গ্রন্থ আলোচনা: হায়দার আকবর খান রনো ও ‘শতাব্দী পেরিয়ে’

জামাল উদ্দিন জামাল

হায়দার আকবর খান রনো ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে সর্বশেষ সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য। জীবনের সুদীর্ঘ সময় ধরে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করেছেন। রাজপথের এক আপসহীন সৈনিক। প্রত্যক্ষ করেছেন রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও ভাঙাগড়া। শুরু থেকেই বাম ছাত্র রাজনীতি, ভাসানী ন্যাপের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি), ওয়ার্কার্স পার্টি ও সবশেষ সিপিবি। তিনি রাজনীতিতে যা কিছুই করেছেন সমাজতন্ত্রের জন্য লড়েছেন। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কখনো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বা কখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদ সাজেননি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য তাঁর আজীবন সংগ্রাম। সভা-সেমিনার বা টিভি টক-শোতেও তার আপসহীন বক্তব্য। তাঁর কথা বা বক্তব্যে কোনো নাটকীয়তা অথবা কৃত্রিমতা নেই। তাঁর ফেলে আসা দিনের অভিজ্ঞতা, মেধা ও বাস্তবতার আলোকেই তিনি বর্ণনা করেছেন।

বামধারার ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম, সেই কারণে স্কুল জীবনে তার লেখা ‘ছোটদের রাজনীতি’ ও ‘ছোটদের অর্থনীতি’ দিয়ে শুরু করেছিলাম। বই দু’টি বহুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। রাজনীতির অঙ্গনে হাতে গোনা দু’চারজন উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নিয়ে সারা জীবন যারা পথ চলেছেন হায়দার আকবর খান রনো তাদের মধ্যে একজন। আমি যখন তাকে আমার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তিনি সাড়া দিয়েছেন। কোনোদিন মিস করেননি।

একদিন শুনতে পেলাম তার লেখা একটি বই ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ প্রথম আলো থেকে সেরা বই হিসেবে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। গুরুত্ব দিলাম, খুব একটা না। কেননা রনো ভাই যে ধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এতে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান তাকে অ্যাওয়ার্ড দিতেই পারেন। আবার এটাও বিবেচনায় আনলাম, আমার মেয়েও তো মেধাবী ছাত্রী হিসেবে প্রথম আলোর অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আমার মেয়েতো আর রাজনীতি করে না। সুতরাং বইটা ভালো হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ; তার মুখেও ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ গ্রন্থের প্রশংসা শুনলাম। সেখানেও গুরুত্ব দিলাম না। কেননা এই গ্রন্থের অনেকগুলো পৃষ্ঠাজুড়ে কাজী জাফর আহমদের শ্রমিক রাজনীতির প্রশংসা আছে। বইটি পড়ার আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে গেলাম। এক সময় হাতে পেয়ে পড়লাম। বিস্মিত হলাম, আপ্লুত হলাম এবং কিছু কিছু স্পর্শকাতর বর্ণনায় কেঁদে ফেললাম। এতো এক রাজনৈতিক দলিল। এ গ্রন্থ শুধু গতানুগতিক স্মৃতিচারণই নয়- এতে রয়েছে সামাজিক সংস্কৃতির আত্মনুসন্ধান। দেশ থেকে বিদেশ, ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজ ও রাজনৈতিক ঘটনা থেকে ছোটখাটো চমকপ্রদ কাহিনী যা গ্রন্থটিকে বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য দান করেছে। বইটি প্রকাশ করেছেন তরফদার প্রকাশনীর পক্ষে মাহবুব আলম। এ ধরনের স্মৃতিচারণমূলক ও রাজনৈতিক গ্রন্থ পাঠকের এতো চাহিদা এবং ১০ বার মুদ্রণ করাও এক বিরল ঘটনা। গ্রন্থের প্রচ্ছদ করেছেন মাসুদ কবির।

বইটি বার বার পড়তে ইচ্ছে হয়। এমনি আকর্ষণ আছে এই গ্রন্থে। শুধুই স্মৃতিচারণ আর রাজনৈতিক বিশ্লেষণই নয়। এতে আছে গ্রামের গরিব কৃষকের করুণ কাহিনী। তিনি ধনী ও অভিজাত পরিবারের সন্তান হওয়ার পরও মেহনতি মানুষের কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন বলেই সেই রাজনীতির পথটি বেছে নিয়েছিলেন। তিনি শতাব্দী পেরিয়ে গ্রন্থে ১৯২ পৃষ্ঠায় এমনভাবেই বর্ণনা করেছেন, ‘কৃষকের গরু হারানো যে কত বড় বেদনাদায়ক ব্যাপার, তা যারা কৃষক সমাজের সাথে ভালোভাবে সম্পৃক্ত নয় তারা বুঝবেন না। খাজনা-ট্যাক্সের জুলুমটাও কৃষককে দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ করেছিল।’

