নারী দিবস: নারীদের স্থায়ী উন্নয়নের প্রত্যাশা

শাহনাজ পারভীন

ড. শাহনাজ পারভীন

আজ আট মার্চ, ২০২২ সাল। আর্ন্তজাতিক নারী দিবস। এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ নিয়ে বিশ্ব নারী দিবস ২০২২’।

এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিশ্বের নানা প্রান্তে আয়োজিত হচ্ছে নানান আয়োজন, নানান অনুষ্ঠান। সারা বিশ্বব্যাপী নারীদের একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকে। বিশ্বের এক এক প্রান্তে নারী দিবস উদযাপনের লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। কোথাও নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা, কখনও বা নারীর আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্ব পায়। কারণ আমরা জানি, এ সমাজ সহজেই নারীকে প্রতিষ্ঠা দেয় না। নারীর কাজের অধিকার, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কাজের বৈষম্যের অবসানের জন্য প্রতিবাদ করেন লক্ষ মানুষ কিন্তু আমরা নারীর প্রকৃত সম্মান দিতে কার্পন্য করি যথা নিয়মেই। এমন একটি পরিবেশে যদি নারী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হন তাহলে তার পক্ষে জাগরণের প্রশ্ন তোলা অবান্তর। আগে শারীরিকভাবে সুস্থ্য হয়ে ঘরে, বাইরের জাগরণের জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হয়। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্যের বিষয়টি এই হিসাবে অত্যন্ত জরুরি। সুস্বাস্থ্যের শ্রেণিবিন্যাস করতে গেলে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ এসে যায়। কিন্ত আমরা জানি, শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি যেমন আমরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি কিন্তু আমাদের সমাজ ওইভাবে সহজ ও সাবলীলভাবে নেয় না। গুরুত্ব দেয় না। এমনকি রোগী নিজেও বিষয়টি সকলের দৃষ্টি থেকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন। এড়িয়ে যায় তার পরিবার। যতটা সম্ভব তাকে গোপনে, লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ভাবতেই চান না, এটা একটা সাধারণ মনের অসুখ। শরীরের অন্যান্য অঙ্গপত্যঙ্গের মধ্যে মনও একটি বিশেষ অংশ। বরং এইটা ভাবেন যে, এটা জানলে সমাজ তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবে। এইসবসহ নানা কারণে প্রথম অবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে বিষয়টি অন্যভাবে মোকাবিলা করার অপচেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে সমাজের নি¤œবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত একই রকম মন মানসিকতা পোষণ করে থাকেন।

সম্প্রতি কথা হচ্ছিলো সমাজের একজন প্রতিষ্ঠিত নারীর সাথে। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর তার বিষয়টি আমার গোচরীভূত করেন। অবশ্য বিষয়টি আমার আগে থেকেই জানা ছিলো, যে তিনি এই ব্যাপারে নিজেকে অবহেলা করছেন। তো দীর্ঘ কথার এক পর্যায়ে তিনি রাজি হলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ নেবার জন্য। এরপর কথা হয়েছে অনেকবার। গতকাল  দেখলাম, তিনি মোটামুাট সুস্থ্যতার দিকে। ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানালেন বারবার। তো চাই, তার মতো সমাজের প্রভাবশালী নারীদের মতো সাধারণ নারীরাও এই খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসুন, সমাজ থেকে এই ব্যাপারে অপব্যক্ষা দূর হোক।  

ইতিহাসে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। অতঃপর নানান চড়াই উৎড়াই শেষে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় রাষ্ট্রসংঘ। এর পর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে।

