দেখে এলাম ভেনিস

কাথেড্রাল স্কয়ারের গির্জা

রানা জামান

শীতকালে ইতালি যাবার সুযোগ পেয়ে নির্বিকার ছিলাম প্রথম দিকে। আমার সাথিরা শীতের ভারি কাপড় কেনা শুরু করে দিয়েছেন। কেউ কেউ টাকা থেকে ইউরো করে নিচ্ছেন কেনা-কাটা করতে। তাপমাত্রা জানলাম সাত, আট, নয়-এর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে। সাধারণ কোটে ও পেন্টে টিকা যাবে না। ওভারকোট ও ইনার হিসেবে টাইস কিনতে হবে; লম্বা মোজা ও মাথা-কান ঢাকা টুপিও লাগবে। কয়েকদিন আগে চুপি চুপি একটা ওভারকোট কিনে ধূতে দিলাম এক লণ্ড্রিতে। আস্তে আস্তে একটা টাইস, লম্বা মোজা ও মাঙ্কিক্যাপ কিনলাম।

ডিসেম্বর ১০১৪-এর দুই তারিখ সকাল সাতটায় ফ্লাইট। সবকছিু গোছগাছ। রাতে জানালো উড়ান বিলম্বিত কয়কে ঘন্টার জন্য-দুপুর আড়াইটায়। সাড়ে বারোটায় চলে গেলাম বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে। আমাদের বড় ছেলে অনিম গিয়েছিলো আমার সাথে; কিন্তু  মন্ত্রণালয়ের প্রোটোকল অফিসার বোডিং থেকে শুরু করে ইমগ্রিশেন করে দিলেন। সরাসরি চলে গলোম বিমানে। টার্কিশ এয়ারলাইন্সের বিমান। আমরা মোট পনেরো জন। ইকোনোমিক ক্লাশ; সিট পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়। আমার সাথে সিরাজগঞ্জ জেলার উপ-মহাপরিদর্শক। জানলা নিয়ে বসলাম। পাশের যাত্রী একটু পর পর হাত-পায়ের ব্যায়াম করে; কেউ ওকে বলে দিয়েছে একটু পরপর ব্যায়াম না করলে হাত-পা’র রক্ত জমাট বেঁধে যাবে! বিরক্তিকর হলেও সহ্য করতে হয়েছে পুরো যাত্রায়; আমারই অধস্তন র্কমর্কতা বলইে হয়তোবা! একসময় বিমান উঠে গেলো উপরে; একেবারে মেঘের উপরে। জানলা দিয়ে নিচে তাকালে শুধু পেজাতুলা মেঘের বিচরণ দখো যায়। ঘুম না আসায় মুভি দেখে সময় পার করে দিলাম। পাঁচ ঘন্টা পর টার্কির ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। এখানে ট্রানজটি। পৌঁছলাম ঠিক আটটায়। আটটা পাঁচের বিমানন বিলম্বিত হয়ে পৌণে নটায় দিলো উড়াল।

