অনিন্দ্য সুন্দর তাজমহলও কি তবে হেরে যাবে সাম্প্রদায়িকতার কাছে?

বিশ্বের অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য তাজমহল

বিশ্বজুড়ে প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে আগ্রায় যমুনার তীরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের তৈরি শ্বেত পাথরের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য তাজমহল। একে ঘিরে প্রতিনিয়ত কত না কবিতা আর গল্প রচনা করে চলেছেন কবি ও সাহিত্যিকেরা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- ‘
           একবিন্দু নয়নের জল
   কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্ব
        এ তাজমহল।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় লিখেছেন-"তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?/অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।"

এটি ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র।  তাজমহল দেখতে প্রতি বছর ভারত ভ্রমণ করেন ২০ থেকে ৩০ লাখ মিলিয়ন পর্যটক, যাদের সিংহভাগই বিদেশি। এই জনপ্রিয় ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জলঘোলা করার চেষ্টা করছেন দেশটির হিন্দুত্ববাদী নেতারা। তাদের কাছে এটির কোনও ঐতিহাসিক মূল্য নেই, বরং কেউ কেউ একে 'ভারতীয় সংস্কৃতির কলঙ্ক' বলে উল্লেখ করেছেন। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা সঙ্গীত সোম ২০১৭ সালে এই বিতর্কিত মন্তব্যটি করেছিলেন। (বিবিসি বাংলা, ১৬ অক্টোবর ২০১৭) তার পথ ধরে ভারতের অনেক হিন্দু নেতাই এখন এটি ভেঙে ফেলার কথা বলছেন।

বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল নিয়ে নতুন করে বিতর্কে মেতে ওঠেছে হিন্দুত্ববাদীরা। তাদের দাবি, তাজ আসলে একটি হিন্দু মন্দির, এটির ওপর জোরপূর্বক এই স্থাপত্য নির্মাণ করেছেন সম্রাট শাহজাহান। যদিও নিজেদের দাবির পক্ষে এখনও পর্যন্ত জোরালো প্রমাণ পেশ করতে পারেনি তারা। তবে ভারতজুড়ে সরগোল ঠিকই তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এই হিন্দুত্ববাদী নেতারা। তাই অনেকের আশঙ্কা, তাহলে কি একদিন বাবরি মসজিদের মতো ভেঙে ফেলা হবে তাজমহলও? আর এভাবেই কি পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে ইউনিস্কোর অন্যতম হেরিটেজ, বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল!

যমুনার তীরে ৪২ একর জমির উপর তাজমহলের নির্মাণ শুরু হয় ১৬৩২ সালে। তা প্রাথমিকভাবে শেষ হয় ১৬৪৩ সালে। পুরো শেষ হতে আরো দশ বছর সময় লাগে। সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় মমতাজ মহলের সমাধি। মুঘল নির্মাণশৈলির অন্যতম সেরা নিদর্শন।

কিন্তু ভারতে সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাজমহলের বিরুদ্ধে আবারও সক্রিয় হয়েছেন ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতারা। তাদের দাবি, তাজমহল আসলে একটি হিন্দু মন্দির। তার নাম ছিল তেজো মহালয়া। শাহজাহান সেই মন্দিরের উপরই তাজমহল বানিয়েছেন। বেশ কিছু বছর আগে পি এন ওক একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে দাবি করা হয়েছিল, তাজমহল আসলে হিন্দু মন্দির। সম্প্রতি সময়ে সেই দাবি নতুন করে তুলেছেন মোদির দলের নেতারা।

বিজেপি সাংসদ ও জয়পুর রাজপরিবারের সদস্য দিয়া কুমারীর দাবি, তাজের জমি ছিল জয়পুরের রাজপরিবারের। সেই জমি শাহজাহান নিয়ে নেন। সেই জমির অধিকার দাবি করেছেন তিনি। দিয়া কুমারী জানিয়েছেন, রাজপরিবারের কাছে কাগজপত্রও আছে। তাজের থেকে কিছুটা দূরে জয়পুরের রাজপরিবারের পুরনো নির্মাণও আছে।

তবে ইতিহাসবিদেরা বলেন, রাজা মানসিংহ ছিলেন মুঘলদের মনসবদার। মনসবদারের কাছ থেকে সম্রাট জমি নেবেন, তা সেই যুগে স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। কিন্তু ইতিহাসের ধার ধারেন না এইসব সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতারা। অতি সম্প্রতি তাজের বেসমেন্টের তালাবন্ধ ২২টি কামরা খোলার দাবি নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছিলেন এক বিজেপি নেতা। বিজেপি নেতাদের দাবি ছিল, তালা খুললেই সত্য প্রকাশ পাবে। যদিও আদালত তার আর্জিকে পাত্তা দেয়নি, এটা খারিজ করে দিয়েছে।

পরে ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ওই ২২টি কামরার ছবি প্রকাশ করে বলেছে, এগুলি একেবারেই সাধারণ ঘর। সংরক্ষণের জন্য তা বন্ধ রাখা হয়েছে। এর পিছনে কোনও রহস্য নেই। ইতিহাসবিদেরা বলেন, সম্রাট শাহজাহান আগ্রা কেল্লা থেকে নৌকায় যমুনা পার হয়ে তাজমহলের সামনে নামতেন। তারপর নীচের কামরায় একটু বিশ্রাম নিয়ে উপরে যেতেন।

তাজের ঠিক উল্টো দিকে যমুনার অন্য তীরে কালো পাথরের আরেকটি তাজমহল বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন শাহজাহান। তার ভিত তৈরির কাজও হয়েছিল। তারপর আর কাজ এগোয়নি। আওরঙ্গজেব সেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই কৃষ্ণ তাজ নিয়ে অবশ্য কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু সেখানে কোনও হিন্দু মন্দির ছিল এমন দাবি কিন্তু শোনা যায়নি।

বিজেপি নেতাদের এই দাবি নিয়ে ভারতজুড়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। আগ্রা, দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও সরাসরি ছায়াপাত করেছে এই বিতর্ক। সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই স্থাপত্যের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে হিন্দু-মুসলিম প্রসঙ্গ। তাজকে ঘিরেও তৈরি হচ্ছে বিভাজন। তাই অনেকের আশঙ্কা- সাম্পদায়িক চাপের মুখে একদিন বাবরি মসজিদের মতোই নির্মমভাবে ভেঙে ফেলা হবে না তো তাজমহল! ইতিমধ্যে এই দাবিও কিন্তু জোরদার হতে শুরু করেছে।

তথ্যসূত্র-ইন্টারনেট ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/