 নারী দিবসকে নিয়ে মুখে যত সহজে যত সাবলীলভাবে নারীকেন্দ্রীক কথাবার্তা, তাদের জীবনাচার, তাদের অধিকার, দায়িত্ব কর্তব্য, সীমারেখার কথা বলি না কেন, বাস্তবে তার বাস্তবায়ন কিন্তু মোটেও সহজ নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক যন্ত্রণা সয়ে, অনৈতিক নির্যাতন মেনে নিয়ে তাদেরকে বন্ধুর পথ চলতে হয় সারাক্ষণ। সে পথ খুব কম সময়েই মসৃণ ও সাবলীল হয়। এই বন্ধুর ক্ষতবিক্ষত পথ পাড়ি দিতে যেয়ে অনেক সময় নারী রক্তাক্ত হন। আহত হন। কিন্তু সেটা গোপন করেন সযতনে। বাইরের খোলসটা তার ঝকঝকে রোদেলা আকাশের মতো। কাউকে দেখান না, কাউকে বুঝতে দেন না। তার ব্যক্তিত্বই তাকে বর্ম পড়িয়ে রাখে সর্বদা। কাল নাগিনীর হিশহিশ বিষ শুষে নেন দক্ষ ওঝার ভূমিকায়। কিন্তু সাপের বিষ দাঁত কেন যে তারা সব সময় ভাঙতে চান না, ভেঙে দেন না! কেন যে তারা সেই বিষধর অজগরগুলোকে সমাজের কালো চোখে ফোকাস ফেলা থেকে বিরত থাকেন? তা বুঝিনা। আসলে যদি বলি বুঝিনা, সেটা কিন্তু সঠিক হয় না। আমরা বুঝি। আমরা অনুভব করি। আমরা নির্ভুলভাবে জানি। কিন্তু তারপরও তাদেরকে ক্ষমা করি কঠিন মমতায়। ভালোবেসে। সমাজের চোখে তাদের মুখোশ খুলি না। এটাই সম্ভবত সমাজের চোখে মূলত নারীর বড় দুর্বলতা। এ সমাজ নারীর অন্তর বোঝে না। তারা নারীর মেধাকে সহ্য করতে পারে না। এ সমাজ চায় নারীর রূপ। গুণ নয়। অর্থাৎ মেধাহীন রূপবতী নারী। এ সমাজ নারীর মেধাকে সহ্য করতে চায় না, তারা চায় মেধাহীন রূপবতী।

কখনো সখনো যদি এর ব্যত্যয় ঘটে, অর্থাৎ মেধার সাথে যুক্ত হয় রূপ, তাহলে সেই নারীর বিড়ম্বনার শেষ নেই। যে কেহ তাকে রূপের মোহে অন্ধ হয়ে ছুঁতে চায়, কিন্ত যখনই সেই কঠিন মুহূর্তে নানীর মেধার বিষ দংশনে জর্জরিত হয়, তখন সেই সমাজ ওই নারীকে যেন তেন হেনস্তা করতে ছাড়েন না। যে কোনো ভাবেই তাকে পরাস্ত করতে চান সমূহ প্রচেষ্টায় এবং হেরে যাওয়ার পথে ঘি এর আগুন ঢালতে থাকেন অনবরত। একবারও বোঝেন না, একবারও ভাবেন না তাদের ছুঁড়ে দেওয়া অনৈতিক ঢিল অসহায়  কুয়োর ব্যঙের মতো কিভাবে ক্ষত বিক্ষত করে নারীকে, তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে অহর্নিশ। কিন্তু এ সমাজও বোকা, এটা তারা বুঝতে চায় না, তাদের দেয়া ওই আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় মেধাবী নারীরা সমভাবে বিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে ন্যায্যতায়। সেই ফেটে পড়া পিচ্ছিল পথে তারা হেঁটে যায় অটল বজ্র কঠিন পায়ে। কে তারে রোধে, কে তার গতি আটকায়?

অথচ তাদের পথচলার কাহিনী হতে পারতো অন্যরকম অনুভবে, ভালোবাসায়, দরদে, মসৃন মাখনে। তারাই তো তোমাদের সন্তান, তোমাদের প্রেমিকা, জায়া, মমতাময়ী মাতা এবং আজন্ম জন্মদানকারী এক নতুন সভ্যতা। যেই সভ্যতার ঘুর্ণায়নে পৃথিবী ঘুরছে ক্রমবর্ধমান সৃষ্টিশীলতায়। দোহাই তোমাদের! তোমরা তাদেরকে অনৈতিক নির্যাতন করো না। অবহেলা, অসম্মান, অশ্রদ্ধায় পিষে ফেলো না। কি লাভ তাতে? যিনি সেই কঠিন নাগপাশ থেকে বেরিয়ে যাবার যোগ্যতা রাখেন, তিনি ঠিকই সদর্পে বেরিয়ে আসবেন প্রাজ্ঞতায়। তাকে কে বেঁধে রাখে বেড়ি পরা বন্ধনে তোমাদের? তবে কেন এত নিস্পেষণ, কেন এত অত্যাচার, অহেতুক আস্ফালন? দিনশেষে তাদের কাছেই তো ফিরে যাও আনন্দ আয়েশে, নির্ভরতায়। হে পুরুষ, হে সমাজ শুনুন, শুদ্ধ হোন, মানবিক হোন। নারীর নরম হাতটি ধরুন মমতায়। তাহলেই এই সভ্যতা অন্য এক উচ্চাতায় পৌছে যাবে নির্বিঘ্নে, তারাই পৌঁছে দিবে ভালোবাসায়। সে চূড়ায় জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকবে বিজয় কেতন।

