অভিবাসী নারীদের উৎসর্গিত গল্প ‘নদী নামের মেয়েটি’

হোমায়রা খাতুন

হোমায়রা হুমা

এ নদী শুকিয়ে যায়নি ক্ষরায়,ভেসে যায়নি বন্যায়; দূর্নীতি গ্রাস করেছে নদীটিকে। এ কথাটা ইতোমধ্যে সারা দেশে পৌছে গেছে ঝড়ো বাতাসেরও আগে। দলে দলে লোক জমে গেল নদীর বাড়ীর উঠোনে। সালমা বেগমের কান্নার আওয়াজে যেন আল্লাহর আরোশও কেঁপে উঠলো। কে দিবে সান্তনা তাকে। এ যে ইচ্ছে করে নদীকে খনন করে নদীকে হত্যা করা হলো।
নদী সালমা বেগমের চতুর্থ কন্যা, একটি ছেলের আশায় চারটি মেয়ে হলো। তবু মিরাজ মিয়ার খায়েশ মেটে না। ছেলে তার চাই চাই। যেন অর্ডার দিলেই পাওয়া যায়, বাচ্চা বানানোর ফ্যাক্টরি একটা। শেষ পর্যন্ত ছেলে হয়নি সালমা বেগমের। এজন্য মিরাজ মিয়ার চাপার বাইড়ানিতে অতিষ্ট সালমা বেগম আর তার ছোট ছোট মেয়েরা।
–পোলায় থাকলে কামাই কইরা আনতো। হায় আল্লাহ কি করি এখন।
মিরাজ মিয়ার সারাদিনের হাপিত্যেশ ভালো লাগে না।
–আর কত ভাল লাগে, ক্যান মাইয়া মানুষ কি মানুষ না?
মেইয়েরে পড়াইতে পারি নাই এই শয়তানের জন্যি। গ্রামে কি কাম আছে? ঘরের মধ্যে তিন বোনে মিলে কি করবো? সালমা কিভাবে সংসার চালাবে, চিন্তায় চিন্তায় দিন পার করে। শয়তানের কোনোই কামাইরুজি নাই। খালি সারাদিন চাপা নড়ে। কষ্টে আর কতদিন চলে।মাইয়ারা বড় হইতেসে না! একটা উপায় করতে হবে, ঐ শয়তানের বকবকানি থাইক্কে মাইয়াগো বাঁচাইতে হবে।
সামলা বেগম তক্কে তক্কে লোক খুঁজতে থাকে। কারে দিয়া এই কষ্ট থেইকে উপরে উঠা যায়। হঠাৎ তার মনে পড়লো রমিজার কথা। বাঁচানোর পথ পেয়ে মনে শান্তি হইলো তার। সকাল হইতেই রমিজার বাড়ি গিয়া হাজির ও। গ্রামের রমিজা বেগম অনেক বছর থেকে ঢাকায় থাকে। বাসা বাড়িতে ছুটা কাজ করে করে দেশে জমিজমা ভালই করসে। ঈদে রমিজা দেশে আসলে সালমা বেগম কান্নাকাটি করে ওর মেয়েদেরকে ঢাকায় বাসাবাড়ির কাজের জন্য  নিয়ে যেতে অনুনয়-বিনয় করে। রমিজা যেন এর অপেক্ষায়ই ছিল। বল্লো- ‘ঠিক আছে, নিয়া যামুনে।’ ঠিকই ঈদের পর সালমা বেগমের মেয়ে পদ্মা, মেঘনা, সুরমা সখ করে রাখা নাম; তার আদরের মেয়ে, যাদের বয়স মাত্র আট, নয়, দশ। ওর বুকের ধন তিনটিকে ঢাকা শহরে নিয়ে গেল রমিজা বেশ খুশি মনেই।

