মফিদা আকববরে গল্প ‘ঘানির বলদ’

মফিদা আকবর

ঘানির বলদ

কোঁচকানো চামড়ার কোটরে ঢুকে যাওয়া সাদাটে ঘোলা চোখ। ক্ষয়িষ্ণু অবশ-অক্ষম শরীর রমজান মিয়ার। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বয়সের চিহ্ন। তাঁর চেনতায় সাংসারিক আয়Ñউন্নতির বিষয়-আশয় অথবা যে কোনো বিষয়ই হোক না কেন সবকিছু ফিকে মনে হয়। মরণের চিন্তাটাও মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাঁর। পেট পুড়ে খেতে ইচ্ছে করে। কারণ, শুকুর আলীর সংসারে তিন বেলার আহার দু’বেলাতেই দাঁড়িয়েছে বেশ ক’ বছর যাবৎ। সকাল বেলা আর দুপুরের শেষ বিকেলে। ক্ষিদে ক্ষিদে ভাবটা শরীরের মধ্যে সব সময়ই থাকেÑ খা খা করে পেটের মধ্যে।
ইচ্ছে করে আবার সেই সোনালী যৌবনের মুখর দিনগুলোতে ফিরে যেতে। একেকটা সোনামুখী দিন সোনা সূর্য ছড়িয়ে দিত তাঁর আর আয়না বিবির জীবনে। এখন অক্ষম চলৎরহিত শরীর নিয়ে অতীতের ভাবনাও বেশিক্ষণ ভাবা যায় না। শরীরের এখানে ওখানে যন্ত্রণা শুরু হয়, বুক ধুকÑপুকায়, শরীর কাঁপে, নিজের ইচ্ছের বাইরে সবকিছুÑ শরীর অসুস্থ হলে সব ভাবনার মাঝে পানি পড়ে শীতল হয়ে ছিন্ন হয়ে যায় সবকিছু। একটানা কোনো ভাবনার মধ্যেও থাকা যায় না।
এমন জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার দরকারটাই বা কি! পৃথিবী এমন কেন? মানুষের পরিণতিই বা এমন কেন? এমনসব ভাবনাও অনেক সময় পেয়ে বসেÑ কিলবিল করে শুকুর আলীর মাথায়। কিশোরী চপল বালিকা দেখলে তাঁর রক্তে এক প্রকার দাপাদাপি আজও শুরু হয়Ñ সে সময় তিনি আয়না বিবিকে কাছে ডাকেন, ফিরে যেতে চান অতীতে। নাহ্- তিনি পারেন না। ঐ দাপাদাপি পর্যন্তই।
ঘরের দাওয়ায় বসে নিজ পুত্র শুকুর আলীর কুকীর্তি দেখেন আর মনে মনে সবকিছুই ভাঙেনÑ চুড়েন। কিছু বলার সাহস নেই পুত্রের বিরুদ্ধে। কারণ আধপেটা হলেও দু’বেলা যে দু’মুঠ আহার দিচ্ছে পুত্রÑ তাও যদি না দেয় অবশেষেÑ এজন্য পুত্রকে কিছুই বলেন না শুধু দেখেন উদাসভাবে। ইচ্ছে করে শুকুর আলীর বিয়ে করা ঘানির বলদগুলোকে ঠ্যাঙিয়ে বিদেয় করেন। আবার ভাবেন, ওদের বা দোষ কি। অভাবের নিরন্তর কুটকুট কামড়ে ঘানির বলদগুলোর বাবা শুকুরের মত পাত্রের কাছে বিয়ে দিয়েছেন। এই বিয়েতে তাদের সুখ বলতে সকালে একটি পোড়া মরিচ অথবা একটি কাঁচা লঙ্কাসহ দু’মুঠ পান্তা খেয়ে আর্সেনিকযুক্ত কলের পানি খাওয়া। যে পানি ঢক ঢক করে গিলে খেলে পেটের মধ্যে গিয়ে পড়ে। এবং বোঝা যায় পেটের থলির শেষপ্রান্তে গিয়ে পড়েছে। আরো কয়েক