তোমরা আর কোন শিশুকে অত্যাচার করো না, আর কোন কিশোরীকে পাশবিক অত্যাচারে জর্জরিত করো না। তাদেরকে অসময়ে এই পৃথিবীর আলো হাওয়া থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করো না। তোমরা আর কোনো নারীকে ঘরে বাইরে তাদের ন্যায্য পাওনা দিতে কার্পন্য করো না। তাঁরা ঠিকই তাদের অধিকার কেড়ে নেবে প্রাজ্ঞতায়। হয়তো তাদের কষ্ট হবে, রক্ত ঝরবে, তাতে কি এসে যায় তার? ঠিকই সে তার ন্যায্য পাওনা বুঝে নেবে কড়ায় গ-ায়। কারণ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একজন নারী। তিনি অত্যন্ত দক্ষ হাতে দেশ পরিচালনা করে তার দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন বিশ্বময়।

আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫১ বছরে গর্ব করার মতো অনেক অর্জন থাকলেও বৈষম্যহীন ও সবার জন্য নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় নি। আমরা জানি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল দেশের মানুষের মুক্তি, সবার জন্য বাসযোগ্য, বৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়ে তোলা। সমাজে সবচেয়ে বড় অবহেলিত জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গ অন্যতম। তবে গতবারের আর্ন্তজাতিক নারী দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বৈশাখী টেলিভিশন দেশে প্রথমবারের মতো কোনো ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের সংবাদ পাঠক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলো তাসনুভা আনান শিশির নামের সংবাদ পাঠককে। যারা জন্মগতভাবে শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমাদের সমাজে আমাদেরই পরিবারে ভুমিষ্ট হন তাদের সেই চিরচেনা অবহেলা, বঞ্চনার স্বীকার হবার অনাকাক্সিক্ষত বাস্তবতা আমাদের সকলেরই জানা। তাদের সেই বঞ্চনা থেকে উদ্ধার করবার জন্য আমাদের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার এই অবহেলিত নাগরিকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানান উদ্যোগ নিয়েছেন। নারী বা পুরুষ হিসাবে নয়, বরং সরাসরি তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়েই নিজেদের নাম নিবন্ধন করবার অধিকার পেয়েছেন। বিপুল সংখ্যক তৃতীয় লিঙ্গদেরকে সরকার ভাতাও দিচ্ছেন। তবে আমাদের ট্্রান্সজেন্ডারদের ধারাবাহিক ও স্থায়ী উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত করতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। তারই প্রথম উদ্যোগের সহযাত্রী হয়েছেন সংবাদ বুলেটিনের সংবাদে তাসনুভা আনান শিশির এবং নাটক “চাপাবাজ” এর অভিনেতা নুসরাত মৌ এর সংযোজন। এ বছর আর্ন্তজাতিক নারী দিবস ৮ মার্চে দেশের মানুষ ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ নিয়ে বিশ^ নারী দিবস ২০২২’ পালনের মাধ্যমে ঘরে, বাইরে, দেশে বিদেশে সুস্থ্যতার মাধ্যমে আমাদের নারীদের সুস্বাস্থ্য ও জাগরণে বিশেষ ভূমিকা রেখে নানান যোগ্যতায় নারী এগিয়ে যাবেন দৃঢ়তায়, দেশকে এগিয়ে নেবেন সগর্বে। নারীর সাথে সাথে দেশও এগিয়ে যাবে সমানতালে। এই প্রত্যাশা নারী দিবসে। আমাদের।

লেখক পরিচিতি: ড. শাহনাজ পারভীন একাধারে কবি, গবেষক, কথাসাহিত্যিক ও গীতিকার। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গবেষণা, প্রবন্ধ, শিশুতোষ সব মিলিয়ে ২৫টি গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি সম্পাদনা করছেন নান্দনিক ধারার সাহিত্য কাগজ ‘দ্যোতনা’এবং ছড়া সাহিত্যের কাগজ  ‘ছড়াঘর’।  দায়িত্ব পালন করছেন যশোরের সাহিত্য সংগঠন ‘অগ্নিবীণা’র কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি হিসাবেও। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। পেশাজীবনে তিনি একজন শিক্ষক, যশোরের তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ওমেন্স নিউজ /