এই বর্ষা -সেই বর্ষাঃ বদলে গিয়েছে পৃথিবীর ঋতু

সুলতানা রিজিয়া

সুলতানা রিজিয়া

আষাঢ় শ্রাবণ দুইমাস নিয়েই বর্ষাকাল। বাংলার দ্বিতীয় ঋতু। বর্ষাকাল মানেই মেঘ বৃষ্টি, কাদামাটি, উজান জলের ঢল, জলজ পরিবেশ, চারপাশে সবুজ সতেজ বনবনানী, ঝোপঝাড়, নদী নালায় জলের স্রোত, ডোবা পুকুরের পাশে ব্যাঙের সমবেত গান ( চিৎকার ), শাপলা শালুক, ঢোলকলমির বাথানের দোদুলদোল, এখানে সেখানে প্রকৃতির বুকধোয়া জঞ্জালের স্তুপ। স্কুলের পথে বৃষ্টিতে ভিজলে কিম্বা স্কুলের মাঠে জল জমলে ছুটি, শিশু কিশোরদের জলের বুকে দাপাদাপি,বাড়িতে মা’দের হাতে রান্না খিচুড়ি, বেগুন ও ইলিশ ভাজা, নয়তো অন্যরকম এক ব্যতিক্রমি রেসেপি। বাড়িতে বাড়িতে ভাইবোনদের আড্ডা, গালগপ্প, গান বাজনা, গল্পের বই, কবিতার মোহ! আরো কত্ত কি। পাড়াপ্রতিবেশীদের কারো কারো বৈঠকখানায় বা টানা বারান্দায় মা’দের মিলনমেলা। হাসি ঠাট্টার সাথে চা,পান – সুপারি। বাবা, চাচা ও জ্যাঠাদের (বড় চাচা ) সাংসারিক আলাপ- আলোচনা, আয় ব্যয়ের হিসাব, আত্মীয়দের খোঁজ খবর, আগামীর পরিকল্পনায় স্বস্তির সাথে পেরিয়ে যেতো পুরো বর্ষাকাল।

বর্ষাকালের দীর্ঘ অবসবে ঘরে ঘরে নকশিকাঁথার আলাপন জমে উঠতো, ক্রুশকাঁটা, সেলাই মেশিনের কাজে সময় বয়ে যেতো। মাঠে জল, ঘাটে জল, বাজার হাটেও জল। তাই বাইরে তেমন জমতোনা বন্ধুদের চায়ের আড্ডা, তরুণ-কিশোরদের জটলা। তখন লুডু, ক্যারাম, দাবা, তাসের চাহিদা বেড়ে যেতো। ইষ্টিকুটুম, বিবাহিত মেয়ে জামাইয়ের কদরও। নদীর বুকে রঙবাহারি পালের নাওয়ের আদিক্য চোখে পড়তো। নাইওরীদের হাসি মুখে স্বাগত জানাতে ঘাটে ঘাটে মা, চাচী, ফুপু বোনেরা ভিড় জমাতেন। রসুইঘরের খুসবুতেই বর্ষার মহিমা বাঙালিকে জানান দিতো।

আশপাশে বেজে উঠতো কলেরগান বা রেডিওতে দারুণ সব গান-

‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে নাতো মন
ঝর ঝর ঝর ধারা ঝরছে
তোমাকে আমার মনে পড়ছে।’

আমরাও সেই বর্ষায় প্রাণখুলে হল্লা করেছি –

‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধন দিবো মেপে-
কচুর পাতায় করমচা,
যা বৃষ্টি উড়ে যা।’

‘টিনের চালে গাছে ডালে
বৃষ্টি ঝরে তালে তালে।’

ঘরে ঘরে চুপি চুপি দল বেঁধে নেচেছি-
‘নাচ ময়ূরী নাচেরে
রুমঝুমা ঝুম নাচেরে
ঐ এলো আকাশ ছেয়ে
বর্ষা রানী সাজেরে।’

আষাঢ় শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির মায়াবী শীতল পরশে ঘরে ঘরে পারিবারিক পরিবেশে পারস্পরিক সম্পর্কে কত গীত, গীতিকবিতা, পালাগান, জারি সারিগানের সৃষ্টি হয়েছে তার কোন সঠিক হিসাব বা হদিস কারো জানা নেই।

