ইতিহাস ঐতিহ্যের শহর দিল্লী আর আগ্রা ভ্রমণের অমলিন স্মৃতি

বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্য হিসাবে স্বীকৃত ঐতিহাসিক স্থাপত্য তাজমহলের সামনে লেখক

সৈয়দা কানিজ রাসুল

কথায় আছে ‘উঠলো বাই তো কটক যাই ’। সে রকম কোন প্রস্তুতি ছাড়াই আমরা ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। তবে কটক নয়, উদ্দেশ্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর দিল্লী ও আগ্রা ভ্রমণ। সময়টা ছিলো ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর।  দিল্লী-আগ্রা যাবার বাসনা সেই ছেলে বেলা থেকেই মনের মাঝে পোষণ করে রেখেছিলাম। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ইতিহাসে সুলতানি আমলে দিল্লী সালতানাতের কাহিনী এবং মোঘল স্থাপত্যগুলো আমাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করতো। আমার একমাত্র ছেলের এ লেভেল পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। এই সুযোগ। ক্লাস, কোচিং, পরীক্ষা নিয়ে এত ব্যস্ত সময় কাটাতে হত যে কোথাও বেড়ানোর সুযোগ হয়ে ওঠে নি তেমন। আমি আমার এত বছরের লালিত স্বপ্নকে বাস্তব জীবনে পূরণ করতে বেরিয়ে পড়েছি দিল্লী-আগ্রার পথে। আমি সব সময়ই ভ্রমণের জন্য রেলপথকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। যদি সেসব জায়গায় ট্রেনের ব্যবস্থা থাকে। আজকাল ছেলেমেয়েরা একটু বেশি আয়েশী। তারা মনের আনন্দের চেয়ে আরামে ভ্রমণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমার ছেলেরও ইচ্ছে বিমানে যাতায়াত। কিন্তু আমার ইচ্ছে ঢাকা থেকেই ট্রেন জার্নি করবো।

২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর এক কুয়াশা ঢাকা সকালে আমার স্বামী, ছেলে এবং আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশনে ভারতগামী মৈত্রেয়ী ট্রেনে উঠে বসলাম। কিন্তু ট্রেনে উঠে আমার মন বিষন্নতায় ভরে গেল। আমার আসনটি দুই জানালার মাঝামাঝি। আসনে আরাম করে বসে পথের দুপাশের ফেলে যাবার দৃশ্য অবলোকন করার সুযোগ কম। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত রাজধানী ঢাকা শহর। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশা ভেদ করে সূর্য্যি মামা উঁকি দিয়ে তার মিষ্টি রোদ গাছপালা, মাঠে ঘাটে আলোর পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঠে মাঠে নবান্নের ধুম। সোনালী ধান কেটে থরে থরে বিছানো আছে মাঠে মাঠে। কোথাও আবার নতুন ধান লাগানোর আয়োজন চলছে। ইতিমধ্যে আমরা সকালের নাস্তার পাট শেষ করেছি। ঘড়িতে তখন সকাল ১০:২২ মিনিট। ট্রেনের গতি কিছুটা মন্থর। বুঝতে দেরি হলো না আমরা এখন বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর দিয়ে চলছি। ট্রেন অত্যন্ত মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। যমুনা নদীর উপর ঘন কুয়াশা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেনের যাত্রীরা জানালার দুপাশে দৃষ্টি মেলে দিয়েছে। কিন্তু সবাই হতাশ হয়ে আসন গ্রহণ করলো। আমার অতি উৎসাহে ভাটা পড়েছে। চেকার এসে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন ট্রেনের ভিতর বেশি নড়াচড়া বা হাঁটাচলা না করতে । এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এতো দীর্ঘ সেতু, নীচে বিশাল যমুনা নদী। মনে হতেই কিছুটা ভয়ের সঞ্চার হলো। পাশেই যান চলাচলের জন্য যে সেতু সেখানে বাসগুলো দ্রুত গতিতে পার হচ্ছিল। সেতুর উপর গাড়ির নির্দিষ্ট গতিবেগ সকলের মেনে চলা উচিত। এ আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব শুধু মাত্র সরকারের নয়। এই কথাটা যারা শিক্ষিত সচেতন তাদের যেমন মনে রাখা জরুরী, তেমনি যারা অশিক্ষিত, অসচেতন তাদেরকে সচেতন করার দায়িত্ব আমার আপনার সকলের উপর বর্তায়। যাহোক আমরা পর্যায়ক্রমে পাবনা, ঈশ্বরদি, কুষ্টিয়া অতিক্রম করলাম। কুষ্টিয়া অঞ্চলে ভুট্টা এবং কলা চাষ ব্যাপকভাবে প্রসারিত। তা দুপাশে তাকালেই  দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর আমরা পোড়াদহ, আলম ডাঙা, চুয়াডাঙ্গা স্টেশন পার হলাম। ১:৫০ মিনিটে আমরা দর্শনা ইমিগ্রেশনে পৌঁছে গেলাম। সেখানে ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস চেকিং শেষে পুনরায় ট্রেনে আসন গ্রহণ করলাম। পরের স্টেশন কলকাতা। মধ্যবর্তী কোনো স্টেশনে আর চেকিং এর কোন ঝামেলা নেই। তাই নিশ্চিন্তে ওপার বাংলার দু’পাশের শ্যামল শোভা অবলোকন করতে করতে কলকাতা স্টেশনে পৌঁছে গেলাম।