বিখ্যাত মিলান স্টেশন

বিমানবন্দরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগুচ্ছি কাঙ্খিত গেটের দিকে। কী বিশাল বিমানবন্দর! স্থানে স্থানে রানিং এসকেলেটর। এক জায়গায় এক বিরাট হাতলবিহীন কাঠের চেয়ার পাতা। পরে আরো দুই জাগয়গায় দেখেছি; ছবি উঠিয়ে নিলাম। এক ভদ্রমহিলা একটি চেয়ারে বসে ছবি উঠালেন। আরেক জায়গায় এক চায়ের কাপে গরু বসিয়ে রাখা হয়েছে; ওটারও ছবি নিলাম। পুনরায় চেকিং করতে হলো। শুধু শার্ট-পেন্ট থাকলো গায়ে। বোডিং হতে গিয়ে ঝামলো হলো একটু। আমার ও সেই ডিআইজির সিট নম্বর একই হয়ে গেছে। আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। ওঁর টিকিটও ঠিক হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বিমানে ঢুকার ডাক পড়লো। লাইন ধরে ঢুকে গেলাম বিমানের ভেতরে। দুই ঘন্টার ভ্রমণ। রাত থাকায় বাইরে কিছুই দেখা যায়নি। এখানেও মুভি দেখে সময় পার করলাম। কেনো জানি না ঘুম এলো না দুটো বিমানের কোনোটিতেই। অথচ গাড়ি করে অফিসে যাবার সময় বেশ ঘুম আসে এবং ঘুমাই। রাত এগারোটায় ইটালির মিলান বিমানবন্দরে অবতরণ। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে পেয়ে গেলাম আমাদের বাসের ড্রাইভারকে। বুঝতে পারলাম বেশ শীত। বিদেশের বাস বেশ উচু এবং নিচতলা লাগেজের জন্য নির্ধারিত। প্রচুর লাগেজ ধরে। লাগেজ ড্রাইভারের মাধ্যমে বাসের নিচতলায় রেখে উঠলাম বাসে। দুই ঘন্টার ভ্রমণ। ঘুম আসে তো আসে না। রাতে আশপাশের সবকছিুই একই রকম দেখা যায়। রাত দুটায় এসে পৌঁছলাম আইএলও’র আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং সেন্টার, তুরিনে। ইটালি ভাষায় মিলানকে মিলানো, তুরিনকে তুরিনো বলে।

বাস থেকে লাগেজ নিয়ে রিসেপশনে। চেকইন হলাম। এক নিগ্রো বসা কাউন্টারে। ওকে বুঝাতে বেশ বেগ পেতে হলো। পনেরো জনকে চেকইন করতে ঘেমে উঠলো লোকটা এই শীতেও; বেশ কয়েকবার কপালের ঘাম মুছতে হলো ওকে। অভ্যর্থনা প্যাকেট পেলাম সবাই একটা করে; তাতে পানি, ফল, বিস্কুট, জুস ও দুধ। একক কক্ষ বরাদ্দ হলো সবার। ঘড়িতে সময় ঠিক করতে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো ঘড়ি! স্যামসাঙ্ক ট্যাবলেটে সময় এডজাস্ট করলাম। বাংলাদেশ থেকে পাঁচ ঘন্টার পার্থক্য-আগে। কম্পাসে কিবলা ঠিত করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে শুয়ে পড়লাম। ছটায় উঠে ফজরের নামাজ আদায় করলাম। পরে জানলাম ইটালিতে ভোর হয় সাড়ে সাতটায়। সবাই নটায় তৈরি হয়ে নিচে নামলাম। ডাইনিং খুঁজে না পেয়ে টি-ব্রেক হলে নাস্তা সারলাম বিস্কুট, ছোট পাউরুটি দুধ দিয়ে। তাপমাত্রা নয় থেকে সাতের মধ্যে উঠা-নামা করছে। যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে; এখানে বৃষ্টিকাল চলছে।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার র্অগানাইজশেনের ইন্টারনশেনাল ট্রেনিং সেন্টার পো নদীর তীরে অবস্থিত। পো তুরিনের দীর্ঘতম নদী। নদীর এপাড়ে ট্রেনিং সেন্টার আর ওপাড়ে পাহাড়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে হাজার হাজার বাড়ি গড়ে উঠেছে। বহতা নদী; অথচ কূল ভাঙে না।

দুটো শহর দেখলাম। একই ধরনের বাড়িঘর রাস্তাগুলোর দুইদিকে; তিন/চার বা পাঁচ তলার উপরে কোনো ভবন নেই। তুরিনে একটা বহুতল বহন তৈরি করা হচ্ছে। কোনো বাড়িতে গ্যারেজ নেই; ফুটপাতের পাশে পার্কিং; রাতে রাস্তায় সারি ধরে গাড়ি থাকে। রাস্তায় কোনো ময়লা বা পলিথিন বা অন্য কোনো নোংরা নেই। শহরে কোনো ফ্লাইওভার নেই; অথচ শহরের বাইরে হাজার হাজার মাইল রাস্তায় কোনো ট্রাফিক নেই; ওভারপাশ বা আণ্ডারপাশ তৈরি করা আছে। ট্রেনগুলো চলে ইলকেট্রিসিটিতে। বিভিন্ন ধরনের ট্রেন।