রমিজার এখন পোয়াবারো। এই তিনজনকে নিয়ে ভালোই টাকা আসবে। ঢাকায় পৌঁছানো মাত্র এ বাড়ি ও বাড়ি কেনাবেচা শুরু হলো। শেষমেশ আনা-নেয়া খরচ আর খুশি করে দেয়ার নীরব ঘুষ তিনজনে ছয় হাজার একথোকে তার কামাই হয়ে গেল। আর দিনে দিনে পদ্মা-মেঘনা-সুরমাও ঢাকার বাতাসে তরতাজা শুধু না, চালাকচতুরও হয়ে উঠলো। টাকা কামানোর বিভিন্ন পদ্ধতি শিখে বাড়িতে বিকাশ করে বেশ মোটা অংকের টাকা জমলো ওরা ওদের মা-বাবার পকেটে।
ওদের বাবার চোখ তো এখন চড়কগাছ। আগেও কাজ করতো না আর এখন তো গা আরো গরম হইসে ওর। মিরাজ মিয়া গ্রামের চায়ের দোকানে বসে চাপাবাজিতে মশগুল হয়ে উঠে। এখন তো গ্রামে সব পাওয়া যায়। টেলিভিশন লাগে না, মোবাইলেই সারা দুনিয়া হাতের মুঠোয়। মাইয়ার টাকায় টাচ্ মোবাইল কিনলো মিরাজ মিয়া। মিরাজ মিয়া মোবাইলে টাচ করে আর বলে, “এটা নাকি ডিজিটাল বাংলাদেশ। ঢাকায় টাকা ওড়ে।” সেই টাকা তো তিন মাইয়ারা ধপাধপ ধরে আর পাঠায় মা-বাবারে। আরামে আরামে এখন মেরাজের মাথা গরম হয়ে গেছে। তার দরকার আরো টাকা, বিদেশি ডলার। মনে আনন্দের টাকার জোয়ার যেন ফুঁসে ওঠে তার।
দালাল রফিক মিয়া আজ চায়ের দোকানে বসে কত কি বলসে রে। হাজারে হাজারে মানুষের বিদেশে চাকরি করার বেসামাল সুযোগ করসে সরকার। মেয়েলোকেও ধুমসে বিদেশ যায়। ভালো বেতন, সুযোগ সুবিধা সব ভাল। মনে মনে হিসাব করতে করতে ঘরে এসে–সালমা ও সালমা  করে বউকে ডাকে।
মুখে পান গুঁজে হাতে একটা পান নিয়ে এসে স্বামীর হাতে দেয় সালমা বেগম। ভাবলো কি যেন বলবে–শোন্ সালমা বেগম আমাগো মেইয়েরা তো ভালই কামাইতেছে। চালাকচতুর হইসে তিনজনেই। তবু আমার আরো টাকা লাগবো। গ্রামের সব জমি কিনা ফালামু। শুনো এখন তো মেয়ে মানুষেরও বিদেশ যাওনেরও সুযোগ আছে।
–আমারে বিদেশ পাঠাইবা, নাকি তুমি যাইবা ?
–আরে তোমারে কে পাঠায়?
–তাহলে কি চাও?
–শোন্ রফিক মিয়া দালালের সাথে কথা হইসে,
সে বলসে এখন বিদেশে মেইয়েদের চাকরিতে বেতন অনেক বেশি। এখন আমার একটা ছেলে হলে কুনো দুঃখ থাকতো না। বিদেশ পাঠাইয়া দিতাম।
মিরাজকে ঝাড়া দিয়ে সালমা বেগম সরে পড়ে। ও বুঝে গেছে 'ছেলে না হওয়ার দোষ খুঁজতেছে শয়তানটা। কি যেন্ বলে'। ক'দিন পর পর একই কথা। সালমা বেগমের আর তর সইলো না। চিৎকার কইরা বলে উঠলো -এই শয়তান মানসে। তোর জন্যে বুকে পাথর বাইন্দা তিনটা মাইয়া ঢাকা শহর পাঠাইসি শুধু তুই বেটার আরামের লাইগা। বেটা এখন কি কইবার চায়?
রেগে উঠে মিরাজও, চিৎকার করে বলতে থাকে,–শোন্ আসল কথা কই, তোর এই মাইয়াডা নদী, ওরে বিদেশ পাঠায়া দিমু।
–আমার চৌদ্দ বছরের ছোট্ট মেইয়েটারে আমি বাইরে যাইতে দিমুই না।
–তুই থামাইতে আসলে তোরে তালাক দিয়া দিমু বুঝঝিস নি বেটি। আমার আরো জমি, গরু কিনতে হইব। অনেক টাকা লাগবো। মাইয়ারে বিদেশ পাঠায়ে বিদেশি টাকা আনমু, ডলার আনমু । চেয়ারম্যানরে দেখাইতে হইবে যে আমি তার সমান।

