মাহমুদা আকতারের উপন্যাস ‘স্নানঘর’

মাহমুদা আকতার

স্নানঘর
(নদীরও ছিলো কিছু গোপনীয়তা আর ব্যক্তিগত কথন যা গচ্ছিত ছিলো মোহনার বাঁকে। হায়, সে কথা ফাঁস করেছে নির্লজ্জ সাগর। বেলাভূমির সফেদ বালুতটে প্রতিনিয়ত সেই কেচ্ছা বিলিয়ে চলেছে উত্তাল ঢেউ।)

যেদিন সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাটি ঘটলো সেদিনও সে স্নানঘরেই ছিলো। সে যখন প্ল্যাস্টিকের মোড়াটার ওপর বসে পিঠটা পুরোপুরি বাঁকিয়ে সাবান মাখানো ছোট্ট তোয়ালটা দিয়ে সযতনে পায়ের গোড়ালি ঘষছিলো, তখন তার রান্নাঘরে দাউদাউ করে জ¦লছিলো আগুন। আর সেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছিলো সাবিরের মা ফুলবানু ওরফে গেদি। নীরুর জীবনে স্নানঘরের একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো যখন ঘটেছিলো তখন সে স্নানঘরে ব্যস্ত ছিলো। এমনকি যেদিন সে একবস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে এসেছিলো সেদিনও। আসলে সে সত্যি সত্যিই স্নানঘরে ছিলো না, তবে ওই ছোট্ট ঘরটার সঙ্গে তার ঘর পালানোর পরোক্ষ একটা যোগসূত্র তো ছিলোই। অন্তত বাড়ির লোকদের সে এটা ভাবতে বাধ্য করেছিলো যে-সে এখনও স্নানঘরেই আছে। আর তার স্নান বিলাসিতার কথা কে না জানে! নীরুর ঘর লাগোয়া বাথরুমে তখনও লাইট জ¦লছিলো, ভিতর থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছিলো। সে স্নানঘরের দরজাটা কায়দা করে আটকে রাখার আগে মাথার ওপরের ঝরনার কলটাও পুরো খুলে রেখে এসেছিলো। ফলে বাড়ির লোকেরা ভাবছিলো সে এখনও গোসলই করছে। তারা যখন শূন্য স্নানঘর আবিষ্কার করেছে ততক্ষণে ঢাকাগামী দূরপাল্লার বাসে ওঠে বসেছে নীরু।
এমনকি যেদিন বিকেলে সাবিরের দ্বিতীয় বিয়ের কথা পাকা হয় সেদিনও তো গোসলেই ব্যস্ত ছিলো সে। হতে পারে দীর্ঘসময় নিয়ে স্নান করার কারণেই তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটেছে ঠিক এই সময়ে, তার অগোচরে। অবশ্য অনেকের কাছে এগুলো কাকতালীয় বলে মনে হলে হতেই পারে। তাছাড়া সেইসব ঘটনা এখন আর কোনই গুরুত্ব বহন করে না নীরুর জীবনে। কেননা সে অতীত নিয়ে ভাবে না, সবসময় বসবাস করে বর্তমানে। ভবিষ্যত তার কাছে দূরবর্তী জাহাজের মাস্তুলের মতো, অস্বচ্ছ কিন্তু খানিক ঠাওর করা যায়। আর অতীত বরাবরই ঘন কুয়াশায় মোড়া এক বিকেল, যা নিয়ে কেবল আফসোস করা যায়, কিন্তু প্রতিকার বড়ই অনিশ্চিত।
এই বাড়িতে নীরুর আলাদা কোনও ঘর নেই। সেভাবে দেখতে গেলে ওর কোনও নিজস্বতাই নেই। প্রয়োজনও নেই। ও দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে এই পরিবেশে, এই বারোয়ারি মানুষগুলোর সঙ্গে। একসময় নিজের জন্য একটা কান্নাঘর চেয়েছিলো খুব। অনেক আগে নিজস্ব একটা কান্নাঘরের স্বপ্ন দেখতো, যেখানে খিল লাগিয়ে মনের সুখে কিছুক্ষণ অশ্রুপাত করা যাবে। এমনকি একা একা নিজের সঙ্গে কিছু বোঝাপড়াও সেরে নেয়া যাবে নিভৃতে বসে। কেউ একজন বলেছিলো- 'মেয়ে, তোমাকে আমি কান্নাঘর দেব। তবে কথা দিচ্ছি সে ঘরে যাওয়ার সুযোগ তোমার কখনই হবে না। কারণ, তুমি কাঁদতেই ভুলে যাবে।  