কাজী সুফিয়া আখ্তার
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে নূরজাহান মুরশিদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন একজন সুশিক্ষিত-সংস্কৃতিমান সম্পন্ন মানুষ। বলিষ্ঠতা আর মাধুর্যে সমন্বিত তাঁর ব্যক্তিত্বময় চরিত্র জীবনাচরণের প্রতিটি পদক্ষেপে স্বতঃই উদ্ভাসিত হতো। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার অন্তর্গত তারানগর গ্রামে এক আলোকিত পরিবারে ১৯২৪ সালে ২২ মে জন্মগ্রহণ করেন। সাতবোনর মধ্যে নূরজাহান ছিলেন চতুর্থ।
তিনি তার পিতার আগ্রহে কলজাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তার শ্বশুরের আগ্রহে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। বি. এ. পরীক্ষার পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার বাবার ইচ্ছের জন্য পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু ১৯৪৫ সালের ৫ জুলাই নূরজাহান বেগের (তার বিয়ের আগের পদবী বেগ) এম. এ. পরীক্ষার মাত্র ২০ দিন আগে তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার মেয়েকে এম. এ. পাশ দেখে যেতে পারেননি। এই দুঃখ আজীবন নূরজাহান বেগের মনে ছিলো। এম. এ. পরীক্ষার পরে তার চাচার পরামর্শে বরিশাল মজিদুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে হেড মিস্ট্রেস পদে চাকুরি শুরু করেন। এখানে এক বছর থাকার পরে কলকাতার পোস্ট -গ্র্যাজুয়েট মুসলমান মেয়েদের হোস্টেল-মন্নুজান হল এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে যোগ দেন। এই সময়ে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নারী ওছোটদের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। কিছু দিন পরে রেডিওতে একটি স্থায়ী পদে যোগ দেন।
১৯৪৬ সালের 'ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে'তে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে মিটিংয়ে তারা কয়েকজন গিয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আর হল- এ ফিরতে পারেননি। দাঙ্গার কারণে রিপন স্ট্রিটের মিল্লাত পত্রিকা অফিসে মাসাধিককাল কাটাতে তারা বাধ্য হন। এই সময়ে গান্ধীজী শিয়ালদহ স্টেশনের একপাশে মেঝেতে পাটি পেতে শান্তির জন্য অনশন শুরু করেছিলেন। অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরিস্থিতি অনুকূলে আনার প্রাণপণ চেষ্টায় সারা কলকাতা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নূরজাহান দু' বার সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে গিয়ে গান্ধীজীর দেখা করেন। গান্ধীজী তাঁর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন,"সামনের দিনের দায়িত্ব বোধহয় তোমাদেরকেই নিতে হবে, তোমরা এগিয়ে না এলে জনজীবন শুদ্ধতর হবে না। "
দেশভাগের পরে রেডিওতে চাকরি সূত্রে যে- ঢাকাতে তিনি আসতে চাননি, সে- ঢাকাতে চলে এলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক খান সারওয়ার মুরশিদ এর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এ বিয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন তাঁর শ্বশুর আলী আহমেদ খান স্বয়ং।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে নূরজাহান মুরশিদ ঢাকা – নারায়ণগন্জ আসনে জয়লাভ করে সংসদ সদস্য ও পরে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি হন। সেই সময়ে পাকিস্তানের সরকার প্রধান শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁকে পাকিস্তানের একজন প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অষ্টম অধিবেশনে যোগ দিতে পাঠিয়েছিলেন। পাকিস্তানের এই প্রতিনিধি দলে নূরজাহান মুরশিদ ছিলেন একমাত্র নারী রাজনীতিবিদ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ভ্রাম্যমাণ দূত হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যেমন- বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লী, লক্ষৌ ভ্রমণ করে স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন এবং তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ভি. ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, স্পীকার ধীলন,প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজ্জীবন রাম ও বিরোধী দলের নেতা ফখরুদ্দীন আলী আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি দিল্লী পার্লামেন্টের উভয় হাউসের যুক্ত অধিবেশনে স্মরণীয় বক্তৃতা দান করেন। এই সকল খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ইয়াহিয়া খানের নজরে পড়েন এবং তিনি তাকে চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত ও তাঁর সকল বিষয়সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এক ঘোষণা জারি করেন। তিনি একমাত্র নারী যার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খান এই দণ্ডাদেশ জারি করেছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৭৩ সালে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সংসদেও সাংসদ নির্বাচিত হন।
তিনি 'এদেশ- একাল' নামে নারী পুরুষের সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শে একটি উঁচু মানের সাময়িকী আট বছর সম্পাদনা করেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রথম প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ- সভানেত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
নূরজাহান মুরশিদ আজীবন মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন। এদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশের ক্ষেত্রে একেবারে সূচনা থেকেই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন। ভাষা আন্দোলনে মেয়েদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যারা অগ্রণী ছিলেন নূরজাহান মুরশিদ ছিলেন তাদের অন্যতম একজন। ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এই মহিয়সী নারী।
নূরজাহান মুরশিদ আজীবন সুস্থ রাজনীতির চর্চা করেছেন। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন। সুস্থ রাজনীতির চর্চা ব্যতীত নারী নির্যাতন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দূর করা এবং নারী পুরুষের সমতা, সমান সু্যোগ সমাজের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই আজ তাকে স্মরণ করা, তার ঐতিহ্যের ধারক কর্মের আলোচনা নূরজাহান মুরশিদ এর জন্য নয়, আমাদের মানবিক ও আত্মিক এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই প্রয়োজন।
আজ তার ৯৮তম জন্মদিনে তাকে জানাই অন্তর্ময় শ্রদ্ধাঞ্জলি।
কাজী সুফিয়া আখ্তার
ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/