তাহমিনা রহমানের গল্প ‘এলিজার চোখ’

তাহমিনা রহমান

এলিজার চোখ

আমি আমার সাদাকালো চোখে এলিজাকে দেখি । এলিজার চোখ নীলসাদা । অমন চোখকে আমার কাছে অতল সাগরের মতো মনে হয় । মনে হয় এই চোখের পেছনে আরো এমন কিছু আছে যা শুধু দেখেনা দেখায়‌ও । আমার আরো মনে হয় একেই বলে ইনটুইশন । আমি যখন একা থাকি বিশেষ করে রাতের খাবার শেষে টিভি অফ করে শোয়ার আয়োজন করতে থাকি এই যেমন বেডসিট টেনে ঝেড়ে মশারি টানাতে শুরু করি ঠিক তখনই এলিজার নীলসাদা চোখ আমার পিছু নেয় । আমি তখন চোখ বুজে এই পরীক্ষা- নিরীক্ষামূলক পরিবেশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি কিন্তু এলিজার চোখ দুটো তখন দুইপাশ থেকে টর্চের আলো ছড়িয়ে বলতে গেলে আমাকে ধমকিয়ে শাসিয়ে মশারির ভেতরে নিয়ে যায় এবং শুয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত শাসাতে থাকে । আমি একান্ত বাধ্য ছেলের মতো বালিশের উপর মাথাটা কাত করে শরীরটা সামান্য কুঁজো করে মোটামুটি ঘুমের ভান করি কিন্তু সাথে সাথে ঘুম আসেনা । আমি তখন ঘুমকে আহ্বান করি । আস্তে আস্তে ঘুম আসে কোন এক নদীপথ ধরে । অনেক আঁকিবুকি করে মালার মতো পথ তৈরি করে ঘুম আসে ।

লেডি ডাক্তার আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে এক‌ই প্রশ্ন করে-বলুন এলিজার সাথে আপনার কী হয়েছিলো । লেডি ডাক্তারের প‍্যানপ‍্যানানিতে আমার বিরক্তি ধরে যায় । আমি চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি । তার উপর ওই ডাক্তারের চোখ আমার মতো সাদাকালো । আমার মনে হয় ওর মানসিক সমস্যা আছে তা না হলে কেউ কারো ব‍্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলায় না । এলিজার ব‍্যাপারটা সম্পূর্ণ আমার আর এলিজার । তাছাড়া এলিজা আমার জুনিয়র । আমি কখনোই স্বীকার করবোনা যে সে মেধায় মননে আমার চাইতে অনেক বেশি অগ্ৰসর ছিলো । আমার প্রতি তার ইনসালটিং বিহেভ আমাকে ক্রেইজি করে তুলেছে । আমি কিছুতেই চাইনি এবার ওর প্রমোশনটা হোক । সিলেকশন বোর্ডে আমি তাকে পুয়রেস্ট মার্কস দিয়েছিলাম । তারপর‌ও আমার মার্কস ছাড়াই সে পাশ করে যায় । সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ওর প্রমোশন ঠেকাতে পারিনি ।

লেডি ডাক্তারের উল্টাপাল্টা মন্তব‍্যে আমার মন খারাপ হয় । আমি নাকি বিড়বিড় করি । সে আমাকে বলে -বিড়বিড় করে বললেও সে নাকি আমার কথা বুঝতে পারে । আমাকে বলে-এলিজা দেখতে তেমন আহামরি কিছু না । এর চেয়ে অনেক সুন্দরী মেয়ে আমার জন্য প্রস্তুত আছে । আমি মনে মনে বলি – তুমি বুঝো
কাঁচকলা ।
এলিজার চোখের ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত হয় নীল আলো । সেই আলোতে মায়াবী একটা আবেশ তৈরি হয় । আমার ধারণা এলিজার দুই চোখে দুটো হীরে বসানো আছে । কাচের মতো চকচকে হীরে । সেই চাকচিক্যের পেছনে একটা খরস্রোতা নদী । নদীতটে থরে থরে বিছানো আরো শত সহস্র হীরের ঝলকানি । আমার ভাবনায় আসে এলিজার চোখগুলো একসময় রত্ন ছিলো । নীল রত্ন । সাদা কাচের পটে আঁকা  নীলরত্ন । আমার আরো মনে হয় এলিজার চোখ শুধু চোখ নয় । এ চোখের আলাদা জগত আছে । আমি তাই এলিজাকে চোখকণ‍্যা বলি । নীলসাদা চোখকণ‍্যা ।