তোমার পায়ের কাছে এনে ফেলবো পৃথিবীর যাবতীয় সুখ। তুমি সুখ নিয়ে খেলবে, সুখ গায়ে মেখে ঘুরে বেরাবে, বিরক্ত হলে কিছু সুখ ছুড়েও ফেলতে পার জানালা দিয়ে বাইরে।’ কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অনেক প্রতিশ্রুতির মতো এটাও ভুলে গেছে সাবির। নিরুর নিজেরও কি সেইসব এখন আর মনে আছে ছাই! ভুলে গেছে সেই কবে। কান্না পেলে ও এখন ছুটে যায় পাঁচ ফুট বাই চার ফুটের ছোট্ট ঘরটাতে। যা নিয়ে সাবেরের মা প্রায়ই কথা শোনায় ওকে। -কিলো তর এত আয়না দেহন লাগে ক্যান? রূপ কি বাইয়া বাইয়া পড়তাছে! তার ধারণা বারবার আয়নায় নিজেকে দেখার জন্যই স্নানঘরে ছুটে যায় নীরু। দীর্ঘসময় নিয়ে গোসল করার জন্য একসময় নিজের মা-ও কম কথা শোনাননি ওকে। যদিও সারাদিনের মধ্যে এটুকুই ছিলো তার একমাত্র বিলাসিতা। নইলে রূপচর্চা বা সাজগোজ বলতে যা বোঝায় সেদিকে তো কখনই তেমন আগ্রহ ছিলো না নীরুর। এখন আর সেই বিলাসিতা দেখানোর সুযোগও নেই তার। তবে মুখমণ্ডলের নানা অভিব্যক্তি লুকাতে প্রায়শই স্নানঘরের আশ্রয় নিতে হয় নীরুকে।
সাবিরের মাকে সে কিছুই ডাকে না। অন্য কারো কাছে তার প্রসঙ্গে বলার সময় সে সাবেরের মা কিংবা ফুলবানু বলে। ফুলবানু সাবেরের মায়ের প্রকৃত নাম, তবে বাবার বাড়ির লোকজনের কাছে তিনি শুধুই ‘গেদি’। সাবিরও দুষ্টমি করে তার মাকে মাঝে মাঝে ‘গেদি’ বলে। সাত ভাইয়ের পর এক বোন-তাই বাবা-মা আদর করে এই নাম দিয়েছিলেন একমাত্র মেয়েকে। বিয়ের আগে যখন নীরু সাবিরের সাথে খুব ঢং করতে। তখন সাবির বিয়ের পর তার মাকে ‘মামনি’ ডাকার কথা বলেছিলো। নীরু তখন আরও অনেক স্বপ্নের মতো নিজের প্রেমিকের মাকে নিয়েও নানা স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু বিয়ের পর প্রথম যেদিন এই বাড়িতে পা রেখেছে সেদিনই সে বুঝে গেছে-আর যাই হউক এই নারীকে মামনি ডাকা যায়না। পুত্রবধূর কাছ থেকে এই ধরনের সম্বোধন পাওয়ার জন্য যেই ধরনের স্নেহময়ী বা ময়াময় ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ছিলো সেটি তার নেই। তিনি অনেকটা কর্কশ আর বদরাগী ধরনের মানুষ। অন্তত নীরুর প্রতি যে ধরনের আচরণ তিনি করেন তাতে তাকে এমনটিই মনে হয়। তবে নিজের সন্তানদের সঙ্গে কথা বলার সময় এই মানুষটাই অন্য মানুষ হয়ে যান। তখন তার মুখ দিয়ে মধু ঝরে ঝরে পড়তে থাকে। এমনকি তার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও তাকে নানারকম আহ্লাদ করতে দেখা যায়। অবশ্য শাশুড়ি ছাড়া এবাড়ির অন্য কারোর সঙ্গে যে নীরুর খুব মাখোমাখো সম্পর্ক এমন তো নয়। প্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না সে। ননদ কাজলকে সে নাম ধরেই ডাকে। আর সাবেরর বড় দুই বোনকে সে আপা বলে সম্বোধন করে। শাশুড়ির মতো নিজের স্বামী সাবেরকেও কিছুই ডাকে না সে। বিয়ের তিন বছর পর স্বামীর প্রতি কোনওরকম রাগ, অভিমান, অভিযোগ বা অনুযোগ কোনটাই আর অবশিষ্ট নেই তার। সাবেরের প্রতি অনেকটাই নিষ্পৃহ সে। যদিও একসময় গভীর