২২শে নভেম্বর ২০১৫ আমরা আগ্রার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। যোধপুর এক্সপ্রেস ঠিক রাত্রি ১১:৪০ মিনিটে হাওড়া স্টেশন ছেড়ে গেল। প্রায় মধ্য রাত্রিতে ট্রেন জার্নি  আমার কাছে দম বন্ধ করা এক পরিবেশ। ট্রেনের দরজা –জানালা সব বন্ধ। বাইরে নিকশ কালো অন্ধকার। মাঝে মাঝে দূরে লোকালয়ে দু একবার আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছে। গভীর রাত্রি। যাত্রীরা স্লিপার সিটে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরাও ঘুমানোর আয়োজন সম্পন্ন করেছি। নভেম্বরের মাঝামাঝি চলন্ত ট্রেনে কিঞ্চিৎ শীত অনুভূত হচ্ছে। আমরা দুটো পাতলা কম্বল নিয়ে গিয়েছিলাম। খটাখট শব্দ তুলে ট্রেন ছুটে চলেছে গন্তব্যে। প্রচন্ড দুলুনিতে ঘুমের বারটা বেজে গেছে।

সারা রাত প্রায় নির্ঘুম কাটিয়ে রাত পোহালো। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। জানালায় দৃষ্টি মেলে দিলাম। দূরে বড়ো বড়ো ধুসর পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনো পাহাড়ের গায়ে সংকীর্ণ হাঁটা পথ এবং পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির দৃশ্যমান। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ট্রেন চলার কারণে সে সব অতি দ্রুত চোখের সম্মুখ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। গাছপালা হীন শুষ্ক ভূমি এবং পাহাড় দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আমরা এখন বিহার রাজ্য অতিক্রম করছি।  বিহারের গয়া একটি ইতিহাস বিখ্যাত স্থান। সম্রাট অশোক, বিম্বিসার,মৌর্যবংশ সব যেন ইতিহাসের পাতায় দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আমার স্বামী সকালের নাস্তা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমার সেদিকে কোন আগ্রহ নেই। জানালা থেকে চোখ ফেরালেই যেন সব কিছু হারিয়ে যাবে। আমি নাস্তা রেখে গোগ্রাসে গিলতে থাকি পথের দুপাশের দৃশ্য। ইতিমধ্যে ট্রেন পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার ছাড়িয়ে উত্তরপ্রদেশে প্রবেশ করেছে। মোঘল সরাই স্টেশনে ট্রেন বেশ দীর্ঘ সময় বিশ্রাম নিল। এরপর একে একে মির্জাপুর, এলাহাবাদ অতিক্রম করলাম। দ্রুতগামী ট্রেন হঠাৎ করেই অত্যন্ত মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে স্টেশন ছাড়াই থেমে যাচ্ছে। এমনটা হওয়ার কারণ ট্রেন লাইনে সিগন্যাল পাচ্ছে না। এদিকে দিনের শেষে চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। আগ্রা স্টেশনে আমাদের ৭:৪৫ মিনিটে পৌঁছানোর কথা। ঘড়িতে তখন রাত্রি ন'টা বাজে। যাত্রীরা উৎকন্ঠিত। আমাদের সহযাত্রী বাংলাদেশের  পরিবারটি বেশ আলাপ জমিয়েছেন। আলাপে জানতে পারি পরিবারটির বাড়ি ঢাকার বংশালে তারা মসজিদের কাছে। স্ত্রীর বাড়ি জয়পুর। সেই সুবাদে এই রুটে তাঁদের যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আছে। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ করে চার ঘন্টা পরে রাত্রি এগারোটায় ট্রেন আগ্রা স্টেশনে থামলো। সারারাত সারাদিন জার্নি করে আমাদের মন মেজাজ খুব খারাপ। সেইসাথে উৎকন্ঠা কাজ করছে এত রাতে কোন হোটেল পাবো কিনা। কারণ আমাদের  আগে থেকে কোনো হোটেল বুক করা ছিলো না। এমন সময় স্টেশনে এক সুদর্শন যুবক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে জানতে চাইলো আমরা টুরিস্ট কিনা এবং কোনো হোটেল বুক করা আছে কিনা। যেহেতু অনেক রাত হয়ে গেছে তার উপর সম্পূর্ণ অচেনা স্থান বিধায় আমরা ছেলেটির উপর নির্ভর করলাম। যুবকটি পেশায় একজন অটো ড্রাইভার। আমাদেরকে তার অটোতে উঠিয়ে একটা হোটেলে নিয়ে এলো। সেখানে একটা রুমই খালি ছিল এবং আমাদের কাংখিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশী ছিল। স্থানটি বেশ থমথমে। দোকানপাট সব বন্ধ। যাহোক আমরা আর দ্বিতীয় কোনো হোটেল যাচাই না করে সেখানেই রাত্রি যাপন করতে মনস্থ করলাম। রুমের চাবি আমার হাতে দিয়ে আমার স্বামী রাত্রের খাবার কেনার জন্য অটো ড্রাইভারের সঙ্গে বাইরে গেলেন। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে রুমে গেলাম। রুমটা বড়সড় হলেও বেশ অপরিষ্কার মনে হলো। হোটেল বয়কে ডেকে রুম পরিষ্কার করালাম। ফ্রেশ হয়ে ডিনার শেষে শুয়ে পড়লাম।