লেডি ডাক্তার আবার আমাকে চমকে দেয় । বলে – যাকে এতো ভালোবাসেন তাকে প্রতিপক্ষ ভেবেছেন কেন ?
এবার আমার খুব রাগ হয় । রেগে গেলে আমার মুখে খারাপ শব্দ চলে আসে । নিজেকে বারবার শাসিয়েও অভ‍্যাসটা বদলাতে পারিনি । অথচ এলিজা রেগে গেলে সাঁই সাঁই করে ইংরেজি বলে । প্রমোশনের পর ওকে বলেছিলাম – নিশ্চ‌ই হেড অফিসে গিয়ে বসের সাথে ফস্টিনস্টি করে প্রমোশন বাগিয়ছো । ওর পোশাক আশাক সাজগোজ নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছাড়িনি । ও আমাকে অত্যন্ত ভদ্রভাষায় চাবকেছে । তখন আমি ওর হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে অনেক শব্দ‌ই মিস করে ফেলি । ও চলে যাবার পর বারবার ওর কথাগুলো আমার মাথায় রিভিউ হতে থাকে । আসলে আমি ওর স্মার্টনেসের সামনে নিজেকে কিছুতেই খাড়া রাখতে পারিনা । আমি যতবারই উত্তেজিত হয়ে আক্রমণাত্মক কথা বলেছি ততবারই সে এতো বেশি ঠাণ্ডা জবাব দেয়েছে যে আমি স্রেফ শামুক বনে গেছি । আমি পরবর্তী এ্যকশনের প্রস্তুত হ‌ই । খোলসের ভেতর ঘাপটি মেরে রাগে ফুঁসতে থাকি। এমন নেকেটলি সে আমাকে বহুবার আক্রমণ করেছে ।  ইনডাইরেক্টলি জানিয়ে দিয়েছে আমি তার যোগ্য ন‌ই । এভাবেই বারবার আমার ব‍্যাচেলর ভেনেটিতে আঘাত খেয়ে খেয়ে একসময় আমি মারমুখো হয়ে উঠি ।

যে কোন ফাইল -থ্রো প্রপার চ‍্যানেল যাবে কথাটা বিশেষ করে এলিজাকে জানিয়ে দিই । সরাসরি এলিজাকে বসের টাচে যেন যেতে না হয় তার সব ব‍্যবস্থা করি । ওর ইমিডিয়েট বস ওর কাজের প্রতি হাইলি সেটিসফাইড একথাটা আমার মনমতো হয়না । আমি উইকলি ওর সেকশন ইন্সপেকশন করি । আমার অতি সিনসিয়ারিটিকে এলিজা উপদ্রব মনে করে । ঠোঁটের উপর বাড়তি একটা চাপ রেখে নাকের পেট দুটো ফুলিয়ে রাখে । ফাইল টেনে এটা ওটা জানতে চাইলে স্ট্রেইট কাট জবাব দেয় । সবচে বেশি অসহ্য লাগে ওর ড‍্যামকেয়ার ভাবটা । আমিও ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে থাকি ইনফরমাল কিছু পেলেই ফাঁসিয়ে দেবো ।

