শেখ হাসিনার কাছে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ: হিরণ্ময়ী দাস রুনু

বীর মুক্তিযোদ্ধা হিরণ্ময়ী দাস রুনু

হিরণ্ময়ী দাস রুনু একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যিনি রণাঙ্গণে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে, নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে। ১৯৯৯ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর বলতে গেলে একা হাতেই দুই মেয়েকে মানুষ করেছেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের নানা স্মৃতি বর্ণনা করেছেন। একই সঙ্গে কথা বলেছেন সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুতে। ওমেন্স নিউজের জন্য এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কবি ও লেখক হোমায়রা হুমা

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে বেশ কয়েক দিন ধরে অল্প অল্প করে কথা বলেছেন হোমায়রা হুমা। শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তিনি নানা বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। ধৈর্য্য সহকারে তার সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তার প্রিয় রুনু দি।

মুক্তিযুদ্ধে আপনার অংশগ্রহণের সুযোগ কীভাবে হয়েছিল?
-১৯৭১ সালে গৌরনদী কলেজে পড়ি। ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রী। গৌরনদী কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম আমি। বাবার সরকারি চাকরি। একটি সচেতন সাংস্কৃতিমনা ও রাজনীতি পারিবারিক পরিবেশ বেড়ে ওঠা আমার। সে সময়  ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে কমিউনিস্ট কমিউনিস্ট পার্টির মনি সিং ও সাধারণ সম্পাদক ছিল মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন নেতৃত্বে। আমার দুই ভাই এর সাথে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হেঁটে হেঁটে কলকাতায় চলে যাই, জগন্নাথ হলের ভিপি কালীরঞ্জন শীল এর সহযোগিতায় (পরবর্তীতে তার সাথে আমার বিয়ে হয়) এবং তার অনুপ্রেরণাতেই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংএ অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। তারই সহযোগিতায় বেহারা ক্যাম্প থেকে নানাভাবে খোঁজ খবর নিয়ে ভারতের ৯নং সেক্টরের  টাকি মহিলা ক্যাম্পে যোগ দেই। সেখানে টিম লিডার ছিলেন রমা দাশ এবং তার মাধ্যমে আমিসহ বীথিকা বিশ্বাস, কল্পনা, মিনু, শোভাকে নিয়ে ১৮ জন ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। আমি জুলাই মাসে মেজর জলিলের অধীনে ক্যাপ্টেন বেগের কাছে টাকি ক্যাম্পে সারাদিন ছোট বড় অস্ত্রের ব্যবহার, টাইম বোম, ক্রশিং করে যুদ্ধ করার ট্রেনিং নিয়েছি। বর্ডার এলাকায় ছিল আমাদের ক্যাম্প। সারারাত মর্টারের শব্দ। মাঝে মাঝে টাকি ও ইছামতী নদীর পাড়ে গিয়ে দেখতাম শত শত মাথার খুলি পড়ে আছে। ৯নং সেক্টরে ট্রেনিং এর সময় তৎকালীন মন্ত্রী গুলজার লাল নিন্দার সাথে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম, ওই সাক্ষাৎকার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বারবার সম্প্রচার করা হয়েছিল।
 
দিদি, ট্রেনিং সময়ে বিশেষ কোনো স্মৃতি আছে কি?
-ট্রেনিং ক্যাম্পের ১৮জন মেয়েদের মধ্যে আমি ছিলাম সবার ছোট। এরকম ট্রেনিং নেয়া সময় হঠাৎ একদিন আমার প্রচুর ছবি তোলা শুরু করলেন এক ভদ্রলোক। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবছি, তিনি কে? টিম লিডার জানালেন, তিনি ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান। তিনি ছবি তোলার জন্য আমাকে নির্বাচন করেছিলেন। ওই ট্রেনিংএর মাঝেই আমার প্রায় পাঁচ শতাধিক ছবি তুলেছিলেন তিনি।

তারপর?
-দেড় মাস ট্রেনিং এর পর আগস্টের দিকে আট দশটা ছেলের সাথে আমার যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আগস্টের শেষের দিকে সিদ্ধান্ত হয়  ঈশ্বরদী সীমান্তে পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালাবে। ওই অপারেশনের তথ্য সংগ্রহের ভার পড়ল আমার ওপর। আমি তখন ছেঁড়াখোড়া কাপড় পড়ে খুব অসহায় মেয়ের বেশ নিয়ে রওনা দেই ঈশ্বরদী ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।  আমার এনে দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ওই অপারেশন চালানো হয় এবং তাতে আটজন পাকিস্তানি আর্মি মারা যায়।

