‘নারীর প্রতি সকল বৈষম্য বিলোপ বা সিডও সনদ বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়’

মহিলা পরিষদের সিডও সনদের ওপর আয়োজিত মত বিনিময় সভার একাংশ

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ঢাকা মহানগর কমিটির আন্দোলন উপ-পরিষদের উদ্যোগে রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকালে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে ‘নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় চাই সিডও সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন’ সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত বক্তারা এই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন।

সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাবেক তথ্য উপদেষ্টা, বাংলাদেশ অবজারভারের  সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, জেলা প্রশাসক (ঢাকা) মো. শহীদুল ইসলাম, ঢাকা হাইকোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি আব্দুল আজিজ মিন্টু, সংসদ সদস্য এ্যারোমা দত্ত, ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান এবং সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা.ফওজিয়া মোসলেম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম।

সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, নারীরদের অধিকার সুনির্দিষ্ট করে আদায় করতে হবে। নারী ও শিশুর অধিকার ও মর্যাদার উপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্রের মর্যাদা বোঝা যায়। আইন আছে কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন নেই। পার্লামেন্টে নারী সদস্য আছে কিন্ত তাদের কথা বলার কতটুকু অধিকার আছে। নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে নারীরদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে । সংসদে নারীরদের কার্যকর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন-মানসিকতার পরিবর্তন না হলে নারীর ক্ষমতায়নসহ নারীর অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। নারী আন্দোলন একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এতে পরিবর্তন আনতে হবে স্বাভাবিকভাবে-সব ক্ষেত্রেই।

তিনি আরও বলেন- নারীর আন্দোলন ক্ষেত্রে মিডিয়ার প্রচার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তাই এসব অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচার দরকার।

ঢাকা হাইকোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি আব্দুল আজিজ মিন্টু বলেন, নারীর প্রতি বৈষম্য এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। সিডও সনদের মূলে আমরা দেখতে পাই মানব সমাজ, সভ্যতা বিকাশ ও উন্নয়নে যুগ যুগ ধরে নারীরা যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছে তার যথাযথ স্বীকৃতি দান।