লেডি ডাক্তার বদের হাড্ডি  । এতক্ষণ আমি বিড়বিড় করেছি আর সে নিঃশব্দে সব শুনেছে । আমি আৎকে উঠি ওর – ' ঠিকাছে আরেক দিন কথা হবে '। শুনে সে যাবার আগে আমাকে জানিয়ে যায় -আমরা একদিন বেড়াতে যাবো এলিজার ওখানে । আপনি তৈরি থাকবেন কিন্তু ।
এলিজার ওখানে বেড়াতে যাবো আমি  ! লেডি ডাক্তার আমার মনে একটা তুফান ব‌ইয়ে দিয়েছে । এলিজা এখন অনেক দূরে । সে এখন বিগ বসের ডানহাত । বস ওকে ট্রান্সফার করে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন । স‍্যারের দৈনন্দিন কাজের তালিকা এখন এলিজা প্রস্তুত করে । আমার সিনিয়ররাও ওকে কেয়ার করে চলে সালাম ঠুকে ।

আহা নীলসাদা চোখ । আহা সামুদ্রিক চোখের এলিজা । আমার ভেতরে নতুন ঢেউ জাগিয়ে দিয়েছে লেডি ডাক্তার । ভয়ের কিছু নেই লেডি ডাক্তার সব ম‍্যানেজ করবে । পেছনে থাকবো আমি । পেছনে থেকে এলিজার চোখের রঙে রঙিন হবো ।  এখন আমার সবচে কাছের মানুষ লেডি ডাক্তার । তাকে ভেরি ভেরি থ‍্যাংকস ।

এলিজার জন্য বড় একটা ফুলের তোড়া নিয়ে যাবো । হ‍্যঁ নেবোইতো । ওর ফেয়ারওয়েলের দিন আমি ছাড়া সবাই ওকে ফুল দিয়ে বিদায় জানিয়েছে । আমি ওই সময়টাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । মনে আছে একটা ঘুমের ট‍্যাবলেট খেয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । ঘুম ভাঙার পর দেখি সব শেষ । ছুটে বেরিয়ে আসি চেম্বার থেকে । দৌড়াতে থাকি লম্বা করিডোর ধরে । বিশাল হলরুমের মাঝখানে সূতোছেড়া ঘুড্ডির মতো এলোমেলো হয়ে দাঁড়িয়ে যাই । ঘড়ি দেখি রাত আটটা । আলোকিত রাতের নীরবতাকেই প্রশ্ন করি – এলিজা ! এলিজা কোথায় ?  হেকিম আলী পেছন থেকে জানায় – ম‍্যাডাম তো নেই । বিকালেই চলে
 গেছেন । সেই থেকে আর এলিজাকে দেখিনা । এলিজা নেই । অফিস জুড়ে শুধুই অন্ধকার ।

ক্লিনিকের বারান্দায় বসে দাঁড়িয়ে পায়চারি করে কাটছে সময় । কখন আসবে লেডি ডাক্তার । সে আমাকে কথা দিয়েছে – এলিজার কাছে নিয়ে যাবে  । লেডি ডাক্তার কী যেন নাম তার । নামটা ঠিক মনে করতে পারছিনা । জেনে নেবো এখানে সবাই তার নাম জানে । সবাই তাকে ভালোও বলে । হ‍্যঁ ভালো খুব ভালো । আমাকে কখনো অপমান করে না বরং সম্মান করে । নরম মৃদু স্বরে কথা বলে । নামটা… নামটা .. হ‍্যঁ হ‍্যঁ মনে পড়েছে – সুভ্রা । সুন্দর নাম । শুচিসুভ্র । পবিত্র । কিন্তু ওর চোখ আমার মতো সাদাকালো । এলিজার মতো অসাধারন কিছু নয় ।