]

সেন্ট মার্ক স্কয়ার

প্রথম সেশনে পরিচিতি, ওয়ার্কশপের পদ্বতি, ইত্যাদি জানানো হলো। সাড়ে সাতটা থেকে ব্রেকফাস্ট, সকাল এগারোটায় প্রথম টি-ব্রেক, দুপুর সাড়ে বারোটায় লাঞ্চব্রেক, সাড়ে চারটায় দ্বিতীয় টি-ব্রেক ও রাত সাড়ে সাতটা থেকে ডিনার শুরু। প্রথম দিন ব্রেকফাস্ট মিস করে টি-ব্রেকে ব্রেকফাস্ট করে একজন আফসোস করে বললো: আগামীকাল থেকে ব্রেকফাস্টে পরোটা পাওয়া যাবে। ব্রেকফাস্টে কোনো পরোটা-টরোটা নেই; তবে লাঞ্চে বড় রুটি পাওয়া যায়। আমি মিস করেছি। ইউরোপয়িান খাবার। বেছে হালাল খাবার খেতে গিয়ে মাংশ পুরোপুরি বাদ দিতে হয়েছে। এক লাঞ্চে খিচুড়ি দেখে কয়েকজন বগল বাজাতে শুরু করলো কয়েকজন। খিচুড়ি! বেশ মজা করেই না খাওয়া যাবে। কতদনি পর দেশি খাবার! ট্রে ও প্লেট নিয়ে ছুটে গেলাম। একজন বললো: ওতে র্পক মানে শূয়রের মাংশ আছে! প্লেকার্ডে তাকিয়ে দেখলাম: র্পক লেখা আছে। র্স্পশলাগা লজ্জাবতীয় মতো সবাই নেতিয়ে গেলাম। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রায় সবাইকে অমাংশাসি হতে হয়েছে(দুই একজনকে মুরগীর মাংশ খেতে দেখেছি)।

পবিত্র কুরানের সুরা মায়েদার আয়াত ৫-এ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: আজ তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হলো। আহলে কিতাবের খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল এবং তোমাদের খাদ্য তাদের জন্য হালাল।  আহলে কিতাব বলতে খৃস্টান ও ইহুদিদের বুঝানো হয়েছে; অথচ খৃস্টানরা হারাম খাদ্য নাক-মুখ ডুবিয়ে খায়। ছি!

হালাল খাবারে থাকার জন্য দুপুরে ও রাতে সালাদ, ভেজেটেবল, সামুদ্রিক মাছ, ইত্যাদি খেতে হয়েছে। প্রথম দিন টমেটো ও পণিরের পিজ্জা খেয়ে বেশ ভালো লাগায় আরকেদিন রাতে পিজ্জা নিলাম; কিন্তু ভালো লাগলো না। ইউরোপে নাস্তার মেন্যু মোটামোটি এরকম: টোস্টের মতো বিস্কিট, মিষ্টি ও কম মিষ্টির ছোট ছোট পাউরুটি, ছোট ছোট শক্ত পাউরুটি, পাউরুটির স্লাইস(ওভেনে সেঁকা যায়), আলুসিদ্ধ, ডিমসিদ্ধ, এগস্ক্রাম্বল, চিকেন রোল, কয়েক ধরনের র্পক আইটমে, চার ধরনের র্কণ ফ্ল্যাক্স, গরম ও ঠাণ্ডা দুধ, মধু, কয়েক ধরনের পণির, জ্যাম/জেলি, বিভিন্ন ফলের জুস, বিভিন্ন ধরনের ফল,কয়েক ধরনরে আইসক্রিম, চা ও কয়েক ধরনের কফি ইত্যাদি।