প্রেম ছিলো এই মানুষটার প্রতি এবং দুই পরিবারের কেউ-ই রাজি ছিলো না বলে তারা বিয়ে করেছিলো একা একা, পালিয়ে গিয়ে। একমাত্র ছেলের বউ হওয়ায় বিয়ের কিছুদিন পরেই নিরুকে পুত্রবধূ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ফুলবানু ওরফে গেদি। কিন্তু তাকে কোনওদিন মন থেকে মেনে নিতে পারেননি তিনি। তখন তিনি প্রায়ই বলতেন-‘আমার একমাত্র পুতেরে মনে করছস কাইরা নিছস তুই। আমি এর শোধ নিমু। একদিন ঠিকই আমি আমার ছেলেরে ফিরিয়া আনমু।’ আর এজন্য খুব বেশি সময়ও নেয়নি ফুলবানু। খুব দ্রুতই বদলে যেতে থাকে সাবের। তাই বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় সে বুঝে গেছে প্রেম আসলে পুরুষ মানুষের সাময়িক মোহ মাত্র এবং এই ঘোর কাটতে তাদের বেশি সময় লাগে না। এক্ষেত্রে সাবেরও ব্যতিক্রম নয়। যে কারণে বিয়ের পর তাকে কলেজে ভতির্ করানো এবং ওর জন্য কান্নাঘর বানিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে আরও অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। এ নিয়ে স্বামীর প্রতি কোনও অভিযোগ নেই নীরুর। এমনকি কখনও আফসোসও করে না সে। কেননা এখন সে জানে এটাই বাস্তবতা। মেয়েদের জীবন এমনই হয়।
এখনও সেইসব দিনগুলোর কথা মনে হলে আফসোস হয় নীরুর। কখনও বা ভাবে-যদি তার আর সাবিরের জীবনে ফুলবানুর কোনও অস্তিত্বই না থাকতো তাহলে তাদের দাম্পত্য জীবনটা অন্যরকম হলে হতেও পারতো। এই বয়স্ক মানুষটা তাদের তো কখনও নিভৃতে আসার সুযোগই দিতে চাইতেন না। অনেক রাত অবধি বসে থাকতেন ছেলের বেডরুমে। যেন প্রিয় পুত্রের সঙ্গে তার কত গুরুত্বপূর্ণ কথা জমে আছে যা সেই রাতের মধ্যেই শেষ না করলে নয়। সাবির তখন বার বার তাড়া দিতো- ‘মা, আপনি গিয়া শুইয়া পড়েন। সকালে কথা কমুনে।’ তারপরও বসে থাকতেন ফুলবানু। কখনও বা খাটের একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। রাগে, দুঃখে, অভিমানে কতদিন ওপাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নীরুও। কিংবা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে থেকেছে কতদিন। নিরূপায় সাবির তখন নীরুকে নানাভাবে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করতো-‘কী করমু কও! মা তো-হেরে তো আর ফেইলা দিতে পারি না।’
সাবেরের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলে কিংবা সিনেমা দেখতে গেলে সঙ্গী হতো তার ননদটি। তাকে জোর করে রেখে যাওয়া মানে তো আরও অশান্তি টেনে আনা। বাড়ি ফেরার পর ফুলবানুর কাছ থেকে যেসব অপমানজনক কথাবার্তা শুনতে হতো তারচেয়ে বরং কাজলকে সাথে নিয়ে যাওয়াই ভালো মনে হতো তার কাছে। সাবির কখনও কখনও ছোট বোনটাকে রেখে যাওয়ার জন্য নানাভাবে প্রলুব্ধ করতো। বলতো- ‘আমাগো লগে গিয়া কি করবি। এই ৫০ টাকা রাখ, মজা খাইস।’
-আমার মজা লাগতো না, আমি যামু। তোমরা মার্কেটে যাওয়ার কথা কইয়া সিনেমা দেখতে যাইবা, না? আর তার শাশুড়ি তখন বলতেন- ‘সাবেইরা, এমন করছ কেন, ছোটমানুষ লগে নিয়া যা। অয় কি তোগো কোলে উইঠ্যা যাইবো?
