল মোকাররমের ভেনাস জুয়েলারসে পদ্য। ডায়মন্ডের নোজ পিন কিনেছে। প্রতি মাসে হাবির দেয়া হাত খরচে পদ্য যা ইচ্ছে তাই করে। পাঁচ মাস চলছে বিয়ের বয়স। গত মাসের হাত খরচের পুরোটা খুঁজে খুঁজে বয়স্ক মহিলা ফকিরদের দান করলো। এরও আগের মাসে আজিমপুর সরকারি কবরস্থানে গিয়ে প্যাকেট খাবার বিলিয়েছে। এইভাবে চলছে ওর সদ্য বিবাহিত জীবনের আঁকা আলপনা ।
জুয়েলারি দোকানদারদের আপ্যায়নের কোল্ড ড্রিংক্স হাতে নিয়ে চিন্তা করে এরপর কোথায় যাওয়া যায়। হঠাৎ বায়তুল মোকাররম মসজিদের যোহরের আজান ভুমিকম্পের মত পদ্যর কানে এসে লাগে । কোল্ড ড্রিংক্সের স্ট্রতে জোরে টান দিয়ে এক চোটে সবটুকু শেষ করে পদ্য জুয়েলারি মালিককে বাই বলে বেড়িয়ে যায় । মার্কেটের ফুটপাতে হুজুরদের কুরআন বিক্রি করতে দেখে ইসলামিক ফাউন্ডেশানের কথা মনে পড়ে , সেই সাথে শবনম নামটি ।
কলেজ জীবনে দেখা। এমন দেখা আর কারো সাথে হয়নি পদ্যর। গা শির শির করা অনুভুতি । স্পেশাল সেই শবনম এই ইসলামিক ফাউন্ডেশানে চাকরি করে একথা যেন তেল আর জলের মত। একটা মানুষের মন এতটা আপ ডাউন হয় কি করে ! রীতিমত হাস্যকর ! যে মেয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পার করেও টম বয় চলা ফেরা করতো , সে মেয়ে কি চিন্তা করে ঢাকা ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিতে এম এ ডিগ্রি নিয়ে বোরকা পরে মোল্লা মুনশিদের সাথে বছরের পর বছর চাকরি করতে পারে ? একটাই কারণ। সরকারি চাকরি । নিশ্চিন্ত ভবিষ্যত। একটা নিশ্চিন্ত সম্ভাবনার দেখা পেলে সব বাঙালিরাই বোধয় গরু থেকে ছাগল ,ছাগল থেকে মুরগি হয়ে যেতে পারে ! তাহলে মানুষের শখ , স্বপ্ন , উচ্চাকাংখার কোনও প্রয়োজন নেই ? নাহ ! হতে পারে ওর মা বাবার ইচ্ছে পুরন করেছে । যাক ,আমরা মানুষেরা আমাদের ভাগ্যের কাছে , জীবনের কাছে নতজানু । বিচলিত পদ্য বায়তুল মোকাররম থেকে এগিয়ে যাচ্ছে ফাউন্ডেশানের দিকে । কয়েক বছর আগে চাকরিতে ঢুকে শবনমের এফেয়ার হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন অফিসারের সাথে । ওর যা আচরণ ! সহজে কোন পুরুষ ওকে বিয়ে করার জন্য রাজি হবার নয় । কিন্তু হয়েছে । আজকাল পৃথিবীতে অসম্ভব কিছুই না । এসব আগডুম বাগডুম বিভিন্ন পুরনো ঘটনা পদ্যর মনের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে । শেষে পাওয়া গেল লক্ষ্যস্থান । ফাউন্ডেশনের চারদিকের পরিবেশ বলে দিচ্ছে হিজাব বোরকা ছাড়া মহিলারা এখানে বেমানান । পদ্য সন্তর্পণে ডানে বামে তাকিয়ে দেখে নেয় কেউ ওকে দেখছে কিনা। যদি কেউ উঠতে না দেয় তাহলে কি বলবে , কীভাবে বলবে । তিন তলা পর্যন্ত আসা হল । সরকারি অফিসগুলো সাধারণত যেমন হয় তেমনই । ব্যাতিক্রম শুধু ,নামায পড়ার শব্দ , দাড়ি টুপি পাঞ্জাবিওয়ালা পুরুষ । পুরুষের তুলনায় মহিলা স্টাফ কম । হিজাব বোরকা ছাড়া পদ্য এই অফিসের পরিবেশে পদার্পণ করা মাত্র সবাই এমন ভাবে চেয়ে থাকছে যেন অস্বাভাবিক কোন ঘটনা ওদের নিজেদের দোষেই ঘটছে ।