টি-ব্রেকের মেন্যু এরকম: টোস্ট-বিস্কিট, পিঠা, ডোনাট, চিপস, অন্যান্য মিষ্টি জাতীয় খাবার, বিভিন্ন ধরনের ফল, জুস, চা-কফি ইত্যাদি। লাঞ্চ ও ডিনারের মেন্যু এরকম: সব্জিসিদ্ধ(ফুলকপি, ব্রকলি, বরবটি ইত্যাদি), স্যুপ, টিনজাত অলিভ ওয়েল, আলুসিদ্ধ, পাস্তা, কয়েক ধরনের সালাদ, টমেটো/লেটুস/গাজর ইত্যাদি কাটা, মিষ্টি ব্রেড, ভাত, আলুর ডাল, সামুদ্রিক মাছ ভাজা ও তরকারি, বিফ ও চিকেন, র্পক, পিজ্জা, রুটি উইথ চিকেন রোস্ট, ভেজেটেবল কেক, আরো কতো কী!

শনি-রবি সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় শুক্রবারে জুম্মার নামাজ হলো না। অবশ্য আশপোশে কোনো মসজিদ না পাওয়ায় এমনিতেই জুম্মার নামাজ আদায় করা যেতো না। শনিবার চলে গেলাম সবাই স্বপ্নের শহর ভেনিস দেখতে। বাসে; ট্রেনেও যাওয়া যায়। বাসে চার ঘন্টার ভ্রমণ। ভোর চারটায় রওয়ানা দিলাম সবাই। সকাল আটটায় পথপাশের এক মেগাশপ Autogrill-এ বাস থামলো। ওখানে ওয়াশরুমে যাওয়া ও নাস্তা খাওয়া হলো। আর কোথাও থামে নি। বাস চলছে তো চলছেই; কখনো সমতলে, কখনো ফ্লাইওভারে, কখনো আণ্ডারপাশে। কোনো দিকের কোনো গাড়িকে ট্রাফিক সিগনাল পেতে হয় না। ভেনিস সাগরের উপর গড়ে উঠা হাজার বছরের পুরোনো শহর। বহু সিনেমায় দেখেছি; বিশেষ করে জেমসবণ্ড ছবিতে।

ইন্টারনেট ঘেটে জানা যায় যে, ভেনিস খৃস্টর্পূব ৪২১ খৃস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছে। তখন ভেনেটি নামের কিঝু মানুষ ভেনিস এলাকার হৃদে এসে গ্রাম গড়ে তোলে। সর্বপ্রথম বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য দ্বারা ভেনিস শাসিত হয়। ৭২৬ খৃস্টাব্দে ভেনেটিয়ানগণ আংশিকভাবে স্বাধীনতা র্অজন করে এবং Orso Ipato-কে Doge নির্বাচিত করে। ধীরে ধীরে ভেনিস ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে এবং জাহাজ আসা-যাওয়া করতে থাকে। ভেনিসে লোকসংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ৮২৮ খৃস্টাব্দে সেন্ট মার্কের মরদেহ চোরাচালান করে ইজিপ্ট থেকে ভেনিসে নিয়ে আসে এবং পরবর্তীতে সে ভেনিস শহরের দেশপ্রেমিক সেইন্ট হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। দ্বীপ দেশটি কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন আক্রমনকারী শাসকের হাতে হাতবদল হতে থাকে। ১৮৬৬ খৃস্টাব্দে এক যুদ্ধে অস্ট্রিয়া পরাজিত হয় এবং ভেনিস ইটালির সাথে যুক্ত হবার অনুমতি পায়। ১৯৩৩ খৃস্টাব্দে মুসোলিনি ইটালির মূল ভূমির সাথে ভেনিসের যোগাযোগের জন্য সড়ক নির্মাণ করনে।