থালা খাওয়া যেত থাকলে। কিন্তু অভাবের সংসারে কোনদিনই তা জোটে না। অর্ধাহারেই বছরের পর বছর থাকতে হচ্ছে এই সংসারের মানুষগুলোর। আধপেটা খেয়েই কেউ ঘানি টানতে শুরু করে, কেউ ঢেঁকিতে ধান ভানে, কেউবা পাকঘরের পিছনের আমগাছের নিচে বসে গোবর দিয়ে ঘুটে বানিয়ে রোদে দেয়। ওদের ছেলে-মেয়েরা ধুলো-মাটিতে গড়াগড়ি খায়, নাক দিয়ে সর্দি গড়িয়ে পড়লে চেটেপুটে খায়। অর্ধাহারে, অনাহারে থাকা বাচ্চাগুলো মা’র কাছে বার বার খেতে চেয়ে খাবারের পরিবর্তে মা’র হাতে ধুমাধুম পিটুনি খায়। অনাহারক্লিষ্ট পুষ্টিহীন কঙ্কালসার বাচ্চাগুলোকে দেখলে রমজান আলীর মনে হয় পশু-পাখির একপাল বাচ্চা। অযথাই পিল পিল করে তাঁর ধারে-কাছে। হৈÑচৈ ঝগড়াঝাটি। সব মিলিয়ে অসহনীয় গুমোট পরিবেশ। ইচ্ছে করে এখান থেকে পালিয়ে যেতে। এক সময় তিনি আর তাঁর বিবি একটি তুলতুলে শিশুর জন্য রীতিমতো দরগায় দরগায় শিন্নি মানত করেছিলেন। ডাক্তার-কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েছেন। অবশেষে অনেক তদ্বিরের পর শেষ বয়সে শুকুর আলীর জন্মের পর মনে হয়েছিল আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। আর আজ পঙ্গপাল যখন রমজান আলীর চারপাশে থাকে, ঘুরঘুর করে তখন রীতিমতো হাতের লাঠিটা দিয়ে বেদম পেটাতে ইচ্ছে করে। সাত রাজার ধন নাতি-নাতনীগুলোকে আদর করে কাছে ডাকতে ইচ্ছে করে না এখন আর। এদের দেখলেই ভয় করে রমজান মিয়ার। এদের কোলাহল থেকে সর্বদাই তিনি মুক্ত থাকতে চান।
আজকাল রমজান মিয়া ওপারের ডাকের জন্য অপেক্ষা করেনÑমৃত্যুর পরের জীবন বেহেশত-দোযখ নিয়ে নিজের মনেই তিনি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেন। সেসব বিশ্লেষিত সূক্ষ্ম খ- খ- ভাবনার উত্তর যখন মেলে না তখন মসজিদে যেয়ে মৌলভী সাহেবের কাছে অনেক বিষয়াদি জিজ্ঞেস করেন। যে উত্তর তিনি পান তাতে তাঁর বিস্তার লাভ হয় নাÑ ফের প্রশ্নটি করে নিজের মনের জটিলতা দূর করার চেয়ে জটিলতা যে বাড়বে তা তিনি বেশ বুঝতে পারেন। চাল-চুলোহীন রমজান আলীর মনে জানার যে শাখা-প্রশাখা গজিয়ে ওঠে তর তর করে তিনি তা শক্ত হাতে ছেঁটে ফেলেন নিঃশব্দে। কুঁজো হয়ে লাঠি ভর দিয়ে এক পা এক পা করে সাবধানে হেঁটে বের হয়ে আসেন মসজিদ থেকে। তাঁর সমবয়সী পেলে দু’দ- বসেন কোনো গাছের ছায়ায়। সুখ-দুঃখের কথা বলেন। এ এলাকায় তাঁর সমবয়সী তেমন নেই বললেও চলে। তাই কাউকে না পেলে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে রাজ্যের ভাবনা ভাবেন উদাস হয়ে।