অবশেষে এলো সেই দিন । সুভ্রা এলো । আমি বিশেষ দিনে পাঞ্জাবী পরি আজো বুকে এ্যমব্রয়ডারি করা নীল পাঞ্জাবী পরেছি । বারবার চিরুনী চালিয়েছি চুলে ।
আমাকে অবাক করে দিয়ে সুভ্রা পরেছে নীল শাড়ি । নীল শাড়িতে সুভ্রিকে খুব মানিয়েছে ।
ড্রাইভিং সিটে সুভ্রা । আমি তার পাশে এলিজার অপেক্ষায় আছি। কখন দেখবো এলিজাকে । কখন তার নীলসাদা চোখে অবগাহন করবো ।
একি ! এ কোথায় নিয়ে এলে আমাকে-সুভ্রার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাই ।
সুভ্রা বলে – আজ যাত্রাবিরতি । আজকের দিনটা এই রিসোর্টেই কাটাবো আমরা ।
সুভ্রার কথামতো অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি গাড়ি থেকে নেমে আসি ।  কী সুন্দর স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ ! ফুলে ফুলে ভরা উদ‍্যান । পাখির কুঁজন । বৃক্ষের পাতায় ঝিরিঝিরি বাতাস । সুভ্রা আমাকে হাত ধরে নিয়ে যায় ঝর্ণার পাশে ।  সুভ্রা আনন্দে নাচছে – ছুটছে – দৌড়াচ্ছে । আমি কংক্রিটের আসনে বসে সুভ্রাকে দেখছি ।
সুভ্রা আমাকে গান গাইতে বলে । গান ! আমিতো গান গাইতে জানিনা । তবে গান শুনতে ভালোবাসি ।
সুভ্রা নাচের তালে তালে গান গায় ।

ফুলে ফুলে ঢ'লে ঢ'লে
বহে কিবা মৃদু বায়
তটিনী হিল্লোল তুলে
কল্লোলে চলিয়া যায়…..

পরের লাইনগুলো আমার মনে পড়ে যায় । সুভ্রার সাথে আমিও গাইতে চেষ্টা করি ।

পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
কুহু কুহু কুহু গায়…

সুভ্রা ছুটে এসে আমার হাত ধরে । আমি ওর সাথে তাল মিলিয়ে নাচতে চেষ্টা করি ।

পরদিন সকালে আমরা এলিজার অফিসে এলম । আমাদের রিসিভ করা হলো প্রটোকল অনুযায়ী । আমরা এলিজার আগমন অপেক্ষায় আছি । ইমার্জেন্সি কাজ সেরে আসছে – এলিজা খবর জানিয়েছে । আমাদের আপ‍্যায়নে কোন ত্রুটি নেই । বেশ কিছু জার্নাল দেয়া হয়েছে টেবিলে । সেগুলোর পাতা উল্টাচ্ছি । এলিজা এলো । বিনয়ের সাথে সালাম জানালো । আমি এলিজার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি । আমার বহু কাঙ্খিত নীলসাদা চোখের সন্ধান করছি কিন্তু কোথায় সে চোখ!

সুভ্রা বলে – আপনারা কথা বলুন আমি পাশের রুমে আছি ।
আমি সুভ্রার হাত চেপে ধরে বলি  – না তুমি থাকো । এলিজার সাথে আমার কথা শেষ ।
সুভ্রা রাজ‍্যের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকায় । আমি দেখতে পাচ্ছি সুভ্রার চোখ নীলসাদা । সামুদ্রিক নীল জমে আছে ওর চোখের রেটিনায় । আর এলিজার চোখ একেবারেই সাধারণ -সাদাকালো ।

লেখক পরিচিতি: গল্প, কবিতা, উপন্যাসসহ সাহিত্যের সব শাখাতেই সমান স্বাচ্ছন্দ্য তাহমিনা রহমান। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, অনলাইন ও লিটলম্যাগে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার লেখা। ইতিমধ্যে তার দুটি গ্রন্থ বেরিয়েছে। এর একটি ছোট গল্পের সংকলন – ‘লাল ফড়িং ও অন‍্যান‍্য গল্প’ এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস -‘জোছনার মোম’। তিনি অর্থনীতিতে মাস্টার্স এবং একই সঙ্গে এল এল . বি সম্পন্ন করেছেন।

ওমেন্স নিউজ/