সেইসব দিনের কথা মনে হলে এখন আর তেমন কষ্ট হয় না নীরুর, কেবল হাসি পায়। আহা, কী বোকাই না ছিলো সেসময় সে! সংসারের কোনও ঘোর প্যাঁচই তার ধারণায় ছিলো না। যে কারণে কোনও রকম অপরাধ না করেও কথা শুনতে হয়েছে। কখনও বা সাবিরের কাছে অনায়াসেই তাকে দোষী সাব্যস্থ করে তুলতে পারতেন ফুলবানু। সেই দোষের জন্য সে যখন স¦ামীর কাছে অপমানিত হচ্ছে, তখন আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাসতে দেখা গেছে ফুলবানু ওরফে গেদিকে।
অবশ্য বিয়ের প্রথম প্রথম মায়ের রূঢ় আচরণের প্রতিবাদ করতো সাবির। কিন্তু সেই আচরণ বদলে যেতে খুব বেশি সময় তো লাগেনি। আর এখন তো উল্টো নীরুর প্রতিই রুষ্ট সে। সাবির তাকে প্রায়ই বলে-‘এতদিনেও মায়ের মনটা জয় করতে পারলা না। এগুলো পরিবার থেকে শিখতে হয়, এমনি এমনি আসে না।’ এসব কথায় আগে রাগ হতো নীরুর। অভিমান করে কতদিন না খেয়ে থেকেছে সে। এখন আর কিছুই হয় না। সে জানে-বউদের অপমান করতে হলে স্বামীরা তাদের পরিবারকেই কথা শোনাবে। সাবিরও ব্যতিক্রম নয়।
ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় সাবিরদের আত্মীয়-স্বজনের কমতি নেই। প্রতি শুক্রবার বাড়িতে মেহমান আসে। ব্যতিক্রম হয়নি আজও। বরং আজ অতিথিদের সংখ্যা আরও বেশি। ওর ননাস অর্থাৎ সাবিরের বড়বোন মুমতাজ আপার ছেলে এসএসসিতে জিপিএফাইভ পেয়েছে। নাতির সাফল্যে উৎফুল্ল সাবিরের মা পার্টির আয়োজন করেছেন। এতে কেবল ওর ননাসরে পরিবার নয়- সাবিরের তিন চাচা ও তাদের ছেলেমেয়েরাও এসেছেন। এই আয়োজনের ঝড়ঝাপটা পুরোটাই গেছে নীরুর ওপর দিয়ে। একই সঙ্গে সাবেরের মায়ের গালিগালাজও শুনতে হয়েছে। ওর কোনও কিছুই তার পছন্দ নয়, সবকিছুতেই দোষ ধরা চাই। কিন্তু বিশেষ দিনগুলোতে তার প্রতি অভিযোগের পরিমাণটা যেন বেড়ে যায়। কেননা এইসব দিনে রেহানা আসে যে তাদের বাড়িতে। রেহানা সাবিরের মেঝ চাচার ছোট মেয়ে। ওর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সাবেরের। কিন্তু সে হঠাৎ করে নীরুকে বিয়ে করে ফেলায় তার মায়ের সেই স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। তাই রেহানাকে দেখলে পুরনো কষ্টটা পুনরায় জেগে ওঠে ফুলবানুর এবং নীরুকে অহেতুক বকাঝকা করতে থাকেন। অবশ্য নীরু তার শাশুড়ির কোনও কথারই প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে নীরবে কাজ করে যায়।
তবে সাবরিকে বয়িে করা নয়িে রেহানার সঙ্গে নীরুর কোনও ঝামেলা হয়নি। নীরুর মতো সাত চড়েও রা না করা টাইপের নারীকে কোনেওদিনই নিজের পথের কাঁটা ভাবে না রেহানা। তাদের দু’জনের সম্পর্ক অতি মাত্রায় স্বাভাবিক। মাঝে মধ্যে দু চারটে নির্ভেজাল রসিকতাও হয় তাদের মধ্যে। কখনও কখনও নীরুকে ঠেস দিয়ে রেহানা বলে-তুমি তো উইড়া আইসা জুইড়া বইছো।
-ইচ্ছা হলে তুমিও আইসা বসতে পার। সাবিরের সংসারে তো আর জায়গার অভাব নাই।
-ইস মনে কোনও ডর নাই না! ইচ্ছে করলে যেই কোনও দিন চইলা আসতে পারি কিন্তু। তোমারে বিয়া করনের আগে আমার লগে তো ইটিস পিটিস কম করে নাই সাবির ভাই। আমারেই তো বিয়া করনের কথা আছিলো তার। যৌতুকের কারণেই তো বিয়া ভাইঙা গেল। আর মাঝখান দিয়া তুমি আইসা গেলা। অবশ্য এতে সাবির ভাইয়েরই সব দোষ আছিলো-এমন না। বিয়াটা ভাঙছে আসলে আমার ফুফুর কারণে। তার তো ম্যালা লোভ!