নতুন জায়গায় খুব ভালো ঘুম না হলেও গতকালের জার্নির ধকল কিছুটা সামলে উঠেছি আমরা। সকালে সবাই স্নান সেরে নাস্তা করে বিশ্বখ্যাত তাজমহল দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। আমি ভীষণ উত্তেজিত। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য তাজমহল দেখার বাসনা পূরণ হতে চলেছে। তাজমহলের গেটে টিকেট কাউন্টারে টিকেট কেটে আমরা প্রবেশ করলাম। বেশ কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলে তাজমহল প্রবেশের প্রধান ফটক। ফটকে প্রবেশ করতেই অদুরে তাজমহলের দেখা মিললো। আমি বিশ্বাস ই করতে পারছিলাম না তাজমহল তার আলোকোজ্জ্বল বিভা নিয়ে আমার চোখের সম্মুখে দন্ডায়মান। সকালের সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে তাজমহল। আমার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাহান কবিতার সেই চরণ–
‘হীরামুক্তামাণিক্যের ঘটা
যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধুনুচ্ছটা
যায় যদি  লুপ্ত হয়ে যাক,
শুধু থাক
একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।’
তাজমহল প্রবেশের প্রধান ফটক মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মিত। মোঘল সম্রাট শাহজাহানের পত্নী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজ মহল নামে পরিচিত। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই অপূর্ব কারুকার্য শোভিত সৌধটি নির্মাণ করান সম্রাট শাহজাহান। এই তাজমহল নির্মাণে ভারতের রাজস্থান, পাঞ্জাব ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তিব্বত, চীন, আফগানিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা থেকে অনেক মূল্যবান পাথর এবং বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছিল। আফগানিস্তান থেকে নীলকান্ত মণি সংগ্রহ করা হয়েছিল। আমরা ইতিহাসে পড়েছি ১৮৫৭সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা এই সব মহা মুল্যবান পাথর এবং স্বর্ণ তাজমহলের ক্ষতি সাধন করে লুটপাট করে ব্রিটেনে নিয়ে যায়। এরপরও মোঘল স্থাপত্যের এই অপূর্ব কারুকার্য খচিত তাজমহলের আকর্ষণে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক এখানে ছুটে আসেন শুধু মাত্র একনজর দেখার জন্য। তাজমহলের চার কোণে চারটি বিশালাকৃতির মিনার রয়েছে। পেছনে প্রবাহমান যমুনা নদী। তাজমহলের ভিতরে মূল যে সমাধি কক্ষ তার ভিতর সম্রাট শাহজাহান এবং তাঁর পত্নী মমতাজ মহলের করব রয়েছে। সম্রাট শাহজাহানের সমাধিটি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতায় অপেক্ষাকৃত বড়ো। এখানে পূর্ব –পশ্চিম বরাবর দুটো মসজিদ আছে। এই মসজিদে প্রায় ৫৬৯ জন মুসল্লী একসাথে নামাজ পড়তে পারেন। মেঝেতে কালো পাথরের ওপর জায়নামাজের আদলে খোদাই করা দাগ কাটা আছে। এছাড়াও তাজমহলের ভিতরে সবুজ উদ্যান, ফোয়ারা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।