তিনি উল্লেখ করেন, সমসাময়িক বিভিন্ন দিক নিয়ে শিশুরাও ধর্মীয় গোড়ামীতে আবদ্ধ হচ্ছে পরিবার থেকে। মনের পর্দা বড়, বাইরের পর্দা বড় না । একই সঙ্গে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রচলিত আইন সংস্কারের বিষয়টিও সামনে তুলে ধরেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবেদা খাতুন বলেন, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ বা সিডও সনদ বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়। নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অনেক সময়েই অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষরা বলছেন-নারীর সমস্যা তার কোনও সমস্যা নেই। আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়ের জন্য অনুভূতিও আলাদা করে রাখা হয়। ছেলে মেয়েদের কাজের ধারাগুলো আলাদা আলাদা ভাবে শেখানো হয় সমাজে এবং পরিবারে। তাই সমতার সমাজ গড়তে হলে মেয়ে ও ছেলেশিশুকে সমান সুযোগ দিতে হবে।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা.ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বাংলাদেশ সরকারের যেগুলো অধিকার আছে সেগুলো পূর্ণতা পাবে নারীর বৈষম্য দূরীকরণের মধ্য দিয়েই। নারী যেন সকল ক্ষেত্রেই  তার সমান অধিকার পায় সেটাই হচ্ছে সিডও সনদ।  নারীর প্রতি সহিংসতার রোধে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের বিকল্প নাই।নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করে এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। নারীর বাস্তব সমস্যা চিহ্নিত করে সরকারের কাজ করা উচিত। পুরুষ ও নারীর সমতার বড় সমস্যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর প্রতি বৈষম্য। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ কম হওয়ার কারণে উপার্জন কম নারীদের। গৃহকর্মে নারীর অবদানের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নারীর অধিকার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ থাকতে হবে। সিডও সনদের প্রতি দায়বদ্ধতার রেখে সকলের প্রতি এর বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক সিডও দিবস। সিডও সনদ হচ্ছে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক দলিল বা চুক্তি। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পরও বৈষম্য বিরাজমান। বাংলাদেশ সরকার আজ থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৮৪ সালে সিডও সনদের অনুমোদনকারী রাষ্ট্রসমূহের একটি হিসেবে স্বাক্ষর করে। নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকরণসহ মানুষ হিসেবে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য অনুকূল সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এটি একটি চুক্তি। সিডও সনদের ২ ধারায় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে আইনের সংস্কার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং ১৬ ( ১)( গ)  ধারায় বিয়ে ও পারিবারিক আইনে সম-অধিকার  বিষয়টি উল্লেখ করেন। তার প্রশ্ন-রাষ্ট্রের সংবিধান মেনে চললে সিডও সনদ মানতে সরকারের সমস্যা কোথায়। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বিশেষ অতিথি সংসদ সদস্য এ্যারোমা দত্ত তার বক্তব্যে বলেন, ৫২ ভাষা আন্দোলন থেকেই নারীর অধিকারের পথ তৈরি হয়। নারীরা তাদের অধিকারের ব্যপারে কতটা দৃঢ়/সচেতন তা ভেবে দেখতে হবে। যে নারীরা প্রযুক্তিতে পিছিয়ে আছে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নে এগিয়ে আসতে হবে। কোন কোন জায়গায় নারীর সার্বিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা চিহ্নিত করে কমিটি মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাতে হবে। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ও আন্দোলনে নতূন প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ইন্দু প্রভা বলেন, CEDAW হল একমাত্র মানবাধিকার চুক্তি যা নারীর প্রজনন অধিকার নিশ্চিত করে এবং লিঙ্গ ভূমিকা এবং পারিবারিক সম্পর্ক গঠনকারী প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লক্ষ্য করে। এটি নারীদের তাদের জাতীয়তা এবং তাদের সন্তানদের জাতীয়তা অর্জন, পরিবর্তন বা ধরে রাখার অধিকার নিশ্চিত করে।  নারী ও পুরুষ অর্থাৎ লিঙ্গ ভেদে যে বৈষম্য তা আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীদের প্রতি নানামুখী অন্যায়-অত্যাচার এবং সহিংসতার একটি মূল কারণ। সিডও বাস্তবায়ন ছাড়া সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় জানিয়েছেন।

নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় সিডও সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ১১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান। তিনি বলেন-মাঠ পর্যায়ে নারী অধিকার আন্দোলন এগিয়ে গেলেও নীতি নির্ধারকদের কারণেই বারবার পিছিয়ে পড়তে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা-পুরুষের সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষ সমঅধিকার নিশ্চিত হওয়াটা জরুরি। বিশেষ করে সম্পদ-সম্পত্তি ওপর নারীর অধিকার ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখনো আমাদের দেশে গুরুত্ব পায়নি উল্লেখ করে নারী–পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন এই জনপ্রতিনিধি।

রোববার অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রেহানা ইউনুস। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গোড়াপত্তনের ইতিবৃত্ত ও আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন-এ সংগঠন পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীর মর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ব্যাপী আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) অনুমোদন করলেও এর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারার ওপর থেকে এখনো আপত্তি প্রত্যাহার করা হয়নি। সনদের সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণ অনুমোদনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান রেহানা ইউনুস।

মত বিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ঢাকা মহানগরের সভাপতি মাহাতাবুন নেসা এবং মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সংগঠনের ঢাকা মহানগরের সহ-সাধারণ সম্পাদক মঞ্জু ধর। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের ঢাকা মহানগরের আন্দোলন সম্পাদক জুয়েলা জেবুননেসা খান।

আরও পড়তে পারেন-আগামীকাল সিডও সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতবিনিময় সভা

ওমেন্স নিউজ ডেস্ক/