সাবিরের মায়ের চরিত্র নীরুর চেয়ে ভালো আর কে জানে! ছেলের বিয়েতে কোনও রকম আর্থিক সহযোগিতা আসেনি এটাই তো নীরুর প্রতি বিতৃষ্ণার অন্যতম কারণ। তার বাবার বাড়ি থেকে কিছু নগদ টাকা আর জিনিসপত্র আসলেই তো সাবিরের মা তাদের বিয়েটা সানন্দে মেনে নিতেন। কিন্তু যৌতুক দেয়ার কথা মুখ ফুটে নিজের মাকে কখনই বলার সাহস পায়নি নীরু। কেননা সে জানতো তার মা এতে কখনই রাজি হবেন না। বরং উল্টো মেয়েকে কথা শোনাবেন- ‘সাবিরের মতো ছেলের কাছে যে মেয়ে দিয়েছি এটাই যথেষ্ট, আবার যৌতুক!’ নীরুর এভাবে বাড়ি থেকে একা একা ঢাকায় পালিয়ে এসে বিয়ে করাটা এখও পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি তার বাড়ির লোকজন। তাই স্বামী বা শ^শুরবাড়ি নিয়ে কিছু বলতে উল্টো তাকেই কথা শুনতে হয়। যদিও এখন খুলনায় আসা-যাওয়া স্বাভাবিক হয়ে এসেছে অনেকখানি।
নীরুর বাবার বাড়ি খুলনা শহরে হওয়ায় তারা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। অন্যদিকে সাবিররা ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকায় এক আত্মীয়ের বিয়েতে এসে সাবেরের সঙ্গে পরিচয় নীরুর। বিয়ের ওই পাঁচ/ছয় দিনেই মন দেয়া নেয়া শেষ। ঢাকায় বেড়ানো শেষে খুলনায় নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরও সাবিরকে ভুলতে পারেনি নীরু। দুজনের মধ্যে যোগাযোগ চলতো চিঠি আর মোবাইলের মাধ্যমে। খুব চিঠি লেখার শখ ছিলো নীরুর। সে তখন প্রচুর বাংলা উপন্যাস পড়তো, সিনেমা দেখারও নেশা ছিলো খুব। তখন সাবেরকে ইনিয়ে বিনিয়ে চিঠি লিখতো সে। সেইসব চিঠির ভাঁজে ভাঁজে কত স্বপ্ন, কত আবেগের কথামালা যে গুঁজে দিতো নীরু! আর সাবির নিজেও কি কম স্বপ্ন দেখিয়েছে তাকে। তখন তো তার মনে হচ্ছিলো তার জন্য বুঝি আরেকটা তাজমহল তৈরি করারই প্রস্তুতি নিচ্ছে সাবির। আহা তাজমহল!
সবার দুপুরের খাওয়া শেষ হওয়ার পর রান্নাঘরের বাকি কাজ গুছাতে গুছাতে প্রায় সন্ধ্যা। এরপর অতিথিদের বৈকালিক নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীরু। চুলায় চা বসিয়ে কাজের মেয়ে ফাতেমাকে ময়াদায় ময়ান দিতে বলে ¯œানে যায় সে। তখন ড্রয়িংরুমে বসে অতিথিদের সঙ্গে আড্ডা মারছিলো সাবির ও তার মা। সেদিন কি গোসলে একটু বেশিই সময় নিয়েছিলো নীরু! সে লেবুর টুকরো ঘষে ঘষে দুই আঙুলের নখ থেকে মশলার দাগ উঠানোর চেষ্টা করছিলো। গুণগুণ করে সুর ভাজতে ভাজতে লম্বা মতো মাজুনিটা দিয়ে পিঠ ঘষছিলো সে। নীরু একসময় গান শিখেছিলো। স্কুল-কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত গাইতো সে। এখনও গায়, তবে কেবল ¯œানঘরে।
গোসল সেরে বের হয়ে দেখে অতিথিদের নাস্তার পাট চুকে গেছে। দই, মিষ্টি, বিস্কিট আর চা দিয়েই তাদের বৈকালিক আপ্যায়ন সম্পন্ন করিয়েছেন সাবিরের মা। অতিথিরা সবাই তখন বিদায় নেয়ার আনুষ্ঠানিকতা করছিলো মাত্র। যাওয়ার আগে টুক করে ওর ঘরে ঢুকে পড়ে রেহানা। ‘শোন, তোমার সতীন হওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ। কেবল আনুষ্ঠানিকতা বাকি। ভয় কইরো না, আমি তোমার সংসার ভাঙমু না। যদিও আমার ফুফুর ইচ্ছা ছিলো তোমাদের তালাক দেয়ার। কিন্তুক আমি একজন মেয়ে হইয়া সেইটা করতে চাই নাই। আশা করি, আমার এই অবদান তুমি কোনদিন ভুলবানা।
