শাহনাজ পারভীনের গল্প ‘রুম নম্বর ১০১৩’

শাহনাজ পারভীন

রুম  নম্বর ১০১৩

মানুষের জীবনটা বদলে গেছে অনেকই। বদলে গেছে জীবনের মানচিত্র। বদলে গেছে সকাল বদলে গেছে বিকেলের সূর্য রং। বদলে গেছে অভ্যর্থনার কৌশল। বদলে গেছে আতিথিয়তার ধরণ, বদলে গেছে বিদায়ের ঘনঘটা-ছায়াচিত্র। মামা বাড়ির বিদায় টা এখনো মনে পড়ে জ্বলজ্বল। কতটা পথ হেঁটে আসতো খালামনি!  বড় মাঠ পেরিয়ে খালের দু’ধারে বড় রাস্তায় যতটা পথ দেখা যায় ততটা পথ পিঠের উপর ছুঁয়ে থাকতো নানু আপির চোখ।  যতক্ষণ দেখা যেত সীমানা ততক্ষণ ছুঁয়ে থাকত চোখের কার্নিশ। আর এখন? বারান্দীপাড়ায় তাও তো অন্তত রিকসায় ওঠা পর্যন্ত কাউকে ছুঁয়ে থাকা যেত। ইদানিং বড় বুবুর অবশ্য সিঁড়ির সীমানা দেখা যায় চারতলার দোর গোড়ায়। কিন্তু এইটে তো একেবারেই নতুন যুথির জীবনে। বিদ্যুৎ লিফ্ট এর বিদায় দেয়া। অবশ্য বিদ্যুৎ লিফ্ট এর বিদায় নিয়েছে সে আগে ফুলচাচার ফ্লাট থেকে কিন্তু দেয়া হয়নি কাউকেই। এই-ই প্রথম। অন্য রকম লাগছে। একে বারে অন্য রকম। অবশ্য সকালটাই শুরু হয়েছিল অন্য রকম ভাবে। একে বারেই অন্য আলোয়।

যুথি ও বাড়ির মেজো বউ। সবারই আদরের। থাকা হয় না বাড়িতে স্থায়ী ভাবে। সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়। আজ কক্সবাজার তো কাল মুলাদী তো পরশু বাগেরহাট। বর্তমান ঢাকায়। সমস্ত পোর্ট গুলোর দায়িত্বে আছে ওর হাজব্যান্ড। এখনো বাসা পায় নি, মাত্র জয়েন করেছে। প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ঘরটা নিজেরই সামলাতে হয় বরাবর। বাইরেটা সানিফ যত বোঝে ভেতরটা ঠিক ততটাই আনাড়ি। যুথির অবশ্য এ নিয়ে কোন কালেই কোন আফসোস নেই, থাকার কথাও নয়। ও পারেও বটে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ইকোবানার প্রাকটিসটাও ভাল রপ্ত করেছে। সপিংয়ে ও এক্সিলেন্ট। কিন্তু আজ ওকে ওসব কিছুই করতে হয় নি।

