সুলাইমান মাহমুদ রাসেলের প্রবন্ধ কুরবানির মাহাত্ম্য ত্যাগ ও তাকওয়া

সুলাইমান মাহমুদ রাসেল

কুরবানি মাহাত্ম্য ত্যাগ ও তাকওয়া

আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান আর মানুষ নাফারমান। আল্লাহ তায়ালার সিফাত বান্দাকে মাফ করা আর বান্দার স্বভাব বেশি বেশি গুনাহ করা। বিপরীতমুখী অবস্থানের জন্যই বান্দা সুখী হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কও থাকে না।

ইলেকট্রনিক ডিভাইস মোবাইল থেকে যখন অন্য ডিভাইসে তথ্য আদান-প্রদান করা হয় তখন মাধ্যম হিসেবে ব্লুটুথের ব্যবহার অনিবার্য। কিন্তু যে কোন একটি ডিভাইসের ব্লুটুথ অচল থাকলে কস্মিনকালেও কোন তথ্য বা অডিও-ভিডিও আসা যাওয়া করবে না। একইভাবে আল্লাহ তায়ালার সাথে বান্দার সম্পর্কও গড়ে উঠবে না যতখন পর্যন্ত তাঁর কলব স্বচ্ছ না থাকবে। আল্লাহ তায়ালা মহাপবিত্র। তাঁর কুদরত রহমত বরকত ও অলৌকিক নাজ-নিয়ামত ভোগ করতে চাইলে তাঁর আদেশ-নিষেধ হুকুম আহকাম আবশ্যিকভাবে মানতে হবে। সঙ্গতকারণেই বান্দার কলবকে পবিত্র করতে হবে। তা না হলে কোনো মহব্বতই সৃষ্টি হবে না,  কোনো মেসেজও অনুধাবন করা সহজ হবে না। কলবকে পবিত্র করার যে সকল পদ্ধতি  দ্বীনের মধ্যে  প্রচলিত আছে তার মধ্যে অন্যতম নামায, রোযা, ইসলাহ বা আত্মশুদ্ধি, কুরবানি করা, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, আল্লাহ তায়ালার পথে দাওয়াত (নবীওয়ালা কাজ) প্রভৃতি।

শাশ্বত জীবনব্যবস্থা ইসলামের সৌন্দর্য যে কোন মানুষকে সহজেই বিমোহিত করে। কলুষিত কলবকে পরিষ্কার করা অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া ঈমান মজুবত হবে না, আমলও পরিশুদ্ধ হবে না। পরকালীন জীবনে শান্তি ও সুখের চিরস্থায়ী ঠিকানা জান্নাত লাভের জন্য একটি পবিত্র অন্তর যেমন দরকার তেমনি দরকার তাকওয়া। আত্মসংশোধনের বড় একটি সুযোগ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার বান্দাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন। আর তাই একটি বছরে দুটি ঈদের হুকুম রেখেছেন তোহফা স্বরূপ। এ ঈদ মুসলমানদের জন্য আনন্দ ও অগ্নিপরীক্ষাও বটে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা বান্দার অন্তর পরীক্ষারও সময়। ঈমানদার ব্যক্তি কখনোই আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে থাকতে পারে না।

ঈদুল আযহার তাত্ত্বিক ব্যাখা ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। সেদিকে ধাবিত হব না। স্বল্প কথায় মৌলিক দিকগুলো তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র। ঈদুল আযহাকে সামগ্রিকভাবে মুমিন মুসলমান কুরবানি হিসেবেই জানে। মুসলিম জাতির জাতীয় জীবনে কুরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। কুরবানির ইসলামি পরিভাষা বৃহত্তর অর্থে ব্যবহৃত। স্বাভাবিক চিন্তা থেকে শব্দটির মর্মার্থ অনুধাবন করলে আত্মত্যাগেরই ইঙ্গিত দেয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের রাজিখুশি, একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্ট অর্জনের জন্য পবিত্র ঈদুল আযহার দিনে হালাল পশু জবেহ করে পরিশুদ্ধ আত্মার পরিচয় দেয়াই মুসলমানের কাজ। তাও যার সামর্থ্য আছে তার জন্যই প্রযোজ্য। কুরবানি  অর্থ পশু জবাই করে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করা নয় বরং কুরবানি হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন অতিবাহিত করে আল্লাহ তায়ালার রাহে বা রাস্তায় নিজের জান মাল বিলিয়ে দেয়া। কুরবানি মানেই পশু জবাই নয়, কুরবানি আল্লাহ তায়ালার জন্য নিজের সবকিছু নির্দ্বিধায় উৎসর্গ করা।

আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার ত্যাগ ও মুহাব্বতের পরিচয় নেয়ার জন্যই মুসলিম উম্মাহ জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর প্রিয় পুত্রকে নিজ হাতে জবাই করার হুকুম দিলেন। নবী ইবরাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় পুত্র, প্রিয় ধন হযরত ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছুরি দ্বারা জবাই করতে গেলে আল্লাহ তায়ালার হুকুমে কুদরতিভাবে পশু কুরবানি হয়ে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর ‘সাহিবে নিসাব বা শরিয়া মোতাবেক পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদের মালিক’ কে জিলহজ্ব মাসে হালাল পশু জবাই করে শরীয়া অনুযায়ী বন্টন করে দিতে হয়। ইসলামি হুকুমত এবং ফিকহি মাসায়েলের পর্যালোচনায় যাব না। বর্তমান সমাজে প্রচলিত অনিয়ম ও রিয়াকে সংক্ষেপে তুলে ধরার প্রচেষ্টা।

কুরবানির মৌসুমে কুরবানির প্রকৃত মাহাত্ম্য কতটুকু খুঁজে পাই— সমাজপতি ধনকুবের বা সাহিবে নিসাবের মধ্যে? কুরবানির মত স্বচ্ছ ও সুন্দর একটি বণ্টন অন্য কোথাও কি আছে? দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, সমাজের অধিকাংশ লোক কিন্তু লোকদেখানো কুরবানি করে। ফ্রিজভর্তি গোস্ত জমা করে তা দিয়ে কেউ পিকনিক করে, কেউ বিয়ের অনুষ্ঠান করে ইত্যাদি। অনেকেই সঠিকভাবে বন্টন করে না। এটা কি কুরবানি হয়? আবার পশু ছোট বড় নিয়ে বড়ত্ব করে, গোস্ত জমা করে রাখে। অথচ আত্মীয় স্বজনরা, প্রতিবেশী হকদারদেরকে তাদের প্রাপ্য জিনিসটুকুও পৌঁছে দেয়া হয় না। ইয়াতিম মিসকিন সারাবছর কত কষ্টে কাটায়, ভালো মন্দ খেতে পারে না। একটা দিন তাদেরকে অকৃপণ হাতে বিলিয়ে দিতে কি অসুবিধা!  তারা এই সমাজের তাদের ওপরও দায় আছে দায়িত্বশীলদের। এই বিবেচনা না করে মুখে শুধু কুরবানি কুরবানি করলে হবে না। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্ট অর্জনের মুখ্য বিষয়— আল্লাহর ভয়, তাকওয়া অর্জন। আর সেটিই যদি না হয় তবে কুরবানি কি হয়!

আল্লাহ তায়ালার রহমত ও পরকালে নাজাত পেতে সহিহ তরিকায় কুরবানি করুন। কুরবানির হক আদায় করুন। পরিবার পরিজন প্রতিবেশির হক আদায় করুন। আল্লাহ তায়ালা নিজেই কুরআনুল হাকীমে ঘোষণা করেছেন যে, পশুর রক্ত জমিনে পরার আগেই কুরবানির কবুল হয়ে যায়—যদি নিয়ত থাকে পাক্কা, আর দিল থাকে পরিষ্কার। পশুর শরীরের পশমের চেয়েও বেশি সওয়াব আল্লাহ তায়ালা দিবেন। তিনি আরও বলেন, পশুর রক্ত নয় আল্লাহ তায়ালার কাছে পৌঁছায় বান্দার তাকওয়া। তাই আসুন, মাছলা-মাছায়েল জেনে হক আদায় করে কুরবানি করি। ঈদুল আযহা পালন করি। সমাজে সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করি।

লেখক পরিচিত: বরিশালের কবি সুলাইমান মাহমুদ রাসেল ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ ও গদ্যসাহিত্য রচনায় স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশসহ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে আটটি যৌথকাব্য। মুজিব মানে বাংলাদেশ, হে পিতা, বিনীত প্রকৃতি, মিষ্টি প্রেমের কাব্য, স্বাধীনতার আত্মকথা প্রভৃতি। উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে; করছেন শিক্ষকতা। কবিতা ও প্রবন্ধে বিশেষ অবদান রাখায় পেয়েছেন— আবুল মনসুর আহমদ প্রবন্ধ পুরস্কার (২০২১), শ্রেষ্ঠ লেখক পুরস্কার  ঝালকাঠি জেলা (২০২০), জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার প্রবন্ধ পুরস্কার (৫ বার), বঙ্গবন্ধু শিশু একাডেমি প্রবন্ধ পুরস্কার (২০১১) এবং বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার।

ওমেন্স নিউজ/