ওর কথা শুনে নীরু কষ্ট পায়নি, কাঁদেনি। এমনকি তার পরিবারকে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি। কেননা সে জানতো-বাবা-মা জানলেও তার ভাগ্যের তেমন হেরফের হবে না। রেহানা সাবেরের দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ায় তার জীবনযাত্রায় তেমন কোনোও পরিবর্তন হয়নি। এমনকি রেহানা তার ঘরটাও দখলে নেয়ার চেষ্টা করেনি। সে উঠেছে দোতলার বড়সড় নতুন ঘরটায়, যার দুইটা জানালা ও দুইটা দরজা। ব্যালকনি সংলগ্ন ঘরটায় একটা এটাস্ট বাথও রয়েছে। বিয়ের আগে সাবিরদের পুরনো একতলা বাড়িতে যে দোতলা উঠেছে সেটা তো রেহানার বাবার টাকাতেই। সঙ্গতভাবেই বাড়ির সবচেয়ে ভালো ঘরটা তো রেহানারই প্রাপ্য। এ প্রসঙ্গে অন্য সব বিষয়ের মতোই নীরবতা পালন করেছে নীরু। তবে এ নিয়ে সাবেরের মা ও তার শ^াশুড়ি ফুলবানুর অসন্তুষ্টি গোপন থাকেনি। ভাতিজির এমন স্বার্থপরতায় তিনি যে মর্মাহত-তা প্রকাশ্যে দ্বিধাও করেননি। তবে রেহানা তো নীরু নয়! সে তার সর্বক্ষেত্রে নিজের অধিকার বুঝে নিতে পিছ পা হয়নি। নীরুকে যেভাবে নিজের কব্জায় রাখতে সফল হয়েছেন তার শাশুড়ি, দ্বিতীয় পুত্রবধূর ক্ষেত্রে তার সেই টেকনিক কোনই কাজেই আসেনি। সাবির এখন বাড়ি ফিরেই দোতলায়, নতুন বউয়ের ঘরে। স্বামী ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয় রেহানা। তাই ছেলের নতুন বউয়ের ঘরে প্রবেশের কোনও সুযোগই পান না ফুলবানু। তাই বুঝি ভাতিজির ওপর দিনে দিনে তার রাগ বাড়তেই থাকে। এগুলোকে থোড়াই কেয়ার করে রেহানা! নিজের ফুফুর মুখের ওপর ন্যায্য কথা বলতে কখনও পিছ পা হয় না সে। বরং দিনে দিনে বেপরোয়া, আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে থাকে সে। ফলে বিয়ের দিন কয়েকের মধ্যেই রেহেনার সঙ্গে ফুলবানুর দ্বন্দ্ব ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। প্রায়শই রেহানাকে ঠেস দিয়ে এটা সেটা বলতে থাকেন। – নিজের কপালে নিজে আগুন দিছি। খাল কাইট্টা কুম্ভির আনছি!
-খাল কাটতে না জানলে তো এমুনই হইবো।
দুই নারীর দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করে নীরু। তাছাড়া ফুলবানু সঙ্গে রেহানার লড়াইয়ে তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তেমন কোনও পরিববর্তন তো হয়নি। আগেও সে সংসারের যাবতীয় কাজ একা হাতেই করতো। এখনও সে সারাদিন নিজের কাজই করে যায় চুপচাপ। রেহানা তো সংসারের কুটাটাও এদিক থেকে ওদিকে নিতে রাজি নয়। এইসব নিয়ে খুবই বিরক্ত সাবেরের মা। নিজের ভাতিজির সঙ্গে পেড়ে না উঠলে এখন বরং নীরুর কাছেই ছুটে আসেন ফুলবানু। তার কাছেই রেহানার দোষ ত্রুটি বয়ান করে হয়তো বা কিছুটা মানসিক শান্তি পান তিনি। বরাবরের মতোই নিঃশব্দে ঘরের কাজ করতে করতে শাশুড়ির অভিযোগ শোনে নীরু। এ নিয়ে অবশ্য রেহানা তাকে আড়ে ঠাড়ে দু চার কথা শোনাতে ছাড়ে না। -এখন তো দেখি তোমার লগে খুব খাতির! অথচ তোমারে পছন্দ না বইলা সাবিরকে আবার বিয়া করালো। তোমারে তো অপয়া, আটকুঁড়া অপবাদ দিতেও দ্বিধা করেনি! আর তুমি সেসব এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছ! তুমি ক্যামন মানুষ গো!