দারুণ! রুনু'দি  আপনি তো রণাঙ্গনের যোদ্ধা! অথচ আপনি কত সাধারণভাবে থাকেন। উত্তরে রুনু'দি হাসলেন। এটুকুই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কি করলেন ?
-দেশ স্বাধীন হয়েছে সেই বিজয় উল্লাস টাকি তখন ফেটে পড়েছিল হাজার হাজার জনতার মিছিল, চর্তুদিকে আতসবাজির শব্দ, মিষ্টি বিতরণ এবং বিজয়ের শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত, সেই মুহূর্তগুলো এখনও মনে পড়লে আনন্দে দিশাহারা হয়ে যাই।

এখন কেমন আছেন দিদি?
এক মুখ হাসি ছড়িয়ে বললেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ পেরিয়েছে বাংলাদেশ , বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার এই শাসন আমল বড় অহংকারের বড় শান্তির। দেশ এগিয়েছে , ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আলোকিত, স্পষ্ট, উজ্জ্বল। যারা একদিন বাংলাদেশকে তলাহীন ঝুড়ি বলেছিল, আজ তারা বাংলাদেশের বন্ধু।

আপনি তো বাংলাদেশ মহিলা পরিষদেই পঞ্চাশ বছর ধরে আছেন?
-হ্যা তাই। পরম নিশ্চিত শান্তিময়  হৃদয়ের বন্ধনে ভালবাসা আর বিশ্বাসে দীর্ঘ বছর এখানেই কাটিয়ে দিয়েছি।

আপনার মেয়েরা?
-আমার বড় মেয়ে মৈত্রী দেবী ও ছোট মেয়ে  প্রীতিলতা। তারা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করছে। ছোট মেয়ে  প্রীতিলতা পিএইচডি শেষ করে  বর্তমানে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এসিসটেন্ট প্রফেসর। করোনার কারণে পিছিয়ে যাওয়া পিএইচডি পেপার জমা দিচ্ছে এখন বড় মেয়ে মৈত্রী দেবী ।

বর্তমান নিয়ে কিছু বলবেন?
-বর্তমানে আমরা ভাল আছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকারে আসার পর থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বীর সন্তানদের জন্য মাসিক   ভাতাসহ মুক্তিযোদ্ধা সনদের ব্যবহার করে চিকিৎসা সুবিধা, পোষ্যদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সুযোগসহ নানামুখী সুব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে 'বীর' লিখতে ও বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। এসবই সম্ভব হয়েছে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৃজনশীল গুণাবলীর জন্যে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে আমি ও আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ । তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর প্রার্থনা করি প্রতিক্ষণ।

রুনু'দি আপনার প্রতি এ প্রজন্মের কৃতজ্ঞতা জানাই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা  রুনু'দি রণাঙ্গনের যোদ্ধা, তার সাথে কথা বলতে বলতে তার সাথেই পেরিয়েছি গৌরবাণ্বিত মুক্তিযুদ্ধের কলাকৌশল ঘেরা পাকসেনাদের আক্রোশ প্রতিঘাতকে প্রতিবাদের প্রতিজ্ঞ বলিষ্ঠ কঠিনতম মুক্তিযুদ্ধের চ্যালেঞ্জিং দিনগুলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা রুনু'দি মুক্তিযুদ্ধের অহঙ্কারী দিনেগুলোর কথা বলছিলেন। তিনি প্রথমেই বলেছেন, আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা জোর গলায় বলতে পারছি, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানের সাথে কত সুবিধা ভোগ করছি, এখন মুক্তিযোদ্ধাদের মৃতদেহে জাতীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয় — এমনটি '৭৫ পরবর্তীতে ভাবতেই তো পারিনি।

রুনু'দি আরও জানান, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মোশতাক সরকার সংসদে ইনডিমনিটি আইন করে শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রোধ করে নি, সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠকেও স্তব্ধ করে দিতে চেষ্টা করেছিল। দীর্ঘ বছর মুক্তিযোদ্ধারা নিজ দেশে পরাধীন ছিল, রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। দুঃখের সাথে দেখেছি '৭৫এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা, পরবর্তীতে রাজাকার আলবদদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা। কবি সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম, নীলিমা ইব্রাহীম, নুরজাহান মুর্শিদ, ডা মাখদুমা নার্গিস , আয়েশা  খানম, ফওজিয়া মোসলেমসহ আরো অনেক থোকা থোকা উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ চেতনায় প্রতিবাদে মুখরিত হয়েছেন তৎকালীন সরকারের হীন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে।

যুদ্ধ ও বিজয় সেই ঋদ্ধময় সময়কে বুকের গভীরে ধারণ করে মহিলা পরিষদের সকলের প্রতি স্নেহশীল রুনু'দিকে নতুন করে জেনেছি। রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা রুনু'দি আপনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

হোমায়রা হুমা

হোমায়রা হুমা: কবি, লেখক ও মানবাধিকার কর্মী।   

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/