কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ফেলে আসা কিছু স্মৃতি

আফরোজা অদিতি  

অস্ট্রেলিয়া ঘুরে আসার পরপরই আবার বেড়াতে যাওয়া হবে ভাবতে পারিনি। আমার খুব যাওয়ার ইচ্ছা ছিল মিয়ানমার কিন্তু সেটি হলো না সাংসারিক নানাবিধ কারণে! যাই হোক মিয়ানমার যাওয়া না হলেও এই বছরে সরকারী বন্ধ বৌদ্ধ পূর্ণিমা রবিবার হওয়ায় শুক্র শনি সরকারী ছুটি একত্রে তিনদিন হওয়ায় স্থির হলো কুয়াকাটা যাওয়ার। প্রথমে স্থির হয়েছিল সোমবার মেয়ে অফিস ছুটি নিয়ে চারদিন বেড়ানো হবে। কিন্তু পরে তা কমিয়ে তিনদিনই হলো। রাহগীরের পরীক্ষা, ওর মায়ের অফিস এসব মিলিয়ে তিনদিন। আমরা লঞ্চে না গিয়ে মাইক্রো ভাড়া করে চললাম শুক্রবার ভোরে। যাত্রা দীর্ঘ কিন্তু মন্দ না! বরিশাল যেতে দুইপথে ফেরি পার হওয়া যায়; একটি মাওয়া থেকে কেওড়াকান্দি, অন্যটি পাটুরিয়া থেকে দৌলদিয়া। আমরা পাটুরিয়া দিয়ে নদী পার হলাম। পাটুরিয়া দিয়ে জলপথে সময় কম, রোডে সময় বেশি লাগে। আর মাওয়া দিয়ে গেলে জলপথে সময় বেশি রোডে সময় কম।  বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার পথে আরও চারটি ব্রিজ আর একটি ফেরি পার হতে হলো আমাদের। এখানে পাঁচটি ফেরি ছিল শুনেছিলাম এখন ব্রিজ হওয়ায় ফেরি কম; অবশ্য টোল দিতে হয় প্রতিটি ব্রিজেই। এই সব পথের পাঁচালি গাইতে গাইতে যখন কুয়াকাটা পৌঁছলাম তখন রাত আটটা পার হয়ে গেছে। আমরা যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম ছয়টার মধ্যে কুয়াকাটা পৌঁছে সাগর সৈকতে যাব কিন্তু তা হলো না, হোটেলেই কাটাতে হলো। পরদিন ভোরে ‘সাগর কন্যা কুয়াকাটা’ সমুদ্র সৈকতে গেলাম। সৈকতে সাগরজলে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখতে সবসময়ই ভালো লাগে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। প্রথম গিয়েছি ১৯৯৫ এ। প্রথম সাগর দর্শনের অনুভূতি সম্পূর্ণরূপে আলাদা যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না কখনও। এ শুধু অনুভবের ব্যাপার।   

কুয়াকাটা যে হোটেলে ছিলাম (হোটেল নীলাঞ্জনা) সেখান থেকে হেঁটেই যাওয়া যায় সৈকতে। যাওয়ার পথে রাখাইন মহিলা মার্কেট আর শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধমন্দির পার করে আমরা সৈকতে গেলাম। কুয়াকাটা সৈকত প্রায় ১৮ কি.মি. দীর্ঘ, ৩.৫ কি.মি প্রস্থ। এই সৈকতের বালি কক্সবাজারের বালির মতো নরম নয়। কুয়াকাটা সৈকতে একই স্থানে দাঁড়িয়ে ভোরে সূযোদয় আর সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখা যায়। দীর্ঘ সৈকত ধরে নারকেল গাছের সারি। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনে ধ্বংসের মুখে আছে এই নারকেল বাগান। পটুয়াখালি জেলার কলাপাড়া উপজেলার পৌরসভা এই কুয়াকাটা। কুয়াকাটা পৌরসভার আয়তন ৮.১১ বর্গকিলোমিটার। ২০১০ সালে ১৫ ডিসেম্বরে লতাচাপালি, গঙ্গামতি, কাউয়ার চর, চর চাপালি মৌজা নিয়ে এই পৌরসভা গঠিত হয়েছে। মনোমুগ্ধকর এই পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা; পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে কুয়াকাটা সেই কুয়াকাটা নামের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাখাইন বা আরাকানবাসীদের এখানে আগমনের দুঃখজনক এক দেশত্যাগের কাহিনী। কথিত আছে ১৭৮৪ সালে যখন বার্মার রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করে সেই সময় রাখাইনরা পালিয়ে আসে এখানে। যুদ্ধের সময়ে বার্মা থেকে ৫০টি নৌকা নিয়ে ১৫০ জন রাখাইন (মতান্তরে ১৫০ টি নৌকা ২৫০ জন রাখাইন) এখানে আসে। এবং এখানে আশ্রয় গ্রহন ও বসতি স্থাপন করে। বেঁচে থাকার তাগিদে বনজঙ্গল কেটে আবাদ করে এবং সাগরের লোনাজল খাওয়ার অনুপযুক্ত হওয়ায় সুপেয় জলের জন্য কুয়া খনন করে। কুয়াকাটাতে বেশ কয়েকটি মন্দির আছে যেখানে বৌদ্ধভিক্ষুরা ধর্মসভা করে।  প্রতিটি মন্দিরের পাশেই সুপেয় জল পাওয়ার জন্য একটি করে কুয়া খনন করা হয়। এই ঐতিহ্যবাহী কুয়ার জন্যই এই স্থানের নাম কুয়াকাটা। এরপরে ১৯০৭ সালে বৃটিশ সরকার তাঁদের থাকার জন্য এই জমি বরাদ্ধ দেন। সেই থেকে কুয়াকাটাতে রাখাইন সম্প্রদায়ের বাস। কুয়াকাটার সবচেয়ে বড়ো রাখাইন সম্প্রদায়ের বসতি গোড়া আমখোলাপাড়া রাখাইন পল্লী।  