এর নির্মাণ শৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। তাই যুগ যুগ ধরে এর স্থাপত্যকলা ও সৌন্দর্যের কারণে বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম তাজমহল।

তাজমহল দর্শন শেষ হলে আমরা আগ্রা ফোর্ট দর্শনে রওনা হই। তাজমহল থেকে মাত্র ২.৫ কিলোমিটার দুরত্বে যমুনা নদীর ডান তীরে এর অবস্থান। আগ্রা দূর্গ লাল বেলে পাথরের তৈরী। ইতিহাস বিখ্যাত এসব স্থানে এসে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। কি অপূর্ব কারুকার্য শোভিত মনোমুগ্ধকর একেকটি স্থাপনা! মোহগ্রস্থের মতো আমরা একে একে জাহাঙ্গীর মহল,  হাওয়া মহল, খাসমহল, শীষমহল, দেওয়ান–ই খাস, দেওয়ান–ই আম, মোতি মসজিদ, নাগিনা মসজিদ দর্শন শেষ করি। আগ্রা ফোর্টের বাইরের প্রাচীরের চারপাশে একটি বিশাল পরিখা রয়েছে। এটি জলবেষ্টিত থাকার কারণে শত্রুপক্ষ এই পরিখা পার হয়ে দূর্গের ভিতর প্রবেশ করতে পারতো না। এছাড়াও এর প্রবেশ দ্বার সম্মুখ থেকে ভিতরে যেতে বেশ খাড়া অর্থাৎ প্রাসাদের প্রবেশ দ্বার থেকে প্রায় ৬০ডিগ্রি ঝুঁকে রাস্তাটি নেমে গেছে। যাতে শত্রুপক্ষ হাতি নিয়ে দূর্গ আক্রমণ করতে না পারে। এ থেকে তৎকালীন মোঘল শাষকদের শাণিত বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। এখানকার স্থাপনা সমূহ পারসিক শিল্পকলা এবং ভারতীয় শিল্পকলার এক আশ্চর্য মিশ্রণে নির্মিত।

দিল্লির বিখ্যাত ইন্ডিয়া গেটের সামনে সপরিবারে লেখক

আমরা সকালে হোটেল থেকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করেছিলাম। এটি একটা প্যাকেজের আওতায় ছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভার আগ্রা শহরের স্থাপনাগুলো আমাদের দর্শন করিয়ে একেবারে দিল্লী পৌঁছে দিবে। সেই মোতাবেক তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট, দর্শনের পর আমরা মোঘল সম্রাট আকবরের রাজধানী উত্তর প্রদেশের একটি শহর ফতেপুর সিক্রির স্থাপনাগুলো দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। কিন্তু পথিমধ্যে আমার ছেলে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলে আমরা ফতেপুর সিক্রি ভ্রমণ বাতিল করে দিল্লী যাবার মনস্থ করি।