রাজনীতির অঙ্গনে সে সময়ের দুই দিকপাল মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি কাউকেই ছোট করেননি। কাউকে কারো সাথে তুলনাও করেননি। মওলানা ভাসানী বয়স, অভিজ্ঞতায় এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবীণ হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে তাকে ছাড়িয়ে যান। কীভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যান এবং কীভাবে শতাব্দীর মহানায়ক হয়ে ওঠেন সে কথাও তিনি বর্ণনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রকৃতিকে ভালো লাগার কথা বর্ণনা করেছেন এইভাবে, ‘আমি একবার চাঁদপুরের কাছাকাছি এক গ্রামে গিয়েছিলাম সভা করতে। গ্রামটার নাম মনে নাই। তবে তা চাঁদপুরে নয়-বৃহত্তর ফরিদপুরের অন্তর্ভুক্ত। রাতের বেলায় ছোট নৌকায় করে প্রশস্ত মেঘনা পাড়ি দিয়েছিলাম। আকাশে চাঁদ ছিল। নদীর ওপরে চাঁদের আলো পড়ছে। বড় চমৎকার লাগছিল। অমন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব কমই দেখেছি। প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত জায়গাও দেখেছি। কিন্তু চাঁদের আলোয় নদীর যে শোভা তা কারোর চেয়ে কম নয়। গভীর রাতে বিশাল মেঘনা নদী পাড়ি দেয়া কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারও বটে, বিশেষ করে আমার জন্য। যে শহরে মানুষ এবং সাঁতার জানে না বললেই চলে। তবু সেদিন বাইরের প্রকৃতির শোভার ভয়-ডর মুছে ফেলে দিয়েছিলো’।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, কীভাবে শতাব্দীর মহানায়ক হয়ে উঠলেন সেটা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন। অবশ্য লেখক বইয়ের কোথাও জাতির পিতা বলেননি (তিনি এ ব্যাপারে টেলিফোনে বলেছেন, ‘জাতির আবার পিতা হয় নাকি? আমি এটা মানি না)। গ্রেফতারের পর গ্রেফতার। বছরের পর বছর জেলে কাটানো। এভাবেই জনতার সহানুভূতিও পেতে থাকেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ছয় দফা, ১১ দফা কর্মসূচি শেখ মুজিব দ্রুত পৌঁছে যান জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এতো জনপ্রিয় নেতা পৃথিবীতে বিরল।
’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান খালাস হন এবং মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। তিনি লিখেছেন, ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় তিনি ভাষণ দেন। ৫ লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ হয়। এর আগে তার সমাবেশে এতো লোক কখনোই হয় নাই। পরে অবশ্য অনেকবার এই রকম বা এর চেয়ে বেশি লোকের সমাবেশ হয়েছে তবে সেগুলো শেখ মুজিবের জনসভা- এভাবেই শুরু হয় তার উত্থান। শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানীকে সব সময় শ্রদ্ধার সাথে দেখতেন। তার পা ধরে সালাম করতেন। ভাসানীও তাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন এমনটি তার গ্রন্থে ফুটে উঠেছে।

হায়দার আকবর খান রনো তার রাজনৈতিক জীবনের এই কাহিনী লিখতে গিয়ে গ্রন্থের প্রায় জায়গায় লেখা আছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, লালবাগের সাবেক এমপি হারুন অর রশিদ, সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার, আতিকুর রহমান সালু ও কবি বুলবুল খান মাহবুবের কথা। এতে লেখা আছে তার অতীত দিনের ভালোবাসার কথা। লেখা আছে মৌলবাদের উত্থানের কথা, আছে ভারতবিরোধী মনোভাব ও দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ বর্ণনা। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কথা লেখা আছে পাতায় পাতায়। কি নাই এই গ্রন্থের আর কেনইবা থাকবে না। তিনি এখন ৭২ বছর পার করেছেন। এই সুদীর্ঘ জীবনের আঁকাবাঁকা পথের কোনো কিছুইতো বাদ দেননি। তিনি লিখেছেন এভাবে, ‘১৯৭৩ সালে মওলানা ভাসানী যে দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত শুনতে পেরেছিলেন, ১৯৭৪ সালে সে দুর্ভিক্ষ সত্যি সত্যি দেখা দিলো। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের কথা শুনেছি মার কাছ থেকে, গল্পে উপন্যাসে পড়েছি। এবার স্বচক্ষে দেখলাম। কমলাপুর স্টেশনে, তোপখানা রোডের ফুটপাতের উপরে ও অন্যান্য জায়গায় ৮/১০টি লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। এবার পার্বতীপুর রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে দেখি প্লাটফর্ম পার হতে পারছি না। কারণ মানুষের লাশের ওপর দিয়ে অথবা অনেক কায়দা করে একটা ফাঁক খুঁজে লাফ দিয়ে ডিঙ্গিয়ে পার হতে হবে। এর মধ্যে সব লাশ নয়, কারো কারো হয়তো প্রাণটুকু কোনমতো টিকে আছে, কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে চলে যাবে। বোঝার উপায় নেই নারী না পুরুষ, অথবা বয়স কত, হয়তো হাসপাতালে নিতে পারলে বাঁচানো যেত। কিন্তু কে নেবে কয়জনকে? ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে কত মানুষ মারা গেছে? এর সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না।’ এই বিষয়গুলো আজকের প্রজন্ম হয়তো কিছুই জানে না। যদিও হায়দার আকবর খান রনো ইতিহাস লিখেননি। লিখেছেন স্মৃতিচারণ। তারপরেও এটা একটি ইতিহাস। বইয়ের প্রতি পাতায় পাতায় প্রসঙ্গক্রমে আমাদের দুই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানীর কথা বলেছেন।