আজও রমজান মিয়া ঘরের দাওয়ায় বসে ফোক ফোক করে কেশে দলায় দলায় কাশ থু মেড়ে উঠোনে ফেলছেন। সে কাশির দলাগুলো মুরগির বাচ্চাগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। কাশতে কাশতে হাঁপাচ্ছেন রমজান মিয়া। শরীরটাও অবশ অবশ লাগছে আজ। বুকের মাঝে ধড়ফড় করছে। দু’পয়সার ওষুধ খাওয়ার সামর্থ্য নেই। তিনি আয়না বিবিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বউ, কাশের যন্ত্রণায় তো আর মনে অয় বাঁচতাম না। কি যে করি আমারে একটু বসাকের কড়া পাতা আর আদা একলগে ছেঁইচ্যা রস বানাইয়া শর্তাডা আগুনে পোড়াইয়া রসটা ঝালাইয়া দিবানি। রসের লগে খার নাইলে একটু চিনি থাকলে দিও। খাড় ছাড়া রসটা কেমুন  যেন বিস্বাদ লাগে। তিনি আবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আমি আর বাঁচতাম নারে বউ। মইরা গেলে আমারে মাফ কইরা দিছ। রমজান মিয়ার কথার উত্তরে আয়না বিবি বললেন, আপনের যে কতা, খালি মরণের কতা কইন কিলাইগ্যাÑ মরণ আইলে তো মরতে হইবই। আর হুনেন, আইজকাল বসাকের পাতা কইত্থুন পাইবাম। মড়ার মাইনষের পঙ্গপাল কোনহানে জঙ্গল রাখছে! কাইট্টা সাফ কইরা হালাইছে না।
রমজান মিয়া হতাশকণ্ঠে বললেন, তাইলে আর কি করবাম বউ। আমি যে আর বাঁচি না। কাশতে কাশতে বুকডা বেদনা করে। তোমার শুকুর আলীর মনে কত শান্তি দেখছোনি!
আয়না বিবি কিছুই বলেন না। তিনি শুকুর আলীর চার নম্বর বউ বুলির ঘানি টানার দিকে চেয়ে থাকেন আনমনে। আয়না বিবি পুরুষ মানুষের চোখ দিয়ে ঠাঁয় চেয়ে থাকেন বুলির পানে। বুলির শরীরটা তেল কুচকুচা হলেও ওর শরীর থেকে যেন এক প্রকার আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। উঠোনের এক কোণে তেলের ঘানিটা পাতা। সেই তেলের ঘানিটা নিয়ে অনবরত ঘুরছে বুলি পা পা করে। ঘানির মোটা কাঠের গুঁড়ির মতন জিনিসটা বুলির তলপেটের সাথে লেগে আছে। বুলি এক পা, দু’পা করে এগুচ্ছেÑঘুরছে। ঘানিটা এক প্রকার ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ করছে। অন্যদিন ঘানিটা শব্দ করে না, নতুন বলেই কিনা ঘানিটা আজ অবিরাম ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ করছে। আরেকটি শব্দ বেরোচ্ছে বুলির মুখ থেকে ঘোৎ ঘোৎ করে। মাত্র পনের দিন হল বুলি এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছে। ফিরানি উল্টার দুইদিন পর থেকেই ঘানি টানা শুরু করেছে বুলি। বিশ-বাইশ বছরের যুবা বুলি-ওর শরীরের গড়ন অনেকটা পুরুষালি। এই কয়েকদিনেই