দিল্লীতে হোটেলে রাত্রি যাপনের পরদিন সকালে অর্থাৎ ২৫শে নভেম্বর হোটেলের ম্যানেজার একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা দিল্লীতে যে হোটেলে ছিলাম সেই এলাকাটির নাম পাহাড়গঞ্জ। রাত্রে হোটেলে আমাদের মনপুত ডিনার না থাকায় আমার ছেলে প্রায় অভুক্ত ছিল। তাই সকালে ভালো কিছু খাবারের সন্ধানে আমরা হোটেলের বাইরে বের হই। সেসময় দেখতে পাই এলাকাটি বেশ অপরিষ্কার। যাহোক সকালের নাস্তা সেরে আমরা ট্যাক্সিতে দিল্লীর দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য রওনা হলাম। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড খুব ভালো ছিল। পথে যেতে যেতে আমাদেরকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান সম্পর্কে জানিয়ে দিচ্ছিলেন। আমার চোখ রাস্তার দু’দিকে এবং সামনে বার বার ঘোরাফেরা করছে। ইতিহাসের কত ঐতিহাসিক চরিত্রের কথা, কত যুদ্ধের কথা মনে পড়তে লাগলো। কল্পনায় বইয়ের পাতা উল্টে যেন পড়ে চলেছি। ২৫শে নভেম্বর গুরু নানকের জন্মদিন বিধায় সেদিন সরকারি ছুটি। তাই ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী মেমোরিয়াল সেদিন বন্ধ ছিল। এরপর আমরা ইন্ডিয়া গেট চত্বরে যাই। এটি নতুন দিল্লীতে অবস্থিত। ইন্ডিয়া গেট হচ্ছে ৯০.০০০ ভারতীয় সৈন্যদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত একটি যুদ্ধ স্মারক, যারা  প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই গেটের দুই পাশের কলাম বা খাম্বাতে আফগান যুদ্ধ এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্তে মৃত্যু বরণ করা ১৩৫১৬ জন বৃটিশ এবং ভারতীয় সৈন্যদের নাম খোদাই করা আছে।

ইন্ডিয়া গেট থেকে আমরা কুতুব মিনার দর্শনে গেলাম। ছোট বেলায় বায়োস্কোপে দেখা কুতুব মিনারের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকাশ পানে চেয়ে মিনারের চূড়া দেখি। কানে বাজতে থাকে ছোট বেলার সেই  ছন্দময় সুর, ‘ দেখো দেখো দিল্লীকা কুতুব মিনার দেখো ’। ভারতের মুসলিম শাসক কুতুবউদ্দিন আইবেক এই মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং তাঁর নামানুসারে এর নাম কুতুব মিনার। ভারতীয় মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির একটি অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন এই কুতুব মিনার। কুতুব মিনার প্রাঙ্গণে বাগান, মসজিদ, এবং দিল্লী সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ইলতুতমিশ এর করব আছে। এছাড়াও বেশ কিছু স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এখানে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। কারণ ২৫ নভেম্বর দিল্লী টু কলকাতা টিকেট কাটা আছে। ড্রাইভার কাম গাইড বার বার আমাদের তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। যাতে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে জায়গাগুলো দেখা শেষ করতে পারি। ইতিমধ্যে আমরা এক ফাঁকে লাঞ্চ সেরে নিয়েছি। তিনি এরপর আমাদের লোটাস টেম্পলে নিয়ে গেলেন। সেখানে প্রবেশ করার জন্য বেশ লম্বা লাইন। প্রবেশ করতেই বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল। পদ্মফুলের আকৃতির লোটাস টেম্পল দিল্লীতে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এটি বাহাই ধর্মাবলম্বীদের একটি উপাসনা স্থান। তবে সব ধর্মাবলম্বী লোকজন এখানে অবাধে প্রবেশ করতে পারে। চারপাশে সবুজ উদ্যান, নয়টি জলাধার, ভিতরে বিশাল প্রার্থনা কক্ষ সব মিলিয়ে অদ্ভুত ভালোলাগার পরিবেশ। আমরা কিছুক্ষণ প্রার্থনা কক্ষের আসনে নিরবে বসলাম। ভিতরের আসন সংখ্যা ১৩০০টি।