অবশ্য রেহানার এসব অভিযোগের কোনও উত্তর দেয় না নীরু। নিজের শাশুড়ি কিংবা সতীন রেহানা- কাউকেই কিছু বলে না সে। সে সারাদিন নিঃশব্দে ঘরের যাবতীয় কাজ করে এবং সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সন্ধ্যার দিকে ¯œানঘরে যায় এবং বরাবরের মতোই দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে।
বিয়ের ছয়মাসের মাথায় গর্ভবতী হয় রেহানা। এরপর থেকে বেশিরভাগ সময় সে বাবার বাড়িতেই অবস্থান করতে থাকে। রেহানার ধারণা, এই বাড়িতে থাকলে তার পক্ষে সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করা সম্ভব নয়। কেননা তার বিশ^াস-তার ফুফু ফুলবানু তাবিজ কবজ করে তার অভূমিষ্ট সন্তানকে গর্ভেই নষ্ট করে দিতে পানের। এজন্য সে কোনওরকম রিস্ক নিতে নারাজ। সে ফিসফিস করে নীরুকে বলে- তোমার দুই দুইটা বাচ্চা নষ্ট হইলো ক্যামনে! সে-ই নষ্ট করাইছে। কারণ সে চায় নাই তুমি মা হও। তাইলে তো তোমারে আটকুঁড়া অপবাদ দেয়া সহজ হইতো না। তোমার মা হওয়ার ক্ষমতা নাই এই কথা বইলাই না সে সাবেররে আমার লগে বিয়াতে রাজি করাইছে।
তবে রেহানার এসব যুক্তি কানে তুলেনি নীরু। কারণ সে জানে-একাধিক সন্তানের মা হলেও সাবের রেহানাকে বিয়ে করতো। আর রেহানা না হলে অন্য কোনও মেয়েকে ঘরে তুলতো সে। আর সেক্ষেত্রে তখন অন্য কোনও অজুহাত দাঁড় করাতেও দ্বিধা করতো না সাবের। রেহানা গর্ভবতী হওয়ায় এবং বাড়িতে না থাকায় আজকাল সাবের নীরুর ঘরেই শোয় রাতে। রেহানার এত সুন্দর করে সাজানো ঘরটা তালা দেয়া থাকে। নীরু এখন আর সাবেরকে আগের মতো কাছে টেনে নেয় না। তাই বলে তাকে সেভাবে বাঁধাও দিতে পারে না সে। সঙ্গম করার সময় সাবের ফোঁসফোঁস করে বলে-‘ মাইয়া মানুষের কী সমস্যা কে জানে! প্রেম করার সময় তাদের রূপ রস বাইয়া পড়ে। কিন্তু বিয়ার পর সব শেষ।’
সন্তান প্রসবের দীর্ঘ চার মাস পর স¦ামীর ঘরে ফেরে রেহানা। মা হওয়ায় অহঙ্কার আগের চেয়েও বেশি বেড়েছে তার। ফুলবানু আকার ইঙ্গিতে কথা শোনাতে ছাড়ে না। -মাইয়ার মা হইয়াই এত ফুটানি, পোলা বিয়াইলে জানি কি করতি তুই!
এদিক শ^শুরবাড়িতে প্রথমবারের মতো কদর বেড়েছে নীরুর। অনেকদিন পর সে আবার পোয়াতি হয়েছে। রেহানা তাকে চুপিচুপি বলে-তুমিও আমার মতো বাপেরবাড়ি যাওগা। নইলে আবারও তোমার বাচ্চা পেটেই খাইয়া ফালাইবো আমার শাশুড়ি। যে তুকতাক জানে হে! তার কথা শুনে নীরু হাসে। একজন পার্মানেন্ট ঝি আসায় সংসারের কাজের চাপ এখন কিছুটা কমেছে তার। যদিও রেহানা কিংবা তার শ^াশুড়ি দুজনের একজনও তেমন কাজে হাত লাগাতে চায় না। রেহানার তো বাচ্চার যতœআত্ত্বিতে সময় কাটে। অন্যদিকে ফুলবানু অসুস্থ। বিশেষ করে শীতের সময় তো তিনি খাট থেকেই নামতে চান না। এমনিতেও তার হাঁপানির টান আছে, শীতে যা বেড়ে যায়।
সাত মাসের বাচ্চা পেটে নিয়েই নীরু রান্নাবান্না করে। তাকে সহযোগিতা করার জন্য সম্প্রতি আরেকজন ঝি রেখে দিয়েছে সাবের। তারপরও ফুসরত জোটে কোথায় তার! এরওপর শ^াশুড়ির বুকে পিঠে তেল মালিশ করার কাজ তারই ভাগে। ওজু গোসলের জন্য গরম পানি কর, ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা করো-এসব তো আছেই। আজকাল জীবন কত সহজ হয়ে গেছে। একটা গিজার লাগালে কিন্তু পানি গরম করার ঝামেলাটা হয় না। এখন তো ঘর গরম করার হিটারও চলে এসেছে বাজারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এই বাড়ির সবকিছু আদিম নিয়মে চলবে। গোসল করার পর তার শাশুড়ি কাঁপতে কাঁপতে যাবে রান্নাঘরে, গ্যাসের চুলায় আগুন পোহাতে। এটা তার সেই শৈশবের অভ্যাস। গরম কাপড় গায়ে রেখে শরীর উষ্ণ করার চাইতে আগুন পোহানোই নাকি বেশি আরামদায়ক তার কাছে। আগে আগুন পোহাতো মাটির চুলায়, এখন গ্যাস বার্নারে-এটুকুই যা পার্থক্য! তো সংসারের নানা