দিলারা হাফিজের স্মৃতিকথা ‘মাহে রমজান ও আমাদের শৈশববেলা’

দিলারা হাফিজ

মাহে রমজান ও আমাদের শৈশববেলা

 

শ্যাওলা সবুজ বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক গলিয়ে বহু সাধ্য-সাধনায় দেখা দিতো রমজান মাসের প্রথম সন্ধ্যার মোহনীয় এক রূপসী চাঁদ। এক মাস শিয়াম সাধনার পরে ঈদ-উল-ফিতরের চিকন বাঁকা চাঁদ দেখার মধ্যে যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, প্রেম ও মমতা মাখা আনন্দের স্রোতধারা বয়ে যেতো—সলাজ শৈশবে দেখা সেই অতুনীয় চাঁদ যেন চাঁদ নয়, মানুষের অবয়বে প্রাণময় ভালোবাসা ও আনন্দের যুগপৎ এক খণ্ড মানবপ্রাণ। ইচ্ছে করতো চাঁদ মামাকে ছুঁয়ে থাকি, মায়ের মতো বুকে চেপে ধরে থাকি তার জ্যোৎস্নাধারা। কিন্তু ঐ অত্ত দূরের চাঁদ সুদূরের বার্তা বাহকের মতো দূরেই থেকে গেছে সারা জীবন।

এই চাঁদের মতো সুদূরের মূর্ছনায় আমাকে কাছে ডেকে নিয়েছিলো আমার মাতামহী বেগম হায়াতুন্নেসা। আমার জন্মের পর পরেই আমার মা—তার ছোট মেয়ে লেবুর সংসারে থেকেছেন আমাদেরকে ভালোবেসে। আমার ছোট ভাই সেলিমের জন্মের পরেই নানীমার কোলে পিঠেই আমি বড় হয়েছি, মানুষ হয়েছি। আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি তিনি জাগিয়ে দিয়েছিলেন অলৌকিক এক তরণী বেয়ে। তিনি আমার প্রথম ভালোবাসা, শিক্ষাগুরু—সব-সবই। রমজান মাস এলেই বার বার তার মুখের একটি কথা শুনতাম,গভীর মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করার চেষ্টাও করেছি কিন্তু তখন তার মর্মার্থ বুঝতে পারিনি। তিনি বলতেন, রমজান মাসের তিরিশটি রোজা রাখতে পারেন যিনি, তিনি পরকালের জন্যে তিরিশটি মুক্তা বা পার্ল অর্জন করেন প্রতি বছর। আমার ছোটবেলায় শোনা—-এ কথার মাজেজা তখন মোটে বুঝতে পারিনি।পরে বুঝতে পেরেছি, ইসলামে রোজার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতেই মূলত কথাটি বলতেন তিনি। যখন আমাদের বয়স ৬/৭ মতো হবে। তখন থেকে ৩/৪ টি করে রোজা রাখতাম সারা মাসে। এরপর বড় হতে হতে রোজার সংখ্যা বেড়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় এক মাস রোজা করেছিলাম প্রথম। আমার সঙ্গে আমার ছোটভাই সেলিমও রোজা রাখতো তবে, অনিয়মিত। নানী পুরোমাস, মা ভাংতি রোজা বাদে বাকীগুলো রাখতেন।

