মেয়েছেলে, মেয়েমানুষ -সবটাই কি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দোষ?

সুফিয়া বেগম

সুফিয়া বেগম

আমাকে মানুষ বলতে মানুষের কোথায় যেন বাঁধে-অনেক ক্ষোভ থেকে কথাটা বলেছিল কেউ একজন। এ নিয়ে আমি ভেবেছি অনেক। ভেবে ভেবে যখনই কোনো একটা সিদ্ধান্তের কাছাকাছি পৌঁছেছি তখনই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলো নতুন জিজ্ঞাসা। এতগুলো জিজ্ঞাসার সামনে আমি কেমন যেন নিজের কাছেই নিজে প্রশ্নবিদ্ধ হই। অবশেষে সরে আসি সেই অবস্থান থেকে। খুঁজতে থাকি নতুন জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর। শৈশবে, বয়স তখন কত হবে আমার? এই ছয় কি সাত ? কিংবা আট এর কাছাকাছি। আব্বা আম্মার সাথে বাসে উঠলাম এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাব বলে। লোকাল বাস, প্রতি স্টপেজে থামে। আমি যে সময়টার কথা বলছি সেটা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের ঘটনা। তখন লোকাল বাস ছাড়া অন্য কোনো বাসের কথা জানা ছিলনা আমাদের। আমাদের পাশের সীটে একজন লোক বসেছেন, সাথে বোরকা পরা একজন নারীা। বাস দুটো স্টপেজ পার হয়ে পরবর্তী স্টপেজের মাঝামাঝি যেতেই ভদ্রলোক কন্ট্রাক্টরকে বললেন, সঙ্গে মেয়েছেলে আছে, এখানে নামিয়ে দিয়ে যাও। ড্রাইভার বাস থামালে তারা নেমে গেলেন। বাসের রাস্তার সাথে লাগোয়া একটি পুকুর, সেটা পার হতেই বাড়ি। সে বাড়িতে ঢুকলেন তারা। আমি বোঝলাম তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে বাস যায় বলে তিনি এখানেই নেমে পড়লেন। তানাহলে তাদেরকে হয় আগের স্টপেজে নাহয় পরের স্টপেজে নামতে হতো এবং সেখান থেকে হেঁটে অথবা রিকশায় বাড়িতে পৌঁছুতে হতো। কাজেই সঙ্গের মহিলার সুবাদে তিনি ঐটুকু কষ্ট থেকে বেঁচে গেলেন কিংবা রিকশা ভাড়াটাও তার বেঁচে গেল। আমরা আমাদের নির্ধারিত স্টপেজে নামলাম। ঐ ভদ্রলোকের মুখ থেকে বের হওয়া ‘মেয়েছেলে’ শব্দটা আমার মনে গেঁথে রইল, গেঁথেই আছে অদ্যাবধি।

এর অনেকদিন পর, অনেকটা বড় হয়েছি তখন। গ্রামের বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া কানে এলো। স্ত্রী হয়তো দু/একটা উত্তর দিয়েছে। স্বামীর গলা শুনা গেলো স্ত্রীকে শাসাচ্ছে, তুই মাইয়া মানুষ, মাইয়া মানুষের মতো থাকবি। আর যদি একটা কথা কইছস তাইলে – – – – – –  ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকিটা ইতিহাস। শুনার প্রয়োজন পড়েনি আর। সেদিন বুঝেছিলাম ‘মেয়েছেলে’ ‘মেয়েমানুষ’ শব্দ দুটোর অর্থ একই- মহিলা, নারী, রমণী ইত্যাদি। একজন নারী নিঃসন্তান। এ নিয়ে তার চেয়ে তার চারপাশের লোকদের আফসোস বেশি। তারা সব সময় তুক-তাক করছে, নানাকিছু মান্নত করছে তার একটি সন্তানের জন্য। বিধাতা এরপরও নিঃসন্তান নারীকে একটি সন্তান দিয়ে আশীর্বাদ করলেন না। সবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে স্বজনরা এই বলে দোয়া করতে লাগল যেন তাকে একটি মেয়ে সন্তান হলেও দেন বিধাতা। যারা এই দোয়া করছে তারাও মেয়ে। ভাবুন বিষয়টা। কোথায় গিয়ে দাঁড়াল একটি মেয়ের সম্মান। এরাই তো নিজেদেরকে ‘মেয়েমানুষ’ বলে পরিচয় দিতে এক পা এগিয়ে থাকে।