সে প্রমাণ করেছে অন্য তিনজনের চেয়ে বেশ ভালোই ঘানি সে টানতে পারে। বুলি যখন ঘানি টানে উঠোনের অদূরে বসে থাকে শুকুর আলী। বসে বসে আয়েশী ভঙ্গিতে হুঁকো টানে। লোভী কুকুরের মতো তখন তার জিহ্বাটা বেরিয়ে ঝুল ঝুল করে। চোখ দুটোও চিক চিক করে। বুলি যখন ঘানি ঘুরায় তখন নল দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল পড়ে নলের নিচে রাখা পাত্রের মধ্যে। তেলগুলোকে তখন ফোঁটা ফোঁটা সোনার মতো মনে হয় শুকুর আলীর কাছে। ইচ্ছে করে এই ঘানি ঘুরানোর মধ্যেই বুলিকে জাপটে ধরে আদর করে। যখন বুলিকে জাপটে ধরার কথা ভাবে তখন নিজেই অনুভব করে তার নিম্নাঙ্গটা লোহার শাবল হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। তার এক পঙ্গপাল ছেলে-মেয়ে আছে যারা কাছেÑ পিঠেই পশু-পাখির বাচ্চার মতো পিল পিল করছে। ওদের কথাও মনে থাকে না তারা ভুলে যায় তখন দুনিয়ার এসব ভেদ-বুদ্ধি। লাজ-শরমেরও বালাই মনে থাকে না। মনে থাকে না আগের তিন বউয়ের চোখ কটমটের কথাও। শুকুর আলীকে নেশায় পেয়ে যায় বুলির দিকে চেয়ে থাকার সময়। বুলি বহুরঙা ডুরে শাড়িটা ব্লাউজ-ছায়াবিহীন এমন করে পঁচিয়েছে ওর শরীরে যে, ওর হাঁটুর নিচে একহাত খালি, ওপরের দিকে ব্লাউজবিহীন স্ফীত শরীর উঁকি মেরে বের হয়ে পড়তে চায়ে এদিক-ওদিক, প্যাঁচানো আঁচল শক্ত করে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। এমন শক্ত করে প্যাঁচানো যে, নিতম্বও স্পষ্ট। বুলি ঘানি ঘুরাতে ঘুরাতে ঘামছে। বার বার হাত উপরের দিকে উঠিয়ে কেচে মুখ থেকে সরাচ্ছে ঘাম। বুলির অজান্তেই তখন ঘোৎ ঘোৎ করে ওর ভেতর থেকে শব্দ বেরোচ্ছে। নাহ্, শুকুর আলী আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। শুকুর আলী বুলিকে বলল, বউ আমারে এক গেলাস পানি দিবানি। শুকুর আলীর এ কথার সাথে বুলির চোখে মুখে এক প্রকার কাঠিন্য ভেসে ওঠে। কিন্তু কোন জবাব দেয় না সে।
এই দু’ সপ্তাহেই বুলি মিনমিনে স্বভাবের শুকুর আলীকে অনেকটা চিনে ফেলেছে। বুলির বিড়ি টানার স্বভাব আছে শুকুর আলী তা জানে। তাই কোমরে গুঁজে রাখা বিড়ি বার করতে করতে শুকুর আলী মিনমিনে গলায় আবার বলে, বউ এক গেলাস পানি নিয়া গরে আও দেহি একপাক। বুলি জানে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য বিড়ির লোভ দেখাচ্ছে শুকুর আলী। ওর যেতে ইচ্ছে করে না। মিনমিনে মানুষকে কখনো পছন্দ করে না বুলি। এদিকে অনেকক্ষণ যাবৎ ঘানি টানতে টানতে একটু দম নিতে যেমন ইচ্ছে করছে তেমন পেটের মধ্যে