কোনো বারণ শুনলো না। ছলচাতুরী করে চোদ্দ বছরের দুনিয়া না দেখা অবুঝ মেয়েটাকে চব্বিশ বছরের জন্মনিবন্ধন কাগজ বানায়া নিয়া রফিক দালালরে দিয়া জর্ডান পাঠিয়ে দিল পাষান বাবা মিরাজ। ছোট নাবালক মেয়েটি যাওয়ার পরের দিন থেকেই ফোন আসতে লাগলো। ওর নানান অভিযোগ,
–মা,আমি এখানে থাকতে পারবো না। আর কান্না।
আরেকদিন ফোন–মা আমি তো ওগো কোনো কথাই বুঝি না। শুধু কান্না।
আবার ফোন,আবার ফোন, ফোন বাড়তেই থাকে। অভিযোগও কম নয়।
–মা, ওরা মারে।
–মা,এতো কঠিন কাজ করতে পারি না, ওরা অনেক মারে। আমি সইতে পারি না।
–মা, ওরা আমার সাথে রোজ খারাপ কাম করে। অনেক রক্ত বাইর হয় রোজ।
–মা আমাকে বাঁচাও।
–মা আমারে নিয়া যাও। বাজান আমারে কেন পাঠাইসে?
— মা,বাজান কি দেখে নাই আমি ছুট্ট মেয়ে। আমি বাঁচতে চাই।
–মা, আমার শরীল খুব খারাপ। মা বাঁচাও। নিয়া যাও।
— মা আমার গায়ে অনেক জ্বর, ওরা ডাক্তার দেখায় না, মাইনসে খালি খারাপ কাম করে,আর বেটিরা মারে।
–মাগো আর পারি না।
এরপর আর ফোন নেই। এক সপ্তাহ হতে চল্লো কোনো ফোন নাই। সালমা বেগম তো কাঁদতে কাঁদতে শেষ। গ্রামের সবাই জেনে গেছে। সবাই চেয়ারম্যানকে জানালো। দালাল রফিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রমিজ চেয়ারম্যান, মিরাজ মিয়া আর সালমা বেগম ঢাকায় জনশক্তি অফিসে গিয়ে ওঠে। সেখানে গিয়ে অফিসারকে কাগজপত্র দেখিয়ে তার মেয়ের বিপদের কথা বলে সালমা বেগম। তার মোবাইলে টেপ করা নদীর কান্নামাখা কথা, সবকিছু অফিসারদেরকে শোনায়। ছোট্ট মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য অনুনয় বিনয় করে কাঁদতে থাকে সালমা বেগম। অফিসে কান্নার শোরগোল ওঠে সালমা বেগমের। টেলিফোন বন্ধ করলো ক্যান মেইয়েটা? আতঙ্কে সালমা বেগম বেহুঁশ হয়ে পড়ে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ডিজি বরাবর দরখাস্ত করা হয়। তারা খবর নেয়া হবে আশ্বাস দিয়ে তাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন।
এক সপ্তাহ পর মন্ত্রণালয়কে জর্ডানের অ্যাম্বেসি জানায় যে, জর্ডানের এক ডাষ্টবিনে নদী নামের একটি অভিবাসী ক্ষতবিক্ষত মেয়ের লাশ কাগজপত্রসহ পাওয়া গেছে। খবরটি সালমা বেগমকেও জানানো হয়। কান্নার বন্যা এখন নদীর গ্রামের আনাচে কানাচে বয়ে যাচ্ছে। অর্থ লোভী বাবাও কাঁদছে এখন। মন্ত্রণালয় জানায়- লাশ আসতে দুই মাস লাগবে। বুকে পাথর বেঁধে দুইমাস কাটলো সালমা বেগমের।