আগেকার দিনের নানী-দাদীরা তাদের নাতনিদের আচার-আচরণ ও সহবত শেখাতেন অত্যন্ত দায়িত্বের সাথে। বলতেন, মেয়েদের এত লাফ-ঝাপ করতে নেই, ছেলেদের মতো সবকিছুর জন্য বায়না করতে নেই, যেখানে সেখানে যেতে নেই ছেলেদের মতো। মানে যত নিষেধাজ্ঞার পাহাড় মেয়েদের জন্য। ঐসব মহিলাদের মতে মেয়েদের অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হয়। তানাহলে মেয়েমানুষ বলে সমাজ তাদের উঠতে বসতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। অথচ এটা ওদেরকে বোঝানো যাবে না যে, নিজেদেরকে মেয়েমানুষ হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। তারপর সিনেমা নাটক তো আছেই। অহরহ দেখছি এসব দৃশ্যের চিত্রায়ণ। আসলে মেয়েদেরকে মেয়েমানুষ হিসেবে চিহ্নিত করার সেই প্রাগৈতিহাসিক ধারাটা আজও রয়ে গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এমনকি উচ্চশিক্ষিত আধুনিক মনস্ক মানেুষেরাও মেয়েদের মানুষ হিসেবে নয়, মেয়েমানুষ হিসেবে অভিহিত করতে বেশি আগ্রহী। এই ধারাবাহিকতা আদিকালের, চলছে আজও। হয়তো চলবে আরও অনেক কাল অথবা না।
কেন হবে এমন ? উত্তর খুঁজছি আজ যখন আমি পরিপূর্ণ নারী। তখনই নানা বিচার-বিশ্লেষণ সামনে এসে দাঁড়ায়। সবার আগে সবকিছু ছাপিয়ে পুরুষ আধিপত্যবাদের শ্লোগানটি আমার মনে বারবার কড়া নাড়তে থাকে। কিন্তু শুধু কি এটাই কারণ ? মনে প্রশ্ন আসে যখন দেখি একজন নারীও নিজেকে ‘মেয়েমানুষ’ হিসেবে পরিচয় দেয়। এই অভিজ্ঞতা আমার মতো অনেকের হয়ে থাকবে হয়তো। ‘আমি মহিলা মানুষ, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, কাজটা করে দেননা’, ‘দেখছেন আমি মহিলা, না হয় লাইন ছেড়ে সামনে দাঁড়ালাম, তাতে কি হয়েছে?’ এই ধরনের কথা আমরা চলতে ফিরতে রাস্তাঘাটে প্রায়ই শুনে থাকি। তারপর বাসে মহিলা সীট, মহিলা সীট বলে পুরুষদেরকে সেই সীট থেকে তুলে দিয়ে নিজেরা বসা। সেটার না হয় একটা যুক্তি আছে। কারণ এই সীটগুলো মহিলাদের জন্য চিহ্নিত করা। কিন্তু কোনো মহিলাকে বাসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুরুষরা যখন নিজেদের সীট ছেড়ে দিয়ে সেটাতে মহিলাকে বসতে দেয় সেটাকে ভদ্রতা বলার চেয়ে আমি করুণার দিক হিসেবে দেখে থাকি। কারণ মহিলারা যখন নিজেদের সীট থেকে পুরুষদের উঠিয়ে দেয় তখন তাদের মনে একটা অধিকারবোধ কাজ করে, কিন্তু পুরুষরা যখন নিজেদের সীট ছেড়ে দিয়ে মহিলাদের বসতে দেয় সেখানে কোনো অধিকারবোধ কাজ করে না। কাজ করে ‘বিশেষ বিবেচনা’, যেটাকে করুণাও বলা যায়।

তাহলে পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবই শুধু এর কারণ নয়। কারণ রয়েছে অন্য কোথাও। পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এগুলোর মধ্যে অবশ্যই একটি কারণ। তবে নারী পুরুষদের এ ধরনের মনোভাবে কোথাও না কোথাও একটা মিল রয়েছে। আমি নানাদিক থেকে ব্যাখ্যা করে এই অভিন্ন মনোভাবটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। এবং খুব দ্রুতই সেটা পেয়ে গেছি। আমার কাছে এটা ষ্পষ্টত প্রতীয়মান হয়েছে যে, ‘মেয়েছেলে’ সঙ্গে আছে বলে যিনি বাড়ির কাছে বাস থামাতে বলেছিলেন তিনি একটি বিশেষ সুবিধা লাভের জন্য একথা বলেছিলেন অথবা বাসের চালকের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। যে স্বামী ‘মেয়েমানুষ’ বলে তার স্ত্রীর কথা বলাকে গ্রহণ করতে পারেন না তিনি নারীদেরকে তার মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন। আবার যেসব মেয়েরা আগ বাড়িয়ে নিজেকে মেয়েমানুষ বলে পরিচয় দেন তারাও বিশেষ সুবিধা বা কোনো কাজে অগ্রাধিকার পাবার জন্য এটা করে থাকেন। তাহলে মোদ্দাকথা কি দাঁড়াল ? ‘মেয়েছেলে’ ‘মেয়েমানুষ’ শব্দ দুটো ব্যবহারের উদ্দেশ্যটাই নেতিবাচক। নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করে এই শব্দগুলো পুরুষরা যেমন ব্যবহার করে, তেমনি নারীরাও ব্যবহার করছে । দুঃখ এখানেই যে, নারী নিজেই নিজেকে ছোট করছে কিন্তু এই বোধটুকু তার মধ্যে জাগছে না।   