কি একটা হালকা ঘোরের মধ্যে রাতে খুব একটা ভালো ঘুম হয় নি। সকালে ঘুম  ঘুম চোখে  মনটা আঁকুপাকু করছিল। কি করবে, কি গোছাবে, কি রাঁধবে। কিন্তু পুরোপুরি ঘুম ভাঙলেই ওর সব ভুল ভাঙল। ওর মনে পড়ে যায় ও আছে বিয়াম ফাউ-েশনের রুম নং ১০১৩। এখানে ওর কিছুই করার নেই। শুধু মাত্র লাঞ্চ এর ঠিক টাইমে লিফ্ট বেয়ে ন’তলা থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোর পর্যন্ত। ব্যস, ওর আতিথিয়তা শেষ! জীবন হচ্ছে এ রকমই। ওর কাজই বয়ে চলা, যেখানেই যাক আর যেখানেই থাক। ও থামে না কখনো।
এবং আজও ঠিকই বয়ে বয়ে বিদায় পর্যন্ত আসলো।
 ওর প্রিয় বড় জা, মেয়ে-জামাই এসেছিল। নীচে থেকে মেয়ে ফোন দিলে-
– সোনা, লিফ্ট এর আট তলায় চলে আয়। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবি না একদম। এখানকার ট্রেনারদের মত চলে আয়। কেউ যেন কিছু টের না পায়।
ও নিজেই যেখানে গেষ্টের মত লাইফটা লীড করছে সেখানে অন্যদেরকে ও কিভাবে আপ্যায়ন করবে। আর এটাও ঠিক যে তারা আসলে আপ্যায়িত হতে আসেওনি। ওর জা এসেছে যশোর থেকে, কি কি কাজ আছে তার অফিসিয়াল। মেয়ের বাসায় উঠেছে। সেখান থেকে এসেছিল সাহস যোগাতে। পাশে আছে- তা জানাতে। ওর এই ক্রাইসিসে ওর পাশে আছে সেটা জানাতে আসাও তো কম কিছু নয়! ও এখানে আছে আজ ষোল দিন। এ মাসটা পুরোই থাকতে হবে এখানে। বাসা না পাওয়া পর্যন্ত আরো কিছু দিন এখানেই থাকতে হবে। পঁচিশ বাই পনেরোর এই রুমটাতে দুই মেয়ে মানু আর তানুকে নিয়ে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। এইটে পড়–য়া মানু আর সিক্সে পড়া তানুও অন্য একটা থ্রিল অনুভব করছে। ওরা ভিকারুন্নেসা আজিমপুর শাখায় ভর্তি হয়েছে পনেরো দিন আগে। ভাগ্যিস গাড়িও একটা পাওয়া গিয়েছে। বিশাল হাই রাইজ বিল্ডিং এর সামনে থেকে নিয়ে যায়, সময় মত দিয়েও  যায় প্রতিদিন। ওর কোন ভাবনা নেই। ন’তলা থেকে নামতে হয় না তখনো। লিফ্ট এর দোড় গোড়ায় বিদায় দেয় দু মেয়েকে। তারপরই ও ঘর গোছায়। নাস্তা খায়। নাস্তা আর কি? পাউরুটি জেলী আর রাইস কুকারে ডিম সিদ্ধ। ফোলা ফোলা ডুবো তেলে ভাজা লুচি, টক মিষ্টি দিয়ে রান্না করা শুকনো মরিচ ফোঁড়ন দেয়া ছোলার ডাল আর কোথায়? অনেকক্ষণ ধরে ঘন দুধ জ্বাল দেয়া ফ্লেবার ভেসে বেড়ানো চা প্রায় স্বপ্ন। সবই হয় এক রাইস কুকারে। তাও আবার কমপ্লেন দিয়েছে কে। ঘর থেকে নাকি রান্না করার সুবাস ছড়ায় বাতাসে বাতাসে। কি জানি, কি করে কি হয়? ও ভেবে পায় না কিছুই।
 তিন সিটের রুম ভাড়া একশ বিশ। ডবল ড্রেসিং টেবিল। একটা ছোট্ট ফ্রিজ, মাঝারি একটি টিভি, একটা এয়ারকুলার, গিজার মেশিনসহ বিশাল বাথ। তিনটে ড্রয়ারসহ একটা খাবার টেবিল, তিনটে চেয়ার, এক পাশের ওয়াল জোড়া দেয়াল আলমারির এই রুমটাকে ও ভালবেসে ফেলেছে। ও কি ষোল দিন আগের কখনো ভাবতে পারতো মানুষের জীবনটা এভাবে একটা রুমেই বেশ কেটে যায়? এখানে সাতষট্টিটা ফুলের টব নেই, বড় ড্রইং কাম ডাইনিং নেই, নেই বেডরুম সহ ড্রেসিং রুমের কোন আভিজাত্য। তারপরও কত সুন্দর ভাবে চলছে ওর দিনগুলো। একটা মানুষের জীবনে আসলে কত কিই বা লাগে?

