স্কুলের একই ক্লাসের শিক্ষার্থী যখন মা ও ছেলে

দুই সন্তানের মা পার্বতী সুনারের বয়স ২৭ বছর। আর এই বয়সে এসেও লেখাপড়া শেখার আগ্রহ মরে যায়নি তার। ভর্তি হয়েছেন এলাকারই এক হাইস্কুলে। তার ১১ বছর বয়সী ছেলে আর তিনি ওই স্কুলের একই ক্লাসের শিক্ষার্থী। এ নিয়ে কোনও রকম হীনমন্যতায় ভুগছেন না এই প্রাপ্তবয়স্কা শিক্ষার্থী। অন্যদিকে পার্বতীকে দেখে উৎসাহ পাচ্ছেন গ্রামের অন্যসব নারীরাও।

পার্বতী লেখাপড়ার ইতি টেনেছিলেন ক্লাস সেভেনে পড়তে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে। নিজের চেয়ে ৭ বছরের বড় প্রেমিকের সঙ্গে ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন। এরপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। বিয়েশাদি করে সংসার শুরু করেন। তার প্রথম সন্তানের জন্ম ১৬ বছর বয়সে। কয়েক বছর পর দ্বিতীয় সন্তানের মা হন। আর এভাবে পুরোপুরি সংসার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পার্বতী।  কিন্তু লেখাপড়া শিখতে না পড়ার আক্ষেপটা তার রয়েই গিয়েছিলো। তাই তো ছেলের সাথে মিলে ভর্তি হয়েছেন গ্রামের এক স্কুলে।

তার বাড়ি নেপালের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশের পুনর্বাস গ্রামে। এই গ্রামেরই এক স্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর বিয়ের পিড়িতে বসেন। এরপর দীর্ঘ ১২ বছর পর ফের লেখাপড়া শুরু করেছেন তিনি। -‘আমি লেখাপড়া পছন্দ করি। একই সঙ্গে নিজের সন্তানদের বয়সী সহপাঠীদের সঙ্গে বসে ক্লাস করতেও গর্ব বোধ করছি।’ সংসারের দৈনন্দিন সব কাজকর্ম সম্পন্ন করার পরই নিজের স্কুলে যাওয়া আর পড়া শেখার কাজটা করছেন পার্বতী। আর এভাবে উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন দেখছেন এই ২৭ বছর বয়সী এই নারী। নেপালের জনসংখ্যা ২ কোটি ২৯ লাখ। এর মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারীই শিক্ষিত। এইসব নারীদের মতোই শিক্ষিত হতে চান পার্বতীও। তিনি বলেন-আমি স্কুল ছাড়তে চাই না। বিয়ে এবং সন্তানাদি হওয়ার কারণে স্কুলে যেসব ক্লাস বাদ গেছে এবার সেগুলো সম্পন্ন করতে চাই।

মায়ের লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে খুব খুশি তার ১১ বছরের পুত্র রেশাম। সে বলে-মা আমার সঙ্গে স্কুলে যায় এটা আমার খুব ভালো লাগে। মা আর ছেলে মিলে একসাথে টিফিন খায়। এছাড়া স্কুলের পর কম্পিউটার ক্লাসেও যায় দুজনে  মিলে। -‘স্কুলে যেতে যেতে আমরা পড়াশোনার বিষয়ে গল্প করি। এভাবে গল্পের মাধ্যমেও আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি’-বলছিলো পার্বতীর ছেলে রেহান। মায়ের ইচ্ছা ছেলে বড় হয়ে চিকিৎসক হবে।

পার্বতী গ্রামের যে স্কুলে পড়ছেন তার নাম জীবন জ্যোতি। এই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ভারত বাসনেত বলেন-‘পার্বতী লেখাপড়ায় মাঝারি মানের হলেও তার শেখার ইচ্ছা প্রবল।’

গ্রামের দুই কামরার এক টিনসেট বাড়িতে দুই ছেলে রেশাম, অর্জুন আর শাশুড়িমাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার তার। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ছাগল চড়াতে নিয়ে যান। এরপর সংসারের অন্যান্য কাজ শেষ করে গোসল টোসল সেরে স্কুলের পথ ধরেন পার্বতী। তার স্বামী একজন শ্রমিক, কাজ করেন ভারতের চেন্নাই শহরে। তারা দলিত শ্রেণিভুক্ত হলেও এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই পার্বতীর। তাছাড়া নিম্ন জাতের হওয়ার কারণে প্রতিবেশীরাও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। ‘আমার বা আমার পরিবারের সাথে কেউ বৈষম্য করে না।’

দরিদ্র পার্বতীদের খাওয়া দাওয়াও খুব সাধাসিধে। বেশিরভাগ দিনই ভাত আর ডাল রান্না করেন। এরপর স্কুল ড্রেস পরে নেন। তার স্কুল ড্রেস হচ্ছে হালকা নীল ব্লাউজ আর ডোরাকাটা স্কার্ট, সঙ্গে নেক টাই। এরপর ছেলেকে নিয়ে রওয়ানা হন। বিশ মিনিটের মতো হেঁটে পৌঁছে যান গাছগাছালিতে ছাওয়া টিনের ছাদওয়ালা স্কুলে। তার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে ১৪ বছরের বিজয় বিকে। সে বলে- ‘দিদি খুব মজার মানুষ। আমরা লেখাপড়ায় দুজন দুজনকে সাহায্য করি।’

পার্বতীর এই প্রচেষ্টা নেপালের অন্যান্য গৃহবধূদেরও লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তুলছে, যেখানে বাল্য বিবাহ আর শিশু বয়সে মা হওয়ার কারণে অনেক নারীই শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পার্বতীর প্রতিবেশী গৃহবধূ শ্রুতি সুনার পড়েছেন দশম শ্রেণি পযন্ত। তিনি বলেন- ‘ও খুব ভালো কাজ করছে। আমি মনে করি অন্যান্য মহিলাদেরও তার মতো স্কুলে যাওয়া উচিত।’

নেপালে নারীদের প্রাথমিক শিক্ষা ধরা হয় প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পযন্ত। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৯৪ দশমিক নারী এই শিক্ষা গ্রহণ করেছে। কিন্তু ফেডারেশন অব কম্যুনিটি স্কুলের প্রেসিডেন্ট কৃষ্ণা থাপা বলেন, দরিদ্রতার কারণে এদের অর্ধেকই আসলে ঝরে যায়। থাপা আরও বলেন, ‘স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য টয়লেটের মতো পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। আর টয়লেট না থাকায় অধিকাংশ মেয়েরা তাদের পিরিয়ডের সময় স্কুল ছেড়ে দেয় ।’

কিন্তু পার্বতী শিক্ষাগ্রহণের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্কুলের কারণে সে ভারতে বাসাবাড়ির কাজ ছেড়ে নিজের দেশ নেপালে ফিরে এসেছে। আর আপাঃতত তার ইচ্ছা  ১২ ক্লাস পযন্ত পড়া চালিয়ে যাওয়া। এখন তো এরকমটাই ভাবছি। তবে ভবিষ্যতে কি হয় সেটা তো বলতে পারছি না।

আল জাজিরা থেকে ভাষান্তর মাহমুদা আকতার

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/