সুরাইয়া চৌধুরীর ‘বনসাই চাঁদের খোলস’ প্রকৃতি ও পৌরাণিক আলাপ

আলোচনায় পলিয়ার ওয়াহিদ

‘আমরা অরণ্যের কাছে যাবো
আমাদের বাঁধা দিও না’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে প্রাণ-প্রকৃতি ও সভ্যতার প্রতি আকুতি রেখে বলেছেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ সেভাবে ‘ভস্ম হও শমিবৃক্ষ আগুনে’ কবিতায় সুরাইয়া চৌধুরীকে রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিতে দেখি। কিন্তু যখন শমিবৃক্ষ বলেন তখন আরও পিছনে যেতে হয়। পাঠককে চলে যেতে হয় পুরাণের আশ্রয়ে।

মহাভারতের বর্ণনা মনে, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা দুর্যোধন ও তার ভাইদের কাছ থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখতে নানা ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। সেই সময় নিজেদের অস্ত্রশস্ত্রও লুকিয়ে রেখেছিলেন তারা। কথিত আছে শমিবৃক্ষের কোটরে নিজেদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন তারা। তার মানে সুরাইয়া আমাদের শমিবৃক্ষ বলে ভূবন ভ্রমণে বের করেন।

সুরাইয়া চৌধুরীর এ কবিতা আজকের দুনিয়ায় বড় প্রাসঙ্গিক। আমরা দেখতে পাচ্ছি দিন দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় বৃক্ষের নগণ্যতা। তাই সুরাইয়া চৌধুরীর কবিতা পাঠ অতীব প্রয়োজনীয়। কবিতার এই সময় উপযোগিতা হয়ে ওঠা সফল শিল্পের লক্ষণ। কবিতার জন্য এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।

তার কবিতায় উঠে আসে তুঙ্গভদ্রার তীরে পল্লব মেয়েদের কথাও। বোধিবৃক্ষ বলে নিয়ে আসেন ইতিহাসের আরেক নায়ক গৌতমবুদ্ধের ডেরায়। এভাবে তিনি অহল্যা পর্যন্ত পৌঁছে দেন পাঠককে। মিথ-পুরাণ-ঐতিহ্যের অসাধারণ মিশ্রণে তিনি তৈরি করেন সেই আগুন যেখানে ভস্ম হও বলে আমন্ত্রণ করেন। কবিতায় শুদ্ধতর ও মঙ্গলের আহবানের জন্য সুরাইয়াকে সাধুবাদ।

জনসনকে জিজ্ঞেস করলেন বসওয়েল—স্যার তাহলে কাকে বলে কবিতা? তিনিও উত্তর দিলেন সোজাসাপ্টা—‘কেন স্যার, কবিতা কী নয় সেটা বলে দেওয়াই তো সবচেয়ে সহজ। আলো কী জিনিস, আমরা সবাই জানি কিন্তু আলো কী সেটা বলা আদৌ সহজ নয়।’

রান্নাঘরের কবিতা বলেন আর রাজদরবারে কবিতা বলেন সকল কবিতার আসল কাহিনি হল তা কতটা কবিতা হয়ে ওঠল। অনেকে বোদ্ধামহলের স্বীকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রকৃত কবির কাঠগড়া হচ্ছে পাঠক। ফলে আধুনিক কবিতা পাঠের আগে পাঠকেরও কিছুটা পঠন-পাঠন প্রয়োজন বৈকি।

ফরাসি জগতবিখ্যাত কবি পল ভ্যালেরি বলতেন, ‘কবিতার প্রথম পঙ্‌ক্তি আসে স্বর্গ থেকে, বাকিটা, তুমি গড়ে তোলো।’ ব্যাপারটাকে একেকজন একেকভাবে দেখেন। একেক কবি একেকভাবে দিয়েছেন কবিতার সংজ্ঞা। সুরাইয়া চৌধুরীর ‘বনসাই চাঁদের খোলস’ পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে তিনি স্বতস্ফূর্ত লিখে যাচ্ছেন। প্রথম লাইন থেকে শুরু করে শেষ লাইন পর্যন্ত একটানা একটা আবহ সংগীত যেন বেজে যাচ্ছে। তিনি সার্থকভাবে কবিতার শরীর ও প্রাণকে একত্রে নান্দনিক মূর্তি রূপে গড়ে তুলতে পেরেছেন।

সুরাইয়া চৌধুরীর ধীরব পুরাণ, প্রাজ্ঞ ধীরব এক, অনার্য নারী, বেহুলা ভালোবাসা, অতঃপর চন্দ্রাবতী, লালন হাওয়া, সবুজ সভ্যতা কবিতার শিরোনাম। শুধু নাম পাঠ করেও অনেক কবিতা সম্পর্কে ধারো পাওয়া যায়। তার কবিতায় তাই আলাদা করে বলতে হয় না পুরাণ আর প্রকৃতির আলাপ।

‘নিরাপদ ভাষারা এখন জবর দখলে
অযাচিত যতিচিহ্ন শুধু দাঁড়ায় সম্মুখে
বিরতিচিহ্ন রেখে যদি দিন চলে যায়
তবে আর কোথায় পথ খুঁজে পাই?