স্বপ্নের দেশ ছবির দেশ সাগরে ভাসমান দেশ ভেনিসে পৌঁছাই এগারোটায়। প্রচণ্ড শীত। মোটা মোটা শীতের কাপড় গায়ে সবার। ওভার কোট, মোটা জ্যাকেট গায়ে ধরে রেখে মোবাইল ফোন/ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলতে থাকে। নৌ-ভ্রমণের জন্য তিন দলে ওয়াটার বাসে চড়লাম। কী মনোরম দৃশ্য। দুইদিকে কী সুন্দর সুন্দর বাড়ি। যখন ভেনিস শহর গড়ে উঠেছিলো তখন এসব বাড়িতে বসবাস করতো লোকজন। এখন এগুলো হোটেল হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। শীত সহ্য করেই স্যামসাঙ্ক ট্যাবলেটে ভিডিও করতে থাকি। আধাঘন্টা নৌ ভ্রমণ শেষে এপাড়ে এসে পাড়ে উঠি। এরপর লেকের পাড় ধরে হাটা। পরিভ্রমণকালে ভেনিসে প্রচুর বাঙালি পেয়ে যাই। কেউ ভালো আছে, কেউ বা মন্দ। পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে কেউ বিক্রি করছে ফুল, কেউ ক্যামেরার স্ট্যাণ্ড, কেউ ফুটপাথে পসরা সাজিয়ে বসে আছে, কেউ বিক্রি করছে ফাস্টফুড। যাদের ভিসা নেই ওরাই দৌড়ে পালাবার মতো ব্যবসা করছে। ওরা জানালো: অবধৈভাবে থাকার জন্য অনেক সময়ই পুলিশ ধরে নেয় না-কখনো ধরে নিলেও থানায় না নিয়ে কিছুক্ষণ পরে ছেড়ে দেয়। তবুও বিরম্বনা!

বোটে উঠার আগে সবাইকে St. Mark's Square (Piazza San Marco)-এ বিকেল চারটায় একত্রিত হতে বলা হলো। আমরা একসময় গাইডকে হারিয়ে ফেলি। লোকটা অনেক কথা বলে, আমাদের অধিকাংশের ওকে পছন্দ না; কিন্তু কিছু করার নেই।সারাদিন আমাদের দলটা গাইড ছাড়াই ঘুরে বেড়াই। ভেতরে প্রচুর খাল, বাড়ি আর বাড়ি; আর দোকানে ভর্তি। খালে রাজকীয়ভাবে সাজানো গণ্ডোলা।

ইতালির খালে ভাসছেে ঐতিহ্যবাহী নৌযান গন্ডোলা

  প্রচুর চার্জ থাকায় আমরা উঠার চিন্তাও করি নি। হাটতে হাটতে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে আসে। খুঁজতে খুঁজতে একটা বাঙালি মালিকের হোটেল পেয়ে গেলাম যেখানে পিজ্জা বানায়। পিজ্জা ছাড়া আমাদের খাওয়ার যোগ্য কিছু পাওয়া যায় নি। তাৎক্ষণিক পিজ্জা বানিয়ে খেলাম আমরা ক’জন। এরপর ফের হাটাহাটি। ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যাওয়া গাইডকে পেয়ে যাই। একে একে সবাই St. Mark's Square-এ চলে আসি।

আসরের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে যায়। নামাজের জন্য ওযু করা প্রয়োজন। গণ্ডোলার ল্যাণ্ডিং-এ গেলাম তিনজন সমুদ্রের পানি দিয়ে ওযু করার জন্য। প্রচুর ঠাণ্ডা ও শীত। কাঁপুনি ধরে গেলো। আসরের নামাজ আদায় করে বোটে করে পূর্বের জায়গায় ফিরে এলাম।ওপারে এক বেঞ্চিতে বসে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। এরপর বাসে উঠা। একই স্থানে উল্টোদিকের আরেক অটোগ্রিলে যাত্রাবরিতি। পাস্তা দিয়ে ডিনার। ১০/১২ টুকরা পড়েছে ভাগে। অধকিাংশই খেতে পারে নি। মনে হয় এ যাবৎ কালের মধ্যে একবারে পঁচা ডিনার। রাত এগারোটার মধ্যে আইটিসি-তে পৌঁছে যাই।