এক প্রকার চিনচিনে ব্যথাও করছে-তলপেটটাও ভারি ভারি লাগছে ওর। বুলি ঘানিটা থামিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চট দিয়ে বাঁধা আধাখোলা পায়খানায় গিয়ে বসতেই গুড়–ম শব্দ করে পেটটা খালি হয়ে গেল নিমিষে। শরীরটা আবারও ঘেমে উঠল। পায়খানা থেকে বের  হয়ে হাতটা মাটিতে ঘষে ধুয়ে উঠে দাঁড়াতেই একটা ঝিরঝিরে হাওয়া এসে শরীরটা জুড়িয়ে গেল। প্রকৃতির স্নিগ্ধ বাতাসটা বুলির মন থেকে শুকুর আলীর প্রতি কাঠিন্য দূর করে দিল। পাকঘরের পেছনের আম গাছটায় ঠেস দিয়ে বসেছিল একটু সে। শুকুর আলীর কাছে যেতে ইচ্ছে করে না। এক স্বামী চারজনের ভাগ। ঘেন্না লাগে। সংসারটাও নিজের নাÑ স্বামী তো নয়ই। অথচ নিজের করে সংসার, স্বামী, সন্তান কত কিছুই তো ইচ্ছে ছিল ওরÑ  সে মনে মনে বলে, এই দুনিয়া গরিবের নয়। এসব ভাবতে ভাবতেই বুলির মনে হয় গরিবের কি স্বামীÑসংসার নাই ? একবেলা খাইতাম তবুও আমার সংসার-স্বামী আমারই থাকত। উঠে দাঁড়িয়ে কোমর থেকে প্যাঁচানো আঁচলটা খুলে ঝাড়া দিয়ে ধুলোটা ফেলে আঁচলটা আবার টেনে টুনে শরীরে জড়িয়ে দিয়ে পাকঘরে গিয়ে শুকুর আলীর বড় বউ রাহেলাকে বলল, বড় বুজি গেলাসডা কই। তোমার স্বামী পানি চায়। রাহেলা মাটির চুলার ভেতর তুষ ছিটিয়ে দিতে দিতে বলল,
কানা অইছসনি, দেহস না ছিঁকার মধ্যে যে গেলাসডা।
শুকুর আলীর তিন নম্বর বউ কুসুম। সে দেখতেও কুসুমের মতো, গায়ের রং কাঁচা হলুদ সদৃশ। কে বলবে সে তিন সন্তানের মা হয়েছে। বড় দুই সতীনÑএর মধ্যে দু’জনই কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে।
কুসুম দুই কন্যা সন্তান জন্মদানের পর বছরখানেক আগে একটি পুত্র সন্তানেরও জন্ম দিয়েছে। রূপ, গুণ, কাঁচা বয়স, পুত্র সন্তান জন্ম দেয়া সব মিলিয়ে কুসুমের কদর ছিল শুকুর আলীর কাছে এক নম্বরে। শুকুর আলী ফাঁক পেলেই আদুরে বিড়ালের মতো গড় গড় করে একথা সেকথা বলে কুসুমকে সব সময়ই ভিজিয়ে রাখত। শুকুর আলী যখন মিনমিনে গলায় বুলির কাছে পানি চেয়েছিল রান্নাঘর থেকে আড়চোখে তা দেখেছিল কুসুম। সে কটমট করে রাগতচোখে একটু তাকিয়েও ছিল শুকুর আলীর দিকে। কুসুমের চোখের ভাষা বুঝেছে শুকুর আলী। তাই বুলির জন্য বিড়ি বার করতে করতেই ঘরে চলে গেছে সে। কুসুমও তাই আড় চোখে বুলির দিকে তাকিয়ে খোঁচা মেরে বলল,
বুঝলা বড় বু, খসমের লগে দুইফরসুমায় রঙ্গ কইরবো, হেইর লাইগ্যা গেলাস ভইরা পানি লইয়া যাইব।