ইদানীং ওর লিওটলস্টয় এর সেই বিখ্যাত গল্পটা মনে এসে যায়। একটা মানুষের জীবনে কত কিছু লাগে, কত কিছু?  আসলে লাশটা রাখার জন্য সাড়ে তিনহাত জায়গা ছাড়া আর কিই বা এমন লাগে? তারপরও মানুষ! ছাড়ে না কিছুই, না জায়গা, না জমিন, না আরাম, না আয়েশ! অথচ সব পড়ে থাকে। ভাগ্য ভাল থাকলে কাফনের জন্য কিছু নতুন সাদা কাপড় আর সাড়ে তিন হাত জায়গা! আতর লোবান সুরমা আর ভালবাসার কিছু অশ্রু। বিখ্যাত কেউ হলে মাইকিং কিংবা খবরের কাগজের হেডলাইন, ইলেকট্রিক মিডিয়ায় সম্প্রচারিত হয় কেউ কেউ। তাছাড়া নিজের আমল ছাড়া আর সবই তো পড়ে থাকে। পড়ে থাকে অসংখ্য সার্টিফিকেট, পড়ে থাকে বড় বড় ডিগ্রি, মান সম্মান সব, সবকিছু। যতক্ষণ বেঁচে থাকা ততক্ষণ এই মান-সম্মান, ধন- দৌলত সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে ব্যস্ত থাকার কি আপ্রাণ চেষ্টা! কখন আবার এই সম্মানটা নষ্ট হয়!

কথা ছিল বাসা না পাওয়া পর্যন্ত ওর বড় জায়ের বড় মেয়ের বাসায় থাকবে। কিন্তু বাসা থেকে মেয়েদের স্কুল অনেক দূরে হওয়ায় এবং সানিফের হঠাৎ এক মাসের জন্য বেনাপোল  পোর্টের চার্জ পড়ায় শেষ পর্যন্ত সে আইডিয়াটা নষ্ট হলো।  তখনই সিদ্ধান্ত হলো বাসা না পর্যন্ত ওরা এই রুমটাতেই স্থায়ীভাবে থাকবে।

প্রথম দুএকদিন খুব অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু এখন সব মানিয়ে নিয়েছে। ও নিজেই রান্না করে। এক রাইসকুকারেই সব রান্না করা যায়। চা, কফি থেকে চিকেন বিরানী সব। তবে প্রয়োজনে মাঝে মাঝে সিডিউল টাইমে নীচের ডাইনিংয়েও যায়।  ঝাল পিয়াজ মসলা সবই থরে থরে সাজানো আছে ড্রয়ারে। আলু সবজি মাংস ডাল সবই আছে। চাল আছে তিন রকম, গোসত, ডিম, ফলমুল, টাকা, গয়না  কোন কিছুরই অভাব নেই। সকাল দশটার পরে যখন সবাই কাজে যায় ঐ ফাকে ও রান্না করে। কোন ফ্লেবারও কেউ পায় না। ক্লিনার আসার আগেই সব রান্না হয়ে যায়। ক্লিনারকে অবশ্য ও ম্যানেজ করে ফেলেছে। চিরাচরিত বাজারের প্যাকেটের ধরণটা বদলে ফেলেছে নিখুঁতভাবেই। এই একটামাত্র ঘর, অথচ এখানে সবই আছে চোখের আড়ালে। কেউ হঠাৎ এসে কিছুই টের পাবে না। কি নেই এখানে। কিন্তু প্রথম রাতে দেওয়ালের ‘বিয়াম হোষ্টেলে আপনার অবস্থানকালীন সময়ে আবাসিক রুমে আপনার মূল্যবান দ্রব্যাদি সাবধানে রাখুন। প্রয়োজনে আপনার টাকা, গয়না ইত্যাদি মূল্যবান দ্রব্যাদি অভ্যর্থনা কক্ষে জমা রাখতে পারেন। নিজ দায়িত্বে আবাসিক কক্ষে আপনার কোন মূল্যবান জিনিষ হারালে কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।’ – ‘বিয়াম কর্তৃপক্ষ’ লেখা পোষ্টার দেখে ও ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। সময়ই মানুষকে শান্ত¡না দেয়, সাহস দেয়। যুথীকেও দিয়েছে। কি নিখুঁতভাবে ও সব ম্যানেজ করে। ও নিজেই অবাক হয়ে যায়।