পরদিন শনিবার। অধিকাংশ চলে গেলো জার্মানি; ভবিষ্যতে যেতে পারবো এই প্রত্যাশায় যাই নি। আমরা ক’জন-মহাপরদির্শক সৈয়দ আহমদ, আইএলও-এর সাইদুল ও হাসিনা, জহুরুল হক, একজন দোভাষি সহ মোট ৬/৭ জন চলে গেলাম মিলানে। ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গিয়ে বেকুব বনে যাই সবাই।চমৎকার রেলস্টেশন; ট্রেনও এক একটা একেক ধরনের। টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে সিট পলোম না। এবং যতো মিলানের দিকে যেতে থাকে ট্রনে, ততো বাড়তে থাকে ভিড়। হাসিনাকে আগলে রাখাই কঠিন হয়ে উঠে একসময়। যাই হোক কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।এক স্টেশনে আগে ট্রেন প্রায় খালি হয়ে গেলো। তখন আমরা বসার সিট পেলাম একে একে। তখন বসলেই কী আর না বসলেই কী!

ট্রেন থেকে মিলান স্টেশনে নামলাম।কী সুন্দর প্লাটফর্ম! বিভিন্ন ধরনের ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। মিলান থেকে আশপাশের বিভিন্ন দেশে ট্রেন যায়।স্টেশনে কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে কেএফসিতে লাঞ্চ সারলাম। সেখান থেকে সাবওয়ে করে চলে এলাম ক্যাথেড্রাল স্কোয়ারে। ক্যাথেড্রাল স্কোয়ারের ইটালয়িান নাম Piazza del Duomo। সেখানে একটা ঐতিহাসিক গীর্জা আছে। আর চারিদিকে সুপারশপ তো আছেই। গীর্জার সামনে একটা পাথরের মূর্তি। মূর্তির গোড়ায় বসে থাকার মতো করে স্টেজ বানানো আছে।

 সারাদিন ওখানেই কাটিয়ৈ দিলাম।বিকেলে টের পেলাম ভিড় কাকে বলে। রোববার থাকায় গীর্জার বামপাশে অস্থায়ী বাজার আর খাবারের দোকান। হাটা দায়। খাবারের দোকানগুলোয় আস্ত শূয়রের রোস্ট কেটে কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। ফটো তুলে বেলা গেলো।গীর্জার সামনের মার্কেটে গেলাম। প্রচুর দাম।গীর্জায় এখন আর প্রার্থনা করা হয় না- দর্শনীর বিনিময়ে লিফটে করে ছাদ দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। দশ ইউরো প্রতি জনে। অনেক বেশি মনে হওয়ায় কেউ গেলাম না। সন্ধ্যার পর সাবওয়ে করে চলে এলাম মিলান রেলস্টেশনে। আরো দুটো বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা অপেক্ষআ করছিলো আমাদের জন্য। ট্রেনের টিকিট কাটতে হয় ভেন্ডিংমেশিনে। নতুনদের জন্য একটু বিব্রতকর। টিকিট কাটতে পারছিলাম না কিছুতেই। এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। আমরা হাসিমুখে ওর সাহায্য নেবার জন্য রাজি হয়ে গেলাম। টিকিট কাটা হয়ে গেলো।এরপর ভদ্রমহিলা হাত পাতলেন। পারিশ্রমিক চাই তাঁর। বাধ্য হয়ে এক ইউরো দিতে হলো।পূর্বের কেএফসি থেকে ডিনার প্যাকেট করে আমরা ক’জন চলে এলাম ট্রেন ধরতে।কতক রয়ে গেলো ওয়াশরুম ব্যবহার করার জন্য। টিকিট রয়ে গেছে ওদের হাতে।ট্রেনে যাত্রী উঠে ভর্তি হয়ে গেছে। কিন্তু ওএর আসার নাম নেই। আমরা ট্রেনের বাইরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছি। শেষ মূর্হুতে ওরা এলো। দৌড়াতে লাগলাম। যে যে বগিতে পারি উঠে গেলাম। ছেড়ে দিলো ট্রেন। পরে আমরা এক বগিতে চলে এলাম। সিটও পেলাম।এক স্টেশন পর ট্রেন গেলো দাঁড়িয়ে। চলছে না চলছেই না। ইটালয়িান ভাষায় কী বলা হচ্ছে বুঝি না। এক ইটালয়িান ছেলেকে জিজ্ঞেস করায় বললো: ট্রেনে সমস্যা দেখা দিয়েছে; নাও যেতে পারে।ও-ও মিলান যাবে। অবশ্য কিছউক্ষণ পর চলতে শুরু করলে আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