দিল্লী যাব আর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহে যাব না তা কি হয়? আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড আমার ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগাহে নিয়ে গেলেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়া ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার একজন বিখ্যাত সুফি সাধক। প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার ভক্ত মাজার যিয়ারতের জন্য ভীড় করেন। দরগাহের বাইরে মাজারের চাদর, জায়নামাজ, আতর, ফুলের সারি সারি দোকান। আমরা প্রবেশ পথে খালি পায়ে অনেকটা গলিপথ পার হয়ে মাজারে পৌঁছে গেলাম। ভিতরে মাজারের পাশে ভক্তরা কেউ কুরআন পাঠে মগ্ন,  কেউ নামাজ রত, কেউবা নিজের মনস্কামনা পূরণে প্রার্থনারত। আমরা তিনজনে মাজার যিয়ারত করে সেখান থেকে বের হয়ে আসি।

গান্ধীজির (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী) সমাধিসৌধ রাজঘাট যাবার আগে দিল্লীর চাঁদনিচক মার্কেটে কেনাকাটায় কিছুটা সময় অতিবাহিত করে ভারতীয়দের জাতির পিতা গান্ধীজির সমাধিস্থলে পৌঁছলাম। আমরা জুতো খুলে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। সেখানে সমাধি চত্তর ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। মাঝখানে একটি অগ্নি শিখা জ্বলছে। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী আততায়ীর গুলিতে গান্ধীজি নিহত হন। এখানে তাকে সমাহিত করা হয়। অগ্নি শিখাটি জ্বালানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে গান্ধীজি যেন সকল ভারতীয়ের মনে এই শিখাটির মতো চির অম্লান থাকেন। এখানকার নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ, চারিদিকে সবুজের সমারোহ, মুক্ত হাওয়া মনে এক অনাবিল প্রশান্তি এনে দেয়। এর মধ্যে আমাদের ঘড়ির কাঁটা এবং অস্তগামী সূর্য জানান দিচ্ছে আমাদের বিদায় বার্তা।

রাজঘাট, গান্ধীজির সমাধিস্থল

২৪, ২৫ নভেম্বর এই দুটো দিনে আগ্রা এবং দিল্লী শহরকে অনেক চেনাজানা আপন শহর মনে হয়েছিল। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড একজন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। তিনি বলছিলেন দিল্লীর আয়তন ১,৪৮৪ বর্গ কিলোমিটার। এখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। তা একদিনে  দেখা সম্ভব নয়। এর পরে সময় নিয়ে এসে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ করলেন। তিনি আমাদেরকে তার যোগাযোগ নাম্বার দিয়ে দিলেন। আমাদের যাত্রা পথে যে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো অতিক্রম করছিলাম সে সম্পর্কে আমাদেরকে ওয়াকিবহাল করছিলেন তিনি।  যেমন রাষ্ট্রপতি ভবন, হুমায়ুন টম্ব, আকসার ধাম মন্দির, রেড় ফোর্ট বা লাল দূর্গ। সূর্যের আলো কমে গেলে সেখানকার সড়ক বাতি জ্বলে উঠেছে। হালকা কুয়াশা গাছের পাতায়, শাখায় জড়িয়ে ধরছে। এই দুদিন একটানা দিল্লী আগ্রার যে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার রেশ হয়তো থেকে যাবে আজীবন। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড অপেক্ষা করছেন স্টেশনে আমাদেরকে পৌঁছে দেবার জন্য।

লেখক পরিচিতিঃ সৈয়দা কানিজ রাসুল শিশুসাহিত্যিক, কবি ও ছড়াকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ দুটি-‘বিল্টুর গোয়েন্দা বাহিনী’ ও ‘ভূতের ভয় করবো জয় ’।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/