মানব মণ্ডলের গল্প ‘জোঁক’

মানব মণ্ডল

জোঁক

বিয়ের প্রথম প্রথম যখন তুমি শাড়ির পরতে যেতে তখন কুচি দিয়ে দেওয়ার নাম করে নাভি, পেট ছুঁয়ে নিতাম, আর তুমি আমাকে  ‘শয়তান’ বলতে। আমার খুব ভালো লাগতো শুনতে। কোনও দিন বলিনি তবে আজ বলছি, তুমি কাজল পরলে, তোমাকে লক্ষী ঠাকুর, লক্ষী ঠাকুর লাগতো। যেনো, প্রতি মাসে যাতে তোমার পিরিয়ড না হয়, তার না হয় তার জন্য প্রার্থনা করতাম। তুমি ভাবছো আদর করতে পারবো না তাই! নাগো তুমি কোমরে পিঠে ব্যাথায় কষ্ট পেতে, কিরকম কিরকম অস্বস্তিতে কাটাতে দিনগুলো তাই। তুমি বলবে "আদিখ্যেতা, অতো যদি ভালোবাসো, তবে তনুর বয়ফ্রেন্ডের বার্থডে’তে পিৎজা পার্টি করেছিলাম বলে ঝগড়া করেছিলে কেন???  " জানো তো আমার এগুলো ভালো লাগে না, পিৎজাটা আসলে কি? রোমান সৈনিকরা যখন যুদ্ধ যেতো, আচার মাখিয়ে রুটি পাঠানো হতো, সেটাই পিৎজা। অতো পয়সা খরচ করার মানে হয় ওেই পিৎজার পিছনে। আর তুমি জানতে, ওই টাকাটা, তোমাকে আলাদা করে রাখতে বলেছিলাম। অফিসে থেকে, তপনদাকে অ্যাডভান্স না দিলে, আমি ওকে টাকাটা দিতাম। কারণ ওর ছেলের কলেজে ভর্তির জন্য টাকাটা জরুরি ছিলো। তাছাড়া আমি নরপুর থেকে সেই দিন ফিরেছিলাম।

তুমি তো ভালো পায়খানা, আর ভালো ঘর নেই বলে পালিয়ে এলে ওখান থেকে। ওখানের সুন্দর নদীটাকে তুমি দেখেছিলে। নদীতে ভেসে যাওয়া মরা পুড়ানো কাঠের দখল নিয়ে মারপিট করা ছেলেমেয়েদের দেখেছিলে। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি ওটা ওদের খেলা নয়। ওরা ওদের মায়েদের জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করে ওভাবে। তাই পরের দিন বাপনকে কাজে নিয়েছিলাম। না, না, ওর বয়স কম বলে ওকে হাফ মুজুরি দিতে পারিনি আমি। কারণ ওতো বরঞ্চ বড়োদের থেকে বেশি কাজ করেছে। জানো ওর জন্মটা একটা ট্রাজেডি, ওর মা দরিদ্র বামুন ঘরের মেয়ে। ইটভাটায় কাজ করতে গিয়ে রফিকুল সাথে ওর প্রেম। ও যখন পেটে এলো, তখন বিয়ের জন্য চাপ দিতে রফিকুল পরিবার বলল ওকে ইসলাম কুবুল করতে হবে, ও রাজিও হলো। গরীব মানুষের আবার কোন ধৰ্ম আছে নাকি?? কিন্তু সেই রাত্রিতে ওরা গ্রাম ছেড়ে পালাল। আমি জানো, বাপনের থেকে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। ১০০ দিনের কাজের যে জব কার্ড দেওয়া হয় জেনো তার জন্য, ওদের ১০০০ টাকা দেওয়া হয়। দিনে ১৬০ টাকা করে পাবার কথা কাজ করলে, ১০০ দিন কাজ ওরা করতেও চায়। কিন্তু নেতারা ১০০ দিন কাজ করেছে বলে কাগজে সই করায়, আর দিনে ১০ টাকা করে দেয়। ১০ টাকায় তো ওরা সিঙ্গারাও খেতে পারে না বলল।

আমি বললাম ‘তোকে সিঙ্গারা মুড়ি খাবার পয়সা দেবো, দক্ষিণ এর ডাঙাটা সাফ করে দিবি?’
ও আল্লাদে আটখানা বললো, ‘এখুনি করছি।’
আমি বললাম, ‘বিকাল বেলায় ওখানে যাস না, জোঁক আছে শুনেছি। আর আজ আমি বাড়ি যাবো বেশি পয়সা দিতে পারবো না।’
ও বললো- ‘তুমি কোন দিন দেখেছো? ওরা তোমার থেকে বেশি পয়সা ঝারবে বলে, ওরকম বলে। ২০ টাকা দিলেই হবে আমায়। আজ হাঁট, অনেক দিন মাছ খাইনি-একটু শুঁটকি মাছ কিনে আনবো। বর্ষাকাল তো অনেক দেরি না! তাছাড়া সবাই তো আমাকে কম পয়সাই দেয়।বলে বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করালে জেল খাটতে হবে। তুমি তো পুরো পয়সাই দিলে আজ। তোমাকে জন্য ফ্রিতে করতে পারি কাজ টা।’
আমি বললাম -‘আমি কোন দিন জোঁক দেখি নি জানিস । ঠিক আছে ২০ টাকাই দেবো তোকে।’
পাগল ছেলে ও । জানো, আমাকে দেখাবে বলে কচুপাতাতে মুড়ে দুটো তিনটে জ্যান্ত জোঁক ধরে এনেছে। হঠাৎ চোখ পড়লো ওর পায়ে একটা জোঁক ঝুলছে। আমি বলতে বললে বললো ‘ছেড়ে দেও যতোটা রক্ত শুষে নিতে পারে নিতে দাও, কিছু হবেনা আমার।’

দশটা টাকা বেশি দিতে খুব মন চাইছিল। কিন্তু তোমারা তো আমার পাইপয়সার নেবে। দশ টাকা বেশি দিলে দয়ার সাগর টাগর বলে কথা শোনাবে। কাল সকালে অফিস যেতে হবে । খিদের জ্বালা বড় জ্বালা, ধর্মঘট তুলে নিয়েছে লেবার ইউনিয়ন। কম পয়সায় ওভার টাইম ছাড়াই কাজে যোগ দেবে সবাই। তাই দাড়িটা কাটতে হবে আজ। দাড়িটা অনেক বড়ো হয়েছে। আয়ানায় নিজের মুখ দেখে চমকে উঠলাম। দাড়ির জায়গায় কিলবিল করছে কিছু জোঁক।

মানব মণ্ডল: কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। মূলত ভাষাকর্মী হিসাবে লোকসংস্কৃতি নিয়ে চর্চায় আগ্রহী মানব মণ্ডলের সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ স্বপ্ন অনুঘটক নামক একটি ছোট পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে । বর্তমানে কর্মসুত্রে আবুধাবি অবস্থান করছেন এই ভারতীয় লেখক।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/