কালে কালে আমাদের সেই মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তদের আয়েশী বর্ষা আজ অন্তর্হিত। সেই পুকুর, নদী, নালা, মাঠ ঘাট, খাল, বিলের চিহ্নটুকুও খুঁজে পাইনা। দেখিনা ব্যাঙ, ব্যাঙাচি, মাছের পোনাদের, শাপলা শালুকের জটলা। মেঘ ডাকলে, বিদ্যুৎ চমকালে আজকাল কেউ দৌঁড়ে গিয়ে ধাতবপাত্র ( কাঁসা, পাতল, লোহা ) বালতি, বদনা, ঘটি তুলতে যায়না। তখনকার মানুষ বিপুল অভিজ্ঞতায় জ্ঞানী ছিলো। ঐ সব ধাতবে বৈদ্যুতিকস্পর্শে বজ্রপাতের ক্ষয় ক্ষতির খতিয়ান তাদের জ্ঞানেও ছিলো। বন্যা, দুর্যোগময় পরিস্থিতির মুকাবিলা করার মনোবলও তাদের ছিলো। বন্যার্তদের আশ্রয় দেওয়া, সমবেতভাবে শ্রম দেওয়া সাথে যার যেটুকু সাধ্য সেসকল সামগ্রী অকৃপণভাবে দেওয়া রেওয়াজ ছিলো।
দশে মিলি করি কাজ
হারি জিতি নাহি লাজ-
এ আর্দশেই তখনকার মানুষ বলীয়ান ছিলো।

এখন অর্থবিত্তের মলিকরা নিজ নিজ অট্টালিকা, একাধিক ফ্লাট, গাড়ি বাড়ি, ব্যবসা বানিজ্য, সম্পদ সম্পত্তি নিয়ে আত্মমগ্নে আচ্ছান্ন। কিসে কতভাগ লাভ এবং কোন কোন পথে এই লাভ আসবে তারই সন্ধিসলুকে ব্যস্ত থাকে। টাকা আনা পাই’এর হিসাব বর্তমানে শতক, হাজার, লক্ষের কোঠা ছাড়িয়ে কোটির অংকে পৌঁছেছে। এই টাকার মালিকের সংখ্যাও বিস্মযকর। ফলে শ্রেণি বিভাজনের সেই পুরাতন শ্রেনী বিভাজনের সংখ্যার বিলুপ্তি ঘটেছে।

একইসাথে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছয়ঋতুতে দেখা  দিয়েছে পরিবর্তন। কাগজে কলমে ছয়ঋতুর নাম লিখা থাকলেও বর্তমানে প্রাকৃতিক বৈরিতায় সাকুল্যে চারঋতুই বিরাজমান। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের দুই মাস গ্রীষ্মকালের দুর্দমনীয় ঝড় ঝঞ্ঝা, সূর্যের প্রখরতায় উত্তপ্ত বাতাসে প্রকৃতি হয়ে উঠে অসহনীয়। আষাঢ়ের মেঘ বাদলের ঘনঘটায় শুরু হয় বর্ষাকাল। শ্রাবণের অঝর বর্ষণে দেশীয় নদ নদী, জলাশয়, পুকুর ডাবা উপচে পড়ে। বর্ষাঋতু পুরো দুইমাসের কোটা পেরিয়ে ভাদ্রমাস তথা ৩/৪ মাস অবধি এই বাংলায় দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে থাকে। বর্ষাকাল প্রলয়ঙ্করী ঋতুর অবয়বে আবির্ভূত হয়। অকাল বন্যার সাথে উজানের নেমে আসা জলের আগ্রাসী স্রোতে ভেসে যায় দেশের হাজারো জনপদ, ক্ষেতের ফসল, খামারের গৃহস্থালি পশু, বন্যপ্রাণী, মুখ থুবড়ে পাড়ে গ্রামের অসংখ্য বসতবাড়ি। আসবাবপত্রের সাথে রসুইঘরের আনাজপাতিসহ স্থাবর অস্থাবর সম্পদ বানের স্রোতে হারিয়ে যায়। জনমানুষ বাঁচার প্রয়োজনে স্থানান্তরিত জীবনকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। শুরু হয় তাদের অভাবের সাথে লড়াই, রোগবালাইয়ের বাড়বাড়ন্তে শারীরিক কষ্ট ও আর্থিক অনটন। যারা দিনান্তের শ্রমিক তাদের শূণ্যহাতে সোজা পথে দাঁড়াতে হয়। কাজ নেই, আয় নেই, মাথার ছায়া নেই এর সাথে যুক্তহয় পরনির্ভরতার গ্লানি। শ্রমিকদের পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষগুলো চরম দুর্ভোগের সন্মুখীন হয়। সরকারী বেসরকারী দাতা, স্বেচ্ছাসেবীদের সকল দানই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতির তুলোনায় অপ্রতুল এবং তাৎক্ষণিক। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ বাঁচার তাগিদে শহরমুখি হতে বাধ্য হয়। ক্ষুধা, দারিদ্র, অনিশ্চিত জীবনের কারণে অসৎ ফাঁদে ধাবিত হয়। শুরু হয় তাদের অতল পাপের কারবার। ছিনতাই থেকে খুন, জালিয়াতি, রাহাজানিসহ নানান অপকর্মে ভরা দয়ামায়া বিবর্জিত সহিংস্র জীবন।