এভাবে পাঠ করতে হয় ‘হরিৎ অহং’ কবিতা।

‘ঘাসের ঋণ’ কবিতা আবিদ আজাদের ‘ঘাসের ঘটনা’ মনে করিয়ে দেয়। ‘বিরল ব্যর্থতা’ কবিতার নাম হলেও অনুপ্রাস ব্যবহারে উস্তাদ সুরাইয়া সর্বদা সফলতা দেখিয়েছে এই বইয়ের প্রায় প্রত্যেকটি কবিতায়। তাছাড়া তার কবিতায় হীরা-চুনি-পান্নার মতো দেখা মেলে কতিপয় পুরনো শব্দ। ‘দ্বাপরের কৃষাণীর নিকোনো উঠোনে’ যেন সুন্দরীর হাতে আঙটির মতো হঠাৎ বিভা ছড়িয়ে দেয়। তৃষিত চাতক, বিল পারের কিশোরী, নোনাজল নারী, জলের অতল তলে, বৃত্তের পথঘাট, বুননসূত্র, অন্তমিল দিনের হিসেব, গল্পের শেষ পাতা, অনুপ্রবেশ কথা, মায়াডাক,  হরৎ আবেগ, বর্ষাবাদল, বসন্ত এসে গেছে ও বিভক্তি চিহ্ন কবিতায় মাটি, জল, হাওয়া, বন-বাদড়, বৃক্ষলতা, ফুলপাতা, কাদিামাটি, নিসর্গ, কাশফুল, মৌটুসী পাখি, রিমঝিম ব্যাঙের গজল, ফেনা ফেনা মেঘ, পাহাড়, নদী, ঋতুমন প্রকৃতি এমনভাবে ধরা পড়ে যেন পাঠক আড়ালে বসে কোকিলার মতো কূ কূ করে ডেকে ওঠেন!

‘পারে না ফিরে যেতে সুতো ছিঁড়ে হায়
পাখিটা খাঁচায় বসে পাথর পুরাণ।’
আনন্দ-বেদনার মতো কবি  আশা আর স্বপ্নের দানা ছড়াতে ছড়াতে কোথাও কোথাও নিজেও নিরাশায় বন্দি হয়ে পড়েন। নিজেও যেন তিনি বাঁধা হতাশার শিকলে।  

নামকবিতা ‘বনসাই চাঁদের খোলস’ অতীতস্মৃতিচারণ, মঙ্গল ও শুদ্ধতায় ফেরার প্রার্থনা ও শিল্পীর প্রকৃতির প্রতি যে বিনীত আর্তি তা সরব হয়ে ওঠে। ফলে একথা দ্বিধাহীনভাবে ব্যক্ত করা যায় যে সুরাইয়া চৌধুরীর ‘বনসাই চাঁদের খোলস’ কবিতার বইটি নামকরণে সার্থকতার সাথে সাথে পাঠককে নতুন করে প্রকৃতির নানা রূপকে অবলোকন করাতে পেরেছেন। তার কবিতার শরীর মেদহীন। বাক্য ঝরঝরে। উপমায় নতুনত্ব না থাকলেও অনুপ্রাস সে ঘাটতি দূর করে দেয়। সব ছন্দেই তিনি স্বাচ্ছন্দবোধ করেছেন। কাব্যকে মুক্তি দিয়েছেন অন্ত্যমিলের দাসত্ব থেকে।

এই প্রথম সুরাইয়া চৌধুরীর কবিতার সঙ্গে পরিচয়। মাধ্যম হিসেবে ছিলেন ওমেন নিউজের সম্পাদক মাহমুদা আপা। দুজনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ।

বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শ. ই. মামুন। একুশে বইমেলা ২০২২ সালে প্রকাশ করেছেন কবি ও সম্পাদক খালেদ উদ দীনের প্রকাশনা বুনন। মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ১৮০ টাকা।

পলিয়ার ওয়াহিদ

পরিচিতি: পলিয়ার ওয়াহিদ মূলত কবি। ‘সিদ্ধ ধানের ওম’ ও ‘দোআঁশ মাটির কোকিল’ তার উল্লেখযোগ্য ও বহুল পঠিত কবিতার বই। কাব্যগ্রন্থ মোট ৫টি। এবার কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার ইংরেজি ভাষান্তরের কবিতার বই (Song Of The Soil) মাটির গান। কবিতার পাশপাশি মিষ্টিভাষায় লেখেন স্বকীয় গদ্যও। ২০২৩ বইমেলায় প্রকাশিত হবে তার গদ্যের বই ‘কালো রাজহাঁস’।

কবিতার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেয়েছেন কৃত্তিবাস; তারাপদ রায় সম্মাননা-২০১৯। সম্পাদনা করেন সুফি ঘরানার কবিতার কাগজ 'ভাবযোগ'। তার জন্ম ২৬ ফাল্গুন ১৩৯২। জন্ম, বেড়ে ওঠা যশোর ও সিলেটে। পৈতৃকনিবাস কেশবপুরে। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও এ পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এক স্ত্রী ও এক কন্যাকে নিয়ে একই সঙ্গে বসবাস করেন ঢাকা-যশোর-চাঁদপুরে। প্রিয় কাজ বইপড়া। পছন্দ করেন খেতে ও ঘুরতে।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/