সালমা বেগম এখন ঢাকায়। আজ নদী আসবে। নদী আসছে লাশ হয়ে। সালমা বেগমের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে যেন। ইতিমধ্যে সাংবাদিকরা এমন অমানবিক মৃত্যুর রহস্য নিয়ে রিপোর্টিং করছে প্রতিদিন। প্রবাসী কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ডিজির কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। এখন দেশবাসী জানতে চায় যে, মাত্র চোদ্দ বছরের মেয়েটিকে চব্বিশ বছরের জন্মনিবন্ধন সনদ কে দিয়েছে? এই ছোট মেয়েটির ট্রেনিং ট্রেনার চোখে দেখে কীভাবে কেন তাকে সার্টিফিকেট দিয়েছে। এসব জায়গায় তদারকি নেই কেন? দালাল চক্র কিভাবে পাসপোর্ট বানালো? দালালদের সাথে এ অফিসের কার কার যোগসাজশ আছে। বোঝা যাচ্ছে এক বিরাট শক্ত দুর্নীতির চেইন এই অন্যায় অভিবাসীদের অর্থ আত্মসাৎএর সাথে জড়িত।
সালমা বেগম তার আদরের মেয়ের লাশের গায়ে, মুখে কাটার দাগ দেখে পোষ্টমার্টমের জন্য আর্জি জানালো। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমতি দেয় নি। সালমা বেগম কোথাও কি বিচার পাবে তাহলে? তার জন্য মামলা করবে কে? যেখানে যারা তার নদীকে হত্যা করে ডাষ্টবিনে ফেলে রাখলো তাদেরকে কি বিচারের আওতায় আনা যাবে না? এই মন্ত্রণালয় তাহলে কার জন্য? পোড়খাওয়া গ্রামের মানুষ নীরবে মেয়ের লাশ নিয়ে মাটি চাপা দিয়ে শুধু চোখের জলেই ভাসলো। বিচারের বাণী নীরবে নির্ভৃতে বেদনার হাহাকারে ঊনচল্লিশ বছরের স্বাধীন দেশের আকাশ বাতাস কেবল ভারীই হল।

চোদ্দ বছরের নদীকে চব্বিশ বানানো, বিদেশ পাঠানো ও তার অমানবিক মৃত্যুর চাক্ষুষ প্রমাণ দেয় যে, ঘুষের দুর্নীতির গাঁথুনি এদেশের মাটির গভীরে চলে গেছে। চুরির ভাগের লম্বা চেইন ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত টানা। এ থেকে দেশবাসীর আর মুক্তি নেই। পুলিশের অসহযোগিতায় পরিবারটি সুবিচার থেকে বঞ্চিত হলো। সরকারি অফিসে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম নিরিহ মানুষের বিচারের প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। এ স্বাধীন দেশের  অভিবাসীদের রেমিটেন্সের খবর প্রচার করে কি লাভ যদি অভিবাসীরা তাদের ন্যায্য বেতন, জীবনের দামই না পায়! সাংবাদিকদের কথার উত্তর দেয়ার সময় নেই কর্তাব্যক্তিদের। তারা দেশের উন্নয়ন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এখন। নদীর মায়ের চোখের জল নদীর জলকে তামাটে করে দেয়। কেবল আরেক নদী তৈরি হয়ে অভিবাসীর লিষ্টে নাম লেখায় ভাগ্য অণ্বেষনে।

স্বাধীনতার গাণিতিক সংখ্যা পরিমাপ করে কি হবে যদি দুর্নীতির কলম চোদ্দকে চব্বিশ করা থেকে এখনও বিরত না হয়! তবে তো শত নদী গতিপথ হারিয়ে শুস্ক জলাশয় হয়ে যাবে। আর দুর্নীতির কষাঘাতে সাধারন মানুষ স্বাধীনতার সুফল আর কখনোই কি ভোগ করতে পারবে!

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/