বুলি কুসুমের কথায় আমল না দিয়ে ছিকা থেকে গ্লাস নিয়ে মাটির তাকের উপর রাখা মাটির কলস থেকে পানি ঢেলে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে দক্ষিণের ঘরে যায়। বুলির প্রতি কুসুমের ঈর্ষাকাতরতা দেখে শুকুর আলীর দুই নম্বর বউ বানেছা কুসুমকে উদ্দেশ্য করে বলল, বুবু বুঝবো কেমনেলো মাগি। বুবু তো দুইফরসুমায় খসমের লগে রঙ্গ করবার সুমায়ও পায় না আর খসমও আহে না তার লগে রঙ্গ করতে। হেয় তো রাইতেও পায় না খসম। দুইফরের সুমায় রঙ্গ করে তর লগেÑ তুই না বুঝস হেই কথা। আমিও বুঝি না। মুখ ভ্যাংচিয়ে বানেছা আবার বলল, এই জানসলো বেডাইনগরে আমার মাইরা হালাইতে ইচ্ছা করে। কতায় কতায় মিছা কতা কয় আর নিজের গতর বাঁচাইয়া চাইর বিয়া কইরা চাইর বউএরে বানাইছে ঘানির বলদ। নতুন বউ লইয়া আমোদ করে আবার বউ দিয়াই ঘানি টানায়। আহাÑ! কত শান্তি। বুঝছো বুজি, আমি একটা কতা ভাবতাছি আইজ কয়দিন ধইরা। তুমি যুদি আমারে একটু সহযোগিতা কর তাইলে কথাডা কইতে পারি।…
রাহেলা আবারও চুলার ভেতর গোবরের তৈরি একটি ঘুটে আর একমুঠ তুষ ছিটিয়ে দিয়ে বলল, মন খুইলা কঅ বানেছা। আমারে বিশ্বাস করলে কঅ।
কইতাছি।
ঈর্ষাকাতর কুসুমের বানেছা আর রাহেলার কথা শোনার সময় নেই। সে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে গেল দক্ষিণের ঘরের দিকে।…
হাসতে হাসতে বানেছা বললো, দেখছোনি, বুজি, কুসুম উইঠ্ঠা গেছে, খসম নতুন বউয়ের লগে কেমুন কইরা রঙ্গ করে হেইডা দেহনের লাইগ্যা। অহন বুঝুক কেমুন লাগে।
 হেই কতা বাদ দেলো ছিনাল। বেডাইনগর কতা বাদ দে। আসল কতা কঅ। ঐগুলান তো জানসই। বানেছা আবার বলল, এতদিন নিজে একলা স্বামী ভোগ করছস বুঝসনাইÑ আমরাও যে দুইজুন আছিÑ স্বামীর ভাগ যে, সাতদিনেও একবার আমরা ভাগ পাই। হেই কতা কোনোদিন চিন্তা করছ নাই। শরমের জ্বালায় তুমি তো কিছু কওই নাই। আমার লগে যেদিন আইছে হেদিন আমি তোমার কতাও বুঝাইয়া কইছি গো বুজি। য্যান্ মাসে একদিন অইলেও তোমার গরে যায়। কইত্থন যাইবো, কুসুমের মন যোগাইয়াই পারে না। অহন বুঝুক কত ধানে কত চাইল। বুলিরে বিয়া করনে আমি খুব খুশি গো বু। বেডাইন অইছে কুত্তার জাত। গু দেখলেই যেমুন কুত্তার জিহ্বা লক লক কইরা বার অইয়া যায়। টস টস কইরা পানি পড়ে হেইরহম। রাহেলা আবার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলেÑ নেÑ নে বাদ দে হই কতা। কুসুম আইয়া পড়বো। আসল কতা আগে কঅ।
 বানেছা বললÑ হঅ তুমি আসল কতাডাই হোন, সোয়ামী দিয়া আর কি অইব। ভাটিয়াপাড়ার আঞ্জুর মার আঞ্জুরে চেনোনি।
হঅ চিনি তো। কি অইছে আঞ্জুর?
