তাহমিনা রহমানের গল্প ‘ওর জন্য মায়া’

তাহমিনা রহমান

ওর জন্য মায়া

প্রায় এক বছর পর বাসায় এলো মেয়েটা । আমি ওর জন্য নিচতলায় সিঁড়িতে অপেক্ষা করছিলাম । আমার দিকে একটি বারের জন‍্য‌ও তাকায়নি সে যেন ওর সামনে কেউ নেই অমন ভাব করে আমাকে পাশকেটে উপরে চলে গেলো । মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে সাথের লাগেজটা শব্দ করে টানতে টানতে নিয়ে গেলো । আমি মনখারাপ করিনি  হাসতে হাসতে ভেতরে চলে এলাম । জানি যে ক' দিন থাকবে নিজের মতো করেই থাকবে । রান্নার আয়োজনটাও ভালো রেখেছিলাম মনে আশা ছিলো যদি খেতে আসে , কিন্তু না প্রতি বারেই বাইরে গিয়ে খেয়ে আসছে ।
সেবার অস্ট্রেলিয়া থেকে আসার সময় কিছু কসমেটিকস আর টুকিটাকি অরনামেন্টসের একটা প‍্যাকেট এনেছিলো আমার জন্য । তবে প‍্যাকেটটা দুই তিন দিন পর নিচে এসে দিয়ে গিয়েছিলো । এবার তেমন কিছু আছে কিনা জানিনা ।

পাঁচ বছর আগে ওরা দু'জন ভাড়া এসেছিলো উপরে । ওরা বলতে এই সায়লা আর সাথে রীয়াজ নামে একটি ছেলে । ছেলেটি ভারি মিষ্টি । শ‍্যামলা চেহারা। মুখে হাসি লেগেই থাকে । মেয়েটিও সুন্দর তবে সবসময় চেহারায় একটা বিরক্তি ভাব । আমি মনে মনে ভাবি কেন গো বাবা অমন সুশ্রী চেহারাটাকে কুশ্রী বানিয়ে রাখো । দুদিন পর এক হলিডেতে রীয়াজের কথায় আমি অবাক
 হ‌ই । ওরা বিবাহিত নয় তবে এই বাসা ভাড়া নেয়ার উদ্যেশ্য বিয়ে করা । সাথে সাথে হাজরটা প্রশ্ন চলে আসে আমার মাথায় । কিন্তু রীয়াজ আমাকে থামিয়ে দেয় । তার মানে সে জানে আমি এক্ষুনি তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে শুরু করবো । সে আমাকে থামিয়ে দিলো এই বলে যে তার মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ বিষয়ে কোন ধারণা নেই অর্থাৎ বিয়ের কিছু কেনাকাটা আমাকে করে দিতে হবে । এতোগুলো বিষয় আমি একসাথে নিতে পারছিলাম না তাই বললাম ঠিকাছে দেখা যাবে । এখন আমাকে একটু ভাবতে দাও ।

রীয়াজ আমাকে ভাবতে দেয়নি । সেদিনই সন্ধ্যায় সে আমার হাতে ওর ক্রেডিট কার্ডটা তুলে দিয়ে বললো প্লিজ আমাদের জন্য এইটুকু করুন । আমি বলতে চাইলাম ঠিকাছে চলো আমরা একসাথে সোপিং করি । এতেও রাজী হলোনা রীয়াজ । আমি আগের মতোই হাজারটা প্রশ্নের ভিতর পড়ে র‌ইলাম । পোশাকের ব‍্যপারটা এমনিতেই সেনসিটিভ , প্রত‍্যেকের‌ই নিজস্ব একটা রুচি থাকে সেখানে আমি কী করে কী করবো বুঝতে পারছিলাম না । অগত্যা এ নিয়ে সায়লার সঙ্গে কথা বললাম । সে উল্টো ওর লেপটপে সেইভ করে রাখা কিছু শাড়ির ডিজাইন আমাকে দেখিয়ে দিলো । আমার অবাক হ‌ওয়ার মাত্রা এবার সীমা ছাড়িয়েছে । বললাম তুমি কেন যাচ্ছোনা আমার সাথে । উত্তরে সে একশোটা সমস্যা দেখালো । আমি একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না আমি কিভাবে এই দুই দিনেই ওদের কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলাম ।