বারোমাসে তেরো পার্বণের সেই বাংলাদেশের জলহাওয়া, প্রাকৃতিক ভূমি আজ আর নেই। রূপসী বাংলার পলল বুকে এখন আধুনিকায়নের কঠিন পোড়ামাটি, সিমেন্ট, বালুর মিশেল লোহালক্করে পলেস্তারার আস্তরণ। রুক্ষ শুষ্কতায় বাংলার পুরোটাই আজ লাবণ্যহীন, বেদরদী, নিষ্ঠুরতার কালশিটে শ্রীহীন। শহরের সকল জৌলুশও বর্ষার জলে মিয়ম্রাণ হয়ে যায়। পথেঘাটে যানজটে, জলাবদ্ধতায়  শহরবাসীরা জীবনের স্বাভাবিকতা হারায়। কমবেশি সকলেই এই বর্ষার ছোবলে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন। পন্যসামগ্রির স্বাভাবিক সরবরাহে প্রতিবন্ধকতার অজুহাতে বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। তখন মানুষের ক্রয়সীমায় টান পড়ে, বাজেটের ছক এলোমেলো হয়ে যায়। শুরু হয় ধার কর্যের ( ঋণ ) লেনদেন, জীবনের মান নিম্নমুখীতে বাড়ে হুতাশন, আক্ষেপ।

আমাদের মতো প্রবীণদের মনে এখনকার বর্ষার এমন নির্মম রূপ দর্শনে বেদনার আঁধার নামে, ভাবনায় বর্তমান প্রজন্মের জন্য আফসোসের দীর্ঘশ্বাস জাগে। কোনও ভাবেই তারা মিলাতে পারেন না অতীতের নির্মল পরিবেশের সুখোস্মৃতির আনন্দের সাথে আজকের বর্ষার এমন করুণদশা, নাঙ্গা ভুখার পরিস্থিতি। আজ থেকে অর্দ্ধশত বছর পূর্বের আমাদের যুগটা ছিলো আধুনিকায়নের সন্ধিকাল। বিদ্যুত, ট্যাপকল, যানবাহন, সাজসরঞ্জাম, শিক্ষাদীক্ষার প্রসার, শিল্পসাহিত্যের কালজয়ী সৃষ্টির কাহন, রেডিও- টিভির বিনোদনের সুযোগ, টেলিফোন, প্রেস -মিডিয়া সবদিক দিয়েই অবিস্মরনীয়। প্রাচ্যপাশ্চাত্যের মিশেল আধুনিক জীবনে ছিলো স্বস্তিকর।

আমার কল্পনা ছিলো স্বচ্ছ, স্বপ্ন ছিলো বাস্তবমুখী, যাত্রা ছিলো শেকড় ছাড়িয়ে। আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার করার প্রতিজ্ঞায় ভাষার জন্য লড়াই থেকে স্বাধীনতার পতাকার দাবিদার। আমাদের লক্ষ্য ছিলো দিগন্তবিস্তৃত, আমাদের প্রজ্ঞা ছিলো ধীশক্তিসম্পন্ন, আমাদের বাঙালিয়ানা ছিলো শেকড়ের প্রতিচ্ছায়া, আমাদের প্রত্যাশা ছিলো দৃঢ়চেতা নেতার নেতৃত্বের, আমাদের জীবনপণ প্রতিজ্ঞা ছিলো মুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম এক রাষ্ট্র জয়ের।

আমরাই আমাদের সকল লক্ষ্য, স্বপ্ন, সাধ, প্রত্যাশা, এবং প্রতিজ্ঞা পূরণের মর্যাদা পেয়েছি। আমরা বিজয়ী, আমরাই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে পারি ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের দাবিদার আমরা, আমাদের ভাই, পিতা, সন্তান সহ আমরা,  আমাদের মা’ বোন, কন্যারা আপন আপন রক্তদানে, সম্ভ্রম খুইয়ে অর্জন করেছি এই দেশের স্বাধীনতা। আমাদের এই দেশ- বাংলাদেশ! প্রবীণদের চোখে বাংলাদেশ জন্মদাত্রী জননীসম, বুকের ক্ষতে প্রতি নিশ্বাসে জেগে ওঠে স্বজন হারানো কষ্ট।

সত্যের তুমি যতোই করো হেলা
মিথ্যাই মুছে যাবে ডুবলে বেলা।
ইতিহাসের পাতায় শতাব্দীপূর্ব কোন মিথ্যাই শক্তিমত্তায়  টিকে থাকেনি। ইতিহাস বড়ই নির্মম এবং স্বচ্ছ এক আয়না।

রচনাকাল: ১৪ জুলাই, ২০২২

লেখক সুলতানা রিজিয়া লেখাটি পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট থেকে।

সুলতানা রিজিয়া: কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও প্রকাশক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘নন্দিনী’নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করছেন। এছাড়া তার রয়েছে প্রকাশনা হাউস সম্রাজ্ঞী। তার প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থ ৩১ টি। সাহিত্য ও সাংগঠনিক অবদানের জন্য পেয়েছেন ত্রিশটির বেশি সম্মাননা পদক।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/