এ নিয়ে ইচ্ছে করলে নাতিদীর্ঘ একটা রচনা লিখে ফেলা যাবে। সেপথে আমি এগোতে চাইনা। শেষ করতে চাই এখানেই কারণ, আমি যা বোঝাতে চেয়েছি সেটা আশা করি ইতোমধ্যে অনেকেই  বুঝে নিয়েছেন। বুঝেছেন নিশ্চয়ই যে মেয়েদেরকে ‘মেয়েমানুষ’ বা ‘মেয়েছেলে’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার দায় শুধু পুরুষদের নয়। মেয়েরা নিজেরাও এর জন্য দায়ী। আমরা সভ্যতার ঊষালগ্ন পেরিয়ে এসেছি অনেক দিন আগে। আমাদের নানী-দাদীদের আমলের অর্থাৎ আগেকার দিনের চিন্তা-চেতনার অনেক পরিবর্তন এসেছে। নারী আন্দোলন এগিয়েছে অনেকদূর। নারীর সমঅধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন তথা নারী উন্নয়ন এখন নারী আন্দোলনের মূল শ্লোগান। নীরবে অথবা সরবে, আমরা  প্রত্যেকে এই শ্লোগানকে গ্রহণ করেছি। গ্রহণ করেছি নিজেদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা হিসেবে। এই গ্রহণ করার পেছনে মূল সুর যেটা সেটা হলো, আমরা অর্থাৎ নারীসমাজ নিজেদেরকে মানুষ মনে করছে এবং সে হিসেবে সমঅধিকার ও ক্ষমতায়ন চাইছে এবং ভোগ করছে। তাই নারীর অগ্রযাত্রার এই যুগে পুরুষ হোক, নারী হোক, সবাইকে নারীকে ‘মেয়েমানুষ’ হিসেবে দেখার মনোভাব ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে, বেরিয়ে আসতে হবে পশ্চাৎপদ কূপমন্ডুকতা থেকে। আর একাজে প্রথম ও প্রধান ভূমিকা নিতে হবে নারীদেরকে। নারী প্রথমে নিজেকে মানুষ ভাববে। তারপর নারীত্বের মাহাত্ম আর অহঙ্কার ছড়িয়ে দিবে সবখানে। অধিকার কিংবা দাবি – সবকিছুই আদায় করে নিতে হবে মানুষ হিসেবে, ‘মেয়েমানুষ’ হিসেবে নয়। সময় ডাকছে সবাইকে। এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকে। মাথা উঁচু করে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, ‘আমি মানুষ। মানুষের সবটুকু অধিকার আমি পেতে চাই।’

লেখক পরিচিতি: সুফিয়া বেগমের জন্ম ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল থানার শেরপুর গ্রামে। সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, অর্থনীতি বিষয়ে। লেখালেখির শুরু স্কুল জীবন থেকে। তিনি যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী তখন তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ময়মনসিংহের একটি আঞ্চলিক পত্রিকায়। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া। লেখালেখি তার পেশা নয়, নেশা। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী, শিশুতোষ এবং গবেষণধর্মী প্রবন্ধসহ সাহিত্যের সব শাখায় রয়েছে তার সমান পদচারণা। এ পর্যন্ত তার একক প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৫টি, যৌথভাবে প্রকাশ করেছেন আরও ১১টি গ্রন্থ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে সমসাময়িক বিষয়ের উপর প্রবন্ধ লিখছেন নিয়মিত।
তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশান, কলকাতাস্থ বিশ্ব বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনি এসোসিয়েশান, রোকেয়া হল এলামনি এসোসিয়েশান এবং নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্রের আজীবন সদস্য। এছাড়া তিনি মাসিক কাব্যকথার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি, শ্যামলছায়া ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি এবং আমরা কুঁড়ির উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
সাহিত্য সাধনায় নিরলস প্রচেষ্টা তাকে এনে দিয়েছে একাধিক সম্মাননা ও পুরস্কার। এগুলোর মধ্যে-আশরাফ সিদ্দিকী ও সাইদা সিদ্দিকী স্বর্ণপদক, শ্যামল ছায়া সাংস্কৃতিক একাডেমী সম্মাননা, বঙ্গবীর ওসমানী স্মৃতি পুরস্কার, শেখ  রাসেল স্মৃতি পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় স্মৃতি পুরস্কার, লোকছড়া ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরস্কার, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিপদক, অনির্বান সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পুরস্কার, নন্দিনী সম্মাননা, আলোকিত নারী সম্মাননা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সুফিয়া বেগম পেশায় একজন ব্যাংকার। কর্মরত আছেন ন্যাশনাল ব্যাংকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

ওমেন্স নিউজ/