ভাসানীর জীবন যাপনের কথা লিখেছেন তিনি এইভাবে, ‘প্রায় নানার বয়সী এই মানুষটিকে বড় আপন মনে হয়েছে। কখনো মনে হয়নি যে, এতো বড় নেতার সাথে কথা বলছি। বহুবার তার ঐ পর্ণকুটিরের বারান্দায় অথবা তাঁর সঙ্গে একই ঘরে থেকেছি। তিনি চৌকিতে, আমি নিচে মাটিতে শুয়েছি। তার সঙ্গে এক ঘরে থাকা আমার জন্য বিশেষ কারণে বেশ অসুবিধাজনক ছিলো। তিনি বেশী রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন এবং ক্রমাগত কথা বলতেন। অন্যদিকে আমার ঘুম ভাঙ্গার আগেই তিনি ভোরে উঠে পড়তেন। যতক্ষণ জেগে থাকতেন ততক্ষণ কথা বলতেন।’ রাত জেগে ভাসানীর কথা বলাকে ঘনিষ্ঠজন, সাংবাদিক শাহ আহমেদ রেজা তার এক গ্রন্থে এই কথা বলাকে আল্লাহর জিকির করতেন বলে উল্লেখ করেছেন। এখানেও কোনো বিতর্ক নেই। হায়দার আকবর খান রনো দেখেছেন এক দৃষ্টিকোণ থেকে শাহ আহমেদ রেজা বলেছেন তার দৃষ্টিকোণ থেকে।

‘শতাব্দী পেরিয়ে’র লেখক মওলানা ভাসানীর জীবনযাপনের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অল্প কথায় চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। ‘একহারা দীর্ঘাঙ্গী দেহের গড়ন। মুখে বাঙালি মেয়ের মাধুর্য। সদালাপি। কৌতুক করতে জানেন। কখনও কখনও চোখের কোণে দুষ্টুমির হাসির ঝলক দেয়। রাজনীতির ব্যাপারে যাই হোক না কেন; তার সঙ্গে কথাবার্তায় বেশ ভালো লাগে। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা যায়। তিনিও অল্প সময়ের মধ্যে বেশ আপন করে নিতে পারেন। রাজনীতির প্রসঙ্গ ছাড়াও নানাধরনের ঘরোয়া কথাবার্তার মধ্যদিয়ে পরিবেশকে বেশ হালকা ও আনন্দায়ক করে তুলতে পারেন। ব্যক্তিগত আচরণের কিছু দিক সম্ভবত: তিনি বাবার কাছ থেকে পেরেছেন উত্তরাধিকার সূত্রে।’

হায়দার আকবর খান রনো সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির নানাদিক তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। প্রসঙ্গক্রমে অনেকের কথা চলে এসেছে। তাদের রাজনীতিতে ভুল থাকলেও তিনি তার লেখায় কোনো আক্রমণ করেননি। তারা কেউ এতে কষ্ট পাওয়ার কথা নয়। বইটি প্রথমে প্রথম আলো পত্রিকার সেরা বই হিসেবে পুরস্কার পায়। এবারে অর্থাৎ ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেন গ্রন্থের লেখক হায়দার আকবর খান রনো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথার্থ মূল্যায়নই করেছেন।

জামাল উদ্দিন জামাল

লেখক পরিচিতি: জামাল উদ্দিন জামাল লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধসহ কথাসাহিত্যের নানা শাখায় তার সাবলীল পদচারণা পাঠকদের মুগ্ধ করে। ইতিমধ্যে নানা বিষয়ের ওপর প্রকাশ করেছেন ছয়টি গ্রন্থ। পেশাজীবনে তিনি একজন সাংবাদিক। কাজ করেছেন বহু প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায়।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/