না কিছু অয় নাই। তয় আঞ্জুয়ে নাহি গারমেসে চারহি পাইছে। ধানীখোলার জব্বার মাস্টারের পোলা ভোলা মিয়া তাঁর এক বন্ধুরে কইয়া নাহি চারহি নিয়া দিছে। পাঁচশ ট্যাকা মাসিক বেতন আর তিনশ ট্যাকা ওভার টাইম লইয়া আটশ ট্যাকা বেতন। লও, ভোলা ভাইছাবরে কইয়া তোমার দুই মাইয়া রানী আর মনু আর আমি চারহি লই। চারহি লইয়া এইহান থাইক্যা জাইগা ঢাহা।
 ঠিগই কইছস লো। খাড়া বানেছা চিন্তা কইরা দেহি। ঘানি টাইন্যা খাইয়া না খাইয়া, আর চলতে পারি না। রানী, মনু বড় অইতাছে অগরে বিয়া দিতে অইব। তর মাইয়াগুলীনও তো বড় অইতাছে বিয়া দিতে অইবো না? বয়স অইছে না এহন। রাহেলা আর বানেছার কথার মধ্যেই কুসুম এসে বলল, দেহ বুজি ঘানিডা হেই কোন্বালা থেইক্যা পইড়া রইছে। তোমার খসম আর নতুন মাগি দেহগা দিনের বেলায় দরজা বন্ধ কইরা কি করতাছে।
অনেকদিন পর মনের ঝাল মেটানোর একটা সুযোগ পেয়ে বানেছা ফোড়ন কেটে কুসুমকে বলল,
তর অত জ্বলতাছে ক্যান লো।
তুই ও তো দুইফর সুমায় কতই না এমুন করছস আমি আর বুজি রাগ অইনাইক্যা কোনোদিন। হুম্ বলে মুখ ঝামটা মেরে মুখ ঘুরিয়ে নিজের কাজে মনে দেয় কুসুম।
পানি নিয়ে যখন ঘরে এলো বুলি। শুকুর আলী নিজেই গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলো। বললো, আয় কাছে আয়, পানি খাওনের লাইগ্যা তো তরে ডাহি নাই। নে বিড়িডা খা। তুই অইছস আমার সোনা বউ-লক্ষ্মী, শুকুর আলী বুলির দিকে বিড়িটা বাড়িয়ে ধরে। আনমনা বুলি বিড়িটা নেয় কিন্তু শুকুর আলীর মিনমিনে ভেজানো নরম কথাগুলোকে খসখসে মনে হয়। শুকুর আলী ওর শরীরে হাত দিলে জৈবিক ক্ষুধায় ওর শরীরও তিরতির করে ওঠে, কিন্তু মুহূর্তেই মনটা বিষয়েও ওঠে। এই একটা লোক চাইরটা মেয়ে মানুষকে কেমুন ভোগ করতাছে। তার চালচুলো ধন-সম্পত্তি কিছু নাইকা। কেবল একটাই সম্পত্তি। প্রাকৃতিক ও ঐশ্বরিকভাবে পাওয়া একটি পুরুষাঙ্গ। যখনই বুলি ভাবে এই পুরুষের বিশেষ একটা অঙ্গ তখন নিজের শরীরের দিকে তাকায়। নিজের শরীরে নিজেই হাত বুলায়। আমারও তো কিছু অঙ্গ আছেÑ গরিব অইতে পারি কিন্তু এই প্রাকৃতিক সম্পত্তি তো আমারও আছে। বিয়ের পর থেকেই এই ভাবনাগুলো পেয়ে বসেছে বুলির মাথায়। বুলি আনমনা হয়ে এসব ভাবতে ভাবতে যখন বিড়িতে টান দেয়। খিড়কি দিয়ে চেয়ে থাকো বাইরে, ধোঁয়া ছাড়েÑ মনের মধ্যে পুষে রাখা আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে। তখন শুকুর আলীর অনেক কথাই কানে যায় নাÑ নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পড়ে থাকেÑ শুকুর আলীর উঠানামার ভালোবাসায় সে নির্জীব বস্তুর মতো। শুকুর আলী তেল চিটচিটে বালিশে আর তক্তপোষের উপর শুইয়ে দিয়ে আদরে আদরে অন্য জগতে গিয়ে সুখের খনিতে ডোবাতে চায় বুলিকে। ডোবে না বুলি, ভেজে না বুলি। পুরুষালি গড়নের বুলি তখন বিলি কাটে বেরিয়ে আসতে শুকুর আলীর আঁশহীন বুননহীন ভাঙ্গা স্বপ্নের খাঁচা থেকে। এই কয়দিনে বুলির একটা বিশ্বাস জন্মেছে যে, স্বপ্নহীন খাঁচায় মানুষ কেনÑ পাখিও বাঁচতে পারে না। অতৃপ্ত ক্ষুধা নিয়েই শুকুর আলীর কবল থেকে বেরিয়ে এসে শাড়ির আঁচল আবার শক্ত করে কেচে ঘানি টানা শুরু করে। ঘানি থেকে আবার ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ হয় এবং ওর নিজের অজান্তে ওর দেহের ভেতর থেকে এক প্রকার শব্দ বেরোতে থাকে ঘোৎ ঘোৎ করে।
