শুভ জন্মদিন গীতিকবি সাবির আহমেদ চৌধুরী

গীতিকবি সাবির আহমেদ চৌধুরী

মোঃ জাকির হোসেন

আজ ১৫ জুলাই, মানবতাবাদী গীতিকবি সাবির আহমেদ চৌধুরীর নিরানব্বইতম জন্মদিন। প্রায় শতবর্ষী এই গীতিকবি তার যাপিত দীর্ঘ জীবনে সাহিত্যচর্চা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্ন মানবসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।

সাবির আহমেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯২৪ সালের ১৫ জুলাই (১৩৩১ সালের ৩১ আষাঢ়) নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার (বর্তমনে বেলাব) হাড়িসাংগান গ্রামে। পিতা হানীফ মোহাম্মদ ও মাতা আছিয়া খাতুন। দীর্ঘজীবনে তিনি লেখালেখির পাশাপাশি অনেক মানবসেবামুলক এবং সমাজ সেবার কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে দেশের ভেতর থেকে অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছেন।

গীতিকবি হিসেবে বিভাগোত্তর বৃহত্তর বাংলায় সাবির আহমেদ চৌধুরী এক সুপরিচিত নাম। সে সময় তার জাত-বর্ণবাদহীন কবিতা ও মানবতাবাদী গানগুলো অনেকের কাছেই সুপরিচিত ও সুপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ গানগুলো সে সময়ের অনেকের কাছে সুরারোপিত হয়ে লোকজ শিল্পীদের কণ্ঠে প্রচার হতে থাকে। এভাবেই কবি বৃহত্তর বাংলায় পরিচিত হয়ে ওঠেন।

হাড়িসাংগান গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার প্রথম পাঠ শুরু হয়। এরপর নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে তিনি ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে সাব ও ওভারশিয়ার ডিগ্রি লাভ করেন এবং দেশবিভাগের পর স্কুলটি কলেজে রূপান্তরিত হলে ওই কলেজ থেকেই ১৯৪৮ সালে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা কোর্স সফলভাবে শেষ করেন। তারপর তিনি একই সালে সিএন্ডবি বিভাগে উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৫৪ সালে চাকরি ত্যাগ করে ‘সাবির আহমেদ এন্ড কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর দেশের বিভিন্ন বড় বড় নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি বিয়ে করেন মেহেরুন্নেসা চৌধুরীকে যিনি হাসান রাজার পুত্র হাসিনুর রাজা চৌধুরীর কন্যা। নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজ করতে করতে তিনি দেশের সে সময়ের বড় বড় পত্রিকাগুলোর সাথেও সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এভাবেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে দেশের বরেণ্য কবি ও গুনী ব্যক্তিত্বের সাথে।

বর্ষীয়ান গীতিকবি ও সাহিত্যিক সাবির আহমেদ চৌধুরীর সাহিত্য জীবনের চেয়েও যেন তার সমাজসেবামুলক কার্যাবলীর জীবন অনেক বড় হয়ে ওঠেছে। হাবিবল্লাহ বাহার কলেজ প্রতিষ্ঠায় বাহার মেমোরিয়াল কমিটির তিনি অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে তিনি কিছু আর্থিক সাহায্যও দিয়েছিলেন। ঢাকায় নজরুল সঙ্গীত চর্চার জন্য নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠা হয় তার অর্থানুকুল্যে। তিনি একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে। আজো তিনি এ একাডেমীর আজীবন সদস্য। তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ-এর প্রতিষ্ঠা-পর্ব থেকে জড়িত ছিলেন এখনো তিনি এ প্রতিষ্ঠানটির আজীবন সদস্য। তিনি গীতিকবি সাহিত্য সংসদের আজীবন সদস্য, কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিসের পৃষ্ঠপোষক, লালন পরিষদ কেন্দ্রীয় সংসদের উপদেষ্টা, বাংলাদেশ লেখক সমিতির উপদেষ্টা, ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্রের উপদেষ্টাসহ আরো অনেক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত এবং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কাজ করেছেন।

সাবির আহমেদ চৌধুরী জলসিঁড়ি নামে একটি পত্রিকা বের করেন। এ পত্রিকায় সে সময় অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, মোফাখ্খারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, নয়ীম গহর, জাহানারা আরজু, আবদুস সাত্তার, কাজী রোজীসহ সে সময়ের প্রতিনিধিত্বকারী অনেক লেখক লিখতেন। ঢাকায় যখন মুকুল ফৌজ গঠন হয় তখন তিনি এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি হিসেবে যুক্ত হন। কবি বেগম সুফিয়া কামালের সাঁঝের মায়া বাড়ির নকশা এবং প্রথমতলা নির্মাণ হয় কবি সাবিরের সহযোগিতায়। আবদল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত কণ্ঠস্বর, কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত খেলাঘর, চট্টগ্রামের বেগম মুশতারী শফি সম্পাদিত বান্ধবী, শশাঙ্ক পাল কর্তৃক সম্পাদিত শ্রাবস্তি পত্রিকাসহ অনেক পত্রিকায় তার অবদান অনস্বীকার্য।
একজন মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ সবসময়ই সমাজের মহৎ চিন্তা করে থাকেন। তিনিও সারা জীবন গান কবিতাচর্চাসহ নানান মানবিক ও সেবামূলক কাজের সাথে ব্যাপৃত রয়েছেন। নিশ্চয়েই গুণী এই শিল্পীর আসামান্য সাহিত্যকর্ম ও সমাজসেবামূলক কাজ আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ ছাড়াও তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

আজ এই মানবতাবাদী ও গীতিকবির ৯৯তম জন্মদিনে তার প্রতি রইলো আমাদের প্রাণঢালা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী।

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/