অনেকটা বাধ্য হয়েই সপিংএ বের হলাম । বিয়ের কেনাকাটা করবো শোনে বিক্রেতারা দ্বিগুণ আগ্ৰহে আমাকে একটা ভালো কর্নারে বসিয়ে দিলো । এটি মহানগরের উল্লেখযোগ্য সপিং মলের একটা । বলতে গেলে সব আইটেম‌ই এক ফ্লোরে পাওয়া যায় । বেশ কিছু কোয়ালিটি শাড়ি মেলে ধরেছে ওরা আমার সামনে । রঙবেরঙের শাড়ী দেখে অনেকদিন পর আমার মনের কোথায় যেন একটু রঙ লেগে গেলো । বিয়ের শানাই বাজতে শুরু করেছে । দোকানীরাই ছোটাছুটি করে একটা কমপ্লিট বিয়েবাজার সম্পন্ন করে ফেললো । এবার সায়লা আর রীয়াজকে বিয়ের সাজে দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে । এখন আমিই যেন ওদের একমাত্র আপনজন । সায়লাকে নিজের সন্তানের মতোই ভাবতে শুরু করেছি । অনেক দিন যোগাযোগ নেই এমন বন্ধুদের কথাও একে একে মনে পড়ছে । ভাবছি এই বিয়েতে আমি আমার ইচ্ছেমতো সব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দাওয়াত করবো । বহুদিন পর একটা মিলনমেলা হবে ।

তাই হলো । বেশ ঘটা করে বিয়েটা হয়ে গেলো। বিয়ের পর রীয়াজ নববধূকে নিয়ে চাকরিস্থানে চলে গেলো পেছনে ফেলে গেলো আমার জন্য এক বিশাল
 নীরবতা । যে আমি একাকীত্বে অভ‍্যস্থ উঠে ছিলাম সেই আমি এখন যেন এক বিস্তৃত খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে গেছি । প্রহর গুনছি তেমন একটি উজ্জ্বল সময়ের
 জন্য । জানলাম রীয়াজের চাকরির প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশে ট‍্যুর করতে হয় । প্রতি ট‍্যুরেই সায়লাকে সঙ্গী করে সে । বিয়ের পর যে কয়বার এসেছে সায়লাকে নিয়েই এসেছে । উপরের ফ্ল্যাটটা ওরা ছাড়েনি । আমিও মাঝে মাঝে ঝাড়মুছ করিয়ে রাখি । এবার সায়লা কেন একা এসেছে রীয়াজ কেন আসেনি এখনো জানা হয়নি । তবে জানতে খুব ইচ্ছে করছে ।

সকালের নাস্তা সেরে খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছি অমনি আমার চোখে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সায়লা এলো আমার কাছে । হাতে একটা ছোট্ট ব‍্যাগ । আমি সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই । আমার বয়সের ব‍্যবধান ভুলে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি । অনেকক্ষণ বুকের সাথে মিশিয়ে ওর মাথায় পিঠে হাত বুলাই ।
সায়লা ব‍্যাগটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় । আমি বলি – না এর ভেতরে কী আছে একটা একটা করে আমাকে দেখাও । ও প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করে পরে ব‍্যাগ খুলে একটা একটা করে জিনিস বের করে টেবিলের উপর রাখে । রূপার উপর পার্ল বসানো একটা ব্রেসলেট আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । আমি ওটা হতে নিয়ে বলি –  দাও এটা আমাকে পরিয়ে দাও । ব্রেসলেটটি ও আমাকে পরিয়ে দেয় । কী একটা শিহরণ লাগে আমার মনে । যেন কতকাল আমি অমন একটা স্পর্শের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম । আমি ওর হাতে কপালে চুমু খাই । এরপর চমকে উঠি ওর ঠোঁটে দেখা দিয়েছে চাঁদের মতো এক ফালি হাসি । শুধু তাই না চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওর চোখ  দুটিও ।
এমন সময় রীয়াজ এসে হাজির হলো আমাদের মাঝে । রীয়াজের মুখে সেই চিরন্তন হাসি ।
রীয়াজকে দেখছি আর ভাবছি মানুষের হাসি এতো সুন্দর হয় কিভাবে ।
রীয়াজ ছোট্ট করে বললো – সায়লার সুস্থতার জন‍্য‌ই আমি আপনার মতো একজন মাকে খুঁজে নিয়েছিলাম ।
আমি রীয়াজের কথার উত্তর না দিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি – আমিও কী তাহলে এতোদিন অসুস্থ ছিলাম ?

লেখক পরিচিতি: গল্প, কবিতা, উপন্যাসসহ সাহিত্যের সব শাখাতেই সমান স্বাচ্ছন্দ্য তাহমিনা রহমান। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, অনলাইন ও লিটলম্যাগে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার লেখা। ইতিমধ্যে তার দুটি গ্রন্থ বেরিয়েছে। এর একটি ছোট গল্পের সংকলন – ‘লাল ফড়িং ও অন‍্যান‍্য গল্প’ এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস -‘জোছনার মোম’। তিনি অর্থনীতিতে মাস্টার্স এবং একই সঙ্গে এল এল . বি সম্পন্ন করেছেন।

ওমেন্স নিউজ/