প্রথম দিনে  নামাজের জন্যও কিবলা খুঁজে পাচ্ছিল না। কোন দিকে কিবলা। বিশাল বিল্ডিং এর কোন দিক থেকেই সূর্যের আলো দেখতে পাচ্ছিল না। কিভাবে দিক নির্ণয় করতে হয় তা ওর জানা ছিল না। ও বুঝতেও পারে নি। হঠাৎই ওর চোখ দেওয়ালে আটকে যায়Ñ‘কবনষধ ভড়ৎ ঢ়ৎধুবৎ’ কেবলার দিকে মুখ করে লেখা  বড় পোষ্টার দেখে ও আর একবার অনুভব করে মহান আল্লাহ ওর সব চাওয়ার উত্তর রেডি রেখেছেন। শুধু খুঁজতে হবে। শুধু অনুসন্ধান করতে হবে। সেদিনের কথা বিশেষ ভাবে মনে পড়ে। খেতে গিয়েছে নিচের ডাইনিং-এ। এত ভিড়, এত হুল্লোড়। ওকে খুব নার্ভাস লাগছিল। একেবারে ঘরোয়া পোশাকে, ঘরের মেজাজে ওখানে মানাচ্ছিল না। মনে মনে খুঁজছিল একটু নির্জন, নিরিবিলি। একটু অনুসন্ধানী চোখে হাত ধোবার বাহানায় চোখ খুঁজছিল অন্যকিছু। ভেতরের রুমে দরজা ঠেললেই ওখানেও বড় হরফে দেয়ালের পোষ্টারে চোখ আটকে যায়Ñ শুধুমাত্র উপ সচিব বা তদুর্ধ কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ ডাইনিং সংরক্ষিত’ ব্যস, আর যায় কোথায়- চক্ষু হরিণী দুটো সরাসরি মেয়েদের সমান্তরালে ধাবিত হলেই ওরাও চলে আসে ওর পিছু পিছু এই নির্জন, নিভৃত পরিচ্ছন্ন ডাইনিং টেবিলে। আহা! আনন্দ! আকাশে বাতাসে ভাসে-আহা আনন্দ!