আব্বা বাড়িতে থাকলে শেষ রাতে উঠে মা প্রতি সেহরিতে গরম ভাত-তরকারি,ভাজি-ভর্তা করতেন বহুল পরিমানে। কিছু তরকারী এবং নিজেদের গাভীর দুধ ঘন করে জ্বাল দিয়ে রাখতেন সন্ধ্যা রাতেই। খুরমা-খেজুর, নানা ধরণের ফল-মূল আব্বা ঢাকা থেকে নিয়ে আসতেন।লেবু শরবত দিয়ে রোজা খুলেই আব্বা প্রথমে খেতেন আখের গুড় দিয়ে মাখানো কাঁচা হলুদ, কাঁচা আদা, কাঁচা বুট এবং দুধে ভেজানো খুরমা-খেজুর।এরপর পেঁয়াজু, বেগুনি এবং কাঁচা পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে মাখানো ছোলা-মুড়ি, জিলিপী ও অন্যান্য খাবার খেতেন পরিশেষে। আব্বা মনে প্রাণে আস্তিক কিন্তু আধুনিক মননের মানুষ।প্রচুর যাকাত দিতেন। দান ধ্যানে অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব তিনি। দরিদ্র গ্রামবাসীর মধ্যে শাড়ি লুঙ্গি বিলাতেন। রোজা রাখতেন প্রথমদিকে, এরপর বিরতি দিয়ে। কিন্তু ১১ রমজান আমার বড় কাকার প্রয়াণ দিবস, কাজেই এই দিনটিতে তিনি রোজা রাখতেন। বাড়ির ছোট বড় ছেলে মেয়েরাও রোজা রাখতো। এগারই শরীফ পালন করা হতো রোজদারদেরকে ইফতারের নিমন্ত্রণ করে। বেশ বড় আকারে জমজমাট ইফতার পার্টি হতো। তখন আমরা বলতাম আজ বাড়িতে রোজদার খাওয়ানো হবে। সিয়াম সাধনার সঙ্গে এর সংযুক্তি ছিলো তখন। এখন এর সঙ্গে পার্টি শব্দ যুক্ত হয়ে বিষয়টিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। ফলে সকলেই এখন ইফতার পার্টি করে। যা পরম মহিমের নৈকট্য লাভের চেয়ে লোক দেখানো ফ্যাশনবোধে পরিণত হয়েছে বলে ধারণা করি।

আমি জানি, মানুষ মাত্রই নিজের সময়কে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানে আত্মতৃপ্তি লাভ করে—তবু সব ক্ষেত্রে তা সবৈব সত্য নয়। আমার ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে এই কবিতাটি রচনা করেছি।গদ্যের সঙ্গে পদ্যটিও যুক্ত করে দিলাম পাঠক বন্ধুদের জন্যে। মাহে রমজান রমজানের চাঁদের প্রথম দিন থেকে মায়ের মনে বর্ষা,শরৎ যুগপৎ ছয় ঋতু খেলা করতো ডানকিনা মাছের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে— আমরা অপেক্ষা করতাম কবে বাতাসে আব্বা আব্বা গন্ধ ভেসে আসবে? উত্তর আকাশের তারা গুণে গুণে শেষরাতে সেহরী হতো মাটির আলগা চুলায় সেদ্ধ ভাত বসাতেন মা প্রাণহরা ঘৃতগন্ধে আব্বার প্রিয় বেগুন চাসনী, আমাদের জন্যে আলু ডিমে মাখামাখি ভর্তা, নয়তো ঘুম ঘুম চোখে বেগুনখাসি রেসেপিতে ধোঁয়া ওঠা পাতে গরম ভাত আউশ ধানের লাল চালের—— ঘন মুশুরী ডাল,পরিশেষে সবরী কলা আর দুধভাতে ইতি। লেবু শরবত,গুড়ে মেশানো কাঁচা হলুদ, নুনে মেশা আদাকুচি দিয়ে প্রথম ইফতার আর সেহরির সেসব দিনগুলো শৈশবের জাদুঘরে সেই যে লুকালো, খুঁজে তারে পাই না আর কিছুতেই। সকলেই কি আমার মতো অভাগা বয়সের জাতক? যখন স্মৃতিটুকু হারিয়ে যায় গোধূলির আলোর মতো।

রচনাকাল-১৫ এপ্রিল, ২০২২; ধানমণ্ডি, ঢাকা

লেখক পরিচিতি: কবি ও কথাসাহিত্যিক। তিনি কর্মজীবনে তিতুমীর কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

ওমেন্স নিউজ/