হাবিজাবি কাজ শেষে গোসলে যেতে এখনও বেলা বয়ে যায় নীরুর। সে স্নানঘরে ঢোকে বিকেলে এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে। গর্ভবতী হওয়ার পর তার স্নানঘরে সময় একটু বেশিই লাগছে। সেখানে বসে সে নিজের গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে কথা বলে। সুখ-দুঃখের কত কথা যে বলে সে! গুনগুন করে পুরনো কোনও গানের সুর ভাজে। আজকাল আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সে। বলাবাহুল্য সেই স্বপ্নের অধিকাংশই গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে। সেইসব স্বপ্ন সে লিখে রাখে একটা ডাইরিতে। আর ডাইরি লেখার কাজটাও সে স্নানঘরে বসেই করে। কেননা এই বাড়িতে নীরুর আলাদা কোনও ঘর নেই। তার কোনও নিজস্বতা নেই। ফলে স্নানঘরই তার একমাত্র স্থান যেখানে তার কিছু একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় গোপনীয় রাখা যায়।

এমনই এক শীতের বিকেলে বরারবরের মতো স্নানঘরে ছিলো নীরু। সে লেবুর টুকরো ঘষে ঘষে হাতের আঙ্গুলগুলো থেকে মশলার দাগ পরিষ্কার করছিলো। সাবান দিয়ে ডলছিলো গোটা শরীর। এসময় সে গলা ছেড়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছিলো, অনেকদিন পর। স্বভাবতই সেদিন তার চান করতে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই সময় লেগেছিলো। গোসল শেষে বাইরে এসে সে দেখে অসংখ্য মানুষ। আর চামড়া পোড়ার বিশ্রী গন্ধ গোটা বাড়ি জুড়ে। এরই মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন তীরের মতো ছুটে আসতে থাকে তার দিকে।
-ও বউ তুমি কই আছিলা, তোমার শাশুড়ির গায়ে যে আগুন লাগছে জানো না? আমরা আইসা আগুন না নিভাইলে তো এতক্ষণে বুড়া মানুষটা পুইড়া ছাই হইয়া যাইতো।
খবর পেয়ে ছুটে এসেছে সাবেরের বড় দুই বোন, মমতাজ আর পারভীন আপা। -বাড়িতে দুই দুইটা জ্যান্ত মানুষ থাকতে এমন ঘটনা ক্যামনে হইলো। আমার মারে তোমরা দুইজনে মিল্লা খুন করছো!
ফুলবানু ওরফে গেদির ঠা-া কমাতে আগুন পোহানোর অভ্যাস তো অনেক দিনের। এ কথা তো তার ছেলে মেয়েদের অজানা নয়। শীতের সময় সে প্রায় দিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রান্নাঘরে গ্যাসের চুলার ওপর দাঁড়িয়ে আগুন পোহান, বেশ কিছু সময় নিয়ে। সেদিনও পরনের শাড়িটা দু হাতে হাঁটু পর্যন্ত উঁচিয়ে আগুন পোহাচ্ছিলেন। পিছন দিকে শাড়ির আঁচলে কখন যে আগুন ধরে গেছে টেরই পাননি। তার গোটা শরীরে আগুন লাগার পর পাশের বাড়ির লোকজন এসে আগুন নিভিয়েছে। ভাগ্যিস সড়র দরজাটা খোলাই ছিলো। দিনে তাদের বাড়ির সড়র দরজা বেশিরভাগ সময় খোলাই থাকে। রেহানা তখন দোতলায় নিজের ঘরে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ফলে সে শাশুড়ির চিৎকার শুনতে পায়নি। আর নীরু ছিলো তার প্রিয় স্নানঘরে। আর কে না জানে গোসলে ঢুকলে নীরুর কোনও দিকে খেয়াল থাকে না।

রাত দশটার দিকে হাসপাতাল থেকে ফুলবানুর মৃত্যুও খবর আসলে কান্নায় ভেঙে পড়ে রেহানাসহ বাড়ির সকলে। কেবল নীরুর চেহারায় শোকের কোনও অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় না। সে সকলের অলক্ষ্যে নিজের প্রিয় স্নানঘরে ঢুকে পড়ে। এক দৃষ্টিতে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় তার হাসি পায়। অনেকদিন পর সে খুব হাসে এবং হাসতেই থাকে। হাসির দমকে তার দুই চোখের কোণে জল জমে। এসময় যুড়পৎ কান্না আর হাসির এক বিচিত্র অনুভূতি খেলা করে নীরুর গোটা  মুখমণ্ডলে। বিস্মত দৃষ্টিতে আয়নার নারীটিকে দেখতে থাকে সে। যেন নিজেকেই নিজে চিনতে পারছে না আজ সে!

 মাহমুদা আকতার: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও অনূবাদক। প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি।

ওমেন্স নিউজ/