শবনমের সার্টিফিকেটের নামটা মোটেই মনে পড়ছে না । শবনম বললে কি চিনবে কেউ ? তিন তলার সিঁড়িতে এসে এক কোণায় দাঁড়িয়ে নামটা মনে করার চেষ্টা করতে না করতেই পদ্য কে লক্ষ্য করে একজন পিয়ন ধাঁচের লোক । এসে বলল, কার কাছে আসছেন? হাজেরা খাতুন ম্যাডামের কাছে ? তাইতো এ নামটাই, হ্যাঁ ! পদ্য অবাক হয়ে সম্মতি জানালে লোকটা হাত উচু করে দেখিয়ে দিল রুম । দরজার উপরে নেমপ্লেটে লেখা হাজেরা খাতুন। নামের নিচে পদবি কি কি যেন। পদ্যর অত তেল নেই সবকিছু দেখার। শবনম হলেই হলো । মুখোমুখি দেখার আগে পদ্যর চোখে ভাসছে , বড় একটা টেবিলে এক গাদা হুজুরদের সাথে বসে শবনম মিটিং নিয়ে ব্যাস্ত । বোরকাওয়ালি শবনম হাত বাড়িয়ে চা ,বিস্কিট নিচ্ছে-হুজুররা সুন্দরী শবনমের হাতে আঙ্গুলে ছোঁয়া লাগিয়ে দিচ্ছে। এই বিল্ডিংয়ের একমাত্র নারী অফিসার হাজেরা খাতুনের রুমে পর্দা ঝুলছে। অজানা এক অনুভুতি নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে পর্দা সরালো পদ্য । মোটা ফর্সা বেটে আর মিষ্টি মুখশ্রীর শবনম চোখ তুলে তাকায় সোজাসুজি দরজার দিকে । শবনমের চোখে মুখে একরাশ লজ্জা জড়তা। কি করবে বুঝতে পারছে না । নিমেষে কত কিছু যে মনে পরছে দুজনেরই । কলেজ ইউনিভারসিটি সেই মধুময় দিনগুলো । যে দিনগুলোতে ওদের একান্ত বোঝাপড়া ওদেরকে মুগ্ধ করতো । আনমনে , নির্জনে , গোপনে । দুজনেরই ঠোঁট নড়ে এক সাথে । কেমন আছো ? পদ্যরটা সামান্য আগে হয়ে যায় , ভালো । তুমি ?
এইতো , কি করে জানলে আমি এখানে ?
বসতে বলবে না ? তারপর না হয় বলি কি করে জানলাম ।
ওহ ! সরি ! এত বছর পর তোমাকে দেখে সব গুলিয়ে যাচ্ছে । শবনম দৃষ্টির সব কটা জানালা খুলে দিয়ে পদ্যকে দেখে নিচ্ছে । আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে পদ্য । কি যে মানিয়েছে শাড়িতে ! না জানি কেমন করে সংসার করছে বরের সাথে । পদ্য বুঝতে পারে শবনম ওকে দেখে অবাক ।
কন্ঠে আড়ষ্ঠতা শবনমের । কি খাবে বল ?
কিছুই না । পদ্য সুনিপুণ ভাবে খেয়াল করলো শবনম আগের মতই ঠোঁট কামড়ে, নাক ফুলিয়ে কথা বলে । ওরা দুজন দুজনের বাস্তবতাকে মেনে নেয় হাসি মুখে । তারপরও ওদের পরস্পরের প্রতি বিস্ময়ের রেশ কাটছে না । শবনম ভাবে, ও কেন এলো ? ও কি আগের সম্পর্ক ফিরে পেতে চায় ? পদ্য নিজের মনে নিজে চিন্তা করে , ওর কাছে আর আসা ঠিক হবে না । আবার পুরনো নেশা জেগে উঠতে পারে ।
তোমার বিয়ের কত দিন হলো পদ্য ?
প্রায় ছয় মাস ।
শবনম, তোমার সংসার জীবনের কথা বল।
দুই ছেলে স্কুলে পড়ছে । ওদের বাবা বাংলাদেশ ব্যাঙ্কে আছে ।
সুখি সংসার !
পদ্য ,আমাকে মনে পড়ে ?
খুব একটা না । কারণ ,বন্যরা বনেই সুন্দর আর নারীরা পুরুষের সাথে।
লাজুক হাসি হেসে বলে-ঠিক বলেছ পদ্য। চারটি চোখের অনড় চারটি পলক। ওরা বার বার হারিয়ে বার বার ফিরে আসছে ।
কেন লিখেছিলে আমাকে?
কি ?
তোমার মন আছে? একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে কি অমন কথা বলে ?
না বললে তো তোমাকে আমার মত করে পেতাম না।
একটা কথা জানতে চাই শবনম ? জানাবে ?
নিশ্চয়ই।
তুমি প্রথম সমকামী হলে কিভাবে ?
স্কুল লাইফে ,ভারতেশ্বরী হোমসে থেকে ।
চল, আজ থেকে আমরা অপরিচিত । আর দেখা না, কথাও না ।
কিন্তু পদ্য, আমরা কেউ কাউকে ভুলব না ।
দুজনের দৃষ্টি আবছা । একজন উঠে চলে যাচ্ছে । আরেকজন চলে যাওয়া দেখছে।
কাজী ইয়াসমিন: তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ কবি ও লেখক। কাজী ইয়াসমিন অনেকদিন ধরেই লিখছেন যদিও মুড়ি মুড়কির মতো বই বের করতে নারাজ। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিনটি- দুইটা গল্পের, একটা কবিতার। বর্তমানে তিনি ব্যস্ত আছেন উপন্যাস লেখার কাজে।
ওমেন্স নিউজ/