আজ ২২ মে, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরী ঘোষের জন্মদিন। উপমহাদেশের একজন কুখ্যাত ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় দীর্ঘ সাত বছর জেল খাটেন এই নারী। এসময় তার ও তার পরিবারের ওপর অকথ্য নি চালায় ব্রিটিশ সরকার। তবে কেবল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী হিসাবে নয়, একজন মানবদরদী চিকিৎসক হিসাবেও দারুণ সফল ছিলেন সুনীতি চৌধুরী।
১৯১৭ সালের ২২ মে কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুনীতি চৌধুরী। তখন কুমিল্লা ত্রিপুরার সাব ডিভিশন হিসাবে বিবেচিত ছিলো। বাবা উমাচরণ চৌধুরী সরকারি চাকরি করতেন। মা সুরসুন্দরীদেবী ছিলেন একজন বিদূষী নারী। কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী ফৈজন্নেসা গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলেন সুনীতি। আর ওই বয়সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। সহপাঠী প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ময়ের অনুপ্রেরণায় যোগ দেন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’য়ে। ১৯৩১-এর গোড়ার দিকে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত একটি ছাত্র-সমাবেশ কিশোরী ছাত্রীদলের উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। তাদের নিয়ে একটি ‘ছাত্রীসংঘ’ গড়ে ওঠে। সুনীতি ছিলেন সেই ছাত্রী স্বেচ্ছাসেবী দলের নেতা। এরপর শুরু হয় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। কুমিল্লার ময়নামতী পাহাড়ে লাঠি চালানো, ছোরা খেলা, রিভলবার চালানো শেখেন সুনীতি। এরপর নেমে পড়েন মিশনে। সুনীতি ও তারই সহপাঠী শান্তি ঘোষকে যৌথভাবে পাঠানো হয় কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করার মিশনে। তখন তারা দুজনই ফৈজন্নেসা গার্লস স্কুলের ছাত্রী, পড়েন ক্লাস এইটে। তখন সুনীতির বয়স ১৪, আর শান্তির ১৫ বছরের কিশোরী।
১৯৩২-এর ১৪ ডিসেম্বর সাঁতারের ক্লাব করার অনুমতি নেয়ার কথা বলে স্টিভেন্সের বাংলোয় যান দুই কিশোরী। তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গুলি করেন কুখ্যাত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে। সুনীতির প্রথম গুলিতেই স্টিভেন্স মারা যান। কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়েন শান্তি ও সুনীতি। এই অপরাধে তাদের কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হয় দীর্ঘদিন। এর জের টানতে হয় সুনীতির পরিবারকেও।
বিচারের জন্য সুনীতি ও শান্তিকে যখন আদালতে তোলা হয় তখন সবাই তাদের দেখে অবাক হয়ে যায়। এত অল্প বয়সী বিপ্লবী! গোটা ভারতবর্ষজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলো এই ঘটনা। আর বিপ্লবী নেতারা তখন এই দুই কিশোরীর ছবি দিয়ে বিভিন্ন লিফলেট বানিয়ে সেগুলো প্রচার করতে থাকে। এমনি এক লিফলেটে লেখা ছিলো- ‘ রক্তে আমার লেগেছে আজ সর্বনাশের নেশা’- বের করে। এটি তখন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। দুই কিশোরীর বয়স আর নানা দিক বিবেচনা করেই ফাঁসির বদলে তাদের দ্বীপান্তর দণ্ড দেয় আদালত। যদিও তাদের দীপান্তর দণ্ড কার্যকর হয়নি। বরং প্রথমে তাদের পাঠানো হয় কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখান থেকে স্থানান্তরিত করা হয় মেদিনীপুর জেলে। এসময় শান্তিকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে রাখা হলেও সুনীতিকে তৃতীয় শ্রেনীর কয়েদি হিসাবে রাখা হয়। জেলখানায় তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। তার অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে করতে হয় তার পরিবারকেও। বন্ধ করে দেওয়া হয় সুনীতির বাবা উমাচরণ চৌধুরীর সরকারি পেনশন । বিনা বিচারে আটকে রাখা হয় তার বড় দুই ভাইকে। পুরো পরিবারকে বছরের পর বছর কাটাতে হয় অনাহারে, অর্ধাহারে। অপুষ্টিতে ভুগে যক্ষ্মা রোগে মারা যায় তার ছোট ভাই। এই অসহনীয় অত্যাচার কিন্তু সুনীতির চরিত্রকে করে তোলে ইস্পাতের মতো দৃঢ় আর কঠিন।
শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরীকে নিয়ে করা ঐতিহাসিক লিফলেট
বিভিন্ন সময়ে শান্তি-সুনীতিকে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। তবে এত অত্যাচারের পরও কখনই ভেঙে পড়েননি এই দুই অসীম সাহসী তরুণী। তারা যেখানেই যেতেন গান গেয়ে অন্য কয়েদিদের মন জয় করে নিতেন। এছাড়া তারা নানা দেশাত্মবোধক গান গাইতেন পুলিশের ভ্যানে, এমনকি আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও। তাদের মনোবল ছিলো ইস্পাতের মতই কঠিন আর দৃঢ়। আর এ কারণেই শত নির্যাতন চালিয়েও এউ দুই কিশোরীর মুখ থেকে একটি কথাও বের করতে পারেনি পুলিশ।
পরবর্তীতে হিজলি কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয় সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষকে। সেখান থেকে মহাত্মা গান্ধীর চেষ্টায় মুক্তি পান ১৯৩৯ সালে মুক্তি পান এই দুই নারী বিপ্লবী। তখন সুনীতি ২২ বছরের তরুণী। এরপর আবার লেখাপড়া শুরু করে সফলতার সঙ্গে এম.বি বিএস পাশ করেনএবং চিকিৎসক হিসাবে জনসেবার কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। পেশাজীবনে নিঃস্বার্থ ভাবে দুস্থ ও দরিদ্র মানুষের সেবা করাই ছিল সুনীতির প্রধান ব্রত।
অন্যদিকে শান্তি ঘোষও কলকাতায় বেঙ্গলী উইমেন্স কলেজে পড়াশুনা করেন ও বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন। পরে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং দুইবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসভার সদস্য এবং একবার বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জনসেবা ও সাহিত্যচর্চা করে জীবন কাটিয়ে দেন। তিনি ‘অরুন বহ্ণি" নামে আত্মজীবনীমূলক বই লিখেন। ১৯৮৯ সালের ২৭ মার্চ ৭৩ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।
তবে তার বন্ধু সুনীতি চৌধুরী কখনই ভারতের রাজনীতিতে আগ্রহ দেখাননি। স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে (১৯৫১-৫২) তাকে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানায় কংগ্রেস ও কম্যুনিস্ট দল। কিন্তু তিনি তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। নানা কারণে রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন সুনীতি। বরং নিজের পেশায় সময় দেয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন এই নারী। ফলে চিকিৎসক হিসাবে দারুণভাবে সফলতা পেয়েছিলেন। পরম মমতার সঙ্গে আর্ত পীড়িতের সেবা করতেন বলে কলকাতার গোটা চন্দননগরে ছড়িয়ে পড়েছিলো চিকিৎসক সুনীতি চৌধুরীর খ্যাতি। সেখানকার বাসিন্দারা ভালোবেসে তাকে ‘লেডি মা’ বলে সম্বোধন করতেন।
১৯৪৭ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন শ্রমিক নেতা প্রদ্যোত কুমার ঘোষকে। তাদের একমাত্র মেয়ের নাম ভারতী। মেয়েকে ভারতের নানা উৎসব আর সংস্কৃতিতে উৎসাহিত করে তুলেছিলেন সুনীতি চৌধুরী। সর্বভারতীয় বলতে যা বোঝায় এই পরিবারটি ছিলো তেমনই।
আগাগোড়াই তিনি ছিলেন একজন স্বনির্ভর নারী। এমনকি ভাইদের ব্যবসাতেও আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। এছাড়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা-মাকে তিনিই দেখভাল করতেন। শিশুদের খুব পছন্দ করতেন । তাদের আদর করে শেখাতেন সাঁতর আর বাগানের কাজ।
১৯৮৮ সালের ১২ জানুয়ারি, ৭৭ বছর বয়সে মারা যান এই মহিয়সী নারী।
আজ তার ১০৬তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন কুমিল্লার সাহসী বিপ্লবী নারী সুনীতি চৌধুরী।
স্বামী ও একমাত্র মেয়ের সঙ্গে সুনীতি চৌধুরী
ছবি ও তথ্যসূত্র-ইন্টারনেট
ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/