সৈকতের পাশে উঁচু টিলার ওপর শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধমন্দির অবস্থিত। নয় রকমের ধাতু মিশ্রিত তৈরি ৩৭ মন ওজনের ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ মূর্তি আছে। শুনেছি এই মন্দিরের মূর্তিটি স্থাপন করেন উপেংইয়া ভিক্ষু। সেসময়ে মন্দিরের দায়ক ছিলেন উপজাতি রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী নেতা বাচিন তালুকদার।  মন্দিরে উপরে ওঠার সিড়ি দুই পাশে দুটি মানবমূর্তি আছে; ভেতরে একটি সিংহের মূর্তি ও ভিক্ষু মূর্তি (নাম পড়া যায়নি)  প্রতিষ্ঠিত আছে।  এই মন্দিরে সুপেয় জলের কুয়া আছে। কুয়াটি সিমেণ্ট বাঁধানো এবং ছাদ পর্যন্ত ঘিরে দেওয়া তবুও  দেখলাম নানারকম আবর্জনা ফেলেছে কেউ!  ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তিটির সামনে আগরবাতি, মোমবাতি ছাড়াও আরও নানাবিধ সামগ্রী আছে, আছে একটি দানবাক্স। এই মন্দিরে দুস্থ ছেলেরা থাকে, তারা লেখাপড়া করে; তাদের জন্য পরিদর্শনে যারা আসে তারা ইচ্ছা করলে দান করে যায়। মন্দিরের মধ্যে একটি ছেলের পড়ার টেবিল আছে; ক্লাস এইটে পড়ে সে। আরও অনেক কিছুই আছে যা দেখা হয়নি। এই মন্দিরে পাশে একটি ভাঙা পুরানো জাহাজ রাখা আছে। ঝাউবনের কাছে বালুচরে বালির নিচে এটি পাওয়া যায়। স্থানীয়দের মতে যখন রাখাইনরা নৌকা নিয়ে এখানে আসে এই নৌকা সে সময়কার হতে পারে। কাঠ নির্মিত এই জাহাজটির দৈর্ঘ ৭২ ফুট, প্রস্থ ২৪ ফুট উচ্চতা সাড়ে ১০ ফুট। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ও খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তত্বাবধানে ২৪.০১.২০১৩ সালে এই জাহাজের উদ্ধারকাজ শেষ হয়। এটি নৌকা না জাহাজ এ নিয়ে বিতর্ক আছে। এই বিতর্কে অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা বলেন এটি স্ক্রুনার অর্থাৎ সমুদ্রগামী ছোট্ট পালতোলা জাহাজ। এটির বয়স দেড়শ বছরের বেশি। আনুমানিক ৯০ টন ওজনের এই পালতোলা নৌকা বা জাহাজটি সংরক্ষিত আছে এই শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধমন্দিরের পাশে। কুয়াকাটা সাগর সৈকত ছাড়াও দেখার আছে অনেক কিছু: এখানে আছে রাখাইন পল্লী, শুটকি পল্লী, ফাতরার বন, লেম্বুর চর, মিশ্রিপাড়া সীমা বৌদ্ধবিহার, লাল কাঁকড়ার দ্বীপ,  গঙ্গামতির চর, ইকোপার্ক, কাউয়ার চর।