লিফ্ট এর দরজা খুলে যেতেই বড় মেয়ের টিচার সোহেলের বাড়ানো মুখ। ম্যাম, আস্সালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম আসসালাম।  যাও ভেতরে।
যুথি  ভাবে ওকে ঠিক করতে কত কষ্ট হয়েছে। সানিফ তো একদমই রাজি ছিল না।
-না, কোন দরকার নেই। তোমরা খুলনার বাসায় থাকো। এখানে পড়াশুনার যা মান করনেশানেও তার চেয়ে কম কিছু নয়। ওখানেও তো ওর রোল পচাত্তর জনে পচাত্তর। তাহলে আর এখানে এত কম্পিটিশানের দরকারটা কি?
-ওরা কিন্তু বাগেরহাটে ঠিকই প্রথম পাঁচজনের একজন ছিল। মাত্র তো কর্নেশানে ভর্তি হয়েছিল প্রথম পরীক্ষায়ই কি রোল সরানো ওত সোজা কথা?
– কমও কিছু নয়। পারলে প্রথম পরীক্ষায়ই বাজি মাত হয়। মনে নেই রবিউলের কথা?  ওর বাপ তো চাষা ছিল। ও আসলো, আর ওর জায়গা ও করে নিল।
– তুমি রাখো ঐ তোমার  মফস্বলের ছোট স্কুলের কথা, কিংবা গেয়ো রবিউলের কথা? এখনকার পরিবেশ আর তখনকার কথা তুমি এক করলে? আসলে আমারই ভুল। কেন যে তোমার সাথে আমি এই নিয়ে তর্কে যাই। কোথায় আগর তলা আর কোথায় চকিরতলা। ধুর ছাই… তোমার সাথে কথা বলাও যা কলা গাছের সাথেও বলা তা।
-যুক্তিতে না পারলে তো  তখন এসব ফালতু উপমার অবতারনা কর সেতো আমার জানাই…টাকা তো আয় কর না। বোঝ না, খরচ করতে গেলে আয় করার কষ্টটাও বোঝা উচিৎ।
– কেন বুঝবো, আমাকে তো আয় করার দায়িত্ব দেয়া হয়নি, আমাকে পরিচালনার দায়িত্বটা দেয়া হয়েছে। ব্যস, আমিই বুঝব, কোন স্কুলে আমার মেয়ে পড়বে আর কোন স্কুলে পড়বে না। আয় করার দায়িত্ব তোমার।
 – তোমারও বোঝা উচিৎ, এত বছর চাকরি করছি, এখনো কোন বাড়ি হল না, গাড়ি হলো না!
 – সেটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। করতে চাও। এখনি হয়ে যাবে। ব্যাংক ব্যালান্স তো কম নেই। করছো না কেন? ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার ভয়েই তো কিছু কর না। টাকা জমিয়ে কোন লাভ নেই। বরং মেয়ে দুটো সুন্দর করে মানুষ করতে পারলে ঐ রকম কত গুন ব্যাংক ব্যালান্স মেয়েরাই করবে। দেখে নিও। ওরা যেখানে ভর্তি হয়েছে তার ডানে বামে সামনে ঢাকা ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ, বুয়েট। এর মধ্যে ঠিকই এক জায়গায় ওদের জায়গা করে নেবে। আমরা তো ওদের সেই পরিবেশ দেবার চেষ্টা করছি। ওরাও বুঝবে বিষয়টা। ওদেরও একটা দায়বদ্ধতা আছে আমাদের প্রতি পরিবারে প্রতি সমাজের প্রতি। সর্বোপরি রাষ্ট্রের প্রতি।
– রাখো তোমার গাল ভরা কথা। যদি প্রতিদিন দেখলেই ওখানে সবাই ভর্তি হতে পারতো তো গ্রাম থেকে আসা একটি ছেলেও ওখানে ভর্তি হতে পারতো না। শুধু মাত্র ঢাকা শহরের স্টুডেন্টেই ওসব জায়গা ভরে যেত। তাও তো জায়গা হতো না, জানো তুমি পরিসংখ্যান? ঢাকা শহরের কত পার্সেন্ট স্টুডেন্ট এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে আর কত পার্সেন্ট গ্রাম থেকে এসে চান্স পায়? এখন ঢাকা শহরেই কতটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে আর কত হাজার হাজার ছেলে মেয়ে এই রাজধানী শহর থেকে পাশ করে?
-আমার অত অত পরিসংখ্যানের প্রয়োজন নেই। আমি জানি, মেয়েরা এখানে ভর্তি হয়েছে ব্যস, এখানেই পড়বে। তুমি যাও বেনাপোল। কিংবা, এরপর যেখানে পোষ্টিং হয় সেখানে। আমি থাকছি মেয়েদেরকে নিয়ে ঢাকায়।
-তুমি কি জানো, একটা ছেলেমেয়ে বড় হয়ে উঠবার জন্য সমভাবে তার বাবা এবং মা উভয়েরই প্রয়োজন।
আহা জানব না কেন? তুমি তো আছোই। সপ্তাহে আসবে। তাছাড়া ওদেরই বা অত সময় কোথায় যে বাবা মাকে ওরা সময় দিবে? বেচারাদের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। স্কুল, কোচিং, টিচার, হোমওয়ার্ক। রেস্টের জন্যও ওরা পর্যাপ্ত সময় পায় না।
সানিফ আর কথা বাড়ায় নি। ও জানে ও পারবে না যুথির যুক্তির কাছে। তাছাড়া ওর পোষ্টিং তো ঢাকায়ই। শুধু দুটো টাকার জন্য ওদেরকে খুলনায় ফেলে রাখার কোন মানেই হয় না। কিন্তু ও আবার যখন খুলনার জীবন যাত্রার মান এবং ঢাকার জীবন যাত্রার মানের তুলনামূলক আলোচনায় যায় তখনই আবার মনটা পিছিয়ে আসে। ও যে কম চেষ্টা করেছে তাও নয়। বড় ভাই, বড় বোন সবাইকে দিয়েই ওকে বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ভাই বোন ভাবী সবাই ই তো যুথির দলে। ও আর একা কি করবে?
এবার বেনাপোল যাওয়ার সময় ওর অ্যাটিচিউডও ভাল ছিল না। যাচ্ছি আর আসব না। থাকো, একা একাই থাকো। দেখ, কেমন লাগে? অবশ্য আমি থেকেই বা কি আর না থেকেই বা কি? আমার তো আর কোন প্রয়োজনই নেই তোমার?
-তা হবে কেন? যে দুইদিন তুমি থাকো সে দুইদিন তো মেয়েদের স্কুলও বন্ধ থাকে। ঘরও তো একটাই, না কি? এরমধ্যে প্রয়োজন অপ্রয়োজনের কথা আসে কেন? ঠিক আছে, তোমার জন্য সবই ঠিক আছে। সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমি যখনই তোমাকে ফোন দেই তখনই তোমার ফোন ব্যস্ত। বিষয়টা কি? এত বিজি কেন?
-ওমা, থাকবে না, বিদেশ বিভুয়ে একা একা থাকি। মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই তো আর মরে যায় নি। তারা তো সবাই বেঁচে আছে, না কি?
-রাখো ওসব কথা, সব বুঝি আমি। আমাকে নতুন করে বোঝাতে হবে না কিছুই।
-কী বোঝ তুমি? কী বুঝেছো বলো শুনি। সব ছেলেগুলো একই রকম। কি পার তুমি? বাসা থেকে কিছু জামা কাপড় পাঠাতে বলেছি। পাঠিয়েছো ছয়টা ওড়না, দুটো পাজামা। তো কোন জামা লাগে না? আমি কি শুধু পায়জামা আর ওড়না পড়ে থাকবো? রাবিশ! এইটুকু যে বোঝেনা, কাজের কাজ বোঝেনা । সবই আলমারিতে সাজানো আছে। শুধু বাজে হিন্টস আর বলার বেলায় ওস্তাদ। যাও তুমি।
-ঠিক আছে যাচ্ছি আর আসব না।