রাহেলা আর বানেছা কুসুমের মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে। ওর হলুদমাখা মুখখানায় নিষ্পাপ আর নিষ্প্রাণতার ছায়া স্পষ্ট। মাঝে মাঝে ওর মুখখানায় কালো ছায়াও স্পষ্ট। দু’টো বিষয়ই সমানভাবে খেলা করছে।
ওরা ভেবে পায় না লাশটা সামনে নিয়ে বুক চাপড়ে মাটি চাপড়ে লুটোপুটি করে এমন নিবিড় বিনিয়ে বিনিয়েই কান্না কাঁদছে কেন? রাহেলা আর বানেছা তাদের সন্তানাদি নিয়ে ঢাকা চলে গেলে কুসুম আর বুলিই ছিল শুকুর আলীর সাথে। ইতোমধ্যে রমজান মিয়া আর আয়না বিবিও মারা গেছেন। কিন্তু বুলি শুকুর আলীকে ভালো না বাসলেও শুকুর পেয়েছিল বুলির মাঝে সুখের খনি। ওদিকে কুসুম পেয়েছিল শুকুর আলীর মাঝে নারী জীবনের সার্থকতা।
তাই শুকুর আলী মারা যাওয়াতে কান্নার কথা ছিল বুলির। শুকুর আলীর শেষ অবলম্বন ছিল বুলি। পাড়ার বৌ-ঝিরা কুসুমকে ঘিরে আছে। বুক চাপড়ে, মাটি থাপড়ে আকাশ কাঁপিয়ে নিবিড়, নিখাদ কান্না দেখে কেউ কেউ কান বাঁচিয়ে ফিসফিসিয়ে কিসব বলাবলি করছিলÑ
অবশেষে জানা গেল, শুকুর আলী ঘানি টানার জন্য বলদের বদলে চার বিয়ে করেছিল। তারা ঘানিও টেনেছিলÑ সেই ঘানি টানা সুন্দরী বউ কুসুম শুকুর আলীর প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে কুসুম পই পই করে শুকুর আলীর মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও বুঝতে পারলো তার নাম গন্ধ নেই শুকুর আলী জীবনেÑ সেই পৃথিবীতে শুধুই বুলির অবস্থান।
কুসুম ভুলে যায় জগৎ-সংসারের নিয়মকানুন, ছেলে-মেয়ে পাপ-পুণ্য। কোন এক নিবিড় নিমগ্নতায় শুকুর আলীর নিম্নাঙ্গে চেপে ধরে শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে দর দর করে ঘামতে থাকে কুসুম। শুকুর আলীও বাঁচার জন্য হাতে- পায়ে ধরে কুসুমের। কে শোনে কার কথা! ছটফট করতে করতে নেতিয়ে পড়ে শুকুর আলী।
সেই কুসুমই এমন করে কাঁদছে লোকটার জন্য? যে লোকটা শেষ জীবনে একফোঁটা ভালোবাসেনি কুসুমকে, সুখের স্পর্শ দেয়নি? সেই শুকুর আলী মারা যাওয়াতে কুসুমের বা কি ক্ষতি-বৃদ্ধি হলো? অন্তত রাহেলা, বানেছা বা বুলি তা বোঝে না। একি সত্যিকার কান্না কাঁদছে না কি ভ-ামি করে কান্নার রোল ফেলছে লাশটা সামনে রেখে!… প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভিড় করে সবার মনে। সবার বোবা দৃষ্টির চাইনিই বলে দেয় এসব কথা।

মফিদা আকবর: কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক ও সমালোচক।  লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮৫টি।

ওমেন্স নিউজ/