প্রভাবশালী মিশ্রি তালুকদারের নামে এই রাখাইন পল্লীর নামকরণ  হয়েছে। মিশ্রিপাড়াতে প্রাচীন সীমা বৌদ্ধ মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরে  দুইশত বছরের পুরানো অষ্টধাতুর ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি আছে। আছে প্রাচীন কুয়া। আছে ইকোপার্ক। ইকোপার্ক হলো কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান। ৭০০ একর জায়গা জড়ে এই কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান বা ইকোপার্ক অবস্থিত। এখানে বিভিন্ন রকমের বনজ-ফলজ বৃক্ষ লাগানো হয়েছে। সবুজ বৃক্ষ-পত্রালি পার্ককে সুন্দও করেছে, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কুয়াকাটার মূল পর্যটন স্পট থেকে বেশ কিছুটা দূরে গঙ্গামতি খালে চর গড়ে ওঠায় গঙ্গামতির চর বলা হয় এবং এই গঙ্গামতির চর থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায় বলেই পর্যটক এখানে ভীড় করে।  লেম্বুর চর থেকে সূর্যাস্ত খুব ভালো দেখা যায়। সামুদ্রিক শামুক ঝিনুকের খোলস ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে এসে সৈকতের বালিতে বিছিয়ে থাকে। এই লেম্বুর চর থেকে পশ্চিমে ফাতরার চর দেখা যায়! ফাতরার চর হলো সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এটি দ্বিতীয় সুন্দরবন নামে খ্যাত। এই বনাঞ্চলের আয়তন ৯,৯৭,৫০৭ একর। এই বনে কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী, ফাতরা, গরান, বাইন, গোলপাতা ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং বান, শূকরসহ অসংখ্য জীবজন্তু ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আছে। পাখিদের গানে মুখর থাকে এই বনভূমি। এ ছাড়াও এখানে অজগর, গোখরাসহ নানা জাতের সরিসৃপ। সুন্দর বনের এই অংশ একটি চর। ্এই চর দিনে দুইবার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয়। এখানে ইঞ্জিন চালিত  বোট এবং জাহাজে যাওয়া যায়। গঙ্গামতির চরে মোটর সাইকেলেও যাতাযাত করা যায়; সাগর সৈকতে পর্যটকদের যারা যেতে চায় এই মোটর সাইকেল করে যাতায়াত করতে পারে। কুয়াকাটায় প্রথম পানি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ; পানি সম্পদকে সুষ্ঠ-সুদরভাবে ব্যবহারে সচেতন করার জন্যই এই পানি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পানি জাদুঘর ছাড়াও অনেক জায়গায় দেখা পাওয়া যাবে লাল কাঁকড়ার। সৈকতের বালিতে লাল রঙের চাদর বিছিয়ে থাকে এরা!      

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক মোহময় পর্যটর নগরী কুয়াকাটা থেকে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। যাওয়ার সময় তো দেখেছি ফেরার পথেও ঐ সুন্দর দৃশ্য চোখে লেগে আছে। রাস্তার দুই পাশে লাল কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন। যাওয়ার পথে একটি তেলের পাম্পে থেমেছিলাম সেখানে দেখেছি পারুল ফুল। হাতে মোবাইল না থাকাতে ছবি নিতে পারিনি। ছবি নিতে পারিনি জলাশয়ে কঞ্চির ওপর বসা ধ্যানী মাছরাঙাটির। ভাসমান কচুরিপানা ফুলের মনকাড়া সৌন্দর্য ধরে রাখা গেল না চলমান মাইক্রোতে থাকার জন্য। চলমান অবস্থায় রাস্তার সৌন্দর্য ধরে রাখা যায় না কারণ কাছে আসতে আসতেই সব সৌন্দর্য পেছনে ফেলে পথ চলে যায় দূরে। জীবনের অনেক কিছু অধরা থাকে, হারিয়ে যাওয়া থাকে, না-পাওয়া থেকে যায়; এতে মন খারাপের কিছু নেই! আমরা যে ফিরতে পেরেছে এতেই খুশি! কারণ আমরা রওয়ানা দেওয়ার আগে ভেবেছিলাম কিছুদূর গিয়ে রাস্তায় কোন ভালো রেষ্টুয়ারেণ্ট দেখে নাস্তা খাব। দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করে এলাম কিন্তু খেতে বসার মতো কোন জায়গা পেলাম না। অনেক দূর এসে নাস্তা খেলাম। ক্ষুধার সময় ভালো লাগলো ঐ খাবার। নাস্তা খাওয়ার পরে আবার রওয়ানা দিলাম কিছুদূর যাওয়ার পরে উঠলো ঝড় সঙ্গে নিয়ে এল তার সখি বৃষ্টিকে। কড়কড়-কড়াৎ বাজ পড়ছে। ছবি তুলেছিলাম কিন্তু ভয়েও ছিলাম। ইদানিং বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে ভীত হওয়ারই কথা। বজ্রপাতকে এখন প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসেবে ধরা হয়। আমরা যেখান দিয়ে চলছিলাম ঐ রাস্তাতে এমন কোন শেড ছিল না যেখানে গাড়ি রেখে দাঁড়ানো যায়। চারদিক গা ছমছম ভাবকরা অন্ধকার। যাক এরপরে ঘন্টা পরে থামলো ঝড়। আমরা ফিরে এলাম ঢাকা।

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি: কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫৫টি। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার যার মধ্যে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, কবি কামিনী রায় সাহিত্য পুরস্কার, কবি জীবনানন্দ দাশ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ নারী লেখক সোসাইটির পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

ওমেন্স নিউজ সাহিত্য/