কিন্তু যুথি জানে, এটা ওর মনের কথা নয়। কারণ প্রথম যেদিন ওকে দেখেছে সেদিন থেকেই তো ওকে চেনে। মুখে বলে অনেক কিছুই কাজে কিচ্ছু না। ওর প্রথম দেখাটাও আসলে অন্যরকম ছিল। ওর মামার বাসায় সবাই গেলাম। ওরাও আসল। আরো অনেকে এসেছিল। ঠিক মেজাজী কনে দেখা যাকে বলে সেরকম কিছু না। তবে চমক ছিল এই যে, সাধারণত ছেলে পক্ষ যায় কনের বাড়ি কিংবা কনের আত্মীয় বাড়ি। কিন্তু যুথিরা গিয়েছিল ছেলের মামাবাড়ি। আগে থেকেই যুথির বড় দুলাভাইয়ের মামার সাথে একটু আধটু চেনা ছিল । সেখানে বিকেলে ঘরোয়া পরিবেশে যুথি যাকে ভেবেছিল পরে বিয়ের দিন দেখা গেল সে নয়। সে ছেলে পক্ষের কাছের একজন। কিচ্ছু তো আর করার থাকে না তখন। সারাজীবন মেনেই চলতে হয়। এইজন্য যে কোন ক্রাইসীসেই যুথি ভাবে শুরুটাই যখন এরকম একটা ক্রাইসীস দিয়ে শুরু হয়েছে আর সেটা মেনে নিয়েছি অবলীলায় এখন আর কি বা করবার আছে?