সামনের একটা স্টশেনে গিয়ে ফের ট্রেন গেলো থেমে।ঘোষণা হলো কিছু একটা।ইটালয়িান ছেলেটি জানালো: ট্রেন আর যাবে না-যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। আরেক ট্রেন এলে ওটায় যেতে হবে। সবাই নামছে। আমাদের এক সাথির একটা ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে না। উপরে র‌্যাকে ছিলো। শেষ পর্যন্ত ব্যাগটা পাওয়া গেলো না। ইটালি তথা ইউরোপে ট্রেন থেকে ব্যাগ চুরি যায়! বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা বটে! ট্রেনে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ট্রেন বাতিল হয়ে যাওয়া আরেকটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা! আণ্ডারপাশ দিয়ে ওপারে যেতে হলো। আরেকটা ট্রেন এলে তাতে উঠে পড়লাম। সবাই একত্রে বসতে না পারলওে সিট পাওয়া গেলো। ট্রেনে বসে ডিনার সেরে নিলাম সবাই।ট্রেন চলছে। আমরা ঘুমুচ্ছি।রাত দশটায় পৌঁছলাম তুরিন রেলস্টেশনে। সেখান থেকে ট্যাক্সিক্যাব করে আইসিটিতে।

ইটালি তথা বিদেশের প্রতি ইঞ্চি স্থান দর্শনীয়। বাংলাদেশের সাথে তুলনা করলে স্বর্গতুল্য। বাংলাদশে জনগণের মাঝে এখনো প্রকৃত সভ্যতা গড়ে উঠে নি। যত্রতত্র কাগজের টুকরো, পলিথিন, থুথু ফেলার অভ্যাস তো আছেই; সাথে আছে ফুটপাতের দেয়াল ঘেঁষে নির্দ্বিধায় প্রস্রাব করা। কেউ বাঁধা প্রদান করে না।যেদিন বাংলাদেশে এসব বদঅভ্যাস বন্ধ হয়ে যাবে, সেদিন বাংলাদশও ইউরোপের মতো হয়ে যাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে। এক সপ্তাহ পর ইটালি থেকে চলে গেলাম নেদারল্যাণ্ড। সে আরেক ভ্রমণ। আরেক অভিজ্ঞতা, আরেক বর্ণনা।      

রানা জামান

লেখক পরিচিতি: আমাদের সাহিত্যের অতি পরিচিত মুখ রানা জামান। দীর্ঘদিন ধরে নিরলসভাবে লিখে চলেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুতোষ, সাইন্সফিকশনসহ নানা ধরনের লেখা।  সবমিলিয়ে ৯০টির বেশি বই বেরিয়েছে তার। লেখকের দেশের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন শেষে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে অবসর নিয়েছেন।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/