শেষ পর্যন্ত বাড়তি টাকা না দেয়ার কথা উঠলেও যুথি ভয় পায় নি। কারণ ওর শেয়ার ব্যবসার মাধ্যমে বেশ কিছু জমানো টাকা আছে প্রয়োজনে সেখান থেকে খরচ করবে। সত্যিই সানিফ যুথির চেক বইয়ের একটা পাতা রেখে গেছে। তা দেখে ও অবাক হয় কিন্তু ভয় পায় না। জয়ী তাকে হতেই হবে। কোনভাবেই হেরে গেলে চলবে না। ভাগ্যিস নিজের কিছু জমানো টাকা ছিল। যুথি যেন অকালে কুল পায়। অনেক যুদ্ধের পর শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই সানিফ  জামাইয়ের সহায়তা নিয়েই মেয়েদের জন্য টিচার ঠিক করেছে। প্রথম যে ছেলেটাকে ঠিক করা হল তার সাথে ওর বনিবনা হলোই না। সে বলল:
-তোমাকে তো দেখে আমি ভাবলাম তুমি বোধ হয় ক্লাস ফাইবে পড়। সঙ্গে সঙ্গে ও বলল
-আমিও ভেবেছিলাম আপনি এইটে পড়েন। ওমা, পড়ে শুনি আপনি অনার্স ফাইনাল ইয়ারে।
এই দিয়ে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত ও যদি বলে স্যার আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ পড়ব আর ও বলবে- না, আজ এইম ইন লাইফ পড়।
-কিন্তু ওটা তো আমার পড়া নয়।
– প্রত্যেক স্টুডেন্টরই আগে এইটা পড়া উচিৎ।
-ব্যস, ঐদিনই পড়ানো শেষ তার।
তারপর এই ছেলেটা। বেশ ভদ্র, ভালো পড়ায় আর মার্জিত। টিচারদের আসলে বোঝা উচিৎ স্টুডেন্টদের মেজাজ  মর্জি আর স্টুডেন্টদেরও বোঝা উচিৎ টিচারদের মান সম্মান এর দিকটা।
-আম্মু ভেতরে আসো। চাচীআম্মারা তো চলে গেছে অনেক আগেই। তুমি একা দাঁড়িয়ে কি ভাবছো সেইথেকে।

ও তাই তো, মেয়ের কথায় যুথি সম্বিত ফিলে পায়। ও রুমে ফিরে আসে । কিন্তু ওর খুব টায়ার্ড লাগছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। কিন্তু এই একটা ঘরে ও কি করে ঘুমাবে? টিচার পড়াবে ওকে। ওপাশে তানু ওর হোম ওয়ার্ক করছে। ওর টিচারও আসবে এই টিচার যাবার সাথেই সাথেই।
 ওর মনে পড়ে খুলনার বাসার কথা। দুপুরের পরেই এসি ছেড়ে দিয়ে কি আয়েশের ঘুম। বাকিটা কাজের মেয়েটাই দেখে। কলিং বেল, টেলিফোন টিচার সব… সব।
মুহুর্তে ও আনমনা হয়ে যায়।  এরই মধ্যে ফোনটা বেজে যায় ক্রমাগত। সানিফের ফোন।  সেই যে গিয়েছে ও একবারও ফোন দেইনি। কি ব্যাপার, রাগ কি তাহলে পড়লো সাহেবের? মনে মনে সাত সতেরো ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করেও -আমি কাল সকালের ফ্লাইটে আসছি।
-হঠাৎ?  অফিসিয়াল  ডেতে।

-হ্যাঁ, তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য। একটা কাজ ক্রিয়েট করেছি। বুঝেছো? আমি নাকি কিচ্ছু বুঝি না। কই থ্যাংকস দাও। বলো থ্যাংকস।
-ওকে, থ্যাংকস। রাখি, আম্মুরা পড়ছে টিচারের কাছে। ওর ভেতরের জমানো বরফগুলো গলতে শুরু করে। সব ঠিক হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত
তারপর আবার সব ঠিক। ওর মনটা অন্য এক আলোয় ভরে যায়। ও আস্তে করে যেয়ে তানুর টেবিলে বসে। তানুও  সতর্কে ছবি আঁকার হিজিবিজি খাতাটা  সরিয়ে রেখে হোম ওয়ার্কের খাতাটা সামনে টেনে নেয়।

শাহনাজ  পারভীন: কবি, লেখক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, অধ্যক্ষ, তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ, যশোর।

ওমেন্স নিউজ/